আমাদের সিভিল ও টক সোসাইটি।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:২৩:৫৮ রাত

প্রিন্ট মিডিয়া ও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টক শোর কল্যাণে আমাদের সিভিল সোসাইটির অনেকেই এখন সিভিল সোসাইটি-কাম-কলাম ও টক সোসাইটিরও সদস্য। কলাম ও টক শোর পাঠক-দর্শক একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই লক্ষ করবেন, আমাদের সিভিল সোসাইটির উল্লেখযোগ্য একটি অংশের বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো দলের প্রতি অনুরাগ-বিরাগের আড়ালে নিরপেক্ষতার ভান করা, গবেষণা ও তথ্যনির্ভর ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার চেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়া, অপ্রচলিত ও অপ্রাসঙ্গিক তত্ত্বের কচকচানি ও সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তবতাবিবর্জিত পরামর্শ।আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত 'তিন উদ্দিনের' সরকারের প্রধান কুশীলব ছিল আমাদের সিভিল সোসাইটির একটি অংশ। এমন অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, তাদের পক্ষে সভা-সেমিনার করেছে। পত্রিকায় কলাম লিখেছে। টেলিভিশন টক শোতে তাদের পক্ষে মুখে ফেনা তুলেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থার সময় আমাদের সিভিল সোসাইটির একটি অংশ আবারও সেই অসাংবিধানিক জুজুর ভয় দেখিয়েছে বারবার। রাজনীতি যতই অশ্লীল হোক তাকে শ্লীল করার নিরন্তর দায়িত্ব সিভিল সোসাইটির। অসাংবিধানিক শক্তিকে স্বাগত জানানো দূরে থাক, তার ভয় দেখানোও সিভিল সোসাইটির সিভিল বা সুশীল না হয়ে ওঠার ইঙ্গিত বহন করে না কি?আমাদের প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার 'মাইনাস টু' নামে খ্যাত ফর্মুলাকে সিভিল সোসাইটির অনেকেই আমাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই,প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন, তাহলে তাঁদের জায়গায় তারেক জিয়া ও সজীব ওয়াজেদ জয় স্থলাভিষিক্ত হবে না কি? তারেক জিয়া ও সজীব ওয়াজেদের রাজনীতি কেমন তা বোধ করি বাংলার মানুষের অজানা নেই। আবার যদি ধরে নিই, তারেক জিয়া ও সজীব ওয়াজেদ জয় স্থলাভিষিক্ত হলেন না কিংবা রাজনীতিতেই এলেন না, তাতেও সমাধান আছে কি? তৈলমর্দন, সুবিধাবাদিতা ও লুটপাটের রাজনীতির যে সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পরিবারতন্ত্রের অনুপস্থিতি রাজনীতিকে আরো উপদলীয়, সাংঘর্ষিক ও খণ্ড-বিখণ্ড করে রাজনীতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবে না কি?আর এতে অসাংবিধানিক অরাজনৈতিক শক্তির আশঙ্কা আরো জোরালো হবে না কি? ইতিমধ্যে আমাদের সোনার ছেলেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে ত্রাস সৃষ্টি করছে তার দায়ই বা কার? কেন তাদের নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না? তারা নিয়ন্ত্রিত হবে কি করে যেখানে তারা দেখছে মন্ত্রী এমপিদের বাড়ি হয়ে যাচ্ছে প্রথম শ্রেনীর দেশগুলোতে।একটি ধ্বংস আর একটি ধ্বংসকে ডেকে আনে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগাছা পরিষ্কারের কথা বলেছেন।এমপি মন্ত্রীরা কি আগাছা পরিষ্কার করবেন? আগাছা যদি পরিষ্কার হয়েই যায় তাহলে তাদের মসনদই টিকে রাখবেন কিভাবে? তবে আগাছা পরিষ্কার করলে যে ফলন ভাল হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের সিভিল সোসাইটির একটি অংশ এখনো নির্দলীয়-তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য দাওয়াই মনে করে এর পক্ষে পত্রিকার কলামে-টক শোতে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সেবন করা তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই রাজনীতি ও গণতন্ত্রের রোগ নিরাময়ে কার্যকর দাওয়াই হয়ে উঠতে পেরেছে কি? না কি এ দাওয়াইয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সরকারের একটি অঙ্গ প্রায় বিকলাঙ্গ হতে বসেছিল? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করায় বিচার বিভাগের বিকলাঙ্গতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদান্তে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান ছিল। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার এক ধংসাত্মক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। এর ফলে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারিক চরিত্র পাল্টে একে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এক ভয়ানক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। দেশের উচ্চ আদালতকে রাজনৈতিকভাবে দখলের কলাকৌশল শুরু করে প্রধান দুই দলই। দখল-কৌশলের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করার সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা ভঙ্গ করা হয়। প্রশ্নবিদ্ধ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। কেবল উচ্চ আদালতের বিচারকদের বয়স বাড়ানো হয়। আদালত অঙ্গনের পবিত্রতা নষ্ট করে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতি শুরু হয়। এজলাসের দরজায় লাথি মারা হয়। এজলাসে বসে থাকা বিচারককে উদ্দেশ করে গালাগাল শুরু হয়। আইনজীবীরা বিভক্ত হয়ে আইনের শাসনের চেয়ে দলীয় আদেশ-নির্দেশের প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ অসুস্থ রাজনীতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কেবল ক্ষমতার পালাবদলের গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে ধ্বংস করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যাবে কি? বিচারপতিদের বাদ দিলে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা যাবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা আছে কি? উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো ব্যক্তি আছেন কি? বিগত অচলাবস্থার সময় যে কয়েকজনের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তাঁদের নেতিবাচক আক্রমণের শিকার হতে হয়নি কি? এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বক্তব্য পাঠক-দর্শককে বিনোদন দেওয়া ছাড়া আর কি হতে পারে?অবশ্য বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বক্তব্য থেকে সরে এসেছে।গত নির্বাচনে পিছিয়ে থেকে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজেদের নেতাকর্মীদের জেল জুলুমের দ্বারস্হ যেমন করেছেন তেমনি একটি গোপনীয় শক্তির মাধ্যমে দেশে কয়েক মাস ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।এতে ক্ষতি হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষের।কোন ক্ষমতাশীন সরকারের ক্ষতি হয় না। আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে আরো পরিশীলিত করার জন্য সিভিল সোসাইটির যতটুকু সিভিল হওয়ার দরকার ছিল, তা হতে পেরেছে কি? রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ, দূরদর্শিতার অভাব, গবেষণা ও তথ্যের চেয়ে অনুমান ও আবেগনির্ভর পরামর্শ সিভিল সোসাইটির সিভিল হয়ে ওঠার পথে বড় বাধা নয় কি? অসংখ্য দলে বিভক্ত জাতি কখনো দেশে উন্নয়নের দ্বার উম্মোচন করতে পারে না।পশ্চিমা দেশগুলোতে বহুদলীয় গনতন্ত্র থাকলেও তারা দেশের অকল্যান হয় এমন কোন কাজ করে না।আমাদের দেশের সিভিল ও টক সোসাইটির বৃহৎঅংশের বিভক্তির কারন হলো ক্ষমতাশীনদের আশ্রয়ে থেকে কিছু পাওয়ার আশা,তানাহলে তারা একতাবদ্ধ হতে পারছে না কেন?

বিষয়: বিবিধ

১০৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File