বাঙালি মুসলিমের এত ব্যর্থতা কেন?
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৩ মার্চ, ২০১৪, ০২:১০:২৪ দুপুর
এই পৃথিবীর কাজ সফলতা ও বিপলতাকে ঘিরে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মুসলিম জাতির একটা বর্নাঢ্য ও ঐতিহ্যপুর্ন ইতিহাস থাকা স্বত্বেও কেন মুসলিম সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এর কারন হিসেবে বলা যায় মুসলিমরা তাদের মুল পথ থেকে অসংখ্য বাঁকা রাস্তা অবলম্বন করার কারনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। মুসলিম মনিষীরা যুগে যুগে পথ দেখিয়ে চলছেন কিন্তু মুসলিম শাসকরা যদি তা অনুসরন করতে ব্যার্থ হন ও এই রোগগুলো চিহৃিত করে বিনাশ করতে না পারেন তাহলে অচিরেই এই মুসলিম জাতি একটি ব্যার্থ জাতিতে পরিনত হবে এবং তা মুসলিম সমাজ দেখলেই সহজে প্রতীয়মান হয়।
মূল রোগটি কী?
অসুস্থ দেহে নানা ধরনের রোগভোগ ও ব্যথা-বেদনা থাকে। শুধু দুর্ভোগ ও যাতনাই নয়, কোনো কোনো ব্যাধি দ্রুত প্রাণনাশও ঘটায়। অসুস্থ জনগোষ্ঠীর জীবনেও তেমনি দ্রুত ধ্বংস বা বিপর্যয় ডেকে আনে কিছু গুরুতর সামাজিক ব্যাধি। ডেকে আনে মহান আল্লাহর গজবও। সে ধ্বংস বা গজব থেকে বাঁচতে হলে চিকিৎসকদের মতো রাষ্ট্রনায়কদের দায়িত্ব হলো জাতিধ্বংসী সে মূল রোগটিকে দ্রুত শনাক্ত করা ও চিকিৎসা করা। প্রশ্ন হলো, বাঙালি মুসলমানের জীবনে সে মূল রোগটি কী? ক্যানসার নানা ধরনের লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়। এ রোগে যেমন ক্ষুধা লোপ পায়, তেমনি শক্তি ও ওজনও কমতে থাকে। শরীরে লাগাতার ব্যথা-বেদনাও দেখা দেয়। তবে মূল রোগটি ব্যথা-বেদনা, ওজনহ্রাস বা শক্তিহানি নয়, বরং সেটি হলো ক্যানসার। ফলে ব্যথা-বেদনা, ওজনহ্রাস বা শক্তিহানি সারাতে হলে ক্যানসারের চিকিৎসায় হাত দিতে হয়। তেমনি অসুস্থ জাতির জীবনেও মিথ্যাচার, ব্যভিচার, দুর্বৃত্তি, সন্ত্রাস, খুন-গুম, লুটতরাজ ও নানা ধরনের কুকর্মগুলো মূল রোগ নয়, বরং সেগুলো হলো মূল রোগের উপসর্গ। মূল রোগটি হলো জ্ঞানহীনতা। ইসলামের পরিভাষায় এটি জাহেলিয়াত।
অজ্ঞতাই যে সব ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্যহানির মূল কারণ এবং সেটি যে জাহান্নামের পথে টানার শয়তানি কৌশল—সে রায়টি কোনো ব্যক্তির নয়, বরং মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার। অজ্ঞতার কারণে চেতনার ভুবনে তখন সৃষ্টি হয় ঘন কালো অন্ধকার, সে অন্ধকারের কারণেই মানুষ পথ হারায় এবং জাহান্নামে পৌঁছে। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা বাক্কারার ২৫৭ আয়াতে বলেন, আল্লাহ তাদের পৃষ্ঠপোষক যারা ঈমান এনেছে,তিনি অন্ধকার থেকে তাদের আলোতে বের করে আনেন।আর যারা অবিশ্বাস পোষন করে তাদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে তাগুত,তারা আলোক থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।তারাই হচ্ছে আগুনের বাসিন্দা,তারা তাতে থাকবে ধীর্ঘকাল।' এখানে আলোকিত পথটি হলো কোরআনি জ্ঞানের। শয়তানসৃষ্ট অন্ধকারটি হলো জ্ঞানহীনতার। সে জ্ঞানহীনতাটি মহান আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত ওহির জ্ঞান না থাকার। ইসলামের মূল লড়াইটি তাই অজ্ঞতা হটিয়ে ওহির জ্ঞানে বিশ্বকে আলোকিত করার। এ নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন সূরা আনফালের ৮ আয়াতে এভাবে, ‘তিনি সত্যকে সত্য প্রতিপন্য করেন ও মিথ্যাকে বাতিল করে দেন, যদিও অপরাধিরা অপছন্দ করে।' একমাত্র ওহির জ্ঞানই দেয় জান্নাতের সঠিক পথটি খুঁজে পাওয়ার জ্ঞান। সে জ্ঞানের অভাব দেখা দিলে মানুষ নানা ধরনের ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক রোগ নিয়ে বেড়ে ওঠে। বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে বা বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীলতায় সে রোগ থেকে মুক্তি ঘটে না। পিরামিডের নির্মাতারা ফেরাউনকে খোদা বলেছে তো সে অজ্ঞতার কারণেই। একই কারণে, শত কোটির বেশি মানুষের মাঝে মূর্তিপূজা আজও বেঁচে আছে এবং এখনও দেবতারূপে গণ্য হয় গরু-বাছুর। এ ধরনের পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তায়ালা নামাজ-রোজার আগে ওহির জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। দেহের খাদ্য গাছপালা, কীটপতঙ্গ এবং পশুপাখিও জোগাড় করতে জানে, এজন্য নবী-রাসুলের প্রয়োজন পড়ে না, আসমান থেকে ফেরেশতা নেমে আসারও প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু জান্নাতের পথ খুঁজে পাওয়া ও সুস্থ চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য যে জ্ঞান সেটি একমাত্র ওহির জ্ঞানেই পাওয়া যায়। এজন্য মানবসৃষ্টির পর অপরিহার্য হয় নবী-রাসুলে প্রেরণ এবং প্রথম মানুষটি নিজেও ছিলেন একজন নবী। মুসলমানদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যে সভ্যতাটি নির্মিত হয়েছিল, তার মূলে ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত ওহির এই জ্ঞান। সে জ্ঞানের বলেই আরবের আদিম বর্বরতা থেকে তারা মহামানবের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যবাসী ক্ষেত-খামার বা কলকারখানায় উৎপাদন বাড়ালেও ওহির জ্ঞানের অভাবে মানবতায় সমৃদ্ধ মানুষ গড়তে ব্যর্থ হয়েছে; ফলে ব্যর্থ হয়েছে মানবিক সভ্যতা গড়ায়, বরং বাড়িয়েছে অসভ্যতা। সভ্যতার যে দেশ এমেরিকা ,কানাডা ,ফ্রান্স ও ইটালি সহ অন্যান্য উন্নত দেশগুলোকে বলা হয় সেখানের চিত্র দেখে কি তাদের সভ্য বলা যায়? এমেরিকাতে প্রতি এক মিনিটে একটি ধর্ষন ও কানাডাতে প্রতি তিন মিনিটে একটি ধর্ষন সংঘঠিত হয়। সে অসভ্যতার প্রমাণ শুধু উলঙ্গতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও সমকামিতা নয়, বরং সেটি বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন, গণহত্যা ও সম্পদের বিনাশে। মাত্র বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধেই তারা সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। বিনাশ করেছে বিপুল সম্পদ, যা দিয়ে বহু শত বছরের জন্য গোটা মানবজাতির পানাহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেত। তারা উত্সবভরে নির্মূল করেছে আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের। নিরস্ত্র মানুষের ওপর ড্রোন নিক্ষেপ ও গণহত্যা এখনও শেষ হয়নি।
যে ফরজটি পালিত হয়নি -
