সবার ওপরে মা

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৪ মার্চ, ২০১৩, ১১:৪৩:১১ সকাল

পৃথিবীতে আল্লাহ বহু প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হচ্ছে মানুষ। মানুষের ভেতর জ্ঞান দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন, অনুভব করার শক্তি দিয়েছেন। অন্য প্রাণীর ভেতর প্রাণ দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন; কিন্তু মানুষের মতো বিবেক দিয়ে কিছু করার ক্ষমতা দেননি। মানুষকে কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন, কারণ এটা ইবাদত। কর্মের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার ভেতর মানুষকে আল্লাহ পরীক্ষা করেন, অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে এই পরীক্ষা নেই। এজন্য মানুষকে সত্যিকারভাবে অনুভব করার শক্তি দিয়েছেন। ন্যায় কর্ম আর ভালোবাসার বিনিময়ে একজন মানুষ জান্নাত পেতে পারেন। একটা পরিবারে অনেক সদস্য থাকেন। তাদের ভেতর দু’জন প্রধান ব্যক্তি থাকেন—তারা হচ্ছেন বাবা-মা।

সন্তানদের এই দু’জনকে ভালোবাসতেই হবে, এটা আবশ্যিক। বাবা-মা সন্তানদের কখনও অমঙ্গল চান না। ছেলে-মেয়ে বাবা-মায়ের কাছে কতটা আদরের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাবা-মা সন্তানকে আদর-ভালোবাসা দিয়ে যখন বড় করেন এবং যোগ্য করে গড়ে তোলেন, তখন তাদের চোখে স্বপ্ন থাকে—তারা যখন বৃদ্ধ হয়ে যাবেন তারাও সন্তানদের কাছ থেকে আদার-ভালোবাসা পাবেন। এমন আশা সব বাবা-মাই করেন। কিন্তু সব বাবা-মা আদর-ভালোবাসা পান না। কারণ এখন এমন একটা যুগ হয়েছে, শেষ বয়সে তাদের কোনো মূল্য থাকে না সন্তানের কাছে। কিন্তু বাবা-মা যে অবস্থায়ই থাকেন না কেন, যেমন ধনী-গরিব, মধ্যবিত্ত যে কোন ধরনের সম্পদ বা অর্থ থাকে; সেই বাবা-মা চেষ্টা করেন তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় বড় করে তোলার। বাবা-মার ফেলে আসা অতীতের কথা এবং ভবিষ্যতে কী অবস্থা হবে সে কথা চিন্তা না করে আদরের ছেলে-মেয়েকে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে বড় করেন। বাবা-মায়ের কাছে সন্তান যেন অন্যরকম। এক সময় সন্তানদের বিয়ে হয়, সংসার শুরু হয়ে যায়। তখন বাবা-মায়ের সংসার সমাপ্ত হয়ে যায়। বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে যান কিন্তু বেশিরভাগ বাবা-মায়ের সেই ভবিষ্যত্ স্বপ্ন থাকে না। কারণ সন্তানের কাছে তখন সংসার অনেক দামি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তখন বৃদ্ধ বাবা-মাকে গুরুত্ব দেয়া বা আদর-যত্ন করে দেখার সময় থাকে না। অন্য কোথাও রাখার পরিকল্পনা আসে যেমন বৃদ্ধ আশ্রম বা দূরে কোথাও একজন অপরিচিত মানুষের কাছে রেখে আসে।

সন্তানের সংসারে তাদের থাকার জায়গা থাকে না। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ যদি তাই হয় তাহলে, একজন মা কখনো অমর্যাদা পেতেন না। মা হচ্ছেন একজন মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে মায়ের সম্মান-মর্যাদা প্রথমে। যেমন—এক ব্যক্তি হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—হে নবীজী! আমি কোন ব্যক্তির সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করব। নবীজী উত্তরে বললেন, তোমার মা। সে ব্যক্তি আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোন ব্যক্তির সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করব। নবীজী আবারও উত্তরে বললেন তোমার মা। সেই ব্যক্তি আবারও শেষবার জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোন ব্যক্তির সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করব। নবীজী চতুর্থবার উত্তরে বললেন তোমার বাবা।

আমাদের নবীজী হজরত মোহাম্মদ (সা.) কত বড় সম্মান দিয়ে গেছেন বাবা-মাকে আর আল্লাহ দেবেন সে সম্মানের জন্য জান্নাত। সন্তানের জন্য আর কী হতে পারে এর থেকে বড় কিছু। মা সন্তানকে কখনও আলাদা চোখে দেখেন না। তাই তো মা সন্তানের জন্য তিন ধরনের ঘর তৈরি করে দেন।

১-সন্তানের জন্য মা প্রথম ঘর তৈরি করেন তার নিজ গর্ভে। মা এই ঘরের ভেতর একটু একটু করে সন্তানকে বড় করেন। মায়ের গর্ভের মতো নিরাপদ ঘর কোনো সন্তান অন্য কোথাও পাবে না।

২-সন্তানদের জন্য মায়ের দ্বিতীয় ঘর—সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলে তখন মা-বাবার দায়িত্ব বাড়ে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে এক সময় বিয়ে দিয়ে একটি ঘর-সংসার তৈরি করে দেন।

৩-মায়ের তৃতীয় ঘর—সর্বশ্রেষ্ঠ ঘরের জায়গা যা কল্পনা করা যায় না। তা হচ্ছে জান্নাত। মাকে সত্যি করে একটু সেবা, যত্ন, উত্তম ব্যবহার করলে সন্তান পায় আল্লাহর তরফ থেকে জান্নাত।

মায়ের কাছ থেকে সন্তান কত সুন্দর ঘর ও জায়গা পায় আর মায়ের কত দোয়া আশীর্বাদ থাকে সন্তানের জন্য তা সন্তান বোঝে না। পৃথিবীর আরাম ঐশ্বর্যের কারণে সন্তান ভুলে যায় আসল ঠিকানার কথা, বৃদ্ধ বয়সে মাকে একটু ভালোবাসার কথা। মা-বাবার বাড়িতে সন্তান একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। তাহলে বাবা-মা কেন সন্তানের বাড়িতে বৃদ্ধ বয়সে থাকার জায়গা পাবে না—এটা বড় কষ্টের কথা, বড় দুঃখের কথা। ভাবতে অনেক খারাপ লাগে। বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার এমন কী চাহিদা থাকে যা সন্তানের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না। সামান্য চাহিদা থাকে বৃদ্ধ বয়সে একটু আশ্রয় এবং বেঁচে থাকার জন্য সামান্য অন্ন। এই আশ্রয় থেকে কত মা-বাবা বঞ্চিত হচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সব শ্রেণীর ভেতর দেখা যায় যে, বৃদ্ধ বয়সে কত বাবা-মার একটু থাকার আশ্রয় ও সামান্য আহার মেলাতে কত কষ্ট হয়।

আমি একজন মায়ের কথা বলছি। এটা বাস্তব ঘটনা। এক মা ছিলেন অতি ভালো ও সমাজসেবী। তার নিজ সন্তানকে ভালো করে বড় বরেন এবং এই মা সমাজের ঘরে ঘরে সন্তান প্রসবের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কোনো প্রসব কাজের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। নিজের টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেতেন। নিজের সন্তানের সংসার হলো আর মা বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু মায়ের কোনো ঠাঁই হলো না সন্তানের সংসারে। মা তিনটি ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে রান্না করে খেয়ে শেষ জীবন পাড়ি দেন। এটা বড় কষ্টের কথা, বড় কঠিন জীবন।

এখনও বিভিন্ন জায়গায় খুব কঠিন জীবন-যাপন করতে দেখা যায় বাবা-মাকে। তাই আজ যারা ছেলে-মেয়ে, আগামীতে তারাও বাবা-মায়ের মতো বৃদ্ধ হবেন। কিন্তু মাঝখানে একটা ফাঁক থেকে যাবে যা কোনোভাবে সন্তান বৃদ্ধ বয়সে আর পূরণ করতে পারবে না। কারণ বাবা-মায়ের সেবা আর ভালোবাসার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আছে সন্তানের জন্য জান্নাত, এই জান্নাত চিরস্থায়ী একটা জায়গায়। এই চিরস্থায়ী জায়গা থেকে কোনো সন্তান বঞ্চিত হবে না। ইসলাম ধর্মে একটা কথা আছে— কাবিরা গুনাহ যেমান-পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে অন্য সব গোনাহ মাফ করেন। এই অপরাধের জন্য তিনি পৃথিবীতেই এর শাস্তি দিয়ে থাকেন।

তাই প্রতিটি সন্তারনর জন্য কিছু কথা—

* মা সন্তানকে কত সুন্দর সুন্দর ঘর উপহার দেন আর সন্তান কী পারবে না তার নিজ বাড়িতে একটি ঘরে মাকে থাকতে দিতে।

১-আপনার নিজ বাড়িতে বাব মাকে রাখুন এবং সবাই মিলে একই খাবার খান ও সাথে উত্তম ব্যাহার করুন।

২-ব্যস্ততার মাঝেও বাবা মায়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলুন।

৩-কখনও বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলা উচিত নয়, এতে বাবা মায়ের কষ্ট হতে পারে।

৪-বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের চিন্তা-ভাবনা কম থাকে, ভুল করতেই পারেন। তাই বলে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। নিজে একটু ভাববেন কারণ বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট হয় শারীরিকভাবে সবারই। তাই বাবা-মা রাগ করে কথা বলতে পারেন। এটা চিন্তা করতে হবে সুস্থ মানুষকে এ কারণে যে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে ভালো ব্যবহার করাটা উত্তম, ভালো ব্যবহার করাটা ইবাদত।

পৃথিবীতে প্রত্যেক সন্তান তার নিজ বাড়িতে একটি ঘরে বাবা-মাকে থাকতে দিন, তাতে সন্তানের ভবিষ্যত্ জীবন উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলজ্বল করবে।

দু’জন সন্তান পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার মর্যাদা দিয়েছেন তা গোটা দুনিয়ার মানুষের জানা এবং ইতিহাসের বুকে মায়ের প্রতি ভালোবাসার চিহ্ন। এই চিহ্ন কেউ কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না। সাধারণ ঘরে জন্ম। আরাম-ঐশ্বর্যের ভেতর না থেকে কঠিন জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে মায়ের কথা ও মর্যাদা কখনও তারা ক্ষুণ্ন করেননি। এই কৃতী সন্তান দু’জন হচ্ছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর আর বায়েজিদ বোস্তামী। মায়ের অসুখের চিঠি পেয়ে দামোদর নদী পাড়ি দিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার অপেক্ষা না করে কাজকর্ম ফেলে ছুটে গেলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর গভীর রাতে মা তার ছেলে বায়েজিদ বোস্তামীর কাছে পানি খেতে চাইলেন এবং ঘরে কলসিতে পানি না পেয়ে বাইরে গেলেন। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পানি আনতে গেলেন, এসে দেখলেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মায়ের ঘুম ভেঙে গেলে মায়ের কষ্ট হবে ভেবে ছোট ছেলে বায়েজিদ বোস্তামী সারা রাত মায়ের মাথার কাছে পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন—কখন মায়ের ঘুম ভাঙবে, তখন ছেলে মাকে পানি খেতে দেবেন। এই সারা রাত পানি হাতে ছেলেকে দেখে মায়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরে, মা বুকের ভেতর ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন এবং অনেক দোয়া করেন। ভালোবাসা হতে হবে সত্যিকারের কৃতী সন্তানদের মতো।

এখন বৃদ্ধ আশ্রমে অনেক মাকে থাকতে দেখা যায় এবং বুকফাটা কান্না এসব মা-বাবার চোখে। অশ্রু ঝাপসা চোখে মা-বাবা বলতে থাকেন—দিন, সপ্তাহ কখনও বা মাস চলে যায় ছেলে-মেয়েরা দেখতে আসে না কেমন আছি। সেবাযত্ন তো দূরের কথা। বৃদ্ধ হয়ে যাওয়াটা কী অপরাধ? এটা তো আল্লাহর নিয়ম, সবাইকে তো বৃদ্ধ হতেই হবে। এই নিয়মটা তো কারও সাধ্য নেই পরিবর্তন করার।

প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের উচিত তার বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করা।

কথায় বলে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। কিন্তু তা হতে হবে মাকে ছেলে-মেয়েরা কাছে রেখে একটু সেবাযত্ন করলে। মহান আল্লাহই সেসব ছেলে-মেয়েকে দেবেন জান্নাত।

সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য যেমন পৃথিবীতে মা দিবস আছে, তেমনি পরকালে আল্লাহর তরফ থেকে জান্নাত আছে। তাই তো মায়ের ভালোবাসায় জান্নাত পাওয়া যায়।

বিষয়: বিবিধ

১০৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File