আনন্দ বেদনায় ছুটির দিনগুলো।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৯ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:৪৬:৪৮ দুপুর
এক-:
ছুটি মানে আনন্দ।দেশে বা বিদেশে যে যেখানেই থাকুক না কেন ছুটি মুক্ত করে দেয় দীর্ঘ অবসাদ।আমরা যারা বিদেশে থাকি, কাজের মধ্যে কখন দিন পুরিয়ে যায় ভাবতে অবাক লাগে।বছর ঘুরে যখন ছুটির কাছা কাছি এসে যাই তখন আর কাজে মন বসানো খুব কঠিন হয়ে যায়।প্রায় ১৫ বছর ঈদুল আযহায় দেশের মাটিতে পা বসাতে পারিনি।সেই হেতু এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ঈদ দেশেই করবো আর তার সাথে বন্ধুদের অনেককে জানিয়ে দিয়েছিলাম।৭ই অক্টোবর যাত্রা করেছিলাম।জেদ্দা বিমান বন্দরে এবার আমার জীবনের সর্বকালের অভিজ্গতা অর্জন করলাম।ঈদে মানুষের অতি ভীড় থাকে সত্য।ফ্লাইট ডিলে কখনো হয় সেটিও সত্য।কিন্তু ৭ ঘন্টা ডিলে মানুষের জীবনকে এত বিপর্যস্ত করে তা ভাবতে পারিনি।ইমিগ্রেশন পার হতে লেগেছিল ৩ ঘন্টা যা সচরাচর লাগে ২০ মিনিট।পাসেন্জার যদি একা হন তা না হয় মেনে নেয়া যায় কিন্তু যদি ডিপেন্ডেন্ট থাকে আর তা হয় ছোট না বালক বা বালিকা তাহলে বিড়ম্বনার শেষ নেই।এমনই দেখলাম দু/চারজন পাসেন্জার।সাহেব হেঁটে চলছেন আর মা সামলাচ্ছেন দুটো বাচ্চাকে।আমার মনে হলো সন্তান লালনের দায়িত্ব একমাত্র বাচ্চাদের মা'র।এক বাচ্চা কোলে আর একজন মা'র আঁছল ধরে কাঁদছে আর মা'কে অসহ্য করে তুলছে তার উপর হাতে ব্যাগেজ।সাহেব ইচ্ছে করলে মা'কে একটু সহযোগিতা করতে পারতো কিন্তু না--।অনেকে দূর দূরান্ত থেকে ৮/১০ ঘন্টার জার্নি করে এসেছে তার উপর এই ৭ ঘন্টা যেন মৃত্যুর প্রহরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।তার পরও দেশের মায়া মানুষকে টেনে নিয়ে যায় সে যত কষ্টই হোক না কেন।অনেক কষ্টে ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাউন্জে বসে পড়লাম।চোখে ঘুম থাকলেও বসে ঘুমানোর মত মন তৈরি ছিল না।নাস্তা ও কফি নিয়ে বসলাম। এমন সময় একজন আগুন্তক আমার পাশে এসে বসলেন যিনি একটি কোম্পানীতে চাকুরি করেন।তিনিও আমাকে পেয়ে মনে হয় অনেক সাহস পেলেন।দুজনে নাস্তা করে গল্পে মশগুল হলাম।আমার ২৩ বছরের বিদেশ যাপন শুনে তিনিও বললেন,' কিভাবে ১১টি বছর পার করেছি জানিনা।আপনিতো পরিবারের চোঁয়া পান,আমি ১১ বছরে পরিবারের চোঁয়া পেয়েছি মাত্র ৯ মাস।শুধু মাত্র পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জীবনের একটি বিশেষ সময় পার করে দিলাম।" কথাগুলো শুনে আমি নিজেই এতগুলো বছরের ছক টেনে নিলাম।কি পেলাম সেটি বড় কথা নয়,আমার মনে হয় কতটুকু দিলাম আর যারা পেল তাদের কৃতজ্গতাবোধ কড়তুকু সেটিই বড় কথা।অবশেষে আমাদের বিমানে চড়ার সময় এলো।এত কষ্টের মাঝেও মনে পড়লো সক্রেটিসের সেই চির বিদায়ের কথাগুলো," The hour of departure has arrived,i to die, you to live,which is better only God knows" জীবন মানে সত্যের মাপকাঠিতে নিজেকে প্রবহমান রাখা।মিথ্যার বিরোধিতা করা ও সর্বোপরি মানুষের কল্যানে নিজেকে তিলে তিলে নি:শেষ করে দেয়া।যাই হোক, ঢাকায় হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।এই তো আমার জন্মভূমি।মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন,মাতৃভাষা রুপখনি পূর্নমনি জ্বালে।' নিজের ভাষায় কথা বলার আনন্দ দেশে না থাকলে বুঝা যায় না।এবার ব্যাগেজ খোঁজার পালা।কয়েকটি ফ্লাইট আগে পরে আসার কারনে টাকা দিলেও ট্রলি পাওয়া যাচ্ছিল না।প্রায় ৩০ মিনিট পর একটি পাওয়া গেল তাও বড় অন্কের টিপসের বিনিময়ে।অনেকের কাছে শুনেছি এয়ারপোর্টে সমস্যা হয় আমি কিন্তু কখনো তেমন কিছু প্রত্যক্ষ করিনি।গত ২২ বছর ধরে একদিনও আমার সাথে তেমন কিছু হয় নি।এর কারন হলো অনৈতিক কোন মালামাল আমি কখনো বহন করিনি আর আমার এ্যাকাউন্টান্ট ভিসা হওয়ায় অফিসাররা সম্মানের সাথে অনেক সময়ই আমার সাথে কথা বলতেন।আমার মনে হয় প্রফেশনালদের সাথে তারা ভাল ব্যাবহার করে থাকেন।তবে কিছু অনিয়মতো আছেই।আমরা যদি আমাদের চলার পথকে সততার যায়গায় রাখতে পারি তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।আমরা নিজেরা অন্যায় করি বলে অন্যায়ের পথ প্রশস্ত হয়।
আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের সাথে মিশে ঈদ করার আনন্দ আজ আর তেমন নেই যেমনটি আমরা ছোট বেলায় করেছিলাম।শহরে ও গ্রামে আনন্দের এক বিশাল ব্যাবধান আমাকে বেদনার্ত করেছিল।ঈদ আনন্দ এখন পরিনত হয়েছে বিভিন্ন দলে ও গোষ্ঠিতে।মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে ধর্ম আর অধর্মের মাপকাঠিতে ও তারা মনে করছে, যে যার যায়গায় ভাল কাজটি করছে।একটি মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলছে এক ধরনের ভন্ড দুষ্ট আলেমরা।যারা মানুষকে যুগ যুগ ধরে আলকুরআন ও সুন্নাহের সঠিক পথ থেকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। ইসলামের নামে বিভিন্ন খানকা,দরগাহ,পিরের আখড়া তৈরি করে সারা দেশে আলোকিত দীন ইসলামকে অনালোকিত দীন ও ইসলাম দিয়ে ভরিয়ে দেয়া হয়েছে। মিডিয়াগুলো প্রচার করছে মিথ্যা ও মন গড়া হাদিস।ইসলামের ধারক ও বাহকরা এখন দ্বারস্হ হয়েছে টাকার কুমিরদের কাছে।যে মসজিদ থেকে রাসূল সা: দীন কায়েম করেছেন সে মসজিদগুলোর মোতাওয়ালি এখন বেনামাজি ভন্ডরা।তাদের কথায় উঠতে বসতে হচ্ছে ঈমামদের।সত্য যারা বলতে চায় তারা চাকুরি হারায়।অনেক মসজিদে আমার নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে চলার পথে।আমাদের ধারনা মসজিদে যারা যায় তারা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্য যায়।কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হলো-কতেক ঈমামকে নামাজে দাঁড়ানোর পূর্ব মুহূর্তে বলতে শুনেছি,'কাতার সোজা করুন,কাতার পুরা করুন,আপনার ভাল জুতো সামনে রাখুন।'' ঈমামকে অনুসরন করা পিছনের মানুষদের দায়িত্ব।আর একজন নামাজি যখন তাকবিরে তাহরিমা বলে নামাজ শুরু করেন তখন আল্লাহর সান্নিধ্য ছাড়া আর তার সামনে আর কিছু থাকার কথা নয়।যদি চোরের তাড়া থাকে তাহলে সে নামাজ কতটুকু কামিয়াবির দিকে নিয়ে যাবে সেটা চিন্তার বিষয়।যে সমাজে আল্লাহর ঘরে চোর ঢুকে সে সমাজ নৈতিকতার দিক থেকে কত নিম্মগামি তা কল্পনা করা যায় কি?
