পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘হাসিনা দিদি’ সম্বোধন প্রটোকল সম্মত হয়েছে কি?
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৩:০৫:৫৮ দুপুর
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তিন দিনের সফর শেষ হয়েছে গত শনিবার(২১/০২/২০১৫)।বাংলাদেশের আমজনতার একটি প্রশ্ন তিনি কি শুকনো নদীর ইলিশ খেতে চান না আমাদের প্রাপ্য পানি দিয়ে তিস্তার প্রান সন্চার করতে চান? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, এটি সরকারের একটি অত্যন্ত ভাল পদক্ষেপ ।শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের তিনি শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন।কিন্তু আমার মনে একটি খটকা লেগে গেল জনসমুক্ষে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘হাসিনা দিদি’ বলে সম্বোধন করলেন কেন? আমার মনে হয় তিনি বাংলাদেশের মানুষকে জানাতে চেয়েছেন তিনি কত আন্তরিক! প্রটোকল তার কাছে মুখ্য নয়,এটি নিতান্ত একটি গৌণ বিষয়। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে এভাবে প্রকাশ্যে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করা যায় না, মমতা ব্যানার্জির কাছে এটা বিবেচনায় আসেনি।কোন কাছের বন্ধু হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন কথা বলা যথোপযুক্ত নয়।তিনি যেমন পশ্চিমবঙ্গের একটি রাষ্ট্রীয় পোষ্টের প্রতিনিধিত্ব করছেন তেমনি শেখ হাসিনাও একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পোষ্ট অলংকৃত করছেন।অন্দর মহলে যেমন ব্যাক্তিগত কোন সম্বোধন করা যায় তেমনি করা যায় না বিশেষ কোন যায়গায়।তিনি কি এমেরিকার প্রেসিডেন্টকে "ব্রাদার" বলে সম্বোধন করতে পারবেন? নিশ্চই তিনি করবেন না।তাহলে ভাষাভাষি বলে এমন হয়ত করা ঠিক হয় নি।
বাংলাদেশের মানুষ অতীতকাল থেকেই অতিথি পরায়ন যা অন্য কোথাও দেখা যায় না।আমাদের গাঁও গ্রামে অপরিচিত কোন যায়গায় গিয়েও দেখেছি কি আদর আপ্যায়ন যেন তাদের সাথে দীর্ঘ একটি উঠাবসা ছিল।আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি একটি দুর্বলতা আছে এবং তিনিও এটিকে বেশ পছন্দ করেন, আর সেকারনে মমতা ব্যানার্জির আগমন উপলক্ষে গনভবনে দুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ পদের খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৪ পদের। তিনি যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে(পররাষ্ট্রমন্ত্রীগন) যারাই নয়াদিল্লি গিয়েছেন, তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার ইলিশ’। এটি আতিথেয়তার অংশ যদিও এখন ইলিশের রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধ।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুন্দর কথা বলেছেন যে,আগে পানি তার পর ইলিশ রপ্তানী।এ কথাটি নিশ্চই দেশাত্ববোধকে উজ্জিবিত করে। তিস্তার পানি বণ্টনের সমস্যা তো সৃষ্টি করলেন মমতা নিজেই। তাঁর আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হলো না এবং এবারও তিনি কোন কমিটমেন্ট করলেন না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানান। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গীর কি কোনো পরিবর্তন কি এসেছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি ‘দুদেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস’ দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছেন এ কথা। তার আগে ভারতীয় হাইকমিশনার কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকি বাংলা’য় মমতা নিজেই বলেছেন তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে, তবে কত দিন? স্থল সীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেই- এটা আগেও আমরা জেনেছি। ঢাকাতেও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তিনি ‘কমিটমেন্ট’ করলেন না কেন? তাঁর আসার কথা শুনে অনেকের আশার সন্চার হয়েছিল যে অন্তত একটি সমস্যার সমাধান হতে পারে।কিন্তু হলো না,তাহলে আমরা ধরে নিব এটি ছিল মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক চরিত্র। যেখানে স্বার্থ রয়েছে, সেখানে মমতা আছেন। ২০১৬ সালে সেখানে বিধান সভার নির্বাচন। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চান না। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি, মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক’টি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে, তার মাঝে তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম। এক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন ঢাকা ঘুরে গেলেন। তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ৫ দিনে তিস্তার পানি প্রবাহ ৫০০ কিউসিকের নিচে নেমে গেছে। সেচ প্রকল্পে পানি দেয়া দূরের কথা, শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার এক হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যু মুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তার পানি প্রবাহ কমতে থাকে।
খবরে প্রকাশ,বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানি প্রবাহ আসছে। ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে, প্রথম দিন পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক, আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (সকালের খবর, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানি প্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এ বছর নামল ৫০০ কিউসেকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের জন্য আরও সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছে।মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতি নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব, আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা কোনো বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারী গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকাল ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মত্তি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি’ ও ন্যায়ের ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জল প্রবাহ কনভেনশন নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এমনভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমনকিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না। এখন ঢাকায় দেয়া মমতার বক্তব্যকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? তার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু আমরা আস্থাটা রাখি কীভাবে এবং তা কতদিন? ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল ক্যারেক্টার’ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। তার কথার কোনো মূল্য নেই। তার অতীত বলে, তিনি এক সময় কংগ্রেসের মিত্র ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। বিজেপির মিত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। সুতরাং তার ওপর আস্থা রাখাটা কঠিন। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই মন্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণবকুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রাখা (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ বাস্তবতার সমাধান করা যায়।
