দরিদ্র ও বন্চিত মানুষের কথা নিয়ে কেউ ভাবে না—
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৬ জানুয়ারি, ২০১৫, ১০:৫৭:৫৪ রাত
এ দেশের কৃষক-মেহনতি মানুষের দীর্ঘদিনের শোষণ-নিপীড়নের সংগ্রাম ও বিদ্রোহের ফল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু 'স্বাধীন' বাংলাদেশের কৃষক-মেহনতি মানুষের 'মুক্তি' কি ঘটেছে? না ঘটে নাই। সে আশা হয়তো সুদূরপরাহত! গনতন্ত্রের নামে দেশে চলছে নৈরাজ্য ও একদলীয় শাসন।একবার কেউ শাসন ক্ষমতায় আসলে আর নামতে চায় না।এটিকেই বলে গনতান্ত্রিক স্বৈরাচার। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা উপরে থাকলেও দারিদ্র্য-বঞ্চনার হার তেমন কমে নাই। কৃষকরা ফসলের দাম পায় না, শ্রমিকরা বেতন পায় না, বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থান নেই। অনাহারে, ঋণের দায়ে, কখনো আত্মহত্যা অথবা নীরব আত্মহননের দিকে সোপর্দ করতে হয় এই সিংহভাগ দিশাহারা সাধারণ জনগণকে।যে দেশের উন্নয়ন কর্মসূচি গৃহীত হয় গোষ্ঠীবিশেষের উন্নতির স্বার্থে, শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হয় জাতিকে পঙ্গু ও কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশ্যে, সে দেশের জনগণকে রাজনীতি-সচেতন না হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই।তারা এখন ভাবতে শিখছে কিভাবে বাঁচতে হবে।গত কয়েকদিনে কারা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত? এদেশের প্রান্তিক সাধারন মানুষ।যাদের একদিন কাজ না করলে সংসার চলে না।এই অন্দোলন সংগ্রামে রক্ত দেয়,আহত হয়ে পড়ে থাকে সাধারন মানুষগুলো।তাদের চিকিৎসা নেই ,ঘরে খাবার নেই তারপরও জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে শরীক হয়।তারা জানে না কে তাদের ডাকছে?আগামি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য ,সুখে থাকার জন্য তারা অন্দোলন করে।কিন্তু যারা ক্ষমতায় আসে তারা ভুলে যায় তাদের এই ত্যাগের কথা।একটি স্বাধীন দেশে গত ৪৩ বছর ধরে প্রান্তিক মানুষগুলোকে এভাবে যারা শোষন করছে আবার তাদেরই তারা ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দিচ্ছে।সমাজের ভাল মানুষেরা বলে যাচ্ছে,লেখকরা লিখে যাচ্ছে কিন্তু কেউ কর্নপাত করছে না।অঘঠন সংগঠিত হয়ে যাচ্ছে আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি,মধ্য শ্রেনীর ব্যাবসায়ি,খেটে খাওয়া মানুষ ও চাকুরিজীবিগন।যে সব ঘটনা ঘটে,এ সবই সংঘটিত হয় রাজনৈতিকভাবে। কালোবাজারি ও এই নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকা রাখার মত বিরুধীদল গড়ে উঠেনি।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসনক্ষমতা বজায় রাখার স্বার্থে এই ভূমির ইতিহাসকে তাদের মতো করে তারা গড়ে তুলেছিল। ইতিহাস বিকৃতিতে ইংরেজদের দোষারোপ করলেও ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তানে কিংবা '৭১-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে জাতি, সমাজ, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি, সংস্কৃতির সমৃদ্ধি, জনগণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলার প্রশ্নে যে বুনিয়াদই প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা ও তাকে কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে উন্নত সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে দিকনির্দেশনার পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় আনার কথা ছিল।তৎকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপরিকাঠামো তাদের নৈতিক পদস্খলন ও রাজনৈতিক প্রজ্গা না থাকা এবং নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় নি। তার অন্যতম কারণ বলা যায় জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রশক্তির অভাব। সরকারি ইতিহাস লেখক অপেক্ষা পণ্ডিতি লেখকের অভাব। ফলে সংখ্যালঘু শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থেই, তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত ইতিহাসে সয়লাব হয়েছে। 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় এক স্থানে লিখেছেন 'মানুষের সমাজই মানুষের সর্বপ্রকার কর্মকৃতির উৎস, এবং সেই সমাজের বিবর্তন-আবর্তনের ইতিহাসই দেশকালধৃত মানব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে।' ফলে আমাদের বিকৃত বহুভঙ্গির ইতিহাসে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরির গতিপ্রকৃতি ভুলপথে চালিত করেছে।
ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়নের অন্যতম জ্বলন্ত উদাহরণ 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' বা সাঁওতালি ভাষায় 'হুল' বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত। শোষণ-নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা এই বিদ্রোহ করেছিল। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভূখণ্ডের জন্য এ জনপদের মানুষ বারবার অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের আগে শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য ব্রিটিশ বাহিনীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই 'সাঁওতাল বিদ্রোহ'। বন্দুক-কামান আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উপেক্ষা করে সাঁওতালরা নেমেছিল নিজেদের ভূমি রক্ষার তাগিদে, নিজেদের দেশ ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই অকুতোভয় সাহসী সহোদর সিদু ও কানু। শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য। মৃত্যুক্ষণে বিপ্লবী কানু বলেছিলেন, 'আমি আবার আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব।' একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছি সবাই। আমাদের লাল-সবুজ পতাকায় জড়িয়ে আছে যাঁদের সম্ভ্রম, তাঁরাই শুধু থেকেছে বঞ্চিত।তাঁরা বস্তিতে বসবাস করে নিদারুন জীবন সংগ্রামে লড়ে,হাড় কাঁপানো শীতে তাদের বাস বিভিন্ন টার্মিনালে,রাস্তার পাশে বা ব্যাবসায় কেন্দ্রের আশে পাশে, তাঁদের মৃত্যুতে জানাজা হয় না, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠে না, অসুস্থতায় চিকিৎসা হয় না! এই অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁদের কথা ভুলতে চায়, ভুলে থাকতে চায়।তাদের রক্তচোষা পয়সা দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে রাত বিরাতে।এ লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয় না।
১৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ছাত্ররা প্রথম থেকেই এরশাদের শাসনক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রদের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রথম মারা যায় জয়নাল দিপালী কাঞ্চন। পশ্চিম থেকে আগত ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে ভেসে এ প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে সেই সব নাম। এ ছাড়া এরশাদের শাসনক্ষমতা দখল যে অবৈধ ছিল, তা শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের রহস্যময় অংশ 'মুজিব বাহিনী'। মুজিবনগর সরকারের অলক্ষ্যে গড়ে ওঠা 'মুজিব বাহিনী' শেষ বিচারে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যও উপকারী কোনো সংগঠন হিসেবে কাজে আসেনি, যার প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতার পর। অন্যদিকে বিএনপি ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। অথচ ৭ নভেম্বর সংঘটিত করার অপরাধে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীর-উত্তমকে বেআইনিভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা আর বরখেলাপের রাজনীতি নবম জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আসনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও ভোটের হারে আওয়ামী লীগের থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। সেই মোতাবেক জনগণের সরকার ও বিরোধী দলের কাছে ছিল সমান প্রত্যাশা। সবাই বিরোধী দলকে সংসদে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গঠনমূলক অবস্থানে দেখতে চান। বিরোধী দলকে ছায়া সরকার বলা হলেও কার্যত তা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সরকারি কিংবা বিরোধী দলের কারোরই কোনো দিন প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। নবম জাতীয় নির্বাচনের আগে তৎকালীন মহাজোট নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, 'উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর করবেন।' আজও পর্যন্ত তা হয়নি, ফলে আজকের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি আষাঢ়ে গল্পে পরিণত হয়েছে।
দলীয় পরিচয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের দলীয়করণ এবং প্রশাসনের ওপর সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের অন্যায্য নিয়ন্ত্রণ একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কাম্য নয়। অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকারের সঙ্গে জনপ্রশাসনের দ্বন্দ্বও দেশের অগ্রগতির জন্য হুমকি। দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে সমূলে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের। কিন্তু আদতে দুদক বরাবর যেকোনো সরকারের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠান হয়েই থেকেছে. আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের ধারণার জন্ম বাংলাদেশে। এর প্রবক্তা ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর সেই আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ এখন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঋণ আদৌ ঋণগ্রহীতাকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলেছে কি না-তা নিয়ে চলছে এখনো বিতর্ক। নারীর অধিকার রক্ষায় সমাজ ও রাষ্ট্র কত দূর?৮ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস। প্রতিবছরই স্লোগানে ও পোস্টারে, সভা আর শোভাযাত্রায় নারী অধিকারের কথা বলাও হয় জোরালোভাবে। কিন্তু আদৌ কি নারীদের অধিকার রক্ষায় এগোচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র? নাকি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই নারী অধিকার কথাটি শুধু কেতাবি কথাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে? খোদ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা কি ঠিকমতো তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন? যদি পারেন-ই তাহলে দেশে নারিরা লান্চিত হচ্ছে কেন? ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতির কলঙ্কময় বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্রলীগের ইতিহাসকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই। আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামে সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই ছাত্রলীগ উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনটি পরিণত হয়েছে দখলবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের নিরাপদ আশ্রয়ে। অন্যদিকে দেশে ছাত্ররাজনীতি খুইয়ে বসেছে তাদের অতীত ঐতিহ্য। বড় ছাত্রসংগঠনগুলো পরিণত হয়েছে অছাত্রদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে। এমাতাবস্হায় দেশের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের প্রয়োজন সামনে এগিয়ে আসা অত্যাবশ্যক।দেশের মানুষকে বাঁচানোর,দেশকে বাঁচানোর এটিই শ্রেষ্ঠ সময়।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন