আমার ছোট বেলার ঈদ।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৩৪:৩৮ দুপুর

সে কবে গ্রামের বাড়ীতে ঈদ উৎসবে গিয়েছি ঝাপসা হয়ে গেছে।ঈদ এলে এখন আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। একসময় সেখানে আব্বা, আম্মা পথ চেয়ে থাকতেন তার সাথে বড় বোনেরা যাদের বিয়ে হয়েছিল গ্রামগন্জে।আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে।ছয় বোনের পন্চম আমি ও আমার পরে একজন বোন। আমার ছোট বোন ছিল পিঠাপিঠি।এসএসসি পর গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়ি শহরের দিকে।উচ্চতর ডিগ্রির প্রত্যাশায় সব রকম কষ্ট করতে হয়েছে।ঢাকায় আনন্দ নিয়ে আসলেও প্রত্যাশার যায়গা গুলো দখল করতে কষ্টের পর কষ্ট করতে হেয়ছে।তবে ঈদের ছুটির সময় এলে আর কোন বাধা মানতো না মন।ছাত্র হলেও সবার জন্য কিছু কেনা কাটা করা বিশেষ করে বাবা মা'র জন্য বিশেষ কিছু কেনা কাটার জন্য মন আনচান করে উঠতো।মা শাড়ি কাপড় পরতেন।সাদা বা ঘৃত রংয়ের শাড়ি বেশী পছন্দ ছিল।বাবা শিক্ষক মানুষ।পাজামা পান্জাবি ও টুপি ছিল তার পছন্দ।ভাগনেদের জন্য খেলনা নিলেই বেশ খুশি হতো।পাড়া পড়শীরা মিষ্টি ও পান সাদা পেলেই অভাবিত খুশি হতেন।ঈদের আগের দিন মা পথ চেয়ে বসে থাকতেন।বাড়ির সামনে দিয়েই ইউনিয়ন কাউন্সিলের রাস্তা।এখন পাকা হলেও তখন ছিল কাঁচা রাস্তা।শীতের বিকেলে কুয়াশাচ্ছন্ন হলেও মা নারিকেল বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন।সাথে থাকতো আমার কোন কোন বোন বা চাচীরা।কখনো এক কিলোমিটার দূরে মেইনরোডে ভাগনেদের পাঠিয়ে দিতেন যেন বোঝা নিয়ে আমার কষ্ট না হয়।