দুই-:
ঈদের পর ৩/৪ দিন ঢাকা ফাঁকা থাকে।সবাই ঈদের ছুটিতে যার যার এলাকায় চলে যায়।বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষেরা যারা কলকারখানায় কাজ করে তারা ছুটির শেষ দিনে যে যার মত এলাকায় চলে যায়।দূর পাল্লার বাস ,লন্চ ও ট্রেন যেন লোকে লোকারন্য। ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসায়িরা এ সুযুগে তাদের অনৈতিক কামাই রোজগারে ব্যস্ত হয়ে উঠে।এত দুর্ঘটনার পরও তাদের মানুষের জীবন নিয়ে ব্যাবসা করার প্রবনতা কমছে না।ঢাকায় ঈদ যাপন করে পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম আমার সেই ছোট বেলার ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট গ্রামের দিকে।ঢাকা থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ।পূর্ব দীগন্তের প্রখর সূর্যের আবহ ভেদ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল।ঢাকা শহরে এখন চলার উপায় নেই।বালিরাশি যেভাবে বাতাসের সাথে ঘুরে বেড়ায়, মাত্র ৩/৪ ঘন্টা শহরে ঘুরে এলেই আবার গোসল করা ছাড়া উপায় থাকে না।সেই রকম অবস্হায় আমরা বেরিয়েছিলাম তবে এয়ারকন থাকায় গ্লাস খুলতে হয়নি।হাজিগন্জ এসে আমার বন্ধু মুনির ও রহিমের সাথে দেখা হলো।আমার পরিবার পরিজনকে মুনির তার বাসায় নিয়ে গেল।চমৎকার বন্ধু ও তার আতিথেয়তা মনে রাখার মত।যখনই যাই সে বন্ধু আঁঠার মত আমাদের তার বাসায় যুক্ত করে রাখে যা থেকে অনেক কষ্টে বের হতে হয়।ভাগ্যিস সেদিন ছিল হাজিগন্জ পাইলট স্কুলের ১০০ বছরের পূনর্মিলনী।আমাদের কাঁচা-পাকা বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালই লেগেছিল।সেদিন সন্ধার পর আমার বন্ধু রহিমের শশুরের (কান্চন মিয়া) বাসায় কুশল বিনিময় করতে গিয়েছিলাম।আমি উনাকে ৩০ বছর আগে নবীনের মতই দেখেছিলাম কিন্তু আজ বয়বৃদ্ধ।কিন্তু মনের যোশ দেখে সেই নবীনত্যের ভাব দেখতে পেলাম।মানুষ মনের দিক থেকে কাঁচা থাকলে বয়সে তাকে হার মানাতে পারে না।হাজিগন্জের পাশেই ডাকাতিয়া নদী।যদিও আজ কোন নদীই এখন নদীর মত নয়।পানির সেই চলাৎ চলাৎ শব্ধ এখন নেই।মাঝিদের কন্ঠে সেই ভাওয়াইয়া গান নেই।আমাদের মনের অজান্তেই তিনি কাউকে দিয়ে দুটো নৌকা ঠিক করলেন এবং বললেন আমরা নৌকা ভ্রমনে যাব।আমরা সবাই পাশা পাশি দুটো নৌকায় উঠলাম।আমার ও রহিমের পরিবার এক নৌকায়।আমার ছেলে মেয়েরা বেশ উপভোগ করেছিল। পূর্নিমার চাঁদ আর তার সাথে শহরের বিদ্যুতের আলোক এই দুই মিলে অতীতের দৃষ্য মনের মনিকোঠায় ভেসে উঠলো।পশ্চিমে বলাখাল ঘুরে এসে সামনে পড়লো এক বিয়াল জাল।জেলের মাছ যা ছিল প্রায় সবই কিনে নিলেন রহিমের শ্বশুর।হারানো দিনের অনেক কথা,রাজনৈতিক সমিকরন মিলে বেশ ভালই কেটেছে প্রায় দেড় ঘন্টা।পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের দিকে। এখন গ্রাম আছে কিন্তু শহরের ছোঁয়া লেগে গেছে প্রায় সব গ্রামে।পাকা রাস্তা তার পাকা বাড়ি।যে গ্রামগুলোতে সকাল বেলা ফজরের পর ছিল ঘরে ঘরে আলকুরআনের পঠিত গুন গুন শব্দ,সেই অবস্হান আজ আর নেই।গ্রামের সেই মক্তব নেই।গ্রামের কৃষকের সেই লাংগল ও বলদ নেই।সকালে চায়ের দোকানে আড্ডা ও রাজনৈতিক সমাচারে ভরপুর।একে অন্যের সাথে সৌহার্দপূর্ন সম্পর্ক নেই,আর নেই বয়োজেষ্ঠদের প্রতি সম্মান।অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে,মসজিদ মাদ্রাসা হয়েছে,মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে কিন্তু নৈতিকতার ধস নেমেছে।কে কাকে ঠকাবে,কে কার আগে টাকার কুমির হবে,কার সম্পদ কে কুক্ষিগত করবে তার প্রতিযোগিতা চলছে।নামাজ কালাম নেই এমন মানুষ মসজিদ তৈরিতে ব্যাস্ত।সরকারি আমলারা যার যার এলাকায় স্কুল কলেজ বিনির্মান করছেন।এত টাকা তারা কোথা থেকে পান তারাই ভাল জানেন।ব্যাবসায়িরা কোটি টাকা অল্প দিনেই কামিয়ে ফেলছেন সে যেন আলাদিনের চেরাগ।আমরা যারা বিদেশ থেকে যাই, তাদের হতভম্ভ হতে হয় তাদের কেনা কাটা দেখে।অনেকে আবার ভৎসনা করতেও ছাড়ে না।কফি বারগুলো চলছে বেদম।কাষ্টমারদের ৮৫% হলো ইয়াং ছেলে মেয়ে। আমি প্রায় ২০টি কফিবার পর্যবেক্ষন করে দেখলাম যার বেশীর ভাগ ইয়াং এবং এ সমস্ত ইয়াং জেনারেশন টাকা পায় কোথায়? একজন স্কুল গয়িং ছাত্র যে কোন সময় ৫০০ টাকা বিল দিতে পারে এমন অনেক সংখ্যায়।মল গুলোতে এখন যে আড্ডা জমে তাও ইয়াংদেরই।এক কথায় বলা যায় নৈতিক উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়ে কাল্পনিক এক জগতের দিকে চলছে সমাজ।মেঠো পথের ধারে ঘুরে ঘুরে অনেক আত্মীয় পরিজনদের সাথে আলাপন আর তার সাথে অল্পদিনের ব্যাবধানে হারানো মানুষের কবরের পাশে দোয়া করে চলতে থাকলাম।একবার ঘুরে এসে অনেককে হারিয়ে ফেলি এভাবে আমরাও একদিন হারিয়ে যাব নি:সন্দেহে।
হাজিগন্জ থেকে বেরিয়ে এলাম।আমার ছেলে মেয়ে বায়না ধরলো সিলেট অন্চল দেখার জন্য।আমার বন্ধু মুনির ও তার পরিবার সাথে যুক্ত হলো।কুমিল্লা - ব্রাম্মন বাড়িয়া হয়ে চললাম সিলেটের পথে।আমাদের রোড ঘাটের অবস্হা এত চরম ভাবতে অবাক লাগলো।মনে হলো সরকারের করার কিছুই নেই।বেশির ভাগ রাস্তাঘাটের অবস্হা খারাপ।১৬ কোটি মানুষের দেশ।প্রকৃতি আমাদের এমন অনেক কিছু দিয়েছে যার লালন আমরা করতে শিখিনি।পথের দু'ধারে ফাঁকা মাঠ।সবুজের সমারোহ,গাছ গাছালি ঘেরা দূরে গ্রাম মনে হচ্ছে কালো পাহাড়।কোথাও পাখির কলকাকলিতে মনকে ব্যাকুল করে তোলে।নীল আকাশ এবং এর মাঝে টিপ টিপ বৃষ্টি যেন আমাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে বলে দেখে নাও তোমার মাতৃভূমিকে।হেমন্তের শেষ লগ্নে বিকেলের এ দৃষ্য আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।আমাদের বছরে ছ'টি ঋতু।একটির পর আর একটি আসে বিভিন্ন রংঙে।এক কালের গোলা ভরা ধান,গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ আর নেই।নেই এখন কৃষকের হাতে সে জমা জমিও।হেমন্ত এলে কৃষকের আমেজ থাকতো আলাদা।যে সকল এলাকা বিশাল মাঠ জুড়ে ছিল ধান চাষ, অন্য এলাকা থেকে হেমন্তে দলে দলে চলে আসতো দিন মজুর।গানের সুরে সুরে তারা ধান কাটতো আর জুটি বেঁধে লাইন ধরে চলতো চাষীদের আংগিনায়।সে দৃষ্য দেখে মনে হতো সত্যিই আমাদের দেশ ছিল এক সোনার বাংলা।কালের পরিক্রমায় সে ধানের জমি কমে যেতে থাকলো আর দখল করে নিল নগরায়নে।নদীগুলো মরে এখন বিলীন।প্রকৃতি এখন বৈরি হয়ে উঠেছে।গ্রামীন কৃষকের হাহাকার আর শুন্যতায় আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে।সিলেটের হাওর বাওড় থাকলেও সেই রমরমা ভাব নেই।এখন হাওরগুলোতে দেখা যায় মহিষের চাষ। সিলেট,হবিগন্জ , শ্রীমংগল ও নবীগন্জের চা বাগান গুলোর দৃশ্য চমৎকার। রাস্তার দুধারে চা বাগান ও রাবার বন।বাগানের ভিতর হেঁটে হেঁটে অনেক দূর যাওয়া।চা শ্রমিকদের দেখে ও কথা বলে মনে হলো তাদের জীবন অতি সাধারন ও অল্পে তুষ্ট।আর এই নিরক্ষর মানুষগুলো তুষ্ট না থেকেই কি করবে।তাদের কথা হলো সাহেবরা যদি আমাদের দিকে না চায় তাহলে আমাদের কি করার আছে।শ্রমিকদের ঘাম থেকে তৈরি হয় প্রাসাদ কিন্তু সে শ্রমিকের বাসস্হান নেই,শিক্ষা নেই ,স্বাস্হের উন্নতি নেই।তাদের ব্যাবহার করে সাহেবরা গড়ে তুলে প্রাসাদ ও পাচার করে অর্থকড়ি বিদেশে।অথচ একটু তাকালে এই শ্রমিকরা ভাল থাকতে পারে।তাদেরতো বড় কোন আকাংখ্যা নেই, শুধু একটু ভালভাবে বেঁচে থাকা।বিয়ানি বাজারে টিলা গুলোতে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ গড়ে তুলেছে প্রবাসি সিলেট বাসিরা।সে সব বাড়িগুলোতে লোকজন তেমন থাকেনা বললেই চলে।অনেকে নিজের বাড়ির সামনে চমৎকার মসজিদ করে রেখেছে যা দেখলে মন জুড়ায়।রাস্তা ঘাট বাগান খুবই পরিপাটি।তবে সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে শিক্ষার প্রসার তেমন ঘটেনি।ভারতের সাথে আমাদের বর্ডারগুলো পাহাড় দিয়ে ঘেরা।দূর থেকে পাহাড়ের ঝরনা গুলো দেখার মত।ছেলেমেয়েদের তাড়নায় যেতে হলো মাজার এলাকায়।ইসলামের নামে সেখানে চলছে শির্ক ও বিদাআত।লাল কাপড় পরিহিত ভন্ডদের দেখে ছোট বেলার পঠিত "লাল শালুর" কথা মনে পড়লো।আল্লাহর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো যে এত অধম হয় তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।শাহজালালের কবর এলাকায় দু'শ্রেনীর মানুষ যায়।কেউ ভ্রমন করে দেখার জন্য আর এক শ্রেনী আছে যারা সেখানে গিয়ে সেজদা দেয়।যারা দেখার জন্য যায় তারা সেখানে আনন্দ উপভোগ করে চার পাশের ভন্ডামি দেখে আবার কেউ বা কেনাকাটা করে হালুয়া(তুষার সিরনি) ও অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় জিনিস।তবে তাদের সংশোধন করার মত নছিহত করা কষ্টকর কারন আলকুরআন ও সূন্নাহের কথা বলতে গেলে জীবনটা চলে যেতে পারে।এ যায়গাগুলোতে ভাল মানুষদের যাওয়া অনুচিত কারন দেখার জন্য যেতে থাকলে তাদের দলই ভারি হবে।এমনও হতে পারে শয়তান তাদের ছহি আক্কিদাকে ওদিকে ফিরিয়ে দিতে পারে।আমি এক ঘন্টা ধরে যা দেখলাম সেখানে অজ্গ মানুষদেরই দেখেছি।কয়েকজনকে জিজ্গেস করলাম আপনি এই কবরে উঠছেন কেন? তারা জবাব দিল,'বাবার কাছে গেলেই তো বাবাকে পাওয়া যাবে।' শাহজালাল যদি এ পথ সৃষ্টি করে গিয়ে থাকেন তাহলেতো ক্কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে লান্চিত হবেন।আর তিনি যদি এ পথ না দেখান ও যারা তার মৃত্যুর পর এ পথ মানুষের দেখিয়েছে তারা লান্চিত হবে ও তিনি এ সবকে অস্বীকার করবেন।
দেশে এখন সালামের প্রচলন বন্ধ হওয়ার মত বলা যায়।গত এক মাসে প্রায় ১৮ দিন ফজরের পর আমি প্রাত ভ্রমন করেছি প্রতি দিন ৩/৪ কিলোমিটার।আমার বাসা উত্তরা হেতু ৫নং সেক্টর লেকের পাড় ঘিরে হাঁটা।চমৎকার সকাল কেটেছে প্রাতভ্রমনে।আমার একজন প্রতিবেশি ছিল প্রাক্তন জয়েন্ট সেক্রেটারি।ভদ্রলোক মসজিদে যেতেন না তবে দেখা হতো লেকের পাড়ে ও আমরা একসাথে প্রাতভ্রমন করতাম।ইসলামের অনেক বিষয় আমরা আলাপ করতাম। প্রাক্তন ডজনখানেক উর্ধতন কর্মকর্তা(সিভিল সার্ভেন্ট),প্রকৌশলী,ডাক্তার মিলে হাঁটেন।৪৫ মিনিট হেঁটে লেক ব্রিজ সংলগ্ন নিচু যায়গা যেখানে আসন করে দেয়া হয়েছে বসার জন্য।জীবন সায়াহ্নে এসে অনেকে সত্য কথা বলেন।জীবনের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের কথা বলেন।কিন্তু ধার্মিকতার কথা কমই বলেন।সকালে লাঠি হাতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন কিন্তু মসজিদে যান না।৫ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম না করলে যে মুসলিম থাকে না তাদের জানা নেই। সালাম দেয়াকে অনেকে নিচতা মনে করেন।এক সকালে গুনেছিলাম প্রায় ১৭৫জনকে।আমি সালাম দিয়েছি প্রায় সবজনকে।এর মধ্যে ৬/৭ জন আমার আগে সালাম দিয়েছে আর বাকিদের আমার দিতে হয়েছে।সালামের অর্থ হলো ,"আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হউক"। যে সমাজের মানুষ একে অন্যের শান্তি কামনা করে না সে সমাজে ইসলাম কায়েম হবে কিভাবে? ইসলামের প্রথম যুগে মানুষের আজকের মত রোগ হতো না কারন তারা অধিকাংশ সময় ক্ষুধার্ত থাকতো।আজকের যুগে এই ভূঁড়ি ভোজন কারিরা যদি কম খেতো তাহলে গরীব মানুষদের গরীবত্ত দূর হতো কিছুটা হলেও।সামাজিক বৈষম্য দূর হতো অনেকটা।আবার অনেকে বলেন মরে গেলে যা হওয়ার হবে।একজন বললেন কিছুদিন পুড়িয়ে আল্লাহ " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর" বরকতে জান্নাতে নিবেন।ইসলাম সম্পর্কে সমাজের এলিটদের এ রকম ধারনা যদি হয় তাহলে অন্যদের কি হবে? আসলে এরা এমন এক জাতি যাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল ইসলাম সম্পর্কে অজ্গ।আজও সমাজের মানুষকে যদি চিহ্নিত করা যায় দেখা যাবে তারা ছিল পাশ্চত্য নির্ভর।তাদের জীবনের একটা বিশেষ অংশ কাটিয়েছে ইহুদি খৃষ্টানদের সাথে।মুসলমান নাম ধারন করে তারা সমাজে বসবাস করছে কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তারা অজ্গই রয়ে গেছে।তবে গত ৫ তারিখ সকালে আমার শেষ সাক্ষাতে অনেক খারাপ লেগেছিল বিদায় নিতে।অনেকে বলে ফেললেন আপনি ভাগ্যবান আল্লাহর নবীর দেশে থাকার আপনার সৌভাগ্য হয়েছে।আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
তিন-:
অক্টোবর এর ২৫ তারিখ,শনিবারে লক্ষ লক্ষ জনতা রাজধানী ঢাকায় সাবেক আমীর এ জামায়াত, অধ্যাপক গোলাম আযমকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জড় হয়েছিলেন। এর দুই দিন আগে তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন। এই জানাযাটি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরো অগণিত গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে।অথচ,অবাক করা বিষয় হলো তার অনেক সমালোচক প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে প্রচন্ড উপহাস করেছেন। এই সুস্পষ্ট দুটি ধারা এবং এ নিয়ে বিতর্ক আরো অনেকগুলা প্রশ্নের জন্ম দেয়।৯১ বছর বয়সে হাসপাতাল কারাগারে থাকা অবস্থায় অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের মৃত্যু হয়। গত বছর আদালত তাকে '১৯৭১ এর যুদ্ধে করা অপরাধে' অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ৯০ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।কিন্তু ৯০ বছরের একজন বৃদ্ধকে কেন আরো ৯০ বছরের দন্ডে দন্ডিত করা হলো?তার জানাযায় এত বিশাল উপস্থিতি আমাকে ভাবিয়ে তোলে একজন প্রত্যক্ষ দর্শী হিসেবে। বায়তুল মোকাররম মসজিদে মাউলানা ওবায়দুল হক সাহেবেরও এমনি যানাযা হয়েছিল।অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,১৯২২ সালে জন্ম এবং পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে,সেই সময়ে বেড়ে ওঠা গোলাম আযম সাহেব পরবর্তীতে ঢাকসুর (Dhaka University Student's Union)জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত হন এবং সেই সময়ে সদ্য জন্ম নেয়া পূর্ব পাকিস্তানে যেকোন রাজনীতি সচেতন যুবকের জন্য এই পদবী ছিল চরমভাবে কাঙ্খিত। এছাড়াও তিনি সদ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবী পেশ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এই ভূমিকাও যেকোন বাঙ্গালী নেতা/নেত্রীর জন্যই ছিল কাঙ্খিত।যাই হোক, গোলাম আযম সাহেবের ক্ষেত্রেই এই হিসাবে কিছুটা গন্ডগোল দেখা যায়। সমকালীন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং একডেমিক লিখনী উভয় ক্ষেত্রেই গোলাম আযম সাহেবের এই ভূমিকাগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে।যদিও তিনি প্রায় শতবর্ষী একজন ব্যাক্তি, কিন্তু শুধুমাত্র ১৯৭১ ই মনে হচ্ছে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই এক বছরেই অনেক অপরাধ ও দুষ্কৃতিকার্য করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু এই সময়ের বাইরে তাকে খুবই উচ্চমার্গের একজন ভদ্রলোক হিসেবেই দেখা গেছে।আল্লাহ আমাদের মেধার বিচার করবেন।আমাদের সমালোচনা করতে হবে যুক্তির সাথে। ১৯৭১ সালের আগে তিনি এই সমাজেই ছিলেন।তখন কি তিনি ধর্ষক ছিলেন? তাহলে ১৯৭১ সালে তিনি ধর্ষক হলেন এ ছিল রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা।রাজনৈতিক ইস্যুতে আজকের একজন ভাল মানুষ আগামিকাল হয়ে যেতে পারেন ইতিহাসের কাল মানুষ। ২০১০ সালে আমি এক ঘন্টা ব্যাপি ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বাংলাদেশে ইসলামের এক বিশেষ দিক নির্দেশনার কথা বলেছিলেন যা এর আগেও আমি আমার একটি লিখায় তুলে ধরেছি।১৯৭১ সালে কি ঘটেছে তা প্রত্যক্ষ দর্ষিরা বলতে পারবে।তবে আমার পড়াশুনায় মনে হয়েছে ইসলামের জন্য তার একটা অবদান রয়েছে।আমরা সবাই মানুষ।মানুষ হিসেবে ভুল থাকতেই পারে।কিন্তু ভুল করে যারা সৎ পথে ফিরে আসে তারা আল্লাহর কাছে যোগ্যতম।
১৯২০ সালে সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আওয়াজ তোলা হয় এবং সেই সময় পাকিস্তানী নেতারা "দ্বিরাষ্ট্রতত্ত্ব" উপস্থাপন করেন। বাঙ্গালী মুসলিম নেতারা পাকিস্তান আন্দোলনের সম্মুখভাবে ছিলেন। মূলত, ১৯৪০ সালে পাকিস্তান নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশের প্রস্তাবনা একজন বাঙ্গালী নেতার কাছ থেকেই এসেছে এবং ১৯৪৬ সালে সেই প্রস্তাবটিই সংশোধন করে পূর্ব বাংলা কেও পাকিস্তানের অংশ করার প্রস্তাব করা হয় এবং এটিও একজন বাঙ্গালী নেতাই করেছিলেন। তার বহূ পূর্বেই ১৯০৬ সালে 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়,যেই সংগঠনটি পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয়।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাঙ্গালী মুসলিমদের সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তান কখনোই অস্তিত্বে আসতে পারতোনা। তাহলে কেন বাঙ্গালী মুসলিমরাই ১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন?এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে কিছু পড়াশোনা করতে হবে।তবে এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো, কিভাবে একজন ১৯৭১ ঘটনাবলীকে বর্ণনা করছে।এই যুদ্ধকে স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা কঠিন কারন কোন রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষনার কোন দলিলপত্র বিদ্যমান নেই।পূর্ব পাকিস্তানিরাই ছিল অখন্ড পাকিস্তানের মেজরিটি অংশ এবং জাতীয় পার্লামেন্টেও অধিকাংশ আসন ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকেই। মেজরিটি অংশের কিভাবে মাইনরিটির কাছ থেকে স্বাধীনতা চাওয়া উচিৎ ছিল?সেটা কি কোন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল?সুশীল ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সেই ক্ষুদ্র গ্রুপটি কি প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে থেকেই ছিল?এর উত্তর সম্ভবত হ্যাঁ।আজকে এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে আমাদেরকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে যেহেতু ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ইসলাম ও গনতন্ত্রের মধ্যেকার বাস্তবসম্মত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন পুনরুত্থিত হচ্ছে।এছাড়াও,মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিরাষ্ট্র গুলা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এবং খিলাফাহর দাবী যেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তাও বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য।১৯৭১ সালে গোলাম আযম সাহেব দাবী করেছিলেন যেন সামরিক শাসকের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী পার্টি আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী তাদের অন্যায় স্বার্থসিদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তাদের নেতাকে বন্দী করে এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। সে সময় গোলাম আযম সাহেব গনতান্ত্রিক নীতির পক্ষে আওয়াজ তোলেন এবং গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা পুনরায় ব্যাক্ত করেন। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ত্যাগ করে ভারত গমন করেন এবং সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু করেন ভারতের সহযোগিতায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা ও ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানী শহরে যখন আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা অবাঙ্গালী সিভিলিয়ানদের আক্রমন করতে শুরু করে তখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীও ম্যাসাকার শুরু করে। এবং এভাবেই একটি সর্বব্যাপী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গোলাম আযম সাহেব এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নেয় আইন শৃংখলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নেয়ার জন্য তারা সরকারকে সহযোগিতা করবে।
কেন তারা দূর্নীতিপরায়ন, অগনতান্ত্রিক এবং ক্ষুদ্র স্বার্থান্ধ শাসকগোষ্ঠীর পক্ষাবলম্বন করলেন? এই অবস্থান তারা নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান এবং ইতিহাসকে সামনে রেখে, যা পরবর্তীতে গোলাম আযম সাহেব ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু, অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেয়া হয় এবং ফলশ্রুতিতে যারা অরিজিনালী আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন না, এরকম অনেকেও সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদান করে। ভারত তার সর্বপ্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য। বাংলাদেশকে তাড়িয়ে বেড়ানো নয় মাস যুদ্ধের উভয় পক্ষই নয় মাসে অনেক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবেই সন্ত্রাস ও ভীতি তৈরী করছিল যাতে লোকজন ভারতে পালিয়ে যায়, আর অপরদিকে স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র গ্রুপ গুলো অবাঙ্গালী নাগরিকদের হত্যা করে তাদের লাশগুলোকে পাকিস্তানী বাহিনীর আগমনপথের সামনে ফেলে রাখতো। এভাবে একটি বিরাট প্রপাগান্ডা যুদ্ধের সূচনা হয়। আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমের ইসলামোফোবিক অংশ এটাকে ইসলাম ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুযোগ হিসেবে গ্রহন করে। প্রত্যেকেরই এখানে স্মরন রাখা উচিত যে, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের নামকরন করা হয় "ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান" হিসেবে। ভারতীয় গনমাধ্যম এসময়ে 'প্রাভদা' নামক মিডিয়ার পুরাপুরি আনুকূল্য পায়, যা কিনা সেসময়কার সোভিয়েত কমিউনিস্ট দের প্রধান অফিসিয়াল মিডিয়া ছিল।
ওআইসির তৎকালীন সেক্রেটারী টুংকু আবদুর রহমান, যিনি একজন মালয়েশীয়,আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আপোষরফার আলোচনা শুরু করার জন্য ভারত সফর করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভারত সরকার এ প্রচেষ্টা রুখে দেয় এবং কোন আন্তর্জাতিক গনমাধ্যম এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ দাবী করে থাকে যে, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে এবং এই সংখ্যাটি অবাঙ্গালী নাগরিকদের হিসাব ছাড়াই।সেসময় কিছু কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থা এই সংখ্যাটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে একটি জরিপ চালায় কিন্তু সেই জরিপের ফলাফল কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।এই সংখ্যাটি বাংলাদেষের ইতিহাসে একটি বিরাট অস্পষ্টতা হিসেবে রয়ে গেছে।আশ্চর্যজনকভাবে যতজন মেজর ব্যাক্তিত্ত্ব এই ট্র্যাজেডির ইতিহাসের সাথে জড়িত ছিলেন সবারই অস্বাভাবিক এবং সহিংস কায়দায় মৃত্যু ঘটেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর দ্বারা স্বপরিবারে খুন হন, যুলফিকার আলী ভুট্টোকেও তার নিজ দেশের আদালত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত তার নিজ দেহরক্ষী কর্তৃক খুন হয়ে যান! এগুলা সবই কি তাদের কৃতকর্মের শাস্তি? যাই হোক, ইতিহাস এগুলার আরো গভীর বিচার বিশ্লেষন করবে।ইতিমধ্যেই ভারতীয় লেখিকা শর্মিলা বোস একাডেমিক এ্যাপ্রোচ থেকে একটি খুব ভাল বই লিখেছেন যেটির নাম হলো "ডেড রেকনিং- ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি", কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১ এবং বইটিতে ৩০ লক্ষ সংখ্যাটিকে খুব শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আরেকজন ভারতীয় লেখক শ্রীনাথ রাঘভান লিখেছেন "১৯৭১ - বাংলাদেশের জন্মের বৈশ্বিক ইতিহাস,হারভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৩" এবং বইটিতে তিনি এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসকে সঠিক জায়গা থেকে দেখতে হলে আরো অনেক একাডেমিক কাজ প্রয়োজন রয়েছে।
গোলাম আযম সাহেব অখন্ড পাকিস্তানের শেষদিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে ছিলেন এবং যুদ্ধের শেষে দেশে ফেরত এসে জামায়াতে ইসলামীর কাজকে পুনর্গঠিত করেন এবং রাজনীতিতে আবারো সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।তিনি দেশের গনতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য তার সংগ্রামকে পুনরুজ্জীবিত করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মজার বিষয় হলো, গোলাম আযম সাহেব অধিকাংশ সরকারী নেতৃবৃন্দের সাথে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে সহযোগিতা করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০০৭ সালে পুনরায় সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পুনর্মঞ্চায়ন ঘটে।প্রো-ইন্ডিয়ান আওয়ামী লীগ অনেকটা পাতানো নির্বাচনের মাধ্যেমে ক্ষমতায় আসে এবং সেই সরকার প্রায় ৪০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গোলাম আযম সাহেবের বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয়।অধিকাংশ পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকার এই উদ্যোগটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বারবার অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছে যে এই ট্রাইব্যুনাল টি আন্তর্জাতিক বিচারিক মানদন্ডে উতরে যেতে ব্যার্থ হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতার ফাঁসী ইতিমধ্যে গত ডিসেম্বরে কার্যকর করা হয়েছে এবং বাকীরাও প্রথম রায় অথবা আপিল বিভাগের রায় এর জন্য অপেক্ষমান রয়েছেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আবেদন এর মধ্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল বান কি মুন এবং আমেরিকার সেক্রেটারী অব স্টেট জন কেরির আহবানকে ও এই সরকার উপেক্ষা করেছে।গোলাম আযম সাহেব একজন বিরাট উদার মনের অধিকারী ব্যাক্তি ছিলেন। বাংলাদেশের জনগন তার জানাযায় শরীক হবার মাধ্যমে তার প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছে। কোন মানুষের মৃত্যুর পর ভাল ছাড়া মন্দের আলোচনা করা যায়েয নয়।হতে পারে মানুষের চোখে একজন মানুষ খারাপ কিন্তু আল্লাহর চোখে ভাল।ইসলামে কোন অপরাধির যদি দুনিয়ার জীবনে সাজা হয়ে যায় সে ব্যাক্তি আখেরাতে মুক্ত হওয়ার আশা রাখে।ইসলামের ইতিহাসে ইসলামের কাজ করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে অনেককে।ইতিহাস তার নীজের গতিতেই বিচার করবে কে ভাল বা মন্দ।প্রতিটি প্রানীকেই মৃত্যুবরন করতে হবে।মানুষের কর্মের ফল রোজ ক্কেয়ামতে দেয়া হবে।যাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে দেয়া হবে তারাই সফল আর দুনিয়ার জীবন খেল তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন