বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের দিকে দিন দিন এগুচ্ছে।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১২ জুলাই, ২০১৪, ০১:৫২:৩৯ দুপুর
গত ৪৩ বছরে যে হারে দেশে বিনিয়োগ হওয়ার কথা তা আশানুরূপ হয়নি। এর বিশেষ কারন হলো রাজনৈতিক অস্হিরতা। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আশানুরূপভাবে পূরণ হয়নি। পক্ষান্তরে দেশে বেকার জনসংখ্যার ছাপ বেড়েছে। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর কর্মসংস্থান না বাড়লে, মূল্যস্ফীতির গতিরোধ করা সম্ভব না হলে দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়া অবধারিত।এই দারিদ্রতা যে প্রকট তা আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত মানুষের ঢল দেখে বুঝতে পারি।প্রায় দেড় কোটি মানুষ এখন এই ক্ষুদ্র শহরে বাস করে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজারগুলো সংকুচিত হওয়া সত্ত্বেও বরাবরের মত বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে বিশেষ সহায়তা করছে। অন্যদিকে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ রেকর্ড পরিমান বাড়ছে দেখে একশ্রেণীর অর্থনীবিদ তৃপ্তির আস্বাদ গ্রহন করছেন । শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত কয়েক বছরে দেশের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। বল্গাহীন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার পেছনে এক ধরনের শুভঙ্করের ফাঁক থাকে, যেখানে ধনীরা আরো ধনী এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হতে থাকে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও শেয়ার বাজারসহ বিনিয়োগে মন্দা, ব্যাংকিংখাতের দৈন্যদশার কারণে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির এই মিশ্র প্রবণতার মধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি প্রধান রফতানিমুখী শিল্পখাত অ্যাপারেল রফতানিতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান হারিয়েছে। গত বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা এবং কারখানায় অগ্নিকান্ড ও ভবনধসের কারণে বিদেশী ক্রেতারা অনেকটা বাধ্য হয়েই পণ্যের জন্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করে। এর ফলে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ভারত দ্বিতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ তৈরি পোশাকখাতে বাংলাদেশ তার বাজার হারাতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর এভাবে বাংলাদেশের পাটের বাজার ভারতের কাছে হারিয়েছিল। বেহিসাব দুর্নীতি, শ্রমিক ধর্মঘট এবং অগ্নিকান্ডের কারণে শত শত কোটি টাকা লোকসানের মুখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব বড় বড় পাটকল যখন একের পর এক বন্ধ হতে থাকে, ভারতে তখন নতুন নতুন পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন মূলত বেসরকারি উদ্যোগ ও বিনিয়োগে গড়ে ওঠা গার্মেন্টস শিল্পেও রহস্যজনক শ্রমিক অসন্তোষ, অগ্নিকান্ড ও দুর্ঘটনার কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই গত কয়েক বছরে বেশ কিছু গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।যদিও গার্মেন্টস মালিকগন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের দৃড় অংগিকার ব্যাক্ত করছেন।তবে যে শ্রমিকের কল্যানে এই শিল্পের যৌবন লাভ করেছিল তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষমতা হরন করছে বলে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এখনো অভিযোগ করছে। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র না থাকা এবং বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এই চাপ কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন অংশীদাররাও নানা রকম শর্তারোপ করছে। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের জন্য আলোচনা করতে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। আমাদের অর্থনৈতিক শক্তির মূল সম্ভাবনার চাকাগুলো ক্রমে শিথিল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার হয়ে দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাকে ভেতর থেকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিচ্ছে। দেশে বিনিয়োগের চরম মন্দার সময় গত বছর রেকর্ড পরিমাণ টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের এক রির্পোটে জানা যায়।
গণতান্ত্রিক অধিকারের পাশাপাশি মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে বৈষম্যহীন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলায় একাত্তরে এদেশের মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তখন বলা হতো ২২ পরিবারের হাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সরকারের বৈষম্যনীতির শিকার হয়েছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এখন লুটেরা শ্রেণী দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ৯ এর গনঅন্দোলনের পর বিশেষ করে সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে যেখানে সুইস ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক ডিপোজিট ক্রমান্বয়ে কমেছে, সেখানে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা শুধুমাত্র সুইস ব্যাংকেই বেড়েছে ৬২ ভাগ, টাকার অঙ্কে তা ১২০০ কোটি টাকার উপরে, গত কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে এর মধ্যদিয়ে সুইসব্যাংকে বাংলাদেশীদের পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায়েছে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বড় বড় ব্যাংকগুলোতে কি পরিমাণ টাকা এ সময় পাচার হয়েছে তার হিসাব এখানে নেই। তবে বর্তমান সরকারের গত বছরগুলোতে বিভিন্ন সেক্টরে কয়েক লক্ষকোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লুট হওয়ার তথ্য ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। সুইসব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংকে পাচার ও বিদেশে বিনিয়োগ হওয়া ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনেকগুলো নতুন বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে যার একেকটির মূলধন হাজার কোটি টাকা। সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাই মূলত বিদেশে টাকা পাচারের সাথে জড়িত। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির এক নেতা সংসদের বাজেট অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে গত কয়েক বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা সেখানে পাচার হয়েছে। একইভাবে হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, যা জাতির জন্য লজ্জাজনক বলে একজন সংসদ সদস্য উল্লেখ করেছেন। একদিকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের নীতিনৈতিকতাও কি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে? দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলে এই প্রশ্নও সামনে চলে আসে। মানবাধিকারের সংজ্ঞাও যেন পাল্টে গেছে। দলীয় কোন্দলে প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে, একসাথে ৭ জনকে হত্যার পর নদীতে ডুবিয়ে দেয়া এবং ৯ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলেও এসব কুর্কীতির মূলহোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একেকটি জনপদ এখন গুম-হত্যা ও সন্ত্রাসে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া দেখলে মনে হতে পারে তারা পরিস্থিতি উন্নয়নে তেমন মনযোগী বা আগ্রহী নন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এখনো দেশে-বিদেশে আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, এমন মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। এটি একটি রাজনৈতিক বৈধতা ও মূল্যবোধের সঙ্কট। হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে অনির্বাচিত সরকার আইনগত বৈধতা পেলেও র্যাোব, পুলিশ, বিজিবি এবং দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করে এই সরকার যে তার রাজনৈতিক বৈধতা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, গত ৬ মাসে তা প্রমাণ হয়ে গেছে। জানুয়ারি থেকে দেশে কোন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা বিরোধিদলের আন্দোলন-সংগ্রাম না থাকলেও বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও সামাজিক নিরাপত্তায় কোন ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি। নির্বাচনের পূর্বে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বা ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে খোদ প্রধানমন্ত্রীও দ্রুত আরেকটি (একাদশ সংসদ) নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সরকারের মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তারা সে অবস্থান থেকে সরে গেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সরকার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে সমঝোতা ছাড়া ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দেয় তখন যথাসাধ্য কঠোর আন্দোলনে নেমে পড়া ছাড়া নির্বাচন বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলোর আর কোন উপায় থাকে না। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ উপেক্ষা করেও র্যাপব-পুলিশ-বিজিবি দিয়ে একপাক্ষিক নির্বাচন করা সম্ভব, তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু শুধুমাত্র র্যােব-পুলিশ-বিজিবি দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং সরকারের প্রতি আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়, এমন কি মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি রক্ষা করাও যে সম্ভব নয়, সরকারের গত ৬ মাসে তা প্রমাণ হয়েছে। বিএনপি ও ১৯ দলীয় জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলে তার রাজনৈতিক জনসভার ভাষণে সরকারকে যথাশিগগির রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যথায় ঈদের পর হরতাল-অবরোধসহ অসহযোগ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।এই ঘোষনার সাথে বিরোধীদল কতটুকু সম্পৃক্ত তা তারা-ই ভাল জানে। তবে বিএনপিকে ভাবতে হবে বর্তমান সরকারের এই একগুয়েমি সরকার গঠনের জন্য বিএনপি-ই পথ দেখিয়েছে।এদেশের মানুষ এখন আন্দোলনের নামে অরাজকতা চায় না।বিরোধীদলকে এখন সংসদে গিয়েই তাদের মোকাবিলা করতে হবে।বিএনপি যেহেতু বিরোধীদলে নেই সেইহেতু জন গনের আস্হা অর্জনের টেকনিক অবলম্বন করে সামনে এগুতে হবে।বাংলাদেশে একদলীয় বা একপাক্ষিক নির্বাচন অতীতেও আরো অন্তত ৩ বার হয়েছে। ১৯৮৬ সালে এরশাদের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করার পরও সরকার ২ বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ কোন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিকদল অংশগ্রহণ না করলেও এরশাদ সরকার আরো ২ বছর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। এরশাদের প্রতি জনসমর্থন ছিল না, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জনপ্রত্যাশার অনুকূলে কঠোর অবস্থানের কারণেই সম্ভবত সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল বিএনপি ১৯৯১ সালের প্রথম মুক্তগণতান্ত্রিক সংসদ নির্বাচনে জনগণের মেন্ডেট পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। আর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তা রক্ষাও করেছিল। সম্ভবত খালেদা জিয়ার সেই রাজনৈতিক কমিটমেন্টের কারণেই ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিল। পনের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ব্যতিক্রম বাদ দিলে, ১৯৯০ সালের পর নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই বিরোধীদল ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতাসীনদের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির নামকাওয়াস্তের নির্বাচনে এই ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটেছে। দেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে জনগণকে ক্ষমতাহীন করার নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন। জনগণের ক্ষমতায়নই গণতন্ত্রের মূলকথা। জনগণকে ক্ষমতাহীন করে, বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলোকে র্যা ব-পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে নিরাপদ রাখার পথ গণতান্ত্রিক পথ নয়। এর মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বা জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিকদলগুলোর অন্যতম। কিছুদিন পূর্বে পেরিয়ে গেল আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দিনভর আষাঢ়ি বৃষ্টিতেও আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকির সমাবেশ করেছে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্টট পার্টিসহ আওয়ামী লীগের সমবয়েসী বা তার চেয়ে বেশি বয়েসী রাজনৈতিক দলও বাংলাদেশে আছে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার আওয়ামী লীগ সুর্দীঘ ৬৫ বছর ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান অংশীদার হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাসের ভিন্ন ধারায় প্রবেশ করে দলটিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যা ইতিহাস বিচার করবে। আওয়ামী রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক প্রবীণ কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী তার সাম্প্রতিক এক কলামে আওয়ামী লীগকে ‘পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো বটগাছ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, যার শিকড়ে পচন ধরেছে। এই পচন ঠেকানো সম্ভব হলে বুড়ো বটগাছে হয়তো নতুন পাতা গজাবে, তা-না হলে টাইটানিকের পতনের মত কিছুটা সময় লাগবে, তবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পতন অনির্বায বলে গাফফার চৌধুরী মনে করেন। বড় বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে সরকার অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে যাচ্ছে। নতুন সরকারের শুরু থেকেই একশ্রেণীর মন্ত্রী-এমপি জনরোষের ভয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও যেতে পারেন না। আওয়ামী লীগের মত একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল সংসদে তিন-চর্তুথাংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় থাকাবস্থায় যদি এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানে ব্যর্থ হলে শুধু ক্ষমতা থেকে পতন নয়, রাজনৈতিক পতনও অস্বাভাবিক নয়। ইতিহাসে এরকম নজির কম নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে একটি অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছিলেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সেই ভূমিকা বা প্রত্যাশা থেকে সরে যায়নি। একইভাবে দেশের জনগণ এবং বিরোধীদলগুলোও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি থেকে একচুলও সরে যায়নি। কিন্তু সরকার দেশি-বিদেশি চাপ বা বিরোধীদলের আন্দোলনের হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছে না বলেই ধরে নেয়া যায়। তারা হয়তো আবারো ধরপাকড় করে, নতুন মামলা দিয়ে, পুরনো মামলায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের আটক করে আন্দোলন দমনের কৌশল গ্রহণ করবেন।সরকার যদি এই কৌশল অবলম্বন করেন সেটা সমিচীন হবে না বলে বিশ্বাস অনেকের। নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলা হলেও, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সারাদেশ থেকে রাজধানী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতির হার বিরোধীদলের আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দাবি অস্বীকার করা যাবে না। আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটানো যায়নি, পাশাপাশি নতুন সরকার রাজনৈতিক লেজিটিমেসি অথবা জনগণের আস্থাও অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু দেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্ভাবনা থেকে বহুপথ পিছিয়ে পড়েছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অচলাবস্থা, গার্মেন্টস খাতে পিছিয়ে পড়া, জিএসপি সুবিধা বাতিল, পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতাদের ঋণ সহায়তা প্রত্যাহার এবং বিদেশী বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনাও অনেক দূরে সরে গেছে। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অভাবে ইতিমধ্যে দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে দেশে নতুন করে হরতাল-অবরোধ শুরু হলে আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে হয়। এমনিতেই দেশে গুম, অপহরণ ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের আতঙ্ক গ্রাস করেছে। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে তা বাংলাদেশের সকল সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দেশের জন্য এতবড় ঝুঁকি নিয়ে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, এটা দেশের মানুষ ভাবতে পারে না। বাংলাদেশের যে কোন সরকার গনবিচ্ছিন্ন হলে তার পরিনতি যে ভয়াভহ তা তারা দেখিয়ে দিয়েছে বার বার।রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সরকার,বিরোধীদল ও জনগনের একনিষ্ঠ কাজ করা ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।ক্ষমতায় এসে ক্ষমতার অপব্যাবহার করে কালো টাকার মালিক হওয়া ও বিদেশে টাকা পাচার করার মাধ্যমে চিরন্তন দলীয় নেতৃত্ব স্হাপন করা যায় না বরং সততা ও দৃড় নৈতিকতার সাথে তৃনমূল থেকে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারলে দীর্ঘ পর হলেও জনগন প্রকৃত গনতন্ত্রের স্বাধ ও আশা আকাংখার আশা করতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন