উৎকোচও এক ধরনের বাণিজ্য।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:২৭:৩৭ দুপুর
উন্নত দেশে অবস্হানকারী একজন শিক্ষিতজনের সাথে কথা বলতেই উৎকোচ শব্দটি উচ্চারন করতে তিনি বললেন 'উৎকোচ' শব্দ আবার কি? একজন বাংলাভাষি মানুষ তার উপর লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিয়ে স্বাধীন করা এই দেশ,তিনি জানেন না নিজের মায়ের ভাষাটি।ভীন দেশে থেকে থেকে নিজের ঐতিহ্য হারিয়েছে হাজার বাংগালী।অথচ ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল তার 'ছবি' কবিতায় এ দেশটির কথা কি সুন্দর করে বিবৃত করেছেন তারই কয়েকটি লাইন:
আপনাদের সবার জন্য উদার আমন্ত্রন
ছবির মত এ দেশে একবার বেড়িয়ে যান
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোন মনোহর স্পট আমাদের নেই
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না
আপনার স্ফীত সন্চয় থেকে উপছে পড়া ডলার,মার্ক কিংবা স্টারলিংয়ের বিনিময়ে যা পাবেন ডালাস অথবা মেনকিস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ।
আসুন ছবির মত এ দেশে বেড়িয়ে যান
রংগের এমন ব্যাবহার বিষয়ের এমন তীব্রতা আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেন না
বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?
অথচ দেখুন! এই বিশাল ছবির জন্য ব্যাবহৃত সব উপকরন
অকৃত্রিম।
আপনাকে আরো খুলে বলি এটা অর্থাৎ আমাদের এই দেশ
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান
আপনাদের খুলেই বলি
সম্পুর্ন নতুন একটি ছবির মত করে সম্প্রতি সাজানো হয়েছে
খাঁটি আর্যবংশ সম্মত শিল্পীর তত্তাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ ন'টি মাস দিন রাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি
এখনো অনেক যায়গায় রং কাঁচা।'
এই ছবির মত স্বাধীন দেশে এখন দৈত্যের হানাহানি।একটি যায় আর একটি আসে।উৎপাদিত হয় নতুন নতুন দৈত্য।ব্যাবসা বানিজ্যে,অফিস আদালতে,কোর্ট কাচারিতে,হাটে ঘাটে,ব্যাংকিং ব্যাবস্হায়,স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলায়ে দৈত্যের যেন পসরা বসেছে।লাখ আর কোটি ছাড়া দৈত্য হানা দেয় না।দিতে হবে কয়েক ঘন্টার মধ্যে।আপনার চাকুরি হবে না,বিদ্যুৎ সংযোগ লাগবে না,কাস্টমস থেকে মাল ছাড়ানো যাবে না,জমিতে মাঠি ভরাট করা যাবে না,ব্যাংক লোন নেয়া যাবে না,জমি পরিমাপ করা যাবে না,শিশুটিকে শিক্ষায়তনে ভর্তি করানো যাবে না,আপনি জীবন সায়াহৃে চিকিৎসা নিতে যাবেন দৈত্যের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে সর্বস্তরে।যত রকম অনিয়ম, জাল জালিয়াতি আছে এই সিন্ডিকেট হলো তার পুরোধা।তারা সরকারের অন্যান্য বিভাগকে জিম্মি করে ফেলেছে।এই দৈত্যের হাত ধরেই এখন চলতে হচ্ছে প্রশাসনকে।ছোট থেকে বড় পর্যন্ত,উর্ধতন থেকে অধস্তন পর্যন্ত এখন বাঘে মহিষে জল খায়।কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক।একটি জাতীয় দৈনিক সম্প্রতি নগরজীবন মাতিয়ে একটি চমকে যাওয়ার মতো খবর ছেপেছে। পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক মাত্র চারটি লাইনে জানিয়ে দিয়েছেন ১০ বছরে ৩০০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার গূঢ় তথ্য। তথ্যটিতে জানতে পারলাম সিটি করপোরেশনের এক কানুনগোর যদি ১২০ মাসে ৩০০ কোটি হয়ে থাকে, তাহলে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, কানুনগোর ওপরে যারা আমিন, তাদের আয় কত হতে পারে!যারা বড় বড় শিক্ষিত তাদের আয় কত হতে পারে!আবার পাশাপাশি বিশাল চরিত্রের পড়াশুনায় মেধাবী,জীবনের সবগুলো গোল্ডেন রেজাল্ট করে নুন আনতে পানতা ফুরোয়।বাজারে গিয়ে ৫০০০ টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস খরিদ করে বকেয়া রেখে আসতে হয়,সামনের বেতনটা পেলেই দিব বলে। কি বিভৎস সমাজ! আইনের শাসন নেই,সুবিচার নেই।স্বাধীনতার পরে ১৯৭২-৭৪ সালে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য এসেছিল, এসেছিল বিনা মূল্যে জুতা-স্যান্ডেল, পুরনো কাপড় এবং নতুন নতুন ফুল তোলা কম্বল। জুতা, স্যান্ডেল এসেছিল পোল্যান্ড ও রাশিয়া থেকে, হাঙ্গেরি থেকে এবং অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় বিশেষত কমিউনিস্ট ব্লকের জনগণ দিয়েছিল পুরনো জামাকাপড়। সম্ভবত তৎকালীন জাপান সরকার দিয়েছিল নতুন কম্বল। সৌভাগ্যবশত সেগুলো এসেছিল ঢাকার রেডক্রস অফিসে। সেই সময়ে রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা। গাজী সাহেব একা সৎ থাকলেও তাঁর সহকর্মী সাঙ্গোপাঙ্গরা অসৎ ছিলেন বলেই সেই সব বিদেশি কম্বল গরিব মানুষের ভেতরে বিতরণ না হয়ে হয়েছিল কতিপয় সচিব, মন্ত্রীদের বাড়িতে এবং বাদবাকি কম্বল হেঁটে চলে গিয়েছিল ঢাকার ইসলামপুরে, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে এবং উত্তরবঙ্গে। হাজার হাজার নতুন কম্বল রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার খবরটি জানতে ও শুনতে পেরেছিলেন জাতির জনক এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু সংবাদ জানার পর অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে রেডক্রসের চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমার কম্বলটি কোথায়? অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্ণধার তিনি নিজেও যখন পাননি, তখন রাগে এবং ক্ষোভে বলেছিলেন, 'আমি যেদিকে তাকাই দেখি সেই দিকেই চোর, আমি কারে ধরব, কারে মারব, সবই তো আমার লোক।' একজন জাতির পিতা, একজন বঙ্গবন্ধু, একজন প্রধানমন্ত্রী যদি একই ব্যক্তি হয়ে থাকেন আর তাঁর মুখ থেকেই শুনতে হয় ওই শ্লেষমিশ্রিত বাক্যগুলো তখন দুঃখের শেষ থাকে না।আজ সেই অতীতের দিকে না তাকিয়ে বর্তমানের দিকে তাকালেই দেখতে পাই, শুধু এই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কানুনগো অথবা ওয়াসার ঊর্ধ্বতন নির্বাহী দিবালোকে কোটি কোটি টাকার মালিক হন কিভাবে? বোধ করি আমরা সবাই দিবান্ধ। একটি চা দোকানের মালিক থেকে গার্মেন্ট কম্পানির মালিক যিনি হতে পারেন, নিশ্চয়ই তিনি মেধাসমপন্ন ব্যক্তি। আর সেই মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি যখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তার যোগসাজশে রাতারাতি হাওয়া করে দিতে পারেন কিংবা বেসিক ব্যাংক থেকে দিবালোকে নিয়ে যেতে পারেন হাজার হাজার কোটি টাকা, সেখানে ওই ৩০০ কোটি টাকা তো সামান্য ব্যাপার। বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন [সিএসপি, পরে সচিব হয়েছিলেন]। জনাব সিরাজুদ্দীন যখন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) চেয়ারম্যান, তখন তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন, সেটি ছিল আশির দশকের প্রারম্ভের দিকেই। তখন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনাধীনে দেশ থাকলেও তিনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে বেসিক ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিলেন, বোধ করি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে।ওই দশকেরই মাঝামাঝি আরো একটি সুন্দর প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিসিকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান [সিএসপি, তিনিও সচিব হয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে এবং বিএনপির এমপি হয়েছিলেন আখাউড়া আসন থেকে]। এখন যেখানে রাজউকের নিকুঞ্জ-১, ওই জায়গাটিতে ছিল বেশ বড় জলাভূমি, খাল, বিল। প্রস্তাবটি ছিল বিসিক ওই জায়গাটি ভরাট করে উন্নত দেশের মতো জেলাভিত্তিক হস্ত ও কুটিরশিল্পের জন্য। ১৭টি জেলার নিজস্ব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মিনি সাইজের পার্ক করা হবে, যেমন ঢাকাই জামদানি শিল্পের কারিগরদের আনা হবে রূপগঞ্জ থেকে, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা থেকে আসবে তাঁতিরা, সিলেটের মার্বেল পাথর, রংপুরের শতরঞ্জির করিগর, রাজশাহী সিল্কের, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশিকাঁথার শ্রমিকসহ জেলাভিত্তিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে, যেন বিদেশি পর্যটকরা এসে পুরো বাংলাদেশের জেলাগুলোর হস্ত ও কুটির শিল্পের বয়ন দেখতে পারেন। পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজধানীতে ওই আঙ্গিকে তৈরি করা হয়েছে শিল্পপার্ক। জনাব মুশফিকুর রহমান, বিসিকের প্রধান নকশাবিদ ইমদাদ হোসেনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে একটি সুন্দর মডেল করার প্রাক্কালে জনাব রহমানকে বদলি করা হয়েছিল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে। ফলে সেই শিল্পপার্ক আর হয়নি। খবরটি হয়তো বা জানতে পেরেছিলেন রাজউকের কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতনরা। একদিন সুন্দর সকালে ওই খালে-বিলে মাটি ভরাট করছেন রাজউকের ঠিকাদাররা। পরবর্তী সময়ে জমি বরাদ্দের সময় রাজউকের ঊর্ধ্বতন থেকে নিম্নতমদের পকেট ভারী হলো এবং চেনমাস্টার থেকে কেরানিদের ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি হলো। তবে কেউ ১০ বছরে ৩০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি।প্রসঙ্গ শেষে রবীন্দ্রনাথের 'জাপান যাত্রা' থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। 'বাণিজ্য দানবটা নিজের বিরূপতায়, নিজের প্রকাণ্ড ভারের মধ্যে নিজের প্রাণদণ্ড বহন করছে।' রবিঠাকুর ঠিকই জেনেছিলেন উৎকোচও এক ধরনের বাণিজ্য।
বিষয়: বিবিধ
১১৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন