মধ্যরাতের টিভি চ্যানেলগুলোতে শিষ্টজনের অশিষ্ট আচরন জনগনকে ভাবিয়ে তুলছে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২৮ মে, ২০১৪, ০৮:৫৫:২৮ রাত

বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলেই পরিচয়। অর্থাৎ আমগাছে আমই ধরে, জাম না। আর জামগাছে জামই ধরে, জামরুল নয়। কিন্তু টিভি নামক বিবিধ নামের বৃক্ষকুলের ফুল ও ফল দেখে কোনটা কোন টিভি, সেটা চেনা খুবই কষ্টকর। আমাদের দেশে চ্যানেলের সংখ্যা যতই বাড়ছে, আশঙ্কাজনকভাবে ততই কমছে চ্যানেলের মান।আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ইদানীং বিভিন্ন রিয়েলিটি শোর চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে টক শো। এর মধ্যে কিছু কিছু টক শো বেশ বিনোদনমূলকও বটে। রাজনৈতিক কিংবা বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু বা সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনার অনুষ্ঠানকে এখন আর তেমনভাবে ‘আলোচনা অনুষ্ঠান’ বলা হয় না, বলা হয় ‘টক শো’ ।স্যাটেলাইট টেলিভিশন আসার পর এই ‘টক শো’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ইতিবাচক দিক।

একসময় দেশে একটি মাত্র টেলিভিশন ছিল, অর্থাৎ বিটিভি। এ প্রচারযন্ত্রটি সব সময়ই থাকে সরকারনিয়ন্ত্রিত। সেদিক থেকে সব দল ও মতের ব্যক্তিদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট টেলিভিশন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যে যা বলতে চাইছেন, যে যা ভাবছেন, যে যেই আদর্শে বিশ্বাসী, যে যেই দল করেন—সবাই সবার কথা মন খুলে এসব টক শোয় বলতে পারেন। যাঁর যা খুশি মন-প্রাণ খুলে, এমনকি হাত-পা ছুড়েও বলা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, দুই পক্ষের ঝগড়া চলছে, অথচ অনুষ্ঠানের সময় শেষ। তখন সঞ্চালক বাধ্য হয়ে ওই অবস্থাতেই অনুষ্ঠান শেষ করছেন। আবার দেখা যায় ভীন্নমতের দু'জন যুক্তি দিতে গিয়ে মারামারি করার অবস্হায় চলে যান আর সন্চালক অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হন। স্বাধীন মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ করাটা যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি কথা বলার স্বাধীনতা পেয়ে যে যা ইচ্ছা তা-ই বলবেন (প্রচার-অযোগ্য), সেটাও কাম্য নয়। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি যদি অন্যজনকে চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ ও মিথ্যুক বলে গালি দেন, তাহলে আগামী প্রজন্ম এ থেকে কী শিক্ষা নেবে? আবার সিভিল সোসাইটির কেউ কেউ যখন একজন আরেকজনকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন, তখন সিভিল আর আনসিভিল অর্থাৎ শিষ্ট ও অশিষ্টর পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।মোটকথা টক শোটি এখন একটা ব্যাবসায় পরিনত হয়েছে।শুনেছি এ সব গনমাধ্যমে কেউ কেউ আসার জন্য পরিচালকদের সাথে সুসম্পর্ক ও করেন যাতে তারা তাদের নৈপুন্য দেখাতে পারেন।

টেলিভিশনের টক শোগুলোয় যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ আলোচকেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে তাঁরা কে কী বলবেন, তা দর্শকমাত্রই জানেন এবং বোঝেন। মুখে আমরা যতই নিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ বলে দাবি করি না কেন, কিছু কিছু টক শোয় আলোচক নির্বাচন, সঞ্চালকের প্রশ্ন ও আচরণ দেখলেই তাঁদের পক্ষপাতমূলক আচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু কিছু টক শোয় দেখা যায়, দুজন আলোচক এক পক্ষের, আরেকজন থাকেন অন্য পক্ষের। আর সঞ্চালকও থাকেন ওই দুজনের পক্ষে। ফলে টক শো চলাকালে ভিন্নমতের একজনের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ লক্ষ করা যায়। যে কারণে টক শোগুলোয় অনেক সময় অনেক বক্তাকে সঞ্চালকের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি এত কথা বলছেন কেন? আপনি তো সঞ্চালক। আমাকে কথা বলতে দিন কিংবা বলতে না দিলে ডেকেছেন কেন?’ ইত্যাদি।

টিভি চ্যানেলের মতো আজকাল কিছু পত্রিকার কলাম লেখকদের নাম ও শিরোনাম দেখলেই বোঝা যায়, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস কী এবং উপসংহারে তিনি কী বলবেন। সবচেয়ে বড় কথা, দর্শক ও পাঠকেরা সবই বোঝেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ‘সবাই যে বোঝেন, সেটা এঁরা বোঝেন

না।’ দর্শকেরা চ্যানেলের কাছ থেকে দল নয়, দেশের কল্যাণ ও শান্তির স্বার্থে নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ভূমিকা আশা করেন।ফুটবল খেলায় যিনি মোহামেডান সমর্থন করেন, তাঁকে যেমন কখনো আবাহনীকে সমর্থন করানো যাবে না। আবার ক্রিকেটে যিনি যে দল সমর্থন করেন, তিনি কখনোই অন্য দলকে সমর্থন করেন না। ভারত বা পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমর্থকদের বেলায় এ কথা বেশি প্রযোজ্য। তেমনি বাংলাদেশে যে যেই দল কিংবা পার্টি সমর্থন করুন না কেন, কোনো যুক্তি দিয়েই তাঁকে অন্য দল সমর্থন করানো যাবে না। এসব সমর্থকের সবাই নিজ নিজ দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী। তবে রাজনৈতিক বিশেষ সুবিধা কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের শর্তে কিছু ব্যক্তির দলীয় বিশ্বাস ও সমর্থনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে। যে কারণে দল বদল কিংবা দল ত্যাগ হয়।

বেশ কিছুদিন আগে একটি টক শোয় একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা তাঁর আলোচনার একপর্যায়ে বলেই ফেললেন, তিনি যা বলছেন, তা কারও পছন্দ হোক বা না হোক, তাঁর কিছু করার নেই। কারণ, তাঁকে দলীয় অবস্থান থেকেই কথা বলতে হবে। অর্থাৎ তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা বা মতামত বলে কিছু নেই।এরা তাদের মাথা দলের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন।মহানেতা বা নেত্রী যদি এদের বলেন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে তাদের আর না বলার উপায় থাকে না।এই যে ধামাধরা নেতা নেত্রি যারা সাংসদ নির্বাচিত হলেন তারা সংসদে গিয়ে জন গনের জন্য কি নিয়ে আসবেন? গুম খুনের কারবার দেশে যারা করে তারা এদের ছত্র ছায়ায় থাকে যা আজকের সমাজিক দুর্ঘটনা গুলো থেকে প্রতিয়মান হয়। টক শোয় মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি আসেন, যাঁদের কোনো দল নেই, তেমনি দলীয় বলও নেই; কিন্তু দেশের প্রতি আছে ভালোবাসা, আছে মমত্ববোধ, আছে সৎ সাহস। তাই নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে পারেন। তাঁদের কথা শুনতে ভালো লাগে। মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। কিছুদিন আগে এক টিভি দর্শক একটি চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আচ্ছা ভাই, আপনারা মিডিয়ায় এই দুই দলের লোকদের না ডেকে দেশের উন্নতি-অগ্রগতির লক্ষ্যে বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের ডেকে আলোচনা করাতে পারেন না? তাতে দেশের মানুষ উপকৃত হবে।’ আপনারা মিডিয়ায় এসব আলাপ কমিয়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন সম্ভাবনা, সমস্যা ও এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক মেধাবী মানুষ টেলিফোনের মাধ্যমে সরাসরি অনেক পরামর্শ দিতে পারেন। তখন দেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা শুরু হবে। গন মাধ্যমগুলো এসব দিকগুলো হাইলাইট করলে দেশের উন্নতি হয়,সমাজিক যে অবক্ষয় হচ্ছে তা থেকে মানুষ রাহাই পায়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছু শব্দ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন গুম - খুন, সংঘাত, সংঘর্ষ, সাংঘর্ষিক, রণপ্রস্তুতি, রণক্ষেত্র, অনিশ্চয়তা, ধরপাকড়, তল্লাশি, হুমকি, বোমা বিস্ফোরণ, ফোনালাপ, সংবিধান ইত্যাদি। আরও কথা প্রায়ই শোনা যায়—ব্যাপক প্রস্তুতি, জিরো টলারেন্স। ব্যাপক প্রস্তুতি কথাটি ব্যবহূত হয় কর্মসূচি পালন কিংবা সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে। আর জিরো টলারেন্সের বিষয়টি তো সবার জানা। আবার তাঁরাই বলছেন, জনগণের জন্যই তাঁরা সব বলছেন, সব করছেন। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। এসব শব্দের পরিবর্তে সম্ভাবনা, অগ্রগতি, উন্নয়ন ও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার মতো কথা বেশি শুনতে পেলে ভালো লাগত। অবশ্য কে কোন উদ্দেশ্যে কী লিখলেন কিংবা টক শোয় কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে কী বললেন, তা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ততটা চিন্তিত নন। কারণ, গ্রামগঞ্জের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সারা দিনের কর্মক্লান্তির পর সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়েন।

আজকাল তো শহরের অনেকেই আছেন, যারা সূর্য যে পূর্বদিকে ওঠে, সেটাই দেখেন না। কারণ, সারা রাত জেগে তাদের অনেকেই ঘুমাতে যান শেষ রাতে, ওঠে দুপুরের পরে। তাদের অনেকেই শীতের সকালের শিশিরসিক্ত ঘাস দেখেননি, দেখেননি পুকুরের মাছ। তারা ঘাসে হাঁটে না, হাঁটে ঘরের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে। সুতরাং সাধারণ পা-ফাটা মানুষের সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যে যা-ই বলি না কেন, যত যুক্তি-তর্কই উপস্থাপন করি না কেন—সাধারণ মানুষ দেখে, কখন তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে, কখন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, সস্তায় চাল-ডাল কিনে পরিবারের সবার জন্য দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে।

আজকাল বিভিন্ন টক শোয় দেখা যায়, সংবিধানের নানা অনুচ্ছেদসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন, বিশ্লেষণ করছেন। এ ক্ষেত্রে পত্রিকার মতো টেলিভিশনেও ভুল তথ্য প্রচারের জন্য সংশোধনী প্রচার করা উচিত। প্রয়োজনে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়ার বিধান থাকা উচিত। অন্যথায়, যখন যাঁর যা খুশি, তা-ই বলতে থাকবেন। তাই বলে বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটাও যৌক্তিক নয়। এ জন্য একটি স্বচ্ছ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এর বাইরেও প্রতিটি চ্যানেলের নীতি-নির্ধারকদেরও তাঁদের টেলিভিশনে কী প্রচারযোগ্য আর কী প্রচার-অযোগ্য, সেটা কঠোরভাবে নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আমরা বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে কিংবা অফিসে বসে যে ধরনের আলোচনা বা ঝগড়া-বিবাদ করি, সেটা টেলিভিশনে করাটা শোভন নয়। যেহেতু টেলিভিশন দেখে অনেকেই প্রভাবিত হন, আবার অনুপ্রাণিতও হন। তাই টেলিভিশনে প্রদর্শিত এ ধরনের আচরণ কারও কাছে উদাহরণ হোক, সেটা কাম্য নয়।

বিষয়: বিবিধ

১২২১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

227653
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৯:৩০
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : মধ্যরাতের টকশোতে সকল পক্ষের লোক হলে তখন আলোচনা সঠিক পথে চলবে নয়তো এগোলো ফালতু। ভালো লিখেছেন ধন্যবাদ
227664
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৯:৫৩
বুঝিনা লিখেছেন : তাদের অনেকেই শীতের সকালের শিশিরসিক্ত ঘাস দেখেননি, দেখেননি পুকুরের মাছ। তারা ঘাসে হাঁটে না, হাঁটে ঘরের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে। সুতরাং সাধারণ পা-ফাটা মানুষের সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। Thumbs Up ^Happy^ ^Happy^
227672
২৮ মে ২০১৪ রাত ১০:০৫
ভিশু লিখেছেন : ভালো বিশ্লেষণ এবং দৃষ্টি আকর্ষণ!
227698
২৮ মে ২০১৪ রাত ১০:৩২
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লিখটির জননো
227784
২৯ মে ২০১৪ সকাল ০৫:৫১
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File