ধোলাইখাল - পাঁচভাই ঘাট লেন সমাচার
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১১ মার্চ, ২০১৩, ০৬:২৮:২৬ সন্ধ্যা
কলেজের দু'টো বছর পার করে দিলাম।এটা ছিল আমাদের ক'জনের জন্য চমৎকার অভিজ্ঞতা।স্কুলে থাকতে হয়েছিল বাবা মা'র নজরে।পড়ার সময় , খাওয়ার সময় ,ঘুমানোর সময় এক কথায় এদিক ওদিক করার কোন উপায় ছিলনা।যেদিন প্রথম কলেজে গেলাম,ব্যাপারটাই ছিল আলাদা।স্কুলের মত একগাদা বই নেই।উঠতি বয়স।পোষাকের ধরন ও পরিবর্তন হয়েছে ইতিমাধ্যে।একটা ডায়েরি ও কলম।১০/১২ জন বন্ধু মিলে একসাথে কলেজে যেতাম।আমাদের এক বন্ধু ছিল ইঁচড়ে পাকা।কালো লম্বা দেহদারি।পড়ালেখায় ভাল না হলেও পড়া চোরে ওস্তাদ ও ছিল টকেটিভ।এসএসসি ও এইসএসসি দু'টো ই অন্যের খাতা নকল করে উত্তীর্ন হয়েছিল।আমরা ট্রেনে প্রতিদিনই তিন মাইল পথ পেরিয়ে আসা যাওয়া করতাম।যেদিন আমরা ক'জন যারা ভাল রেজাল্ট করেছিলাম,তারা না থাকতো ও বন্ধুটি কমপার্টমেন্টে লম্বা গলায় গল্প জুড়ে দিত এই বলে , আমি কয়েক নাম্বারের জন্য স্টান্ড করতে পারিনি।একদিন আমরা দু'বন্ধু চুপি চুপি আগেই কমপার্টমেন্টের ভিতরে গিয়ে বসে পড়লাম।আর অন্য বন্ধুরামিলে আমাদের সেই বন্ধু উঠে বসলো।কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া মেয়েও ছিল।যখন গল্প শুরু হলো।একজন মেয়ে ওকে চিনতো তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার মাধ্যমে।সে বলে ফেললো রহমান ভাই আপনি তো শুধূ পাস করেছেন কেন মিছে মিছি প্রথম শ্রেনীর কথা বলছেন। অন্যরা বললো ভাই আগামিকাল আপনার সার্টিফিকেটের একটা কপি নিয়ে আসবেন আমরা দেখবো।আমাদের দেখে তো "থ" হয়ে গেল। বন্ধুটি আর কোনদিন একত্রে কলেজে যায়নি।তবে কথায় আছে মোটা সোটা আহাম্মক ও ভাল।কলেজে ভর্তি হয়ে ছাএলীগ এ যোগদান করলো ও অলপদিনে নেতা বনে গেল।এবার এলাকা থেকে শুরু করে সব জায়গায় মাসলম্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলো।অল্পদিনে থানায় কয়েকটি কেস এ জড়িয়ে পড়লো।শুনেছি গত বিএনপি'র আমলে রাতের পর রাত ডোবায় পুকুরেও থাকতে হয়েছে পুলিশের ভয়ে।অথচ বন্ধুটি দেশের একজন নেতা ও বেশ পয়সার মালিক।যাই হোক অনেক আনন্দের মাঝেই কলেজ উত্তীর্ন হয়ে সবাই ইউনিভার্সিটি ,মেডিকেল এ এ্যাডমিসন টেষ্ট দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।ঢাকায় এসে ধোলাইখাল - পাঁচভাই ঘাট লেনের একটি পুরুনো বাড়ি যেটি আগের খাল পাড়েই ছিল।আমরা পুরো খাল না দেখলেও খালের কিছু অ্ংশ দেখেছি।বাড়িটি ৩ তলা।মালিক মেস হিসেবে ভাড়া দিয়েছিল।সেখানে থাকতো ছাএ ও ব্যাচেলর চাকুরিজীবি।আমরা ক'বন্ধু মিলে একটি কামরা নিলাম কয়েকমাসের জন্য। আর কয়েকজন ওখানেই জগন্নাথ কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে অনার্স পড়তো।পুরোনো ঢাকার একটা আমেজ ছিল।ঢাকাইয়া কথাগুলো যেমন শুনতে ভাল লাগতো আবার তাদের মেহমানদারিও ছিল চমৎকার।সাদাসিদা মন। হরেক রকম খাবার নাস্তায় তেহারি,টোষ্ট মালাই, বাখরখানি রুটি, কল্পনার স্লাইস ব্রেড, মাঠা, রাতে শিতের পিঠা, হাজির বিরিয়ানি,ষ্টার এর বিরিয়ানি ইত্যাদি।এক খালাম্মার বাসার কাছদিয়ে আমরা আসা যাওয়া করতাম।তিনি প্রায়ই যেতে বলতেন।একদিন দেখে তো আর ছাড়লেন না বললেন, "আহো আহো ,এমুন খানা পাইবা কই, দেহ আস্তা মুরগি,চারটা খাইয়া লও।সামনে ঈদ , কহন যাইবা , যাও বাবা মা'র দোয়া লইয়া আহ আর মনে কিইরা সেমুই চিনি লইয়া যাইবা।" পুরোনো ঢাকার মানুষগুলো বেশির ভাগ ব্যাবসায়ি।পড়ালেখায় আগ্রহ থাকলেও এসএসসি বা এইসএসসি পর্যন্ত।আমি একদিন এক মায়ের বয়সি ভদ্র মহিলাকে পড়ালেখার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলললেন ," পড়ন লাগবো কেলা,খাওন পরনের অভাব নাইকা।বাপের ব্যাবচা আছে,তিন পুরুছেও কমবোনা" খুব সরল মানুষ।একজন সভ্য মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জ্ঞানের যে প্রয়োজন তা ঐ সমাজে বুঝার প্রয়োজন মনে করেনি।তবে শিক্ষিত মানুষগুলোর সাথে চলার কারনে আজ আর সেটা নেই।তখনকার যারা শিক্ষিত ছিল তাদের ছেলেময়েরা সেইন্ট গ্রেগরি ,সেইন্ট ফ্রান্সিস এই পুরনো স্কুল গুলোতে পড়তো তবে স্ংখ্যায় ছিল নগন্য।তখন বাইরের ছেলে যারা লোকাল থেকে আসতো রান্নার ঝামেলা বা কারো আর্থিক অসুবিধে থাকলে লজি্ং বা টিউশন পড়াতো।আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল তারা এভাবেই ডিগ্রি অর্জন করেছে।আবার কেউ চাকুরি করেও টিউশন করে চলতো।আজ বেঁচে আছে কিনা জানিনা,বাদশাহ মিঞা, আ: গফুর ভাই ,মহিউদ্দিন ভাই,শফি ভাই,অনুকুল দা,মন্জু ভাই,আলাউদ্দিন ভাই ,স্বপন ভাই ও সুলতান মাষ্টার।বন্ধুদের মধ্যে মুনির,জহির ,রুহুল আমিন , আ:রশিদ,রতন, আ: রউফ।দিনে সবাই কর্মব্যস্ত থাকতো।রাতে শুরু হতো আড্ডা ও খাওয়ার আয়োজন।সিনিয়র রা তাস খেলতো, জুনিয়ররা ক্রামবোর্ড বা পাশে পরিচিতদের বাসায় টিভি দেখা।আবার মহিউদ্দিন ভাই রসের গল্পও শুনাতো।আমরা দীর্ঘ রাতে পড়তে বসতাম। রশিদ অবশ্য পরে বাড়ির মালিকের মেয়ে বিয়ে করেছে আর এখন ঘর জামাই। দিনে কে কোথায় নতুন অভিজ্গতা অর্জন করলো তা শেয়ার করতো।কারো কোন সমস্যা হলে সবাই মিলে সহযোগিতা করতো।চমৎকার মিল ছিল একে অন্যের সাথে। কিসমতদের একটি পরিবার ছিল যারা বাবা মা ভাই বোন নিয়ে থাকতো।এটা তাদের নানারই বাড়ি।সে হিসেবে একটা এ্যাপার্টমেন্ট তারা দখল করে নিয়ে থাকতো।ঐ মেস বাড়িগুলোতে তখন আলাদা টয়লেট ছিলনা। বাড়ির নিচতলায় ৩/৪ টি টয়লেট ও গোসলখানা একসাথে করা থাকতো। সকালে কে কার আগে গোসলখানায় যাবে সে প্রতিযোগিতা চলতো।তখন আর একটি বড় অসুবিধে ছিল পানির লাইনের স্ংকীর্নতা।অপ্রচুর পানির কারনে পানি ধরে রাখতে হতো।যার পেটে অসুখ ছিল তার জন্য ভীষন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো।তবে আশে পাশে মানুষ আজকালকার মত ছিল না।বললে টয়লেট ব্যাবহার করতে দিত।তখন পুরনো ঢাকার অবস্হাটা এ রকমই ছিল বিশেষ করে যাদের পুরনো বাড়ি ছিল। মুনিরের সাথে ছিল আমার গভীর বন্ধুত্ব।দু'জনই শিক্ষকের ছেলে।মতের ও ছিল অনেক মিল।ঘুরে বেড়াতাম দু'জনে।আবার কখনো এরফান এসে আমাদের সাথে মিলতো।অবশ্য পরে এরফান ও আমি একসাথে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। সদরঘাট ,সোয়ারিঘাট,সূত্রাপুরের নদীর ধারগুলোতে বসতাম।আবার বাহাদুরশাহপার্ক ও উয়ারিতে পার্কে বসতাম।জানঝট আজকালের মত ছিলনা। আজকাল কল্পনা মনে হবে অনেকের। বুড়িগ্ংগা নদীর পানির ঢৈউ ও ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, লন্চ ও বার্জের আসা যাওয়া , বিশেষ করে দক্ষিন অন্চলের লন্চগুলো কানায় কানায় ভরে লোক চাঁদপুর , বরিশাল , পটুয়াখালি,ভোলা এ সব অনচলে যেত। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও রাতের আবছা আলো মনটা কেড়ে নিত।আমার কলেজ জীবনে বেশী উপন্যাস পড়েছি।"পদ্ধা নদীর মাঝি" পড়ে আমার নদীর পাড়ের মানুষের ও নদীর দৃশ্য দেখার ফুরসৎ যখনই মিলেছে , তখনই আমার মনে হয় আমি নিজেকে কিছুক্ষনের জন্য হারিয়েছি।এখনও ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে যখন এ রকম দৃশ্য আসে আমি অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখি আমার নদীমাতৃকাকে।একবার আমরা ক'জন যাছ্ছিলাম নারিন্দা হয়ে টিকাটুলির দিকে।পথিমধ্যে কিছুলোকের মধ্যে আমাদের এক বণ্ধুকে দেখলাম।ওখানে ছিল সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের বাড়ি।তার জন্মদিন ছিল ঐ দিন।এ সুবাদে ৯০য়োর্ধ মানুষটিকে দেখে মনে হয়নি একজন প্রবীন বর্ং নবীনের মত কথার ধার লক্ষ করলাম।আমার ছোট খাট লিখা যখনই শুরু করলাম, আজ আমার মনে হয় যৌবনের চন্চলতার রেশ এখনো কাটেনি। আসলে লেখকরা মনের দিক থেকে নবীনই বটে।
পুরনো ঢাকার এক পরিবার মুনিরের পরিচিত পরে ওর মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয়।নিজের পরিবারের মত আসা যাওয়া করতাম।পারুল ও জোৎস্না আপু, ছমপা ও সুমির আম্মা , মাইজুদ্দিন, চম্পার আব্বা( আল্লাহু ইয়ার হামু) রীনা, তাদের বড় বোনদের ছেলে মেয়ে মুন্না,রুমা,রীতা শাহীন,আসলাম,আজম,আরিফ আরো অনেকে।আমরা অনেক সময় অবসর সময় কাটাতাম।বাখর খানি রুটি ,টোষ্ট ,চা ছিল কমন।প্রথম যখন পুরনো ঢাকা গেলাম আমাকে একজন বললো চল বাখর খানি রুটি খাব। আমি বললাম সেটা আবার কি? ও বললো এটা পুরনো ঢাকার প্রচীন খাবার।সে আমাকে মালাই এর সাথে খেতে দিল।তেমন খারাপ লাগেনি।তবে মোঘল সভ্যতার উপর পড়তে গিয়ে দেখলাম ঢাকার পুরনো ঐতিহ্যপুর্ন খাবারের সাথে বাখর খানি রুটিও আছে।রোজার সময় আর একটি চমৎকার রেওয়াজ ছিল পুরনো ঢাকার ইফতার।বিশেষ করে ছক বাজারের ইফতার আজো তার সাক্ষি প্রমান করে।