শীতের প্রহরগুলোতে গৃহযুদ্ধের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই -----।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১১ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৫৪:৪৯ রাত

আজ কয়েকদিন ঠান্ডা আর হিমেল হাওয়ায় সিংহভাগ সময় শীতের কাপড় জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।গভীর রাতে হিমেল ভাবটি আরো প্রকট হয়ে উঠে।দেশে যেমন শহর আর গ্রামে শীতের পার্থক্য লক্ষ্য করার মত তেমনি মরু দেশগুলোতেও শীতের তারতম্য ঘটে থাকে।রিয়াদ ,দাম্মাম , আলবাহা ও মদিনায় শীতের সময় শীত ও গরমের সময় গরম প্রকট আকার ধারন করে।সে হিসেবে জেদ্দাকে নাতিশীতোষ্ম বলা যায় ও বছরের অধিকাংশ সময়ই আবহাওয়া চমৎকার থাকে।দু'দিনের শীতের সামান্য তীব্রতা আমাকে টেনে নিয়ে গেল ৪০ বছর আগের সেই সবুজ গাছপালা ঘেরা গ্রামের দিকে।হালের বলদ নিয়ে চাষীর মেঠো পথ চলা,গাছীর খেজুর গাছ থেকে রস নামানো,পূর্বদীগন্তের প্রখর রৌদ্রতাপে বসে পিঠাপুলি খাওয়া,শিশিরযুক্ত ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রাম্য হাঁটে যাওয়া,বিবাহের উৎসব,কৃষকের শীতের শব্জি ফলানো এসবের উপাখ্যান ছিল অতীত শীতকালে।কালের করাল গ্রাসে সে সব এখন বিলীন হয়ে নগর সভ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

দেশেও এখন প্রচন্ড শীত এবং বাঘের মতো পিছু নিয়েছে কুয়াশার মায়াবী নাগপাশ, শীতের গল্প ও কবিতা আর সামনে ফেব্রুয়ারির ভাষা সৈনিকদের পূর্বাভাস। কল্পনায় ভাবি, তাকে একবার পেলে আর ছাড়াছাড়ি নেই। তাই কুয়াশা তরুণীকে হাতছাড়া করতে রাজি নই। সেই কবেকার বালক বয়স থেকে দেখেছি আমাদের উঠোনে খুব ভোরে কাজের লোকেরা ধান মাড়াই শুরু করেছে তক্তায় পিটিয়ে বা গাছের গুড়িতে! তার শব্দতরঙ্গ কুয়াশায় ঘেমে-নেয়ে হয়ে উঠত পিচ্ছিল ও লাস্যময়। কখনো বা বড় দিদিরা যোগ দিত শলা-পরামর্শ করে। ফাঁকফোকর করে নিয়ে ছোট বোন ও আমিও সেই কুয়াশার বাড়িতে চুপিসারে ঢুকে পড়তাম। অল্প সময়ের মধ্যে গায়ের শীত পালিয়ে যেত শীতের ঘরে। খড় মাড়াইয়ের সময় হয়ে উঠতাম আরো বেপরোয়া। কারণ তাতে পরিশ্রম কম, প্রমোদ বেশি। খড় মাড়াইয়ের চাকের গরুর পিছু পিছু ছুটা ও পরে উঠোনে বসে শীতের রসের পিঠা খাওয়ার বেপরোয়া মজার কি তুলনা আছে? কুয়াশার শব্দহীন শব্দ তখন হয়ে উঠত সবাক।

ততক্ষণে কুয়াশা আমলকীর মতো পুষ্ট হয়ে গেছে, ভোরের প্রধান আলোয় রৌদ্রাভ হয়ে উঠবে। টুপ টুপ উঠোনের উত্তর পাশে নারিকেল- সুপরি গাছের প্রতিবেশী শিউলির কমলা-সাদা পুষ্প। শরতের রাজকন্যা শিউলি অঘ্রানকে বধ করে পৌষে কৃষকায় হলেও সোমত্ত-সুন্দরী। উঠোনের ওপরে ফাঁকায় কুয়াশারা ওড়াওড়ি করছে বৈশেখের মাছের রেণুর মতো। ওরা এসে জড়িয়ে যাচ্ছে চুলে ও ভুরুতে। গায়ের চাদর নকশিকাঁথা ছুড়ে ফেলে দিয়েছি ধানের আঁটির ওপর, ওখানে সে কুয়াশাভেজা হোক, ওর এখন শীত-গরম বোধকরি খুব একটা মালুম নেই। আমার গায়ে থাকলে টের পেত উষ্ণতা ও শীতের ব্যবধান দূরত্ব।আধুনিককালে কার্তিকের কুয়াশার নিজস্ব নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ। অনিবার্য কার্তিকের রেশ ধরে শীত এসেছে তাঁর কবিতায়। প্রকৃতি, ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার বা নিশ্চেতনার কবি হয়তো তিনি অথবা সুররিয়ালিস্ট। 'অন্ধকার' কবিতায় তিনি দীর্ঘ এক পঙ্ক্তিতে লিখেছেন, 'হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,' এবং তার পরের পঙ্ক্তিতে আছে, 'আমাকে জাগাতে চাও কেন?'