এখন মমতা কলকাতা ফিরে গেলেন। তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট’কে উপলব্ধি করেছেন। তার ঢাকায় থাকা অবস্থাতেই তিস্তার করুণ কাহিনী বাংলাদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই এটা দেখেছেন। বাংলাদেশ তাকে ‘বন্ধু’ মনে করে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। তিনি এখন সেই সম্মানটুকু রাখবেন, এটাই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। স্থল সীমানা চুক্তির প্রতি তার সমর্থনকে আমরা স্বাগত জানাই। এমনকি বাংলাদেশ-পশ্চিমবাংলা বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একই ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে। যে কোনো বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মিল থাকার কারণে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কী কীভাবে উপকৃত হতে পারে, তা খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বইয়ের পাঠকগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখকের বইয়ের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যেমন ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তেমনি কলকাতার অনেক লেখক বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কাজেই বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গের বই বাংলাদেশের পাঠকের কাছে সহজলভ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী কী উদ্যোগ নেবে এদিকেও রয়েছে কৌতূহলী পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে, এ বিষয়টিও বহুল আলোচিত। সংস্কৃতির আদান-প্রদানসহ এ বিষয়ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এটাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যকার যে কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে দুদেশের জনগণের উষ্ণতা ও বিশ্বাসও কার্যকর ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক।পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বই নিয়ে বইমেলার আয়োজন পশ্চিমবঙ্গের জনগণের ব্যাপক আগ্রহ যে আছে তা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বিশ ত্রিশ মাইল দূর থেকেও অনেকে সপরিবারে বইমেলায় এসে হাজির হয়ে থাকেন এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বই ক্রয় করেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বয়স্ক মানুষ বাংলাদেশের মানচিত্র হাতে নিয়ে বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের বাংলাদেশে তাদের আদি নিবাসের সঙ্গে পরিচিত করানোর সময় যেভাবে আবেগাপ্লুত হন তাতে শেকড়ের প্রতি তাদের বিশেষ আন্তরিকতাই স্পষ্ট হয়।
বাংলাদেশে বসবাসকারী যেসব নাগরিকের আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গে, তারাও মাতৃভূমির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই অনুভূতি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কতভাবে উপকৃত হতে পারে তাও খুঁজে বের করতে হবে।শিক্ষাক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিশেষভাবে উপকৃত হতে পারে। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা উপকৃত হতে পারি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে উপকৃত হওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানোর জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।সাগরপথে বাংলাদেশ ও ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। সাগরপথে বাংলাদেশ ও ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলে তা পর্যটন খাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পর্যটন খাতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার যৌথ উদ্যোগ নিলে এতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ বিশেষভাবে উপকৃত হবে। বিশেষ করে নদীপথে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে যেসব সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া দরকার।নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা দরকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের জনগণের আগ্রহ বাড়ছে। এই ব্যাপক আগ্রহ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বিশেষভাবে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।এছাড়া বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের যৌথ উদ্যোগে আরও কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা চিহ্নিত করার জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।ভারত আমাদের বন্ধু তাতে কোন সন্দেহ নেই।তবে সন্দেহ তৈরির মত যে কাজগুলো হচ্ছে তা নীরসন করা জরুরি।সীমান্তে সাধারন মানুষ হত্মা,ক্রটিযুক্ত মালের চোরাচালান(যৌথ উদ্দোগে বন্ধ করন),মাদকের সরবরাহ,জংগি ততপরতা(যৌথ উদ্দোগে বন্ধ করন)।গনতন্ত্রের স্বার্থে সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয় - এই নীতি আমাদের দুদেশকে মেনে চলতে হবে।ভারত একটি বড় রাষ্ট্র হিসেবে তার পার্শবর্তী বন্ধুরাষ্ট্রের একটি দলকে সমর্থন করে অনৈতিক একটি নির্বাচনের পথ করে দিয়ে সম্ভাবনাময় একটি দেশটিকে সুদূরপ্রসারি ক্ষতির দিকে ধাবিত করে দিয়েছেন কিনা এবং তা প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় কিনা তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।আমরা আমাদের বাইরে বড় ছোট সব দেশকেই বন্ধু হিসেবে বরন করে নিতে চাই তবে সেখানে থাকতে হবে দেয়া নেয়ার সম্পর্কের ভিত্তি।শুধু আমরা দিয়েই যাব, এই নীতিতে বাংলাদেশ কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী নয়।
বিষয়: বিবিধ
১৪২০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন