চোর কয় কারে,দেখবি চোর বাত্তি নিবাইলে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:১৮:৪৩ রাত

আমাদের ছোট বেলায় একজন চোরের কথা শুনতাম যার নাম ছিল "হিম্মুত্তা চোর"।দু/একবার দেখেছিলাম।বয়স চল্লিশের কোঠায়।চিমচাম ও স্বভাবে খুব নম্র ভদ্র।কাউকে ভয় পেত না যদিও সবাই জানতো সে চুরি করে।তার প্রয়োজনের কোন জিনিস কার কাছে আছে সে জানতো ও দরকার হলে চাইতে আসতো।যদি কেউ না দিতে চাইতো তখন বলতো বুঝছি হিম্মুত্তারে রাইতে কষ্ট দিবি।রাইতে বাত্তিটা নিবলে আর জিনিসের অভাব অইবোনা।ঠিক ঠিক বলে কয়ে সে চুরি করতো কারো ক্ষমতা ছিল না তাকে ধরার।অনেকে তার চুরির কৌশল নিয়ে কথা বলতো কিন্তু তাকে ধরা বা শাস্তি দেয়ার চিন্তাও করতে পারতোনা।কারন গ্রামের যে বাড়িতে তার অবস্হান সে বাড়িতে অনেকেই চোর আর সে চোরের সর্দার।তার একটা ধর্ম ছিল সে বড় লোকের বাড়িতে চুরি করতো।আবার গরীবদের মাঝে যারা অসুবিধায় আছে তাদের দান খয়রাত করতো।অন্যদের বলতো এই শোন! যাদের টাকা কড়ি আছে ঐ সব বড় লোকদের বাড়িতে চুরি করবি।স্বাধীনতার সূচনা লগ্নে ঐ গ্রাম ও সাথে কয়েকটি গ্রাম একত্রিত হয়ে গ্রামের চারদিকে বেরিকেড দিয়ে চোরদের বাড়িতে মহিলা ও শিশু বাদ দিয়ে প্রায় সবাইকে হত্মা করেছিল।

আজ অনেক পরে মনে পড়লো আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা।সবে মাত্র ঢাকায় এলাম।নব্য বড় লোকদের বাড়ি ঘর দেখে আমার বন্ধু এরফান আক্ষেপ করে বলতো আমার বাবা যে যুগে ষ্টান্ড করেছিল যদি সে মাষ্টারি না করে সরকারি চাকুরি করতো আমাকে টিউশিনি করতে হতোনা।ভাগ্যিস এখন সে সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল ও অনেকগুলো বাড়ির মালিক।এদেশের মেধাবি অনেক ছাত্র আজো ঢাকার বড় এলাকাগুলোতে যারা বড় লোক খ্যাত তাদের বাড়িতে টিউশন পড়ায় বা লজিং থাকে।আবার এদের অনেকেই বড় লোক হয়।দারিদ্রের কষাঘাতে যাদের জীবনের একটি বিরাট অংশ কেটেছে তাদের এমন অনেককেই এখন দেখছি কোটি কোটি টাকার মালিক।আলিসান বাড়ি বানিয়ে সুসজ্জিত গেট,দারোয়ান,দেখার মত বাগান,মডার্ন ডিজাইনে সুসজ্জিত ফার্নিসার ইত্যাদি।এ সব বাড়িতে গরীব মধ্যবিত্ত আত্মীয় স্বাজন ঢুকতে পারে না।সরকারি আমলা,মন্ত্রী,ব্যাবসায়ি এদের মধ্যে অন্যতম।একজন আমলা কত টাকা বেতন পান? একজন মন্ত্রীই বা কত পান? আর সৎ ব্যাবসায়ি হলে কোটি কোটি টাকা অল্প সময়ে কিভাবে কামিয়ে ফেলেন?চোখের সামনে ৬/৭ বছরের ব্যাবধানে কোটি টাকা কামানো বা বিদেশে বাড়ি খরিদ করা দেখে মনে হয় এরা হলো নব্য ডাকাত।হিম্মুত্তা চোর চুরি করতো পেটের দায়ে আর তাও রাতে সিঁধ কাটতো মানুষের ঘরে কিন্তু এরা দিনে দুপুরে অফিসে বসে মানুষের দৃষ্টির সামনে কোটি কোটি টাকা কামায়।আবার বড় বড় বক্তৃতা দেয় মাঠে ঘাটে।সেদিন এক শিক্ষক বললেন অমুক আমার ছাত্র।মাত্র ৮ বছরের মাথায় এখন সে জমিদার।এক সময় সমীহ করে চলতো।এখন আমাদের সমীহ করে চলা লাগে কারন সে এখন বিরাট বড়লোক।গ্রামের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় তার গাড়ির চাকার কাদা আমার কাপড় ভরিয়ে দিয়ে গেলেও বলতে পারলাম না কিছু।আমরা এখন বোবা কান্না নিয়ে বেঁচে আছি।এদের ভয়ে শুধু মানুষই না তাদের চারপাশের মানুষও তটস্হ থাকে এমনকি নিজের স্ত্রী সন্তানও।

পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ২২টি ধনাঢ্য পরিবার ছিল। ২২ পরিবারের কাউকেই কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ তাদের গল্প শুনত, কিন্তু তাদের জৌলুস চোখে দেখার সুযোগ পেত না। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ২২ পরিবার নয়, হয়তোবা ২২ লাখ পরিবার বড়লোক হয়েছে। তারা কেমন বড়লোক,না দেখলে ঠিক আঁচ করা যায় না। হবে হয়তো অনেক বড়লোক। ঠিক এমন কিছু বড়লোককে এখন আমি অনেক কাছ থেকে চিনি ও জানি। সামাজিক কারনে ওঠা-বসাও করতে হয় তাদের কারও কারও সঙ্গে। এরা কিভাবে বড় লোক হয়েছে তাতো দেখেছি।কেউ কন্ট্রাক্টর এক মালের কন্ট্রাক্ট করেছে দিয়েছে অন্য মাল।কেউ অফিস কর্মকর্তা পার্সেজিংএ নয়চয় করেছে।কেউ চাকুরি দিয়ে টাকা দিয়ে টাকা কামাই করেছে।কেউ ফাইল আটকিয়ে কামিয়েছে।কেউ চোরা চালানের সাথে যুক্ত থেকে কামাই করেছে।আবার কেউ হাউজিং এর নামে পরের জমি বিক্রয় করছে। এভাবে প্রায় সব অফিসে কর্মকর্তা ও অধস্তনরা বাড়িওয়ালা ও ব্যবসায়ি বনে গেছে।রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি দারোয়ানকে জিজ্গেস করি এটা কার বাড়ি।দারোয়ান উত্তর দেয় এটা পেশকার সাহেবের ,বা সচিবালয়ের কোন পিয়নের ,বা পুলিশের বা কাষ্টমের কোন অধ:স্তনের বাড়ি।যদি অধস্তনদের এ রকম বাড়ি থাকে তাহলে উর্ধতনদের অবস্হা কি? তাতো আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি।আর এখন দেশে বিদেশে অনেকের বাড়ি রয়েছে যারা সেকেন্ড বা থার্ড ক্লাসে চাকুরি করতো এমন লোকদের।তারা অনেকে দেশে সম্পদ করতে ভীত বলে এসব টাকা হুন্ডি করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছে।

বড়লোক নামের বিষয়টি একেকজন একেক দৃষ্টিতে দেখে। বড়লোক বিষয়টি আসলে বড় বেশি আপেক্ষিক। চীনের কিংবা হংকংয়ের একজন পানের দোকানদার বাংলাদেশের একজন বড় কোম্পানির মালিকের চেয়েও বড়লোক। কত টাকা থাকলে বড়লোক হওয়া যায়? কেউ জানে না। একজন অসৎ সহকারী পেশকার বড়লোক, পুলিশের মাঠপর্যায়ের একজন অসৎ কর্মকর্তাও বড়লোক। কত টাকা থাকতে হয় একটি বড়লোকের পরিবারে? কত বড় বাড়ি হলে লোকে তাকে বড়লোক বলবে?

একজন কলেজের শিক্ষক তার দুই কন্যাসন্তান নিয়ে মফস্বলের কলেজপাড়ায় থাকেন। দু’বেলা-তিনবেলা কোনো বেলায়ই তার ভাতের অভাব নেই। আর ওই যে সাবেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ, যাদের অনেক বড় বাড়ি, অনেকগুলো গাড়ি, বাসায় কাজের লোক অনেক- এদের মধ্যে কে বেশি বড়লোক? আমি যেভাবে দেখি, আপনি যেভাবে দেখেন- সেভাবেই নির্মিত হবে তাদের বড়লোকির মানদণ্ড।

সৎ পথের রাস্তা ভুলে যাওয়া বড়লোক মানুষগুলো যে টাকার বস্তা নিয়ে ধরা পড়ে যায়, আর খেটে খাওয়া শ্রমিকটির পড়ুয়া ছেলেটি যে কাগজের খাতাগুলো খাটের ওপরে রাখে, এদের মধ্যে কোনটার মূল্য বেশি? ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ যদি প্রশ্নের উত্তর বের করতে না পারে, তবে আমি আবার পেছনে ফিরে এসে উত্তরটি জেনে আসবো সেই 'হিম্মুত্তা চোরের' কাছে যদি বেঁচে থাকে।এখন আর চুরির জন্য বাত্তি নিভানোর দরকার নাই দিনের আলোকে আপনি হা্তেই দিতে পারছেন একটি খাম যা ঘুষ নয় নব্য উপটৌকন।

বিষয়: বিবিধ

১২১১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

291821
০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:২৫
নোমান২৯ লিখেছেন : দ-খ-ল |হা হা হা |পড়ে পড়বো|ধন্যবাদ|
291905
০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১২:৫৯
যা বলতে চাই লিখেছেন : ভাইজান, আপনার লেখাগুলো পড়ে আবেগ ধরে রাখা কঠিন। আপনার ছাত্র জীবনের কোন কোন বন্ধু এখন তথাকথিত বড়লোক। আবার একথাও ঠিক, সুযোগ পাওয়া সত্বেও সবাই সেরকম হয়নি। আমরা না হয় বড়লোকির সুযোগ পেয়েও না নেয়ার কারণে একটু অর্থ কষ্টে আছি। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখুন বহু আগেই নিদ্রা তাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। ভাল খাবার তাদের জন্য ডাক্তারের নিষেধ। যাদের জন্য এতকিছু করল, সে স্ত্রী-সন্তান তাদেরকে এখন আর পছন্দ করে না ইত্যদি নানারূপ হতাশা আর দুশ্চিন্তায় তারা আজ দিশেহারা। অপরদিকে আপনার স্ত্রী-সন্তান আপনাকে নিয়ে গর্ব করে আমার বিশ্বাস। এখানেই পরম সুখ আর আত্ম প্রশান্তি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুণ। আমিন। Good Luck
291915
০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০২:৪৭
নাছির আলী লিখেছেন : যা বলতে চাই ভাইয়ের সাথে সহমত।
292035
০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৫২
মহিউডীন লিখেছেন : আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভাল রাখুন।সৎ পথে চলার তাওফিক দিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File