কুয়াশার দিনগুলো পেরিয়ে মাঘরাত্রির কোকিল বা শীত থেকে কে আর সাধ করে বাঁচতে চায়? কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আসলে এখানেও শীত থেকে রেহাই পেতে চাননি। তিনি স্বপ্নবাস্তবতা রচনা করেন মায়াবী কুয়াশা ও আত্মমগ্ন শীত নিয়ে, বনলতা সেন ও সুরঞ্জনাদের ও বাংলা নিয়ে, মহাপৃথিবীর মহাকুয়াশা ও শীত নিয়ে। এমন ঘোরগ্রস্ততা বাংলা সাহিত্যে নেই।আবার তাই শীত এসেছে বহু দেশ ঘুরে বহু পথ পেরিয়ে জাঁক দেখাতে। প্রতিবছর শীত আসে। কিন্তু এ বছর বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সে শরৎকে গোগ্রাসে গিলে হেমন্তকে করে দিয়েছে ক্ষণজীবী। তাই হেমন্ত থেকে শীত এসে পড়েছে। এখন শীত তার বিখ্যাত ভাণ্ড থেকে কুয়াশার জামদানি শাড়িকে করে তুলেছে নিবিড়-ঘন জলডুবি চাদর। সেই সঙ্গে তার একান্ত নিজস্ব শব্দগন্ধচিত্রমালার সাম্রাজ্য উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ আলিঙ্গন ও মর্দনরসে কাতর করে তুলেছে। সে কুয়াশার ও শিশিরের শব্দ হয়ে ঝরে, গন্ধ বিলায় খেজুর ও আখের রসের প্রাতর্স্নানে, তার চিত্রের দৃশ্যমালাও ফের কুয়াশা-রোদের নর্মখেলায় মেতে ওঠে। শীতের হাওয়ার নাচন যখন আমলকীর ডালে ঝাঁপ দিয়ে ডুব দিয়ে পড়ে, তখন তার পত্রপতনশীল শব্দসংগীতও সূক্ষ্ম তান ও তারানা-তেলেনা গাইতে রেয়াত রাখে না। তখন আমলকীগুলো আর লুকিয়ে থাকে না পাতার বক্ষোবাসে। পিঠেপুলি উৎসবের সুগন্ধ ও তা আড়াল করে রাখতে পারে না, আসন্ন বসন্তের উত্তাপের কথা ভেবে ঝলমল হয়ে বাজতে থাকে। শীতের এই শব্দগন্ধসুবাস রমিত হওয়ার যোগ্য কলাকার, সৃষ্টিশীল।

এই কুয়াশার সকালে,কুয়াশার চাদরের ভেতর দিয়ে ছেলেবেলায় যেতে হতো স্কুলে।। শীতকালে কুয়াশার বাড়ির ভেতর দিয়ে আমরা প্রমত্ত আবেগে স্কুলে ছুটে যেতাম। স্কুলের মঠে চিকচিকে রোদে শিক্ষক পড়াতে ভালবাসতেন। আবার কখনো কুয়াশার চাদর জড়িয়ে বাজার করতে যেতাম। তখনো কুয়াশা লেপ্টে থাকত। সব স্মৃতি নিয়ে এ বছর শীত হবে দীর্ঘ, ফাল্গুনকেও তার আগ্রাসী শয্যায় বন্দি করে নেবে। শীতের শব্দগন্ধচিত্রমালায় ভূষিত করবে ভোগবাসনা চরিতার্থ করতে।

আমি একটুও ভুলিনি শীতের প্রধান অহঙ্কার আম্রমুকুলের কথা, কাঁঠালের মুচি ও কুলের মুকুল থেকে কচি ফল হওয়ার কথা। শর্ষের ফুলে উত্তরবঙ্গের বিল স্বর্ণকরোজ্জ্বল হয়ে মৌমাছিদের বাসনা বিভোল করার দৃশ্যগন্ধ বিস্তারের মত্ততা। গ্রামের বাড়ির বেড়া ও টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে জমাট শীতের শিশিরের শব্দ আসবে। টুপটাপ টুবটুব শব্দসংগীতে। পিঁপড়ে, ব্যাঙ, বিলের কিছু জিয়ল মাছ, সাপ শীতঘুমে গিয়ে শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে। পিঁপড়েরা ঠিক ঘুমোয় না; কিন্তু নিরাপত্তার বেষ্টনীতে চলে গিয়ে শীত মোকাবিলা করছে। মজাপুকুর খোঁড়ার সময় শীতঘরে মাছদের দেখা যাবে। কাক এখন যৌবনমদে মত্ত হচ্ছে।শীতে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের নামে ধ্বংসখেলায় মেতে উঠবে।বাংলার প্রকাশনা জগৎ দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজে ঢেলে দিয়েছে অমর একুশের উৎসর্জন তিতিক্ষায়।এসময়টি-ই দেশে বড় আনন্দের দিন।কিন্তু ধ্বংসলীলার মাঝে,গৃহযুদ্ধের দামামাতে আনন্দ হয় কেমন করে? সারারাত্র শীতের প্রকোপে জ্বরাগ্রস্ত মানুষ।নির্ঘুম রাত্র,বোমা ফাটায়,ধাউ ধাউ আগুন জ্বলে ঢাকার অলিতে গলিতে।প্রাতে কুয়াশার চাদরে জড়ানো পথিক এক পা সামনে দেয় তো আর এক পা পিছে।কি জানি আজ বিকেলে ঘরে ফিরবে, না বয়ে আসবে লাশ।তবুও আমি আমন্ত্রন জানাই শীতের সকালে ,শীতের রাতে তোমরা ভালবাসার চাদরে দেশকে জড়িয়ে রাখ।যেমনি আমন্ত্রন জানোয়েছিলেন পল্লী কবি জসিমউদ্দিন তার 'নিমন্ত্রন' কবিতায়-

তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;

মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি

মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,

মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,

তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।

বিষয়: বিবিধ

১৭১০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300200
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৯:৪১
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
300271
১২ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:৩৯
হতভাগা লিখেছেন : বড় জোর আর সপ্তাহ খানেক । জনগন খালেদা ও তার দলকে উচিত শিক্ষা প্রদান করবে ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File