বাড়ির কাছাকাছি গেলে মনে হতো সবাই কোন নতুন কোন মেহমানের অপেক্ষায় আছে।সে দৃশ্য দেখে মন ভরে যেতো।আব্বা ছিলেন ধার্মিক।তিনি তেমনটি করতেন না।বাড়িতে থাকতেন।খাবার তৈরি হয়েছে কিনা? আবার কখনো গ্রামের বাজারে ছুটে যেতেন বড় মাছটি বা আমার পছন্দের শবজি নিয়ে আসতে। কি রান্না হয়েছে সেগুলোর খোঁজ নিতেন।টেবিলে আমার পছন্দের পিঠাপুলি সাজিয়ে রাখতেন।কেউ না বুঝলেও আমি তার উচ্ছাশটি বুঝতাম।মা'কে দেখা মাত্র জড়িয়ে ধরতাম।মনে হতো কারো মনেই যেন আর কোন কষ্ট নেই।ঘরে ঢুকেই দেখতাম হাত পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার স্কুল পড়ুয়া ভাগ্নেরা।তখন গ্রামে কোন বিদ্যুত ছিল না।আবার আজকালের মত তেমন গরম ও ছিল না।বলা যায় নাতিশীতোষ্ন।বাবা বলতেন এই নাড়ুটি খাও।বোন ও চাচীরা হাতে যার যার মত করে তুলে দিতেন।মা বলতেন ছেলেটিকে একটু আরাম করতে দাও।আস্তে ধীরে খাবে।মা হাত দিয়ে শরীরের পরিমাপ করে বলতেন,অনেক শুকিয়ে গেছ।প্রতিটি মায়ের কাছে তার সন্তান এমনই যদিও সন্তানরা বাবা মা'কে তেমন স্মরন করে না।হাত মুখ ধুয়ে সবাই মিলে ঘরের মেঝে পাটি পেতে খেতে বসতাম।আট দশ পদ খাবার।তার মধ্যে পুকুরের মাছ,মায়ের পালা হাস, মুরগীর বুনাই থাকতো পাঁচ রকমের।নারিকেলের পোলাও করতে কখনো ভুলে যেতেন না কারন এটি ছিল আমার পছন্দ।যত কাজই থাকতো আমার ছোট মামা(মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল) আসতেন।মাকে বলে রাখতেন খোকন আসার আগে আমাকে খবর দিবেন।মনে হতো ছোট খাট একটি বনভোজন চলছে।ঈদে উপভোগের আর একটি বিশেষ বিষয় ছিল গ্রাম গ্রামান্তরে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে বেড়ানো।যারা শহর থেকে আসতো গ্রামের মানুষের কাছে ছিল সম্মানের পাত্র।আর শহুরে আগুন্তুকরাও বয়োজেষ্ঠদের পরম সম্মান করতো।আমরা কতেক বন্ধু দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি গুলোতে বেড়াতে যেতাম।কেউ না খেয়ে ছাড়তেন না।আমরা ভারি খাবার না খেয়ে হালকা খাবার হাতে নিয়ে ছুটে যেতাম বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি।অনেক বয়োজেষ্ঠ নারীরা আজো বলে আমাদের সে সন্তানগুলোর মত সন্তান আজ আমরা দেখতে পাই না।আমরা বন্ধুরা ছাত্রজীবন থেকে উপার্জন করতাম।কেউ টিউশন পড়াতো,কেউ কোচিং সেন্টারে পার টাইম শিক্ষক ছিল আবার কারো কারো ছোট খাট ইনভেষ্টমেন্ট ছিল।সেজন্য ঈদে সবার জন্য বা আব্বা-আম্মার জন্য কাপড়চোপড়, ঘড়ি, জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি কিনে নিয়ে আনন্দ পাওয়ার সুযোগ ছিল।বাবা মা'র জন্য যা-ই নিতাম সে টাকাটা আসার সময় পকেটে গুঁজে দিতেন।ছুটি শেষে যখন আসার উপক্রম হতো মা'র মন খারাপ হতো কিন্তু বুঝতে দিতেন না।অসাধারন কথা বলে বিদায় দিতেন।নিজের অনেক কষ্ট থাকলেও আমার মন ভরে দিতেন।পড়াশুনায় উৎসাহ দিতেন যেন ভাল মানুষটি হই।মা'র হাতে কখনো ৫০০ শত টাকার নোট দিলে আবার পকেটে পুরে দিতেন। বলতেন এটি তোমার লাগবে।ঈদে বাড়ি যাওয়ার আনন্দ ছিল। তবে বাড়ি যাওয়া ছাত্রকালে অতটা আরামের ছিল না।ভোরবেলা লন্চে চাঁদপুর হয়ে হাজিগন্জ বা কোচে কুমিল্লা হয়ে হাজিগন্জে যেতে হতো।সকালে উঠলে বাড়িতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যেতো।এখন যখন অতীত স্মৃতি কল্পনা করি সেটিই আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়।

ঈদের ছুটি বা ঈদের নানান রকম আনন্দের বিষয় ভাবতে বসলে খইয়ের মতো ফুটতে থাকে স্মৃতি। মনে হয় অনেক কিছু বদলে গেছে। আবার অনেক কিছু একটুও বদলায়নি।

এখন আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। বাবা মা নেই। বাড়িটি শুন্য হয়ে আছে।কেউ থাকবেনা বলে সেভাবেই পড়ে আছে। ঈদের দিন ওই বাড়িতে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা আসে, মানুষবিহীন বলে ঈদের আনন্দ সে বাড়িতে ঢোকে না।

ঈদের কথা ভাবলে একটা ছবি ভেসে ওঠে মনে। নতুন কাপড় পরে আব্বা ও চাচারা মিলে ঈদগাহে যাচ্ছেন। ঈদের দিন এইকালে সেই একই চিত্র ঢাকাতেও দেখতে পাই। আমার ছেলে মেয়েরা নামাজের জন্য তাদের মা'কে নিয়ে বের হয়,কখনো আমি থাকি,বেশীর ভাগই আমি বাইরে।স্কাইফে দেখে শুধু মনে হয় তারা নয়, আমার বাবা মা'র সাথে ওরা ঈদ করছে। ঈদের নামাজের আগে যখন ঈমাম সাহেব কুরআন হাদিসের আলোচনা করতেন তখন ঈদগাহ কমিটির কেউ কেউ ঈদগাহ সংস্কার অথবা ইমাম সাহেবের সম্মানীর জন্য টাকা তুলতেন। সাদা চাদর বা গামছার চার কোনা টেনে ধরে দু'জন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে আসতেন সামনে। আব্বা আমার হাতে টাকা দিতেন। আমি খুশি হয়ে দিয়ে দিতাম।এখন ভাবি এ'টি ছিল সন্তানকে দান খয়রাত শিখানোর একটি কৌশলও বটে।সেই ছবি বদলায়নি। বদলে গেছে সময়, বদলেছে মানুষ।আমার একটিই ছেলে হাফেয।সবগুলো পরীক্ষায় টেলেন্টপুলে উত্তীর্ন হয়ে এখন বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়লেও ধার্মিকতার সেই দৃশ্য তেমন দেখতে পাচ্ছি না।প্রতি ঈদে এমন সময়টায় আমার মন আনচান করে উঠে। একই প্রশ্ন প্রতিবার মনে জেগে ওঠে, আমি কি সত্যিই আমি, নাকি আমি আমার বাবার অনুসারি।আমরা আমাদের

সন্তানদের দিকে যতবার তাকাই, আমাদের ছোটবেলাকে কি দেখতে পাই?।না, দেখতে পাই না।যুগ পাল্টায় নি,পাল্টিয়েছে মানুষ।বৈজ্ঞানিক সভ্যতা আমাদের অনেক সম্ভার দিলেও কেড়ে নিয়েছে আমাদের অতীত সূতোর টান।এখন ভালবাসা ,মহব্বত সবই পরিমাপ হয় টাকায়।এখন পরিবার নিয়ে নিজের রিজার্ভ করা গাড়িতে যখন যাই মাত্র দুই বা তিন ঘন্টা সময়ে সেই আনন্দ পাই না।কেউ আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না।আজ ব্যাবধান শুধু কতগুলো বছর।অনেক বছর পর গিয়ে বুকটা ধপ করে উঠে।শৈশবের সে চিত্র আর নেই। সে মাঠ গুলো এখন সংকীর্ন হয়ে এখন পাকা বাড়ি তৈরি হয়েছে,রাস্তার ধারে এখন আর সেই সবুজের সমারোহ নেই,মাঝে মাঝে দোকান পাট গড়ে উঠেছে আর দুর্বিত্তের আড্ডা জমে উঠেছে।ঘন আঁধারের সেই জোনাকি দেখার সুযোগ এখন নেই কারন রাতে বের হলে জীবনের ঘন্টাধ্বনি কখন বেজে উঠে কিনা ।বাড়ির সেই নারিকেল , আম জাম ও কাঁঠাল গাছ, পুকুরে মাছের ঝপ ঝপ শব্দ ও তার সাথে হাঁসের ভেলার মত ভেসে থাকা,রকমারি ফুলের সুগন্ধ, ধানখেতে বকের নি:শব্দ মাছ বধ করার প্রতীক্ষা,খালে জেলের জালপাতা, নৌকার মাঝির পাল তোলা নৌকা বাইতে শুরেলা গান,গ্রামের বধূদের রকামারি শাড়ি পরে বিভিন্ন উৎসব পালন, চাঁদনী রাতে মা বোনদের কাজলা দিদির সে ছড়া আর এখন মোহিত করে না আমাদের পাড়া গাঁকে। বড় ছোট'র মধ্যে কথা বলার শালিনতার যায়গা করে নিয়েছে রাজনৈতিক তর্ক – বিতর্ক।মুসল্লিরা বিভক্ত হয়ে আছে মসজিদ ভিত্তিক।এক গোত্র অন্য গোত্রের মসজিদে নামাজ পড়বে না।আরো রয়েছে রাজনৈতিক বিভাজন। ধনী গরীবের ব্যবধান বেড়েছে অনেক।এককালের মোটে কুলিরা এখন বিশাল টাকার মালিক।আর সমাজের সম্ভ্রান্তরা নিক্ষেপিত হয়েছে আস্তাকুঁড়ে। সারাক্ষন মারা মারি ও হানা হানি ও সংঘাতের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আসে চারদিক থেকে।জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা থেকে কি আমরা আবার ফিরে যেতে পারিনা ছোট ছোট গ্রামগুলোতে? আমরা কি আবার সবাই গড়ে তুলতে পারিনা সেই অবারিত সবুজের মাঠ? আমরা কি একে অন্যকে আপন করে নিতে পারি না দেশ গড়ায়? আমাদের স্বার্থপরতায় বিষিয়ে তুলছে চারদিক।যত বড়-ই আমরা হই না কেন আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ঝোপ ঝাড়ের আংগিনায় যেখানে শুয়ে আছেন আমাদের পরম প্রিয় পিতা-মাতা ও তারও আগের বংশধরগন।

বিষয়: বিবিধ

১৩২৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

343508
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:৪০
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
343533
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:০৮
শেখের পোলা লিখেছেন : ফিরে যেতে চাইলেও পারবেননা কারণ মানুষ বদলেছে৷ সাথে মানুষের মনোভাবও, মনুষত্ব চলে গেছে পশুত্বের পর্যায়ে৷ নিরাপত্তা উবে গেছে৷এবং বাজারে এটার নামই উন্নয়ন৷ জাতি উন্নত হয়েছে৷ধন্যবাদ৷
343659
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০১:২৯
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম । ভালো লাগলো পুরোনো স্মৃতিচারণ! শুকরিয়া!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File