খুনের রাজ্যে বসবাস।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০১ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:০২:৫৩ দুপুর
আমার কোনো অভিযোগ নেই, আমি কারও কাছে বিচার চাই না। শনিবার ০১ নভেম্বর ২০১৫,বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শোকে-দুঃখে ক্ষুব্ধ হয়ে একথা বলেন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রবীণ শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, ছেলে খুন হয়েছে কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। মামলা করারও প্রয়োজন বোধ করি না। হয়তো বা বিধির (আইন) কারণে মামলা করতে হবে। কিন্তু কি লাভ? যারা হামলা করেছে তাদের রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। এদিকে শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার তারেক রহীম ও রণদীপম বসুর পরিবারের সদস্যরাও হাসপাতালে ছুটে যান। তারা সেখানে কোনো কথা বলতে চাননি। তবে তারা সবাই আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা ও ব্লগারদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সে বাসায় ছিল। পরে শাহবাগ প্রকাশনীর অফিসে যায়। লালমাটিয়ার খবর পেয়ে আমার ছেলেকে ফোন করি। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করছিল না। দ্রুত আজিজ সুপার মার্কেটে তার অফিসে ছুটে আসি। এসেই তার লাশ পাই।এর আগে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পরা তার বাবা প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায় প্রায় একই কথা বলেছিলেন। তিনিও হামলাকারীদের বিচার হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিচার চেয়ে কি হবে। হত্যাকারীদের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে।এদিকে জাগৃতি প্রকাশনীর ম্যানেজার মো. আলাউদ্দিন বলেন, তৃতীয় তলার ৩০১ নম্বর রুমে অফিসে স্যার বসেন। আর আমরা বসি নিচ তলায় শোরুমে। লালমাটিয়ার খবর শুনে স্যারের সঙ্গে কথা বলি। কিছু সময় পর আবার তাকে ফোন করি। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ধারণা করেছিলাম হয় তো ব্যস্ত। কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্যার ফোন না ধরায় অস্থির হয়ে পড়ি। উপরে অফিসে গিয়ে দেখি অটোলকের দরজা ভেতর থেকে লক করা। এর মধ্যে মার্কেটের লোকজনকে খবর দেই। তারা ছুটে আসেন। শোরুম থেকে বিকল্প চাবি এনে দরজা খুলে দেখি স্যার রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। ভেতরে তখন লাইট জ্বলছিল। পুরো কক্ষে জমাট রক্ত। মার্কেটের লোকজন পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ম্যানেজার আলাউদ্দিন আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছে।খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটের আসেন দীপনের বন্ধু সোহেলুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দীপন একজন প্রকাশক বা ব্লগারই নন, তিনি একজন ভালো পাঠক, সম্পাদক ও লেখক ছিলেন। তরুণ লেখকদের কাছেও তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। এমন ভালো মানুষের ওপর কেউ আঘাত করতে পারে, খুন করতে পারে- এটা ধারণাতেও ছিল না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বাসই করতে পারছি না দীপন আর নেই। এত নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে কারা তাকে হত্যা করল, মানুষ হত্যা করে তারা কি চায়? এ পশুদের বিচার কি কোনো দিন হবে না। এ হত্যার প্রতিবাদ করার মতো ভাষা আমিও হারিয়ে ফেলেছি।দীপনের স্ত্রী চিকিৎসক। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। তার অষ্টম শ্রেণী পড়–য়া ছেলের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা শুরু হবে সোমবার থেকে। আর মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করে টুটুলের এক আত্মীয় জানান, হামলার হুমকি পেয়ে আগেই থানায় জিডি করেছিলেন টুটুল। কিন্তু পুলিশ তার নিরাপত্তা দিতে পারল না। টুটুলের মা-বাবা ও বোনসহ অনেকেই হাসপাতালে ছুটে যান। সবাই নির্বাক। তারা সন্তানকে বাঁচানো নিয়েই ব্যস্ত।এ হলো ষোলকোটি মানুষের একটি মানুষের বিদায়।একজন মানুষের বিদায়ে ক্ষতি হয় পরিবারের ও দেশের।এতে লাভবান হয় কারা? প্রতিদিন খবরের কাগজে এখন অগনিত লাশের খবর ছাপা হয়।ঠুনকো কারনে একে অন্যকে হত্যা করে চলছে যার কোন বিচার নেই।মানুষ এখন বিচার চাইতেও নারাজ।যে দেশে একজন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠের শিক্ষক সরকারের কাছে বিচার চায় না,সে দেশে আইনশৃংখলা কত নাজুক তা অনুমান করা যায়।আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,'আইনের আশ্রয় লাভ এবং কেবল আইন অনুযায়ী ব্যাবহার লাভ যে কোন স্হানে অবস্হানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্হানরত অপরাপর ব্যাক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যাতীত এমন কোন ব্যাবস্হা নেওয়া যাইবে না,যাহাতে কোন ব্যাক্তির জীবন,স্বাধীনতা,দেহ,সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।' আমাদের প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে।কোন ঘটনা ঘটে গেলে তা নিরসন করার কাজ হলো তদন্তকারী বিভাগের।ইংরেজীতে যাকে বলে ইনভেষ্টিগেশন-এই শব্দটির অর্থ হলো তদন্ত,অনুসন্ধান বা অন্বেষন।এর উদ্দেশ্য সত্য উদঘাটন করে বিচার ব্যাবস্হাকে তরান্বিত করা।যে সত্য লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে সেটি জনগনের সামনে নিয়ে আসাই হলো তদন্তকারী সংস্হার কাজ।এই কাজটি হতে হবে নীরপেক্ষ।যে পার্টিই সরকার পরিচালনা করুক না কেন,সরকারের বিভাগগুলো থাকবে স্বায়ত্বশাসিত।তারা ন্যায় নীতির ভিত্তিতে তাদের কাজ করবে।তদন্তকারিরা দেখবে যে ঘটনাটি ঘটলো কিভাবে ঘটলো,কারা ঘটালো এবং কেন ঘটলো? রাষ্ট্র এ কাজে প্রশিক্ষিত ,অভীজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীদের সমন্বয়ে একাধিক সংস্হা বা কর্মীবাহিনী তৈরি করে।অপরাধ একটি সামাজিক ব্যাধি।যে ব্যাধিটি নিরাময়ের জন্য দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা।আধুনিক রাষ্ট্রে অপরাধ দমনের প্রধান উপায় হলো,অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে আপরাধিদের প্রস্তুতি ,ষঢ়যন্ত্র বা নীলনক্সা আগেই দমন করে দেয়া।আমাদের দেশে আইন প্রনয়নকারী ডিপার্টমেন্ট গুলো তো জনগনকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকে না।তাদের অধিকাংশই পাহারা দেয় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের।প্রতি ৬০০ জন মানুষের জন্য যদি একজন পুলিশ থাকে তাহলে কি অনুমান করা যায় কিভাবে সেই পুলিশটি এদের রক্ষা করবে? আর এখন অপরাধ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে।আইনের শাসনের সংস্কৃতি নেই বলে অপরাধিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।মুল্যবোধের অবক্ষয় যেখানে আকাশচুম্বি সেখানে এ রকম ঘটনা তো ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।রাষ্ট্রের এমন কোন অংগ নেই যেখানে অপরাধ হচ্ছে না।আর শিক্ষিত জনরাই অপরাধের জনক।ঘুষ বানিজ্য এখন একটি খোলাখুলি ব্যাপার।যে কোন কাজ করতে হলে দিতে হবে টাকা।চাকুরিতে ঢুকতেই লাখ লাখ টাকা গুনতে হয়।এর পর চাকুরির কয়েক বছরেই বাড়ি গাড়ির মালিক।সাধারন মানুষ যখন এগুলো দেখে তখন হতাশ হতে শুরু করে।এক পর্যায়ে আইনকে তারা হাতে তুলে নেয়।যে রাষ্ট্র দক্ষতার সাথে তার আইনশৃংখলা বাহিনীকে সাজাতে পারে সেই রাষ্ট্রে অপরাধ কমে যায়।সরকার যদি সৎ হয় কোন অপরাধিই অপরাধ করতে সাহস পাবে না,এমনকি জংগীবাদের মত অবস্হানও নড়বড়ে হয়ে যায়।আমাদের জনগন যেমন জানে কারা অপরাধি,সরকারও জানে কারা অপরাধ করছে।সমস্ত বড় বড় অপরাধিরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাস করে।কোন ঘটনা ঘটলে তারা একে অন্যকে দোষারোপ করে।এই দোষারোপের সংস্কৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠে জংগীবাদিরা।একটির পর একটি হত্যা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন বিচার হচ্ছে না দেখে আমাদের ভাবতেই হয় আমরা খুনের রাজ্যে বসবাস করছি।আমাদের মনে রাখতে হবে,আমরা যদি বিচারের মানদন্ড দাঁড় করাতে ব্যার্থ হই তাহলে আপরাধিরা আড়াল হতেই থাকবে।আমরা যদি সত্য উদ্ঘাটন করতে ব্যার্থ হই,সত্যই হত্যা হতে থাকবে।এক সময় আসবে মিথ্যা ও সন্ত্রাস আমাদের ঘীরে ফেলবে তখন আর পা ফেলার উপায় থাকবে না।একটি আধুনিক রাষ্ট্রে যদি ঘাতক চিহৃিত না হয় তাহলে ভয়ের সংস্কৃতি বাড়তেই থাকবে যা কাম্য হতে পারে না।সরকারকে অচিরেই দেশের মানুষকে নিয়ে এই অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য আইনের শাসন পুরোপুরি বলবত করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৫১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন