ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের " Creating Social Business" এর আলোকে শিক্ষাব্যাবস্হা ও বেকারত্ব দূরিকরনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৯ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:০৫:১২ রাত

নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যাবসায়ের উপর একটি চমৎকার ধারনা দিয়ে চলছেন যাকে অনুসরন করে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের অবসান হচ্ছে দেশ বিদেশ ব্যাপি।ইতিমধ্যে তাঁর সম্পর্কে সরকার ও বিরোধী পক্ষ থেকে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। সে আলোচনাগুলো ছিল রাজনৈতিক।কিন্তু আমরা যদি তথ্যভিত্তিক আলোচনায় যাই দেখতে পাব তিনি যে ভিশন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তাতে দশের বেকারত্বের লাঘব হয়েছে।প্রতিটি মানুষের সীমাবদ্ধতা রয়েছে চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে।যারা সমালোচানায় উঠে পড়ে লেগেছেন তারা কি এর চেয়ে ভাল কিছু সৃষ্টি করেছেন?আমি তো সমালোচকদের এমন অনেককে জানি যারা রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর বসে চুরি ডাকাতি করছেন,বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন কিন্তু ক'জন বেকারের সমস্যা সমাধান করেছেন? তাদের অধিকাংশই শোষন করেছেন ও করে চলছেন। যারা ধর্মকে ব্যাবহার করে কথা বলছেন তাদের ভুমিকা কি সমাজে ও রাষ্ট্রে? তারা তার চেয়ে ভাল কোন তত্ত আবিষ্কার করতে পেরেছেন কি? সমাজের মানুষকে দারিদ্রতা থেকে মুক্ত করার জন্য যে যাকাত ব্যাবস্হা সেটাওতো আমরা কার্যকর করতে পারছিনা ব্যাক্তিগত দিক থেকে।ইসলামি সমাজ কায়েমের যে কথা যারা বলেন তারা নিজ নিজ সমাজে কি কার্যক্রম করছেন? মানুষকে তৈরি করার জন্য মানুষের ঈমানি শক্তি বাড়ানো,তাদের অভাব অভিযোগ মিটানোর জন্য সামাজিক কার্যক্রম হাতে নেয়া,দুস্হদের সেবা করা,মানুষকে স্বাবলম্বি করে গড়ে তোলার মত কার্যক্রম না নিয়ে শুধু সমালোচনা বাতুলতা মাত্র।ইসলামের আলোচনার নামে সমাজে এক ধরনের উলামা তাদের কামাই রোজগার করার জন্য যে জলছা তৈরি করে তা দিয়ে প্রকৃত ঈমানদার তৈরি করা যায় না।ইসলামের নামে বিভিন্ন আখড়া তৈরি করে বরং ইসলাম থেকে দূরে সরানো হচ্ছে। একটা জনবহুল দেশে যে সংকট রয়েছে তা নিরসনের জন্য তো আমাদের সবার একে অন্যের সাথে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারনের দরকার,একে অন্যকে শোধরানো দরকার,একজন একটা কিছু ভাল বা মন্দ করলে তার সংস্কার করার জন্য এগিয়ে আসা দরকার।তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।তা না করে আমরা ক্ষতিটিই করি বেশী। আমরা জানি এ পৃথিবীতে সব ভাল করা উচিত।কিন্তু সব সময় ভাল কাজ হবে না।কেউ খারাপ কাজ করবে।এই খারাপ কাজ করা যার যার বিবেকের ফল।পৃথিবীতে মানবতার কাজ করেছে এমন ভাল মানুষ রয়েছে অনেক।আমাদের কাজ হলো তারা যদি ভাল কিছু দেয় আমরা সেটাকে চর্চা করে খারাপ দিকগুলো বর্জন করে আরো ভাল কিছু করতে পারি কিনা? শুধুমাত্র সমালোচনা করা হলো মূর্খতা।যার সমালোচনা যিনি করবেন তাকে হতে হবে ঐ ব্যাক্তির চেয়ে পরিপক্ক।যাই হোক আমি যে কথাগুলো বলতে চাই তা হলো তার সম্পর্কে আমাদের গভীর ভাবে জানা উচিত।আমি উপরে তার যে বইটির কথা উল্লেখ করলাম সেখানে তিনি সামাজিক ব্যাবসার উপর বিশদ বর্ননা করেছেন।কিভাবে বেকার সমস্যার সমাধান করা যায়,উদ্যোক্তার সৃষ্টি করা যায়,সমাজ থেকে দারিদ্রতা দূর করা যায় ইত্যাদি। তিনি বলেছেন,'শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির যন্ত্রটাকে সচল রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী গোষ্ঠী তৈরি করা। শিক্ষা সমাপ্তির পর প্রত্যেকে একটি চাকরি পেয়ে গেলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। শিক্ষা সমাপ্তির পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে নেমে আসে বেকারত্বের দুর্ভোগ।এ রকম একটা অনুচ্চারিত অথচ শক্তিশালী লক্ষ্যকে ভিত্তি করে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা যুগে যুগে সৃজনশীল তরুণ সমাজকে স্বার্থপর ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। তার মধ্যে প্রচলিত পৃথিবীকে গ্রহণ করার মানসিকতাকে দৃঢ়ভাবে পুঁতে দেয়া হয়েছে। তাকে অন্যের হুকুম মানার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কর্মস্থলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার মানসিকতায় তাকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন তরুণের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়া যে, মানুষের মধ্যে সীমাহীন শক্তি আছে। তার মাঝেও সে শক্তি সুপ্ত আছে। সেই সুপ্তশক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াই হল শিক্ষার সবচেয়ে বড় কাজ। তার সব শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোল, অংক, পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য- সবকিছুর পেছনে থাকবে তার নিজেকে জানা। অতীতে যা কিছু ভালো কাজ হয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত করা। ‘ভালো পাস করলে, ভালো চাকরি পাবে’- এ ধারণার বদলে শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দেয়া যে, সে জীবনে যা কিছু অর্জন করতে চায় তার একটা সূত্রপাত সে শিক্ষা জীবনেই করতে পারে। শিক্ষা হল তার প্রস্তুতি। এটা তার জন্য বোঝা নয়, এটা তার সম্পদ। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে, তার সামনে একটি নয়, দুটি পথ খোলা। সে যেন বিশ্বাস করে যে, আমি চাকরি প্রার্থী নই, আমি চাকরিদাতা। চাকরিদাতা হিসেবে সে যেন প্রস্তুতি নিতে থাকে। তার বিদ্যায়তনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যারা চাকরিদাতা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া। তাকে বুঝতে দেয়া যে, সব মানুষই উদ্যোক্তা। এটা তার সহজাত ক্ষমতা। সাময়িকভাবে সে চাকরি করতে পারে; কিন্তু এটা তার কপালের লিখন মনে করার কোনো কারণ নেই। একবার কর্মচারী হলে, একবার শ্রমিক হলে তাকে সারা জীবন কর্মচারী বা শ্রমিক হিসেবে কাটাতে হবে এমন কোনো ধারণা যেন তাকে দেয়া না হয়। তাকে নিজের শক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটা কাজ হল প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পৃথিবী গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করা। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে বর্তমান পৃথিবীটা হচ্ছে অতীতে যারা ছিল এবং বর্তমানে যারা আছে তাদের হাতে গড়া একটা বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় যা যা দোষত্র“টি আছে, সেগুলো উঠতি প্রজন্মকে সংশোধন করতে হবে, এবং তা সংশোধনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়টাই হল শিক্ষা জীবন। এ সময়ের মধ্যে তাদের নতুনভাবে আরেকটা পৃথিবী গড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। নতুন গড়ার ক্ষমতা তাদেরই হাতে। কিন্তু তাদের প্রস্তুত হতে হবে কোন ধরনের পৃথিবী তারা গড়তে চায় তার রূপরেখা তৈরি করার জন্য। প্রতিবছর, প্রতি শ্রেণীতে তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নতুন পৃথিবীর রূপরেখা তৈরি করবে। পরের বছর সেটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবে। শিক্ষা সমাপনের আগেই আগামী পৃথিবীর একটা ছবি তার মাথার মধ্যে যেন স্থান করে নিতে পারে। একবার এ ধারণাটা মাথায় স্থান করে নিলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার কাজের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হতে আরম্ভ করবে। মানুষ হিসেবে আমাদের গন্তব্য সম্বন্ধেও তার একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন,'বেকারত্ব মানে কী? পরিপূর্ণভাবে সক্ষম, কর্মের প্রতি আগ্রহশীল একজন মানুষের কোনো কাজ না করে দিনের পর দিন সময় কাটিয়ে যাওয়া- এটাই হল বেকারত্ব। মানুষ কাজ করতে চায়, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে, তবু সে কাজ করতে পারে না কেন? আমাদের অর্থনৈতিক যন্ত্রটা এমনভাবে বানানো যে, এতে অনেকের জায়গা হয় না। তাই তাদের বসে বসে সময় কাটাতে হয়। তাহলে এটা কি মানুষের দোষ, না যন্ত্রের দোষ? অবশ্যই যন্ত্রের দোষ। আমরা কি কোনো দিন জিজ্ঞেস করেছি, যন্ত্রের দোষে মানুষ কেন শাস্তি পাবে? কেন একজন কর্মক্ষম সৃজনশীল মানুষ এক অদৃশ্য শৃংখলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হবে? এটা যদি যন্ত্রের দোষ হয় তাহলে এ যন্ত্র যারা বানিয়েছে তাদের আমরা শাস্তি দিচ্ছি না কেন? আমরাই বা নতুন যন্ত্র বানাচ্ছি না কেন? যে মানুষ মঙ্গল গ্রহে বাসস্থান নির্মাণের চিন্তায় মশগুল হতে পারে, সে মানুষ একটা উদ্ভট যন্ত্রকে বাতিল করে নতুন একটা যন্ত্র বানাতে পারছে না কেন?

পুরো জিনিসটার পেছনে আছে বর্তমান যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট মানুষের প্রতি মানুষের বাধ্যতামূলক ঔদাসীন্য। পৃথিবীতে দু’চার জন লোক নয়, কোটি কোটি লোক বছরের পর বছর বেকার। আমরা শুধু ব্যাখ্যার জাল বুনে দায়িত্ব সমাপন করে যাচ্ছি। যে অমূল্য সম্পদের আমরা অপচয় করছি, মানুষের জন্য যে সীমাহীন যন্ত্রণার সৃষ্টি করছি, তা নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না।এক্ষেত্রে আমরা দুটো পন্থায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করলে এর চেয়ে আরও ভালো সমাধান অন্যদের কাছ থেকে আসবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। একটা হল, এখন বহুল পরিচিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক এটার জন্মদাতা। পৃথিবীজুড়ে এখন এ বিষয়ে একটা সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রথম স্তরে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। মহিলাদের মধ্যে এটা বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। স্বকর্ম সৃষ্টি বেকারত্ব অবসানের প্রথম ধাপ। কারও কাছে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার দরকার কী, আমি নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করব। এর জন্য শুধু দরকার পুঁজি। ব্যাংক ঋণ দিয়ে ব্যবসা শুরু করব।

দ্বিতীয় পদ্ধতি হল সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন। এটাও অর্থায়নের একটা পদ্ধতি। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয়, সামাজিক ব্যবসা তহবিল বিনিয়োগে অংশীদার হয়, ঋণ দেয়, অন্যান্য পন্থায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করে। একবার ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের অবস্থান থেকে সরে এলে কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। সামাজিক ব্যবসা তহবিলের পক্ষ থেকে একজন বেকারকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি ব্যবসায় নামো, ব্যবসার বুদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে আসো। আমরা তোমার ব্যবসায় পুঁজি দেব। যত টাকা লাগে আমরা বিনিয়োগ করব, তুমি ব্যবসা চালাবে। ব্যবসার মুনাফা থেকে আমাদের পুুঁজি আমাদের ফেরত দিয়ে তুমি পুরো মালিকানাটা নিয়ে নেবে।’ যেহেতু এটা সামাজিক ব্যবসা তহবিলের টাকা, সেহেতু এখানে কারও ব্যক্তিগত মুনাফার কোনো লোভ নেই। শুধু তহবিলের টাকাটা তহবিলকে ফেরত দিলেই হবে।বেকারত্ব সৃষ্টির মূল কারণ দুটি : শিক্ষা ব্যবস্থা; যেখানে চাকরিই একমাত্র ভবিষ্যৎ, এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আরেকটি হল ব্যাংকিং বা অর্থায়ন ব্যবস্থা। ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে। বেকারকে বা গরিবকে পুঁজি দেয়ার জন্য কেউ অর্থায়ন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেনি, যেহেতু মুনাফা অর্জনের জন্য এর চেয়ে আরও বহু আকর্ষণীয় বিকল্প চারদিকে ছড়ানো আছে। সামাজিক ব্যবসা এটা অনায়াসে করতে পারে, যেহেতু এখানে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোনো শর্ত নেই। এটুকুর পরিবর্তন হলে বেকারত্বহীন পৃথিবীর সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব মানুষের কোনো ব্যাধি নয়। এটা অর্থনৈতিক শাস্ত্রকারদের ভুলের সৃষ্ট সমস্যা।অর্থনীতি শাস্ত্রে এমন কোনো কথা জায়গা পাওয়ার কথা নয়, যেটা মানুষের উদ্যমকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল কাজ হবে মানুষের শক্তির স্ফুরণের জন্য পথ খুলে দেয়া, মানুষকে ক্রমাগতভাবে অধিকতর বড় মাপের হওয়ার জন্য আয়োজন করে দেয়া। কিন্তু এখন হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। আমরা এমন শাস্ত্র বানিয়েছি, যেখানে বিশাল মাপের প্রকৃত মানুষকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি। হাতি দিয়ে আমরা মাছি তাড়ানোর কাজ করাচ্ছি।

রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল, সংকটাপন্ন নাগরিকদের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্নে সাহায্য করা। উন্নত বিশ্বে এ দায়িত্ব পালন করা হয় আয়হীন এবং স্বল্প আয়ের মানুষকে মাসিক ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের আরেকটি প্রধান দায়িত্বের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে ভুলে থাকি। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা হল প্রত্যেক নাগরিকের জন্য তার শক্তি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এ সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে যদি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতো এবং সফল হতো তবে কোনো নাগরিককে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার প্রয়োজন হতো না। এখন বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে কিছু নাগরিক সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতার মধ্যে; শুধু তাই নয়, বংশানুক্রমে এ নির্ভরশীলতা থেকে বের হতে পারছে না বা চাচ্ছে না। এর কারণ রাষ্ট্র এদের নির্ভরশীলতার আওতায় আনতে অতিশয় তৎপর বটে, কিন্তু নির্ভরশীলতার আওতা থেকে এদের বের করে আনতে তার কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। বেকারত্বের মতো এটাও মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সমস্যা। বেকারত্ব থেকে মানুষকে বের করার পদ্ধতি বের করতে পারলেই একই পদ্ধতিতে ভাগ্যহীন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য সৃষ্টি করে তাদের রাষ্ট্র-নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের হয়ে

আসার সুযোগ করে দেয়া যায়। রাষ্ট্রনির্ভরশীল একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে তার সারা জীবনে যে ব্যয় করতে হয়, তার একটি ভগ্নাংশ তাকে পুঁজি হিসেবে দিলেই সে কিন্তু স্থায়ীভাবে শুধু নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়েই আসবে না, সে আরও মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে,

তার পরবর্তী বংশধরকে রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত রাখবে এবং সে নিজে করদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থ-জোগান দেবে।

তাহলে এটা রাষ্ট্র করে না কেন? কারণ রাষ্ট্রকে শাস্ত্রকাররা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত তাদের খাইয়ে পরিয়ে রাখতে হবে। চাকরি ছাড়া গতি নেই, এই যে মন্ত্র শাস্ত্রকাররা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, এর থেকে আমরা বের হতে পারছি না। মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে আমাদের মনে অনীহা জমে গেছে।

কথাটা স্পষ্ট করার জন্য তিনি বলেন, কারও মনে এমন কোনো ধারণার যেন জন্ম না নেয় যে, রাষ্ট্রের সহায়তায় যারা জীবন ধারণ করেন তাদের আমি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছি। মোটেই তা চাচ্ছি না। আমি শুধু তাদের মধ্যে যারা আগ্রহ করে, দরখাস্ত করে, রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা ছেড়ে এসে নিজের আয়ে নিজে চলতে চান, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির কথা বলছি। যারা এখন যেভাবে আছেন সেভাবে থাকতে চান, তারা সেভাবে থাকবেন। নিজের আয়ে নিজে চলার বিষয়টি যাতে সবার কাছে আকর্ষণীয় এবং বাস্তবসম্মত করা যায় তার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে, কারণ মানুষের জীবন পরনির্ভরশীলতার জীবন হতে পারে না। মানুষ কর্মঠ জীব। সৃজনশীল জীব। মানুষের প্রকৃতিই হল নিরন্তর নিজেকে বিকশিত করা, নিজের সম্ভাবনার সীমারেখাকে ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত করা। অলস জীবন মানুষের স্বাভাবিকত্বকে কেড়ে নেয়। পরনির্ভরশীলতা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। তাই বেকারত্ব ও দারিদ্র্য এত অসহনীয়।

উপসংহার তিনি বলেছেন,'প্রচলিত পুঁজিবাদী শাস্ত্র পৃথিবীর মৌলিক সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। এই কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে অগ্রসর হলে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান তো হবেই না, বরং এগুলো জটিলতর হয়ে আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে। বড় মাপের প্রকৃত মানুষকে ছোট আকারের রোবট-প্রায় মানুষে পরিণত করে অর্থনীতিশাস্ত্র এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মানুষকে তার স্বাভাবিক সত্তাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিলে বর্তমানে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের স্বার্থহীনতাকে অর্থনীতিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। সামাজিক ব্যবসাকে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে এ উদ্যোগ শুরু হতে পারে। সামাজিক ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিলে অর্থনীতিতে এটা কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যেতে পারবে, নাকি একটা ক্ষুদ্র নামকা ওয়াস্তের কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, এ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মানুষের মধ্যে যে স্বার্থহীনতা এবং সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য কাজ করার যে প্রচণ্ড আগ্রহ ও ক্ষমতা, তা দেখলে মনে হয় একবার সামাজিক ব্যবসা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলে এটা মহাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতার দ্বন্দ্বে স্বার্থহীনতা অগ্রগামী হবে বলে আমার বিশ্বাস।নতুন প্রজন্মের তরুণদের দেখলে, বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে তাদের হতাশার কথা শুনলে আমার এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সময় এসেছে। প্রযুক্তি আমাদের এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের পথ বের করতেই হবে। সামাজিক ব্যবসা আমাদের মনে আশা জাগায়। হয়তো সামাজিক ব্যবসা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এ গন্তব্য হবে সবার জন্য ঋণ, সবার জন্য পুঁজি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য সুশাসন; বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যহীন, পরিবেশ দূষণমুক্ত, যুদ্ধাস্ত্রমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, আয়ের বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবী।

বিষয়: বিবিধ

১১৮৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

286017
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:২৩
বিবেকবান লিখেছেন : Really excellent analysis..carry on your journey
286130
২০ নভেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:২৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
আসলেই একটি নতুন আইডিয়া তিনি দিয়েছেন যেটা অনুসরনযোগ্য।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File