আমাদের কয়েকজন পুরনো ঢাকার সমবয়সি ছিল যারা রোজা রাখতো না তবে ইফতারের সময় টুপি পান্জাবি পরে ইফতার করতে আসতো।আমরা বলতান রোজা না রেখে ইফতার করে কোন লাভ আছে।ওরা বলতো ," হালায় কয় কি? রোজা রাখি নাইকা তয় কোন হালায় কইছে ইফতার খাইবার পরুম না? ঐ হালা ছুন , বিএ এম এ পাছ কইরা কি করবি,দেহসনা বাপ হালা লোহা লক্কড়,টিক ব্যাবছা রাইখ্যা গেছে, মোগ ঐ চলবো , কাল ত-গোরে ইফতার খাওয়ামু " তবে যে জিনিসগুলো ইসলামের নামে আজো হছ্ছে যেমন-মহররমে তাজিয়া মিছিল, ঘটাও করে সূন্নতে খাতনার অনুষ্ঠান, আরো বিদা'আতি অনুষ্ঠান তার জন্য হক্কানি উলামাদের উচিত জনগনকে অবহিত করা। প্রায় ২৮ বছর পুরোনো ঢাকায় যাওয়া আসা না থাকলেও অতীত স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে নাড়া দেয়।অনেকে অতিত ভুলে যায়।অতিতের মধ্যে যে ভবিষ্যতের একটা সম্ভাবনা ও কর্মস্পৃহা থাকে তা আমাদের অনেকের জানা নেই।মানুষের জীবন হলো একটা স্ংগ্রামি জীবন।স্ংগ্রাম করে উন্নতির শিখরে উঠতে হয়।আবার প্রচন্ড স্ংগ্রাম করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছতে হয়।
১৩৮ ন্ং বাড়িটির মানুষগুলোর মন ছিল চমৎকার ও সরল প্রান কিন্তু একটা জিনিষের অভাব ছিল আর সেটা হলো পুরনো ঢাকার মানুষিকতা।জীবনকে বড় করার একমাএ উপায় স্বশিক্ষিত হওয়া।সুশিক্ষা জীবনে না থাকলে যে কোন সময় বিপর্যয় এসে যেতে পারে।মুন্না ,রুমার চন্চলতা আমি দেখছি। রিতা, চম্পা,সুমা ছিল ছোট। রিতাকে আবার মুনির পড়াতো।
মুন্নার আব্বা(আল্লাহু ইয়ারহামু) এ বাড়িতে শালা শালিদের দেখতে আসতো ফারফিউম হাতে করে।আমি ওদের অনেককে ছোট দেখে এসেছি,আজ ওরা সাবাই মা ও বাবা।এটাই প্রকৃতির নিয়ম। মুন্নার নানা অশিতিপর বৃদ্ধ হলেও পরিবারের খোঁজ খবর রাখতো।মুন্নার স্বামীর অন্তর্ধান আমাকে কিছুটা আহত করলেও এটা যে চিরন্তন সত্যের বহি:প্রকাশ এতে কোন সন্দেহ নেই।আমাদের দুনিয়ার যে জীবন তা স্বল্প একটা ভ্রমন বৃহৎ জীবনে পদার্পন করার জন্য।এর উপর আমার একটা লিখা আছে " আমার ভ্রমনের শেষ কোথায়?" পড়লেই এ জীবনের উদ্দ্যেশ্য ও ভ্রমন কিরুপ বুঝতে পারবেন। যারা এ জীবনকে দীর্ঘকালের কল্পনা করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।দুনিয়ার স্বামি স্ত্রী আখেরাতে মিলবে হয় জান্নাতে না হয় জাহান্নামে।যদি দু'জনই আল্লাহর খাছ বান্দা হয়ে যেতে পারে তাহলে আল্লাহর করুনা লাভ করবে।আর একজন জান্নাতি হলে অন্যজন পৃথক হয়ে যাবে।সুতরা্ং কেউ মৃত্যুবরন করলে আহাজারি করা মানে আল্লাহর বিরুধিতা করা।কারন আমরা জানি যে আমাদের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে এ দুনিয়ায়।আর যে ছবরের মধ্যে থাকবে তার জন্য নেয়ামত রয়েছে।ধৈর্য ও ছবর হতে হবে নামাজের মাধ্যমে।আর কোরান ও সূন্নাহ মেনে বেচে বেচে ভাল কাজগুলো করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন