কেমন আছেন দেশ বিদেশের কর্মজীবি দম্পতিরা?

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২৪ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৩১:১৫ রাত

আশির'র দশকের প্রথমে আমরা ক'জন নৌযোয়ান চরে বেড়াতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ,ইন্জিনিয়ারিং,ঢাকা মেডিকেল,নিউমার্কেট,নীলক্ষেত,আজিমপুর, ইলিফেন্ট রোড,সায়েন্স লেবোরেটরি,ধানমন্ডি,পুরনো ঢাকা,শাহজাহনপুর,খিলগাঁও ইত্যাদি এলাকা।তখন জীবন ছিল উচ্ছল।একা- যেখানে রাত সেখানে কাত।কয়েক বছর পর শুরু হলো এক এক করে দম্পত্য জীবনে যেতে।আমার মনে পড়ে আমরা যখন নীলক্ষেত কর্মজীবি হোষ্টেলের সামনের রাস্তা অতিক্রম করতাম তখন আমাদের সিনিয়র কর্মজীবি বোনদের অনেককেই রাস্তার পাশে আড্ডা দিতে দেখতাম।আমাদের পরিচিত এক সিনিয়র বোন থাকতো সেখানে।অনেক সময় আমাদের সাথে দেখা হতো।তার সাথে আলাপে জানতে পারতাম অনেকের করুন কাহিনী।তাদের বেশির ভাগই বাইরের যাদের ঢাকায় বাড়ি নেই বা থাকার সুব্যাবস্হা নেই।অনেকে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ দু'জন দুদিকে থাকেন।সপ্তাহের শেষে মিলিত হতেন ঢাকার কাছে হোলে নিজের বাড়িতে আবার কেউ আত্মীয় স্বজনের বাসায়।আবার অনেক দম্পতি একজন ঢাকায় অন্যজন ঢাকার বাইরে।কখনো স্ত্রী স্বামীর কাছে বা স্বামি স্ত্রীর কাছে মাসে বা ১৫দিনে চলে আসতেন।আবার অনেকের দীর্ঘ বয়স হয়েছে ভাল পাত্র মিলে নি বলে অপেক্ষারত আছেন।আবার অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে এমন।আবার অনেকের স্বামী বিদেশ থাকেন তিনি চাকুরি করেন ও হেষ্টেলে থাকেন।দম্পতিদের মধ্যে অনেকের এমন মিল দেখেছি দূরে থাকলেও তাদের বন্ধন ছিল ইস্পাত কঠিন।আজকের মত ফোনের ব্যাবস্হা ছিল না।চিঠির আদান প্রদান হতো।কেউ কেউ অন্য বন্ধু বা বান্ধবীদের পড়েও শুনাত।যেহেতু ধার্মিকতার ব্যাপার ছিল না সেহেতু অনেক গোপন কথা বলেও হাসাহাসি ও কৌতুক করতো।সপ্তাহের শেষে আমরা যেতাম গল্প শুনতে।গত ছুটিতে গিয়ে নীলক্ষেতে গেলাম ডক্টর ইউনুছের সামাজিক ব্যাবসায়ের উপর একটি বই " Creating Social Business" ক্রয় করার জন্য।আমার ছেলে(মাহের) বিবিএ করছে ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে ও থার্ড সেমিষ্টার অতিক্রম করছে।তার এই বইটার দরকার ছিল বলে ওদিকে মোড় নিতে হলো। অনেক লাইব্রেরি খুঁজে পেলাম না শেষে একজন বললেন একটু অপেক্ষা করুন আমি দেখে আসি।৪০ মিনিট পর তিনি একটি কপি নিয়ে আসলেন।তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ৪৮০ টাকা পরিশোধ করে বের হয়ে আসতেই মনে পড়লো সেই কর্মজীবি হোষ্টেলের কথা।এদিন আমার কোন বন্ধু ছিলনা।ছিল আমার প্রানপ্রিয় ছেলে হলেও বন্ধু অনেক ক্ষেত্রেই।ওদিকে যেতে সে বললো আব্বু ওদিকে যাচ্ছ কেন? আমি বললাম চল আমরা একটু হেঁটে রিক্ক্সায় উঠবো।কর্মজীবি হোষ্টেলের রাস্তায় হেটে হেটে ইলিফেন্ট রোডের দিকে গেলাম আর চমৎকার অতীতকে মনে করে নিলাম।এক মাস ছুটিতে একটি ঘটনা আমাকে কর্মজীবি দম্পতিদের ব্যাপারে লিখায় আগ্রহী করে তুললো।এর পর প্রায় ৩৫টি সাধারন ও কর্মজীবি দম্পতি পরিবারের খোঁজ খবর নিতে থাকলাম।সব মিলিয়ে দেশে বিদেশে ৫৭টি পরিবারের খবর নিয়ে আঁৎকে উঠলাম।অনেক পরিবারে সমস্যা রয়েছে কম বেশি।আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজে বাস করছি।একে অন্যকে জানা খুবই সহজ।কোন সমস্যার সমাধান করাও অনেকটা সহজতর।কর্মজীবি দম্পতিরাই এর বেশি শিকার হন তার কারন হলো বিয়ের পূর্বে বুঝাপড়া না হওয়ার কারনে।আবার অনেকে বুঝা পড়া হলেও বিয়ের পর মেনে নিতে চান না।বিশেষ করে মুসলিম সমাজে এ অবস্হাটি প্রকট আকার ধারন করে।পরিণত বয়সে প্রত্যেকটি পরিবার সন্তান প্রত্যাশা করে প্রাকৃতিক নিয়মে। সেই সন্তান আসে এবং সঙ্গতি অনুযায়ী বেড়েও উঠে। কিন্তু এর পেছনে নারীর অনেক গল্প থাকে, বিশেষ করে কর্মজীবী নারীর। গল্প শুরু হয় কনসিভ করার পর থেকে। খুব কম কর্মস্থলই আছে যারা ম্যাটারনিটি লিভের সময়টুকু ছাড়া সহজে সহযোগিতা করে। কিন্তু সরকারি অফিসে ৬ মাস এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪ মাসের ম্যাটারনিটি লিভ ছাড়াও দীর্ঘ প্রায় একবছরে তার নানা সময়ের অসুস্থতা, চেকআপ ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এ সময়ে অনাগত সন্তানের সুখ স্বপ্নের সঙ্গে মিলে মিশে যায় বর্তমানের চাকরির নিরাপত্তার দুঃশ্চিন্তা। সম্প্রতি বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ শোনা যায় তাদের কর্মজীবী মেয়ে বা বউটি ‘মা’ হতে আগ্রহী নয়। বয়োজ্যেষ্ঠরা এক বাক্যে বলে দেন, বেশি শিক্ষার কুফল। মা হওয়ার কষ্ট করতে রাজি না মেয়ে। আসলেই কি তাই?

সন্তানকে ভালোবাসা মানে শুধু তাকে কোলে বসিয়ে আদর করা বা গালভরা নামে ডাকা নয়। তার ভিত মজবুত করে দেওয়ার মত যথেষ্ট সামর্থ্য ও ইচ্ছেটুকু থাকা চাই। তারও আগে প্রয়োজন যারা বাবা-মা হতে চাইছেন তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়াটা না থাকলে সন্তান কখনও সুস্থ পরিবেশ পায় না। এক ছাদের নিচে বাবা-মা থাকছেন- এটুকুই সন্তানের জন্য যথেষ্ট নয়। লুকানো গল্প থাকে। চারপাশের মানুষ তাকে একতরফা বলে যায় ক্যারিয়ারিস্ট, মা হবার কষ্ট নিতে রাজি নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় সেইসব নারীরা এতদিনের সবচেয়ে কাছের মানুষের দৃষ্টিতে নিজেকে আবিষ্কার করে, সে একজন স্বার্থপর ও আত্মপ্রেমে মগ্ন মানুষ। শুধু তাই না, বোঝাপড়া ও অপ্রাপ্তির গল্পটা তার একারই থেকে যায়।

তবে এই মাতৃত্বের স্বপ্ন দেখা ও তা নিয়ে সংশয়ে পুরুষবিদ্বেষী হবার অবকাশ নেই। বিষয়টি নারী বা পুরুষের দাম্পত্য বিষয়ই নয় শুধু। সমাধানের জন্য পরিবারের সব সদস্যের সহযোগী মনোভাব প্রয়োজন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে। কর্মজীবী নারীটিকে সন্তান ঠিক তখনই নিতে হয় যখন তার ক্যারিয়্যার তৈরি করার সময়। এই স্যাক্রিফাইস কিন্তু পুরুষকে করতে হয় না। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত এমন একটি ঘটনাও শোনা যায়নি যে সন্তানকে বড় করার জন্য বাবাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু মা’র ক্ষেত্রে এটা খুব সাধারণ ঘটনা। রাষ্ট্র ভালো ডে কেয়ার তৈরি করতে পারে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা সম্ভব হলে শুধু জ্ঞান না দিয়ে বা বসতভিটে আঁকড়ে ধরে না থেকে থাকতে পারেন তাদের কাছে এসে। আর যিনি বাবা হতে চাইছেন তিনি যেন তার অনাগত সন্তানের মাকে নারী হিসেবে দেখার আগে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে শেখেন। অপ্রাপ্তি আর সঙ্কটের গল্পগুলো তখন আর নারীর একার থাকবে না। কাছের মানুষেরা পাশে এসে হাত ধরে দাঁড়ালে নারী সব পারে, কাঁধের ওপর শিশুকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাতে শোনাতে আরেক হাতে ভাত ফুটেছে কিনা দেখতে পারে। বাচ্চার স্কুলের খাতার বানান দেখতে দেখতে অফিসের প্রজেক্ট পেপারসও তৈরি করতে জানে। নারীই পারে এমন করতে, শুধু একটা আশ্বস্ততার স্পর্শ মানুষ হিসেবেই তার প্রয়োজন হয় নারী হিসেবে নয়।কয়েকটি সামাজিক কেস ষ্টাডি থেকে আমরা জানতে পারবো দম্পতিদের কার কততুকু ক্রুটি আসুন জেনে নেই:-

কেস নং ১:-

বেশ কিছুদিন আগে একজন লেবানিজ একটি কম্পানির আইটি ইন্জিনিয়ার তবে এসিস্টান্ট হিসেবে কাজ করে।বিয়ে করেছে তিন বছর হলো এবং একটি ছেলে সন্তান ও জন্ম নিয়েছে।দু'জনই চাকুরিজীবি।স্ত্রী একটি ক্লিনিকের জুনিয়র ডাক্তার।ছেলেটি ক্লিনিকের কেয়ারে থাকতো। সংসার ভালই চলছিল সন্তান আসার আগ পর্যন্ত।বাসায় রান্না না হলে বাইরে দু'জনে খেয়ে নিত।স্বামিটি ছিল ভাল।রাতে বাসায় গিয়ে ঘর পরিস্কার করা,খাবার রান্না সহ সবই করতো তবে স্ত্রীর চাকুরিতে নাখোশ ছিল।স্ত্রীর কথা হলো আমার প্রফেশনটা আমি জিয়ে রাখি ঘরে বসে না থেকে।স্বামীর কথা হলো অনেক দিন চাকুরি করেছ,তুমি এখন মা হতে যাচ্ছ আর তাছাড়া বাসায় আসলে দুজনেই যদি ক্লান্ত থাকি তাহলে সংসার ও ছেলেকে কে দেখবে? দু'জনেরই যুক্তি আছে কথায়।স্ত্রী নাছোড়বান্দী।এর মধ্যেই বাৎসরিক ছুটির সময় এলো এবং স্বামিটি ভাবলো দেশে ঘুরে এলে পরিবর্তন হয়ে যাবে।কিন্তু তা হলো না।স্ত্রীটির বাড়ির অবস্হা স্বামীর চেয়ে ভাল।শ্বশুর বাড়িতে কথা উঠলো ব্যাপারটি নিয়ে।স্ত্রী বেঁকে বসলো আমি আর সৌদিতে যাব না।কিছু কথা কাটাকাটি হলো। বিপাকে পড়লো স্বামিটি।ছুটি শেষ হতেই স্বামিটি চলে আসলো। স্ত্রী রয়ে গেল এবং কিছুদিন পর টেলিফোন করলো বাসার সব দায় দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে তবেই আমি আসবো আর না হয় আমাদের জীবন পৃথক হয়ে যাবে।স্বামিটি চেষ্টা করেছিল অনেকদিন।ততদিনে ছেলেটি প্রায় আড়াই বছরে পা দিল।শুনেছি ছেলের খরচ চালায় আর স্বামিটি আর একটি জীবনের খোঁজ করছে।এ ঘটনায় আমরা কি দেখতে পাই? সামান্য একটু সমঝোতার জন্য দুটি জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।দাম্পত্য জীবন গড়ে উঠার উদ্দেশ্য হলো সারাটি জীবন দু'জন দু'জনার মধ্যে ডুবে থাকবে।একে অন্যের সুযোগ সুবিধা দেখবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।যদি এর মধ্যে এক বিন্দুও স্বার্থপরতা থাকে তাহলে সেই দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরতে বাধ্য।

কেস নং ২:-

এক ভদ্রলোক একটি মিড লেভেল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা। দেখতে সুশিক্ষিত ভদ্রলোক ও কাজে কর্মে ছটপট। স্ত্রী গৃহকত্র্রী ও দু'সন্তানের জননী।ভালবেসে বিয়ে ও সংসার।ছেলে মেয়েকে প্রথম শ্রেনীর স্কুলে পড়ানোর আগ্রহ স্ত্রীর এবং করছেও তাই।ছেলে মেয়ের পিছনে সময় দিতে গিয়ে হয়ত দাম্পত্য জীবনে কিছুটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে এবং হতেই পারে।আজকাল মা;রা যেমন করে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে ক্যাম্পাসে ৪/৫ ঘন্টা বসে থাকেন আমাদের সময় এমন ছিলনা।এর জন্য সামাজিক সমস্যাগুলো অনেকাংশেই দায়ী।আবার এমন মা আছেন যারা স্বামীর সাথে কনসাল্ট করাও পছন্দ করেন না কারন হলো পাশের বাসার ভাবির বাচ্চা ভাল স্কুলে পড়ে আমারটা পড়বে না কেন? এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তার আছর পড়ে দাম্পত্য জীবনে।সে দাম্পত্য জীবনে তৈরি হলো এক বিভষিকাময় অধ্যায়।স্বামিটি খরচ বন্ধ করে দিল এমনকি বাসার স্বাভাবিক খরচও।স্ত্রীটির বাবার অবস্হা ভাল এবং তারাই এখন সাপোর্ট দিচ্ছে তাদের মেয়েটিকে।ইতিমধ্যে অনেকের কাছে জানাজানি হয়ে গেছে বিষয়টি কিন্তু স্বামিটির এতে কিছুই যায় আসে না।সংসার চলছে কিন্তু দাম্পত্য জীবনের কোন আনন্দ নেই।এর মধ্যে মাঝে মাঝেই চলে খুনসুটি কারনে অকারনে।একবার এমন তুংগে উঠেছিল যে বিচ্ছেদের মাত্রায় চলে যাওয়ার উপক্রম।এর মধ্যে দুপক্ষের আত্মীয় স্বজন মিলে ব্যাপারটি কোনভাবে সমাধান হলো বটে তবে ভবিষ্যৎ জানে তা কতদিন চলবে।

কেস নং ৩:-

ক’দিন আগে মালিবাগ রেলগেটের কাছে এক ভদ্রমহিলা অফিস শেষে বাসায় ফিরছেন। দুপুরের রোদে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় রিকশায় বসে আছেন। এক তরুণী কোলে বছরখানেকের এক বাচ্চা নিয়ে রিকশার পাশে এসে হাত পাতলো। ভদ্রমহিলার সেদিকে তাকিয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এই বাচ্চাটিকে তিনি কাজের মেয়ের কাছে রেখে প্রতিদিন অফিস করতে যান। দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে দরজা খুলে তার সন্তানটিকে নিয়ে নিরাপদে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য তালা দিয়ে যেতে পারেন না। ভিখিরি মেয়েটি তারই বাচ্চা নিয়ে তার কাছে এসে হাত পেতেছিল। এরপরের ঘটনা যা হওয়ার তাই। বাসার কাজের মেয়ে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে।এমন ঘটনাতো প্রতিদিনই ঘটছে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে।একজনের আয়ে সংসার চলে না তার চেয়ে বড় কথা শিক্ষিত নারীর কাজের সুযোগ থাকলে কেনই বা সে বসে থাকবে! স্বনির্ভরতা প্রত্যেকের অধিকার এবং প্রয়োজন। কিন্তু যে সন্তানটিকে কাজের মেয়ে ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়া দিতো ভিক্ষে করার জন্য সেই সন্তানের দায় কি নারীর একার? এই প্রশ্নের উত্তর ততদিন মিলবে না যতদিন পরিবারের প্রতিটি মানুষ সমানভাবে তার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবে না।

কেস নং ৪:-

আর একটি ঘটনা যার সন্তানটি তাদের বিচ্ছেদের পর কার কাছে থাকবে এ নিয়ে আইনি জটিলতায় পড়ে কয়েকদিন পুলিশের হেফাজতে ছিল। এই সন্তান কি অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠছে তা অনুমানযোগ্য। নানা কারণে কর্মজীবী নারীদের মধ্যে মা হবার প্রবণতা হয়তো কমছে। কিন্তু পরিণত বয়সে কোন নারী মা হতে চাইবেন না এটা বোধহয় ব্যতিক্রম যা উদাহরণ হিসেবে আনা যায় না। কিন্তু কেন এই সংশয় এতটাই প্রকট হয় যে, এই ইচ্ছেটাকে তারা সরিয়ে রাখতে চান কখনও কখনও? শুধুই স্বনির্ভরতা হারানোর ভয় বলে মনে হয় না, এর চেয়ে অনেক বড় বিষয় কাজ করে সন্তানের পিতা যিনি হবেন সেই মানুষটির সঙ্গে তার বোঝাপড়ার সঙ্কট। নারী কর্মস্থলে পুরুষের সমান পরিশ্রম করে, ঘরে ফিরে রান্নাঘর থেকে বাথরুম পরিষ্কারের কাজটিও তার। সেই নারীর অসুস্থতা নিয়ে যখন তার স্বামী সামান্যতম বিচলিত হন না তখন সন্তান গ্রহণের মতো বড় সিদ্ধান্তে নারী সংশয়ে পড়েন। এ বিষয়টি নিয়ে লেখার পেছনে একটি সত্যি গল্প রয়েছে।একজন তার এক পুরনো বন্ধুর বর্ননা দিয়েছেন এভাবে " এতদিন পর দেখা হয়ে যেমন উৎসাহ ওর দিক থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম তা ছিল না। বন্ধুকে হঠাৎ দেখে মনে হয়েছে, বড় একটা পরিবর্তন হয়েছে। চোখের নিচে কালি আর ওবেসিটির লক্ষণ। স্কুল থেকে ওকে সবসময় কিছু জুয়েলারিতে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। হাতে দুটো আংটি, কানে ছোট্ট টপ পরতো। এখন স্বনির্ভর একটা মেয়ে কিন্তু পুরোপুরি নিরাভরণ। অনেকদিনের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আকস্মিক দেখা হলেও মানুষটা পুরনো বলে হয়তো তাকে সহজে বোঝা যায়। আমি জিজ্ঞেসই করে বসলাম কিছু হয়েছে কিনা। গল্পের এক পর্যায়ে যা বললো তা শিক্ষিত ও স্বনির্ভর এক নারীর জীবনে খুব একটা প্রত্যাশিত না।ও কিছুদিন দেশের বাইরে ছিল। ফিরে আসার পরপরই ওর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত ভালো বেতন পাওয়া স্বামী মনে করিয়ে দিয়েছে, নতুন সংসারে কিছু একটা কেনার জন্য বন্ধুটি কিছু টাকা ধার নিয়েছিল বছরখানেক আগে, সেই টাকা ফেরত দিতে হবে। প্রথমে বন্ধুটি আহত হয়েছে, তারপর যখন বলেছে ঠিক আছে মাত্র জয়েন করলাম স্যালারি পেয়ে নেই। তার স্বামী এরপর জবাব দিয়েছে, তোমার আর্থিক সমস্যা আমার দেখার বিষয় না। শেষ অস্ত্র হিসেবে বন্ধুটি জিজ্ঞেস করেছে, এই মুহূর্তে তাহলে আমাকে গহনা বিক্রি করতে হবে। স্বামী ব্যক্তিটি কাঁধ নাড়িয়ে বলেছেন, সেটা তোমার বিষয় কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব ছোট করছো আমার কাছে। এ কথার পর আর কোন কথা থাকে না একজন আত্মমর্যাদাশীল মানুষের জন্য। বন্ধুটি গহনা বিক্রি করে নিজের স্বামীর ধারের টাকা শোধ করেছে। এরপর একদিন আবিষ্কার করেছে বন্ধুটির স্বামী ভদ্রলোকটি স্ত্রীর কাছে ভাংতি ৫০ টাকা পেলেও সেটা একটি ডায়রিতে লিখে রাখেন। গহনা খুব সামান্য জিনিস, একজন স্বনির্ভর নারীর তা ব্যবহার বা বর্জনে খুব বিশেষ কিছু যায় আসে না। কিন্তু এর জন্য যে ক্ষত মেয়েটির তৈরি হয়েছে তার দামটা নেহায়েত কম নয়। বিষয়টা হালকা করতে জিজ্ঞেস করলাম, গহনার শোকে চোখের নিচে কালি ফেলেছো? তখন ও বললো আরও একটা গল্প। পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষেরা বন্ধুটির সঙ্গে কথা বন্ধ করেছে, এই ভারটা সে সহ্য করতে পারছে না।

কেন কথা বন্ধ করেছে? কারণ, ও এখনই মা হতে অনাগ্রহ জানিয়েছে। বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করলো, যে স্বামী তার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে টাকা জমাতে কুণ্ঠা বোধ করে না, যে স্বামী নিজের স্ত্রীর অসুস্থতায় কখনও কপালে হাত রেখে জ্বর এসেছে কিনা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না, স্ত্রী স্বনির্ভর বলে তার নিরাপত্তা নিয়ে পাশের মানুষ হিসেবেও সামান্যতম বিচলিত নয় যে পুরুষ তার কাছ থেকে কতটুকু উষ্ণতা প্রত্যাশা করা যায়? মা হবার সময়ের বা পরবর্তী অংশে যে সমস্ত জটিলতা তৈরি হবে সেখানে তার সমস্ত সহযোগিতা থাকবে কতটুকু ভাবা যায়? হয়তো নিজের সন্তান বলে তার খরচটা আগ্রহ নিয়েই শেয়ার করবে। কিন্তু তার জন্য কখনো রাত জাগবে? সন্তানের মায়েরও যে পরিচর্যা প্রয়োজন হয় সেটা বুঝবে? হয়তো অফিস থেকে ফিরে বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করবে এবং কিছুক্ষণ তাকে অক্ষরজ্ঞান দান করার চেষ্টা করে সকালে অফিস আছে অজুহাত দিয়ে গরম ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু কর্মজীবী মা? বাচ্চার সারাদিনের খাবার, স্বামীর নাস্তা, বাচ্চার টেমপারেচার চেক করা, পরের দিনের দুপুরের রান্না গুছিয়ে তারপর ঠিক যখনই ক্লান্তিতে বালিশে মাথা রাখবে সেই মুহূর্তে সারাদিন মাকে কাছে না পাওয়ার অভিমানে সন্তান ঘুমের ভেতর ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে উঠবে আর তাই দেখে হু হু করবে নারীর বুকের ভেতর। নির্ঘুম চোখ নিয়ে অফিসে যাবে। কাজে মনোযোগ নেই বলে প্রথমেই শুনবে আপনার ওপর নির্ভর করা যায় না।স্বামীর শার্টের কলারের ময়লাটা চোখ এড়িয়ে গেছে। এ দায় তার, দুপুরের তরকারিতে গন্ধ উঠেছে সে দায় তার, বাচ্চার জ্বর রেখে অফিস করতে হচ্ছে এ জন্য সে অভিযুক্ত। সমস্ত কিছু সামলে অফিসে তার মন নেই অতএব পারফরম্যান্স খারাপ হবার দায়তো অবশ্যই তাকে বহন করতে হবে। অতএব সমস্ত দায় মধ্যবিত্ত কর্মজীবী নারীর। এমনকি পরিবারের অন্য বয়োজেষ্ঠ্য নারী সদস্যরাই হয়তো অভিযোগ করতে অগ্রণী ভূমিকায় থাকবেন। সহযোগিতার পরিবর্তে নানা রকম জ্ঞান দান করবেন। তাদের সময়ে কিভাবে ছেলে-মেয়ে বড় করেছেন সেই সব অভিজ্ঞতার কথা বলে নিজেদের তৃপ্তি গ্রহণ করতে করতে মেয়েটিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন সে পুরোপুরি ব্যর্থ মা। নারী ব্যর্থ মা, ব্যর্থ স্ত্রী ও অফিসেও অযোগ্য হতে হতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে উঠবেন, এক দিনে শত শত বার পরাজিত হবেন নিজের কাছে। আশেপাশের এসব ঘটনা দেখে যে কোনও কর্মজীবী নারী সঙ্কটে পড়ে যেতে পারেন মা হবার স্বপ্ন নিয়ে। সবার ক্ষেত্রে বন্ধুটির স্বামীর মত ঘটনা ঘটবে তা নিশ্চই নয় কিন্তু এমন গল্প অনেকেরই রয়েছে তাওতো সত্যি। একদিকে প্রবল মা হবার বাসনা, অন্যদিকে অসহযোগিতার বাস্তবতা নিয়ে কর্মজীবী নারী নিজের ভেতরের সিঁড়িতে বারবার হোঁচট খান।যে নারী মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণে উদগ্রীব কিন্তু তার পাশের মানুষটির সঙ্গে বোঝাপড়া নেই এতটুকু, সেই নারীই শুধু জানে তার সঙ্কট আর যাপিত জীবনের যন্ত্রণার কথা। সে কখনও তার ব্যক্তিগত গল্পটা পরিবারের মানুষকেও বলতে পারবে না। মানুষ মাত্রই স্ব স্ব অবস্থান থেকে আত্মমর্যাদাশীল। তবে যারা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর তারা পড়েন এক রকম সঙ্কটে। ঘরের নারীরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকেন। বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত বলে এই যন্ত্রণার কথাগুলো তারা চাইলে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে অন্তত সহজে বলতে পারেন। সেখান থেকে তারা সান্ত্বনামূলক দুটো শব্দ অন্তত উপহার পান। কিন্তু যে নারীকে তার কর্মস্থল, বাইরের পরিচিতি নিয়ে ভাবতে হয় তার ভেতর নানা রকম সামাজিক সংস্কার তৈরি হয় বা বলা যায় তাকে অনেক কথাতেই সচেতন থাকতে হয়। শুধু সমাজ নয়, এমনকি নিজের বাবা-মায়ের মতো আপনজনদের কাছেও তার ব্যতিক্রম নয়। কেননা আর্থিক সঙ্গতির কারণে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার থাকে। এর ফলে তার ব্যক্তিত্ব পরিবারের কাছেও ঘরের নারীর চেয়ে অন্যরকম। এই যে ব্যক্তিত্বের আবরণ তৈরি হয় এর ফলে সে অনেক ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ভোগ করে। না পারে কাউকে বোঝাতে না পারে সহজে সঙ্কটের উত্তরণ ঘটিয়ে মা হওয়ার কথা ভাবতে। স্বনির্ভর নারীর মা না হতে চাওয়ার পেছনে এমন আরও অনেক অসহযোগিতা আর লুকানো গল্প থাকে। চারপাশের মানুষ তাকে একতরফা বলে যায় ক্যারিয়ারিস্ট, মা হওয়ার কষ্ট নিতে রাজি নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় সেইসব নারীরা এতদিনের সবচেয়ে কাছের মানুষের দৃষ্টিতে নিজেকে আবিষ্কার করে, সে একজন স্বার্থপর ও আত্মপ্রেমে মগ্ন মানুষ। শুধু বোঝাপড়া ও অপ্রাপ্তির গল্পটা তার একারই থেকে যায়।তবে স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন হোক বা কর্মজীবি হোক দাম্পত্য জীবনটা কারো একার নয় ।এখানে বুঝাপড়া দরকার ও কাজের ক্ষেত্রগুলোতে আন্তরিকতার সাথে শেয়ার করে নিতে পারলে কোন সমস্যা নয়।সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষিক জটিলতা।অধিকাংশ প্রেমঘঠিত দাম্পত্য জীবন গুলো বেশি সমস্যার সম্মুখিন হয়।কারন এরা পরিবার থেকে দূরে চলে আসে ও একাকি হয়ে পড়ে।যখনি কোন পারিবারিক সমস্যা আসে কাছে কাউকে পায় না এবং একে অন্যকে দোষারোপ করে সম্পর্ক খারাপ করে ফেলে।এ অবস্হায় বাবা মাকে তাদের পাশে এগিয়ে আসা জরুরি।সন্তান যত অন্যায়ই করুক দূরে ঠেলে দিলে বিপর্যয়ই আসবে।মন্দকে ভাল দিয়ে মুড়ে দিতে পারলে সমাজে এ সমস্যাগুলো কমে যাবে বলে আমি বিশ্বাসী।

বিষয়: বিবিধ

১৩০৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

287850
২৫ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:২০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক বড় হলেও পড়লাম পোষ্টটি।
সত্যিই এই বিষয়ে এখন অনেক বিপদজনক পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় স্বামি স্ত্রি উভয়কে কাজ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। এর সমাধান কিন্তু বেশি কঠিন নয়। যেটা দরকার উদ্যোগ এবং আপস প্রবনতা।
287894
২৫ নভেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪২
আফরা লিখেছেন : লেখাটা অনেক ভাল জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ও কিন্তু একটু বেশি বড় । বড় লেখা পড়ার পাঠক কম ।তাই দুই পর্বে দিলে বেশী মানুষ পড়ত ও অনেক কিছু জানতে পারত ।

সুন্দর একটা লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File