ওহির জ্ঞান প্রতিষ্ঠা না পেলে অসম্ভব হয় রাষ্ট্রে বা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা। ওহির জ্ঞান ছাড়া শান্তি আসতে পারে, এমনটি বিশ্বাস করাই মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে বেঈমানি। ঈমান তো হলো আল্লাহ তায়ালার নাজিল করা কোরআনি বিধানের প্রতি অটল আস্থা নিয়ে বেড়ে ওঠা। এখানে সামান্যতম আপস চলে না। যে রাষ্ট্রে সে বিধানের প্রয়োগ নেই, সে রাষ্ট্র ইতিহাস গড়ে ব্যর্থতায়। সেইসঙ্গে ভয়ানক ব্যর্থতা দেয় পরকালে, সেটি জাহান্নামের আগুনে পৌঁছিয়ে। ওহির জ্ঞানার্জন এজন্যই ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। এ ফরজটি পালিত না হলে অন্যান্য ফরজ পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের জীবনে জ্ঞানার্জনের ফরজটি যথার্থভাবে পালিত হয়নি। এটিই বাঙালি মুসলমানের মূল রোগ। এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে অন্যান্য ব্যর্থতা। এ মূল রোগটির চিকিৎসা নিয়ে যে শুধু অবহেলা হয়েছে, তা নয়। এ ঘাতক রোগটি যে তাদের মধ্যে প্রবলভাবে বাসা বেঁধে আছে, সেটি জানতেও তারা আগ্রহ দেখায়নি। অথচ মানবসৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান সন্তান-সন্ততি বা ধনসম্পদ নয়, সেটি হলো পবিত্র কোরআন। কোরআনের মাধ্যমেই মহান রাব্বুল আল-আমিন তার বান্দার সঙ্গে কথা বলেন। মানুষকে তিনিই জান্নাতের পথ দেখান এবং রক্ষা করেন জাহান্নামের আগুন থেকে। চলার পথে এটিই একমাত্র সঠিক পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকিম। মানুষের এ মহা উপকারটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্য কোনো শাখা কি করে? বিজ্ঞানীরা বিস্ময়কর যন্ত্র আবিষ্কার করেন, ভোগের আয়োজনও বাড়ান, কিন্তু জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার পথ কি দেখান? সে মহাকল্যাণটি করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সে সামর্থ্যটি একমাত্র তাঁর। মহান আল্লাহ তায়ালার নিজের ভাষায়, ‘ইন্না আলায়নাল হুদা।’ অর্থ : নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্বটি আমার।’ প্রদর্শিত সে পথটি হলো পবিত্র কোরআনের পথ। মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এটিই হলো সবেচেয়ে বড় দান। এ দানটি না জুটলে জাহান্নাম জোটে। তাই মুমিনের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া বা সর্বশ্রেষ্ঠ চাওয়াটি ধনসম্পদ বা সন্তান-সন্ততি চাওয়া নয়, বরং সিরাতুল মুস্তাকিম চাওয়া। ‘এহদিনাস সিরাতুল মুসতাকিম,’ অর্থাৎ সিরাতুল মুস্তাকিম দেখাও হে করুণাময় মহান আল্লাহ। এ দোয়াটিও তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি নামাজে সে দোয়াটি পাঠ করতে হয়। বান্দার সে চাওয়াটি পূরণ করতেই মহা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন। তাই কোরআনের জ্ঞান ছাড়া কি সিরাতুল মুস্তাকিম পাওয়া যায়? ভাবা যায় কি জান্নাতপ্রাপ্তির কথা? সম্ভব কি মুসলমান হওয়া? ঈমানের মূল পরিচয়টি তো সিরাতুল মুস্তাকিমে পথচলার মধ্যে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি কোরআনে বর্ণিত সিরাতুল মুস্তাকিমটি জানতেই চেষ্টা করল না এবং কোরআন বোঝার সামর্থ্যই অর্জন করল না, সে ব্যক্তি সে পথটি পাবে কিভাবে? মানবজীবনের এটিই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মানুষ তখন ভ্রান্ত পথ অনুসরন করে, শ্রম দেয় এবং অর্থ ও প্রাণ দেয়। অতিশয় বেঈমান ও দুর্বৃত্তরাও তখন জাতির নেতা বা পিতার মর্যাদা পায়। তখন মুসলিম ভূমিতে জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, স্বৈরাচারী, ফেরকাবাদী, রাজতন্ত্রী ও সেক্যুলারিস্ট,মুসলিম দলের বিভক্ততা, বিদা'আতি পথভ্রষ্টতা ও তাদের অগণিত সমর্থক বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই কোরআনি জ্ঞানের আলেম হওয়া শুধু মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার শিক্ষকদের কাজ নয়, সেটি ফরজ প্রতিটি মুসলিম নরনারীর ওপর। নইলে সে ব্যক্তির মুসলমান হওয়াটিই বিপদে পড়ে। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা : ‘ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহি উলামা’ অর্থ : সমগ্র মানবসৃষ্টির মাঝে একমাত্র (ওহির জ্ঞানে) আলেমরাই আমাকে ভয় করে।’ অর্থাৎ মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি তথা ঈমান সৃষ্টির জন্য আলেম হওয়াটি পূর্বশর্ত। এছাড়া ভিন্ন পথ নেই। তাই নবী করিম (সা.)-এর আমলে এমন কোনো সাহাবি ছিলেন না যিনি কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু ক’জন বাঙালি মুসলমানের সামর্থ্য আছে সে কোরআন বোঝার? আজকের বাংগালি মুসলিমদের ঘরে কুরআনের কোন চর্চা নেই, দায় সারা ভাবে ইসলামিক কাজ কর্ম চলছে সমাজে আর নির্ভর করছে মসজিদের ঈমামদের উপর যাদের অধিকাংশ জিম্মি হয়ে আছে ফিরাউন রুপি ফাসেক মুতাওয়াল্লির কাছে। শরিয়তের বিধিবিধান প্রতিটি মুসলিমের জীবনে জারি করা যে জরুরি তা তারা ভুলে গেছে দুনিয়াকে ভালবাসার কারনে। অথচ কোরআন বোঝার সে সামর্থ্যটি অর্জনের তাগিদেই মিসর, সুদান, মরক্কো, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেনসহ বহু দেশের জনগণ মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবি ভাষাকে নিজেদের ভাষারূপে গ্রহণ করেছিল। অথচ নিছক চাকরি-বাকরি ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কোটি কোটি বাঙালির কাছে ইংরেজি, হিন্দি, ফরাসি, এমনকি চায়নিজ ভাষার মতো ভাষা শিক্ষাগুরুত্ব পেলেও কোরআনের ভাষা ও কোরআন শিক্ষা কি গুরুত্ব পেয়েছে? গুরুত্ব না পাওয়ার কারণ, অর্থলাভ ও চাকরিলাভ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, সেরূপ গুরুত্ব আল্লাহর হুকুম পালন ও মুসলমান হিসেবে বেড়ে ওঠাটি পায়নি। মহান আল্লাহর কাছে কি এ অবহেলার জবাব দিতে হবে না? কোরআনের যে পাঠটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাধ্যতামূলক করলেন সেটি পালন না করায় কি মহান আল্লাহর করুণা বাড়বে? ১৯ কোটি বাঙালি মুসলমানের ক’জন জীবনে অন্তত একবার মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান পবিত্র কোরআন অর্থসহ একবার পড়ার চেষ্টা করেছে? ক’জন চেষ্টা করেছে কোরআনের ভাষা শিক্ষার? পথচলাটি সঠিক পথে না হলে প্রতিকদম চলায় বিপদ বাড়ে। সে বিপদ থেকে বাঁচতে হলে পদে পদে রোড-ম্যাপটি দেখতে হয়। সেজন্য জরুরি হলো রোড-ম্যাপটি পড়া ও বোঝার সামর্থ্য। কিন্তু সে সামর্থ্য আছে ক’জন বাঙালি মুসলমানের? ফলে তাদের জীবনে বেড়েছে সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে লাগাতার ভ্রষ্টতা। বেড়েছে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বাড়েনি আল্লাহর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ। বাংলার মুসলিম জনপদে এজন্যই তো এত খুন-গুম, এত ব্যভিচার ও এত অশ্লীলতা এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অসংখ্য সুদি ব্যাংক, পতিতাপল্লী ও কুফরি আদালত। একটি জনগোষ্ঠী যে কতটা বিকটভাবে পথভ্রষ্ট, এগুলো তো তারই পরিমাপ করে দেয়। এ পথভ্রষ্টতা যে জাহান্নামে পৌঁছার সোজা পথ, সে হুঁশই বা আছে ক’জনের?
মিথ্যাচার যেখানে ক্রিয়েটিভিটি-
গড়ার কাজে শর্ত হলো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সর্বপ্রথম শুরু করতে হয়। প্রাসাদ গড়তে হলে তাই ভিতটি প্রথমে গড়তে হয়। তেমনি উচ্চতর সভ্যতা গড়ার কাজে মানুষ গড়াকে প্রায়োরিটি দিতে হয়ে। মানুষ গড়ার সে কাজটি শুরু করতে হয় কোরআনের জ্ঞানার্জন দিয়ে। সে জ্ঞান দিয়েই নির্মিত হয় ব্যক্তির তাকওয়া ও চরিত্র। নবীজী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে তাই প্রাসাদ, পিরামিড বা তাজমহল গড়ার চেয়ে প্রায়োরিটি পেয়েছিল কোরআনি জ্ঞানের প্রসার। ফলে সে আমলে কোরআনি জ্ঞানের যত আলেম সৃষ্টি হয়েছেন, তা আর কোনো কালেই হয়নি। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটির শুরু প্রথমে যেমন হয়নি, পরেও হয়নি। বরং সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির নামে যা হয়েছে তা হলো নিরেট মিথ্যাচার। কোরআনের তাফসির, হাদিসগ্রন্থ, নবীচরিত্র, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, গবেষণাগ্রন্থের চেয়ে বহুগুণ বেশি লেখা হচ্ছে কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। দেশে এগুলোই বেশি বিক্রি হয়। চেতনায় পুষ্টির বদলে এগুলো বিষই বেশি ছড়াচ্ছে। বিষ ব্যবসায়ীদের সে মিথ্যাচারকে বলা হয় ক্রিয়েটিভিটি। প্রশ্ন হলো, মিথ্যুকের মিথ্যা থেকে গল্প, উপন্যাস বা কবিতায় যে মিথ্যার জাল বোনা হয় তার পার্থক্যটি কোথায়? বঙ্কিম চন্দ্র উপন্যাসের নামে মিথ্যার জাল বুনেছিলেন মুসলিম চরিত্র হননে। রবীন্দ্রনাথও সৃষ্টিশীলতার নামে দরিদ্র মুসলিম প্রজা অসিমদ্দিনকে হিন্দু জমিদারের জারজ বানিয়েছেন। আর আজ সেটি হচ্ছে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে।
যে সমাজে মিথ্যানির্ভর এ ধরনের ক্রিয়েটিভিটি ব্যাপকতর হয়, সে সমাজে বেড়ে ওঠে নানা ধরনের নৈতিক বিপর্যয়। এমন ক্রিয়েটিভিটির দোহাই দিয়ে সালমান রুশদি তার ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর মতো শয়তানি মিথ্যাচার রচনা করেছিল মহান আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসুল ও ফেরেশতাদের বিরুদ্ধে। সাহিত্যের নামে সে মিথ্যাকে বিশ্বময় প্রচারের আইনগত বৈধতাও চেয়েছিল। অন্যদিকে নারী-পুরুষের যৌন ক্ষুধায় উত্তেজনা সৃষ্টির লক্ষ্যে গল্প, কবিতা ও উপন্যাসকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের তথাকথিত সাহিত্যিকেরা। সেইসঙ্গে তারা লাগাতার মিথ্যার জাল বুনছে এবং বিষ ছড়াচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির নামে জ্ঞানচর্চা নয়, বরং এ ধরনের মিথ্যা উত্পাদন বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে। বইমেলার নামে সে শিল্পের উত্পাদিত পণ্যের মেলা বসে প্রতিবছর পুরা ফেব্রুয়ারি মাস ধরে। মিথ্যাকে বাজারজাত করার এ বইমেলার পরিসর যতই বড় হচ্ছে, ততই বাড়ছে বাঙালির চারিত্রিক রোগ ও বিপর্যয়। মুসলমানরা অতীতে যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণ করে, তখন কি ক্রিয়েটিভিটির নামে এ ধরনের মিথ্যার জাল বোনা হয়েছিল? লিখিত হয়েছিল কি এ ধরনের গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক? মিথ্যা সর্বত্রই পাপ, সেটি যেমন কবিতায়, তেমনি গল্পে ও উপন্যাসে। ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতার নামে ভয়ানক মিথ্যাচার যেমন সাহিত্য ও শিল্পের ময়দানে হতে পারে, তেমনি হতে পারে ধর্মের ময়দানেও। ধর্মের ময়দানে সে সীমাহীন ক্রিয়েটিভির ফলে সৃষ্টি হয়েছে শত শত ধর্মমত, ফেরকা ও তরিকা। সে সৃষ্টিশীলতায় যেমন নানা অবয়বের লাখ লাখ মূর্তি যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি সেসব মূর্তির নামে প্রচার পেয়েছে নানা ধরনের মিথ্যা কল্পকথা ও উপখ্যান। শয়তানের বড় হাতিয়ার হলো মানবমনের এ ধরনের উর্বর ক্রিয়েটিভিটি। এর ফলে যিশুখ্রিস্ট যেমন আল্লাহর ছেলে হিসেবে প্রচার পেয়েছেন, তেমনি ভগবান পরিণত হয়েছে ফেরাউন, নমরুদ, শ্রীকৃষ্ণ, রাম, গণেশের সঙ্গে বানর, হনুমান, গরুবাছুর, শাপ-শকুন ও আরও কতকিছু। আর গাঁজাখোর উলঙ্গ কাপালিকরা পরিণত হয়েছে পবিত্র ব্যক্তিতে।
কবিরা গুনাহর রাজনীতি-
বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ব্যর্থতাটিও বিশাল। মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দায়ভারটি স্রেফ কলকারখানা প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ডাক যোগাযোগ বা চাকরি-বাকরি দেয়া নয়। মূল দায়িত্বটি হলো আল্লাহর নির্দেশিত সিরাতুল মুস্তাকিমে চলায় ও কোরআনের জ্ঞানার্জনে মুসলিম নাগরিকদের সব ধরনের সহায়তা দেয়া। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রজার সবচেয়ে বড় কল্যাণটি একমাত্র তখনই হয়। প্রজাদের ঈমানদার রূপে বেড়ে ওঠা ও জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনাটি তখন বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তি মেলে জাহান্নামের আজাব থেকে। এ কাজ নবী-রাসুলদের। রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে তাই স্বয়ং মহান নবীজি (সা.) বসেছেন এবং নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর মহান খলিফারা সে আসনে বসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি ঘটেনি। দেশটির শাসনক্ষমতায় ফিরে ফিরে বসেছে ফাসেক মুসলিম শাসকরা, আল্লাহর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করা ,ইসলামপন্থী ও বিরোধীদের হত্যা করা যাদের মিশন। এটিই হলো একটি মুসলিম রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। সাহাবায়ে কেরামের সময় এমন বিদ্রোহ ও অপরাধ হলে মুসলমানরা জিহাদ শুরু করে দিত। এই জিহাদের অর্থ এই নয় যে দেশকে অস্হিতিশীল করে তুলবে।বরং ইসলামপ্রিয় সব মুসলিমকে এক হয়ে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই সরকারের কাছে দাবি দাওয়া যতটুকু সম্ভব আদায় করতে হবে।আল্লাহ সূরা বাক্কারার ২৫৬ আয়াতে বলেন,' ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নেই,নি:সন্দেহে সত্যপথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।' কোন ফাসেক ও জালেম সরকার দেশে বর্তমান থাকলে ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে দাবি দাওয়া আদায় করতে হয়।আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা হলো মানবরচিত সংবিধানের পিছনে যারা ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করছে তাদের সিংহভাগ ইসলমি চরিত্র তথা আক্কিদার ক্ষেত্রে ইয়াতিম।সুতরাং আগে প্রতিটি মুসলিমকে ইসলামি চরিত্র গঠন করতে হবে কুরআন ও হাদিসের আলোকে। শাসনতন্ত্র কায়েম করা অনেক পরের কাজ। ইসলামের সৈনিক তৈরি না হলে কোন ভূখন্ডেই ইসলাম কায়েম সম্ভব নয়। আমাদের দেশে লাখ লাখ আলেম-ওলামা ও মসজিদের দেশে তেমন কিছুই হয়নি কারন হলো কোরানের সেই চরিত্র বর্তমান নেই। দুর্বৃত্ত শাসকদের বিরুদ্ধে তখনি কথা বলতে পারবে যখন গোটা মুসলিম শক্তি এক হতে পারবে। যতদিন মানুষ প্রকৃত দ্বীনি শক্তি অর্জন না করবে,সত্যবাদি না হবে,জীবন থেকে আপরাধ দূর না হবে , নিজেদের এক শক্তিতে রুপান্তরিত না করবে এবং একাকিত্ব ও নীরবতার সাথে জীবন যাপন করবে তত-ই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাবে কবিরা গুনাহর রাজনীতি। মানবরচিত মতবাদের পক্ষের শক্তি শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠা রোধ ও জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোই সে রাজনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে কারন ইসলামি আইন ও মানবরচিত আইন দু'টো-ই একে অপরের পরিপন্থি। তাদের উদ্দেশ্য, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বদলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটি জনগণের সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে। তখন বিপুল সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে জোয়ার আসে কবিরা গুনাহর। তখন সুদভিত্তিক ব্যাংক, বীমা, লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে জুয়া, মদ্যপান, অশ্লীলতা, পতিতাবৃত্তি ও ব্যভিচার। বাড়ে চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, খুন ও নানা ধরনের দুর্বৃত্তি। দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশের বিশ্বরেকর্ড গড়ার হেতু তো এটাই।
বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যায় প্রায় ১৯ কোটি। এর মধ্যে ১৫ কোটির বাস বাংলাদেশে। বাকি প্রায় ৪ কোটি বাস করে ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম ও অন্যান্য রাজ্যে। পশ্চিম বাংলার শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ এবং আসামের প্রায় ৩৫ ভাগই মুসলমান। বহু লাখ মুসলমানের বাস মিয়ানমারের আরাকানে। আরো প্রায় এক কোটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা বিশ্বে। সংখ্যা-বিচারে বাঙালি মুসলমানরা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তৃতীয়। ইন্দোনেশিয়ান ও আরবদের পরই তাদের স্থান। গাছের সংখ্যা বাড়লে ফলের উত্পাদনও বাড়ে। তেমনি জনসংখ্যা বাড়লে শক্তি-সামর্থ্য এবং ইজ্জতও বাড়ে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি, বরং ইতিহাস গড়েছে শক্তিহীনতা, ব্যর্থতা ও অপমানে। সামনে না এগিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত পেছনে ছুটছে। দুর্নীতির দমনের চেয়ে প্রসারে কাজ করছে দেশের সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন। ফলে অপরাধে ছেয়ে গেছে দেশ। দেশ বা জাতির জীবনে ইঞ্জিনের কাজ করে রাজনীতি। সেটি যখন হাইজ্যাক হয় অপরাধীদের হাতে, তখন মসজিদ-মাদরাসায় ফেরেশতাদের বসিয়েও লাভ হয় না। এজন্যই নবীজি ও সাহাবাদের আমলে দেশের সবচেয়ে যোগ্যমান ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসানো হয়েছে। তাই নবীজি (সা.) বেঁচে থাকতে অন্য কাউকে সেখানে বসানো হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইসলামের সে ইতিহাস থেকে কি আদৌ শিক্ষা নেয়া হয়েছে? ফলে গুরুতর প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দেয় আলেমরা বছরের পর বছর ধরে মাদরাসায় কী শেখেন বা শেখান তা নিয়ে।
বিজয়োত্সব শত্রুপক্ষের
প্রতিটি জীবেরই ভাষা থাকে। বাঙালি মুসলমানেরও তেমন একটি ভাষা আছে। বাঙালির প্রচণ্ড গর্ব বাংলা ভাষা নিয়ে। এ ভাষাকে অনেকে আল্লাহর সেরা দানও বলেন। কিন্তু ভাষার কাজ তো শুধু কথা বা ভাবের বাহন হওয়া নয়, জনগণের ঈমান ও চেতনায়ও তাকে পুষ্টি জোগাতে হয়। নইলে মারা পড়ে ঈমান ও মানবতা। রাষ্ট্রে তখন মনুষ্যরূপী পশুর আবাদ বাড়ে, বাড়ে ভয়ানক বিবেকহীনতা। নল বেয়ে যেমন পানি আসে, তেমনি ভাষার মাধ্যমে আসে জ্ঞান। তবে জীবনরক্ষাকারী পানিও ভয়ানক প্রাণনাশী হতে পারে, যদি তা রোগজীবাণুর বাহন হয়। মহল্লায় তখন মহামারী লাগে। তেমনি দূষিত ধ্যানধারণার বাহন হয়ে জনগণের চেতনা রাজ্যে মহামারী আনতে পারে ভাষা। তখন কি সে ভাষাকে আল্লাহর সেরা দান বলা যায়? আল্লাহর সেরা দান তো তখনই বলা যায় যখন সেটি সেরা কল্যাণটি করে। সে সেরা কল্যাণটি তো জান্নাতপ্রাপ্তি। কিন্তু সে সামর্থ্য বাংলা ভাষার কতটুকু? রবীন্দ্রসাহিত্য, বঙ্কিমসাহিত্য, শরত্সাহিত্য বা পুঁথিসাহিত্যে কি সে সামর্থ্য বাড়ে? ১৯ কোটি বাঙালি মুসলিমের চেতনায় পুষ্টির প্রয়োজনটি বিশাল। অথচ আজ থেকে মাত্র ৬০ বা ৭০ বছর আগে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআনের একখানি তর্জমা বা তাফসির গ্রন্থও প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশিত হয়নি কোনো পরিপূর্ণ হাদিস গ্রন্থ। রচিত হয়নি নবীচরিত, ইসলামের দর্শন ও ইতিহাসবিষয়ক কোনো নির্ভরযোগ্য বই। রচিত হয়নি আরবি, ফার্সি বা উর্দু ভাষা শিক্ষার কোনো অভিধান, যা হয়েছে তা তর্জমা। মৌলিক বই লেখার সামর্থ্য ক’জনের? আজ থেকে হাজার বছর আগে আরবি ও ফারসি ভাষা যে মানে পৌঁছেছিল, বাংলা ভাষা আজও সে মানে পৌঁছতে পারেনি। ভাষার এ ব্যর্থতাই বলে দেয়, আগামী প্রজন্ম কোন দিকে যাবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ খাতটি কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিল্প-কলকারখানা নয়, বরং সেটি শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তির খাত। ফলে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার সংখ্যা বাড়লেও দেশবাসীর সুশিক্ষা বাড়েনি। এমন ব্যর্থতার কারণ, বাঙালি মুসলিম গায়ে-গতরে খাটলেও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে সময়, শ্রম ও অর্থের বিনিয়োগ তেমন করেনি। অথচ সন্তান জন্মদানের পর বাবামায়ের বড় দায়িত্বটি শুধু খাদ্য জোগানো নয়, শিক্ষা জোগানোও। পশু থেকে এখানেই মানুষের পার্থক্য। পশু শুধু খাদ্য জোগায়, কিন্তু মানুষকে খাদ্যের পাশাপাশি জ্ঞানও জোগাতে হয়। উন্নত দেশে তাই শুধু ফসলের আবাদই বাড়ে না, বিপুল ফসল ফলে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ পাট-মাছ-চা রফতানি করে যা আয় করে, ইংল্যান্ডের সাড়ে ৫ কোটি মানুষ তার চেয়ে বেশি আয় করে বই বিক্রি করে। একটি জনগোষ্ঠীর আসল পরাজয়টি তো ঘটে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পরাজয়টি বিশাল। এমন একটি পরাজিত ভূমি দখলে শত্রুশক্তির কাছে অস্ত্রযুদ্ধ তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সে কারণে বাংলাদেশ তো যুদ্ধ ছাড়াই শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত একটি দেশ। শত্রুর পক্ষে বরং যুদ্ধটি লড়ে দিচ্ছে মুসলিম নামধারী বিপুল সংখ্যক বিপথগামী সেক্যুলারিস্টরা। এ যুদ্ধটি যেমন কলমের, তেমনি অস্ত্রের। এককালে যারা ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্যরূপে ইরাক ও ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ লড়ে মুসলিম ভূমি ব্রিটিশের হাতে তুলে দিয়েছিল তারাই এখন নিজভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছে। তাই শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠা রুখতে, আলেম-ওলামাদের লাশ ফেলতে, কোরআনের তাফসির বন্ধ করতে বিদেশি কাফের সৈনিকদের নামতে হচ্ছে না।দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে ভিন দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করাই রীতি, নইলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাতে বহু মানুষের জীবননাশ হয়। তেমনি মাতৃভাষায় জ্ঞানের পর্যাপ্ত আয়োজন না থাকলে ভিন ভাষা শিখে সে জ্ঞান সংগ্রহ করতে হয়, নইলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় জ্ঞানের রাজ্যে। তখন পুষ্টিহীনতায় মৃত্যু ঘটে মানবতার। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন ও ধীরে ধীরে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলা ভাষা পুষ্ট হয়ে উঠে নি দেশীয় শক্রদের কারনে। বাংলা ভাষায় ইসলামের চর্চা কতটুকু তা ভাবার বিষয় রয়েছে।বাঙালি মুসলমানের ব্যর্থতার বড় কারণ এই ভাষার দৈন্য। ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের উত্সবটি যারা ফেব্রুয়ারির পুরা একটি মাস ধরে উদযাপন করে। সে বিজয়কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা দেশের আনাচে-কানাচে শহীদ মিনারের নামে বিজয়স্তম্ভ গড়েছে। তারা কি ভেবে দেখে এ কাজগুলো-ই কি ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য?
বুদ্ধিবৃত্তিতে আত্মঘাত-
যে প্রাণনাশী আঘাতটি একান্তই নিজের পক্ষ থেকে ঘটে, সেটিকেই বলা হয় আত্মঘাত। বাঙালি মুসলমানের জীবনে এমন আত্মঘাত কি কম? সেটি বেশি বেশি হয়েছে সাহিত্যের নামে বিষপানের মধ্য দিয়ে। মুসলমানের চেতনার খাদ্য আর হিন্দুর চেতনার খাদ্য এক নয়। মুসলমানের হারাম-হালাম শুধু খাদ্য-পানীয়ে নয়, সাহিত্যেও। যে ভাষায় ওহির জ্ঞান তথা কোরআন-হাদিসের জ্ঞান নেই, সে ভাষায় অসম্ভব হয়ে পড়ে ঈমান নিয়ে বেড়ে ওঠা। বাংলার তুলনায় আরবি, ফারসিতে শ্রেষ্ঠত্ব যে এ দুটি ভাষায় রয়েছে ইসলামী জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার, যা গড়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে। উর্দুতে ভান্ডার থাকলেও সে ভাষাটা বিতর্কিত হয়েছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কারনে যারা এ ভাষাটা আমাদের চাপিয়ে দিয়েছিল। যার কারনে লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। অন্যদিকে আধুনিক বাংলা ভাষাটি গড়ে উঠেছে বাঙালি হিন্দুদের মনের ক্ষুধা পূরণের লক্ষ্যে। বাংলা ছাপাখানার কাজটি প্রথম শুরু করেছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রিটিশ পাদ্রিরা। তাদের এজেন্ডা ছিল বাঙালির মাঝে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার। ছাপাখানার সে অগ্রগতি থেকে ফায়দা নিতে ময়দানে নামেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র, মোহিতলাল ও শত শত হিন্দু সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। তাদের সাহিত্যের মূল লক্ষ্যটি ছিল হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ আনা, সেটি বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের চেতনায়। সেইসঙ্গে প্রবল অবজ্ঞা বাড়ানো হয় প্রতিবেশী মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে মুসলমান, সেটি কি তাদের সাহিত্য পড়লে বোঝা যায়? নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে বাঙালি মুসলমানদের এ জন্যই অন্য পথ ধরতে হয়। তারা সাহায্য নেয় উর্দু ও ফার্সির মতো দুটি সমৃদ্ধ ভাষার।
মাতৃভাষা আর বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা বহু জাতির জীবনেই এক নয়। কিছু গান, কিছু কবিতা, কিছু কিচ্ছা-কাহিনী বা পুঁথিই একটি ভাষার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনটি আরো ব্যাপক। অথচ বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য বলতে দীর্ঘকাল যা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তা হলো মধ্যযুগীয় মুসলিম কবিদের রচিত কিছু কবিতা ও পুঁথিসাহিত্য। পরে রচিত হয় মীর মোশাররফ হোসেনের রচিত বিষাদসিন্ধু, যা ছিল কল্পকথায় পরিপূর্ণ। বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি জোগানোর সামর্থ্য অর্জনে যে কোনো ভাষার জীবনে বহু শত বছর লেগে যায়। হাজার বছরের অধিক কাল ধরে কাজ করছে আরবি ও ফার্সি ভাষা। ইংরেজি ভাষার এমন একটি সমৃদ্ধ অবস্থার জন্যই মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন বিলেতের আইরিশ, ওয়েলশ ও স্কটিশ সাহিত্যিকরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শতাধিক ভাষার মানুষের বাস, কিন্তু সেদেশেও বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে ইংরেজি। বাঁচার স্বার্থে মানুষ বাজারে পুষ্টিকর খাদ্য খোঁজে। সে খাদ্যটি কোন দেশে উত্পাদিত, সেটি নিয়ে কোনো বিবেকবান মানুষই ভাবে না। সে দেখে গুণাগুণ বা পুষ্টির মান। নিজ দেশের এমনকি নিজের মায়ের তৈরি খাবার দূষিত হলে সে খাবারকে আবর্জনার স্তূপে ফেলতে হয়, নইলে শরীর বাঁচে না। তেমন সতর্কতা নিতে হয় রুহের বা চেতনার খাদ্যের বেলায়ও।
আজ থেকে শত বছর আগেও হাজার হাজার মাইল দূরের তুর্কির উসমানিয়া খেলাফত বাঁচাতে বাঙলার ঘরে ঘরে মুষ্টির চালের হাঁড়ি বসানো হয়েছিল। কেউ কেউ খলিফার বাহিনীর সঙ্গে লড়তে বলকানে ছুটে গেছে। ব্রিটিশের ষড়যন্ত্র রুখতে ‘খেলাফত আন্দোলন’ নামে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম গণআন্দোলন। বাঙালি-অবাঙালি মিলে ভারতব্যাপী গড়ে তুলেছিল সে গণ-আন্দোলন।
মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো কসমোপলিটান হওয়া। সেটি হলো নানা ভাষার মানুষের সঙ্গে একত্রে বসবাসের সামর্থ্য। আল্লাহর ওপর ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে তাকে যেমন নামাজ-রোজার সামর্থ্য অর্জন করতে হয়, তেমনি অর্জন করতে হয় অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলমানকে ভাই রূপে গ্রহণ করার সামর্থ্য। কারণ সে যে ভাই সে পরিচয়টি তো মহান আল্লাহর দেয়া। আর ভাই হিসেবে গ্রহণ করার সে সামর্থ্যটি অর্জিত না হলে বুঝতে হবে ঈমান নিয়ে বেড়ে ওঠায় দারুণ সমস্যা রয়েছে। বাংলার ভূমি এবং বাংলার নগর ও গ্রামগুলো বহু শত বছর আগে থেকেই কসমোপলিটন ছিল। তখন উপমহাদেশের নানা ভাষার অবাঙালি মুসলমানরা বাঙালি মুসলমানদের কাছে ভাই হিসেবে গণ্য হতো। তখন একই জনপদে বাঙালির সঙ্গে একাকার হয়ে বসবাস করেছে আরব, তুর্ক, পাঠান, আফগান ও মোগলসহ নানা ভাষার মানুষ। কেউ কাউকে শত্রু ভাবেনি। কলহ-বিবাদও দেখা দেয়নি। ইখতিয়ার বিন বখতিয়ার খিলজি, ঈসা খান, সিরাজুদ্দৌলার মতো অবাঙালি শাসকেরাও তাদের কাছে অতি আপন হিসেবে গণ্য হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো অবাঙালিকেও তারা নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে চেতনাটি ভাষা আন্দোলনের পর আর বাঁচেনি। একাত্তরে বাংলার মাটিতে অবাঙালিরা গণ্য হয়েছে হত্যাযোগ্য শত্রু হিসেবে। সর্বস্ব লুণ্ঠন করে বস্তিতে বসানো হয় ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা কয়েক লাখ বিহারিকে। তেমনি গলাধাক্কা দিয়ে সাগরে ফেরত পাঠানো হয়েছে মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে থেকে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের। ইসলামশূন্য হলে মানুষ যে কতটা মানবতাশূন্য হয় এ হলো তার প্রমাণ। বাঙালি মুসলমানের চেতনা ও চরিত্রে এ ভয়াবহ পচনটি এক দিনে আসেনি, বরং সৃষ্টি করা হয়েছে বহু বছরের পরিকল্পনায়। সে পরিকল্পনার মূলে ছিল ইসলামী জ্ঞানার্জনকে বাধাগ্রস্ত করা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ঈমানশূন্য মানুষদের জন্তু-জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। সে ঈমানশূন্যতা আসে ইসলামী জ্ঞানের পুষ্টিহীনতায়। যে রাষ্ট্রে মানুষরূপী এ ধরনের পশুরা বেড়ে ওঠে, সে রাষ্ট্রের পক্ষে পৃথিবীর দুইশ’ রাষ্ট্রের মাঝে দুর্বৃত্তিতে বারবার প্রথম হওয়ার মতো নিকৃষ্ট কাজটিও অতি সহজ হয়ে যায়। অতি সহজ হয়ে যায় ভোটডাকাতি, ব্যাংকডাকাতি, খুনগুম, ব্যভিচার ও নানা ধরনের সন্ত্রাস। বুদ্ধিবৃত্তিক পচন এবং দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ার কাজটির শুরু তো তখন থেকেই। বাঙালি মুসলমানদের সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে বড় আত্মঘাত।
শিক্ষা যেখানে দূষণের হাতিয়ার-
শিক্ষালাভের অর্থ ডিগ্রিলাভ নয়, স্রেফ অক্ষর জ্ঞানও নয়। সেটি হলো সিরাতুল মুস্তাকিম চেনার সামর্থ্য। শিক্ষা দেয় মত-অমত, দেয় সত্য-অসত্যের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা। দেয় চেতনা ও চরিত্রে পরিশুদ্ধি। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষানীতি পরিণত হয়েছে পরিশুদ্ধির বদলে দূষণের হাতিয়ারে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিদান হলেও তাতে কি সিরাতুল মুস্তাকিম চেনার সামর্থ্য বেড়েছে, বেড়েছে কি মত-অমত, সত্য-অসত্যের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা? সে লক্ষ্য যে অর্জিত হয়নি সেটি তো প্রমাণিত হয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত তথা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে ভ্রান্ত পথে চলায়। শিক্ষা ব্যবহৃত হয়েছে পথভ্রষ্ট করার হাতিয়ারে। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা যে দুর্বৃত্তদের দ্বারা অধিকৃত তারা তো কোনো বনজঙ্গলে বেড়ে ওঠেনি, বরং উত্পাদিত হয়েছে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। অশিক্ষা বা কুশিক্ষায় মৃত্যু ঘটে ধর্মীয় চেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবতার। অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণেই অসম্ভব হয়েছিল আরবের কাফেরদের মানবতা নিয়ে বেড়ে ওঠা। শয়তান ও তার অনুসারীদের মূল কাজটি তাই সুশিক্ষার কাজটি বন্ধ করে দেয়া। মানুষকে জাহান্নামে টানার এটিই হলো শয়তানের প্রধান স্ট্রাটেজি। নমরুদ ও ফেরাউনরা তাই হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও হজরত মুসা (আ.)-এর মতো মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের জনপদে নামতে দেয়নি। একই কারণে মক্কার কাফেররাও নবীজি (সা.)-কে তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছে। আজও দেশে দেশে শয়তানি শক্তির একই রূপ এজেন্ডা। সে অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই মুসলিম দেশে তারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে। এজন্যই সুদখোর, ঘুষখোর, ব্যাভিচারী ও খুনিদের শাস্তি দেয়া বা পতিতাবৃত্তির উচ্ছেদ নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সেক্যুলার শক্তির কোনো আগ্রহ নেই, বরং তাদের মূল আগ্রহটি হলো কোরআন-হাদিস শিক্ষার মূল পথগুলোকে বেছে বেছে বন্ধ করে দেয়া।
অপরাধ ইতিহাস বিস্মৃতির-
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিবিলুপ্তির মতো ইতিহাস বিস্মৃতির বিপদ বিশাল। মানুষ তখন তার নিজের পরিচয় ভুলে যায়। ভুলে যায় আপনজনদের। বাঙালি মুসলমানদের জীবনে সে ইতিহাস বিস্মৃতিটি বিশাল। সেটির ফলে বাঙালি মুসলমানরা ভুলেই গেছে তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা ও ঈমানি দায়িত্বের কথা। ফলে অতীতে বহু ক্ষুদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে বড় বড় ভূমিকা রাখতে পারলেও ব্যর্থ হচ্ছে ১৯ কোটির বিশাল বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী। মুসলমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবেই প্রতিটি মুসলমানের ওপর কিছু দায়িত্ব এসে যায়। সেটি খেলাফতের তথা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের। প্রতিনিধিত্বের মূল দায়িত্বটি হলো, আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনা। সে দায়িত্বপালনের তাগিদেই তুর্কি সৈনিক ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি তার মাতৃভূমি ছেড়ে ছুটে এসেছিলেন হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলায়। মাত্র ১৭ সৈনিক নিয়ে বাংলা বিজয় করে দেশটির সমগ্র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি তিনিই এনেছিলেন। সে বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঘাড় থেকে নামিয়েছিলেন মূর্তিপূজার মতো আদিম অসভ্যতার জোয়াল। প্রশস্ত পথ করে দিয়েছিলেন ইসলামের। বাংলার মাটিতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে, অনেকের হাতেই এদেশ বিজিত হয়েছে, কিন্তু বাংলার মুসলমানদের এত বড় উপকার কি আর কেউ করেছে? অথচ বাঙালি মুসলমানরা তাকে একরকম ভুলেই গেছে। তবে ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে ভুলিয়ে দেয়ার বিষয়টি কোনো আকস্মিক ভুল নয়, বরং সুপরিকল্পিত। বাঙালি মুসলমানদের চেতনার পট থেকে তার স্মৃতিকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে একটি বিশেষ প্রয়োজনে। সেটি ইসলামের শত্রুদের বাংলার রাজনীতিতে স্থান করে দেয়ার লক্ষ্যে। ইতিহাসকে অস্বীকার করা যাবে না।আমাদের সাথে বৈরিতা ছিল পাকিস্তানি শাসকদের সাথে কোন ভূখন্ডের সাথে নয়। প্রকৃত ইতিহাস রচনা না হলে অনাগত ভবিষ্যৎ অবশ্যই তা উৎঘাটন করবে। শুধু তাই নয়, পরিকল্পিতভাবে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের স্বাধীনতাও। লেখা হচ্ছে মিথ্যাপূর্ণ নতুন ইতিহাস। আমাদের স্বাধীনতার শুরু একাত্তর থেকে তা যেমন ঠিক তেমনি ঠিক১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের স্বাধীনতাও। বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথার কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ পাকিস্তান আমলে ২৩ বছর ধরে এ দিনটি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি নগরে ও বন্দরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়েছে। ১৯৭১-এর পর সারা বছর ধরে কত দিবস উদযাপিত হয়, কিন্তু সে তালিকায় এ দিনটি নেই। অথচ ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বাংলা বিজিত হওয়ার পর বাংলার মুসলিম ইতিহাসে পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পশ্চিম বাংলা, আসাম ও কাশ্মীরের মুসলমানদের জীবনে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আসেনি বলে তারা আজও স্বাধীন হতে পারেনি। ফলে তাদের কাঁধে আজও পরাধীনতার জোয়াল। অথচ সংসদ ভবন, সুপ্রিমকোর্ট ভবন, বঙ্গভবন, গণভবন, বায়তুল মোকাররম, বাংলা একাডেমি, সেনা ক্যান্টনমেন্টসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান যে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেটি কি অস্বীকার করার উপায় আছে?
প্রচণ্ড ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে বাংলায় ইসলামের প্রচার নিয়েও। বলা হয়, বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে সুফিদের উত্তম চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতার বলে। ইসলামের সমগ্র ইতিহাসের সঙ্গে এটি এক মিথ্যাচার। এ কথা বলা হয়, মুসলিম জীবনে জিহাদ বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে। সমগ্র মানব-ইতিহাসে মহান নবীজি (সা.)-এর চেয়ে উত্তম চরিত্র, আধ্যাত্মিকতা ও দ্বীনের দাওয়াত পেশের সামর্থ্য আর কার ছিল? এমনকি কাফেররা তাঁকে আল-আমিন বলতেন। তাঁর কাছে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বাণী নিয়ে তাঁর ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) আসতেন। নবীজি (সা.)-এর নবুয়তের মাত্র কয়েক বছর আগে মক্কাবাসী মহান আল্লাহ তায়ালার কুদরত স্বচোখে দেখেছে। কাবা ধ্বংসে আগত ইয়েমেনের রাজা আবরাহার বাহিনীর হাজার হাজার সৈনিক ও তার হাতিগুলোর ধসে সেদিন কোনো বিশাল বাহিনী লাগেনি। ছোট ছোট পাখিদের মুখ থেকে নিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কঙ্করই সে কাজে যথেষ্ট ছিল। এতসব দেখার পরও নবীজি (সা.)-এর ১৩ বছরের মক্কি জীবনে ক’জন আল্লাহর সে দ্বীনকে কবুল করেছে? মাত্র তিনশ’ জনের মতো। অন্যদিকে মানব ইতিহাসের আরেক মহান নবী হজরত নূহ (আ.) সাড়ে সাত বছর চেষ্টা করেও সফলতা পাননি। মক্কার কাফেররা যে শুধু ইসলাম কবুলে অস্বীকার করেছে তা নয়, নবীজি (সা.)-কে তারা মিথ্যুক, গণক এবং পাগলও বলেছে। তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন করেছে এবং তাঁকে সামাজিক বয়কটও করেছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের সে ষড়যন্ত্রের কারণে নবীজি (সা.)-কে অবশেষে নিজ জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছে। অথচ ইসলাম কবুলের জোয়ার শুরু হয়েছে মক্কা বিজয়ের পর। সামরিক শক্তির যে বিকল্প নেই এ সত্য কি তাই অস্বীকার করার উপায় আছে?
হিরোইনসেবী বা মদ্যসেবীদের মতো মিথ্যা ধর্ম বা অধর্ম নিয়ে বাঁচাতেও প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ততা থাকে। এমন নেশাগ্রস্তদের ওপর নবী-রাসুলদের মতো মহত্ মানুষদের ওয়াজ-নসিহতও কাজ দেয় না। যেমন ওষুধ কাজ দেয় না দূষিত পানি সেবনকারীর ওপর। এরা যে শুধু নিজেদের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে তা নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়। ফলে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণটি জরুরি। প্রয়োজন পড়ে নেশার সামগ্রীর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। সেজন্য চাই সামরিক শক্তি। ইউরোপ-আমেরিকায় হাজার হাজার মসজিদ আছে। বহু হাজার ধর্মপ্রচারকও আছে। বইয়ের দোকানগুলো ভরপুর কোরআন-হাদিস ও ইসলামী বইপুস্তকে। কিন্তু সেগুলো পড়ে ক’জন ইসলাম কবুল করছে? কারণ এসব দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা প্রতিষ্ঠিত তারা প্রচুর পরিচর্যা দেয় কুফরির এবং প্রচলিত ভ্রান্ত ধ্যানধারণার প্রতি নেশাগ্রস্ততা বাড়িয়ে চলেছে দেশের মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্র ও বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে পরিচর্যা দেয় জনগণ তো সেটিই গ্রহণ করে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তির পর কম্যুনিজম সে রাষ্ট্রীয় পরিচর্যা পায়নি। ফলে জনগণের মন থেকে দ্রুত বিলুপ্ত হয়েছে কম্যুনিজম।
মক্কার মূর্তিপূজারিরা নবীজি (সা.)-এর চরিত্র দেখে মুসলমান হয়নি। তাঁর পূতঃপবিত্র চরিত্র মক্কা বিজয়ের আগে তারা বহুবার দেখেছে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর সে কাফেররাই দলে দলে মুসলমান হয়েছে। মক্কাবিজয় কালে নবীজি (সা.)-এর চরিত্রে এমন কিছু যোগ হয়নি যা মক্কায় বসবাসকালে তাঁর মধ্যে ছিল না। সে সময় মূল বিপ্লবটি এসেছিল মুসলমানদের সামরিক শক্তিতে। শক্তিবলে মক্কা বিজয়ের পরই তাদের মধ্যে ইসলাম কবুলের জোয়ার শুরু হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সে সত্যটি তুলে ধরেছেন এভাবে— ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় যখন এলো, তখন তুমি দেখলে দলে দলে মানুষ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে।’—(সুরা নছর, আয়াত ১-২)। তাই মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে, এমন পবিবেশ সৃষ্টির জন্য যেমন উন্নত চরিত্র চাই, তেমনি সামরিক শক্তি এবং বিজয়ও চাই। সামরিক শক্তির বিকল্প শুধু সামরিক শক্তিই। ঈসা (আ.)-এর জন্মই ছিল এক বিশাল মোজেজা। মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতের বরকতে তিনি বহু মৃত মানুষকে জীবিত করেছেন। তার হাতের স্পর্শে বহু কুষ্ঠ রোগী আরোগ্য পেয়েছে। কিন্তু সে মোজেজা দেখে কি ১০০ জনও মুসলমান হয়েছে। অথচ রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইনের খ্রিস্টান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বিশাল ভূভাগের মানুষ খ্রিস্টান হয়ে যায়। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার স্বার্থে জরুরি শুধু উন্নত চরিত্র নয়, বরং অপরিহার্য হলো রাষ্ট্রের ওপর পূর্ণ দখলদারি আর সেটা হতে উন্নত চরিত্র তৈরির মাধ্যমে। এটিই নবীজি (সা.)-এর সুন্নত। মুসলমানদের চরিত্র ফেরেশতাদের মতো হলে শুধু তাতেই ইসলাম কবুলের জোয়ার শুরু হবে, সেটি এক ভিত্তিহীন কল্পনা। মুসলমানদের পরাজয় ও ইসলামের গৌরবহানির শুরু তো তখন থেকে যখন মুসলিম ভূমি একের পর স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয়েছে।
বাঙালি মুসলমানদের অধঃপতনের বড় কারণ, তাদের ওপর ইসলামের শত্রুপক্ষের দীর্ঘকালীন শাসন। সেটি ঘটেছে মুসলমানদের সামরিক শক্তিহ্রাসের কারণে। গরু-ভেড়া ঘরে একদিন অবস্থান নিলে বিস্তর মলমূত্র রেখে যায়। বাংলাদেশের বুকে সাম্রাজ্যবাদী শত্রুদের শাসন ১৯০ বছরের। শত্রুপক্ষের এত দীর্ঘকালব্যাপী দখলদারি বিশ্বের আর কোনো মুসলিম দেশে আসেনি। তাদের প্রত্যক্ষ শাসন শেষ হলেও ধর্মবিরোধী দর্শন, কুফরি আইন, ব্যভিচারের সংস্কৃতি, পতিতাবৃত্তি, সুদভিত্তিক অর্থনীতির মতো আবর্জনার দখলদারি আজও শেষ হয়নি। দিন দিন সেটি বরং বর্বরতর হচ্ছে। সে বর্বরতার হিংস্র রূপটি হলো আলেমদের হত্যা বা কারারুদ্ধ করা হচ্ছে। দখলদারি বেড়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রশ্রয়পুষ্ট সেক্যুলারিস্ট দাসদের। এমন দাসদের উত্পাদন নিয়ে মিসরে ব্রিটিশ শাসনের খলিফা লর্ড ক্রমার বলেছিলেন, মুসলিম দেশে সমচেতনার একটি শ্রেণী গড়ে না ওঠা পর্যন্ত কোনো মুসলিম ভূমির স্বাধীনতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশগুলোতে কুফরি আইন, সুদি ব্যাংক, পতিতাবৃত্তির মতো ব্যভিচারের সংস্কৃতি বলবত্ রেখেছে তো এই সমচেতনার দাসশ্রেণী। ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো তারাও যে ইসলামের শত্রুশক্তি, তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে?
সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা-
শয়তানের বিশাল বিনিয়োগটি সংস্কৃতির ময়দানে। মানুষকে জাহান্নামমুখী করার এটি এক সনাতন কৌশল। সে বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশে সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতাটি বিশাল। প্রতি জনপদে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে নানা নামে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও দিনক্ষণ। নববর্ষ, নববসন্ত, ভ্যালেন্টাইনস ডে, থার্টিফার্স্ট নাইট—এসব নামেও বহু উত্সব। আবার পাশের দেশ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিয়ে আসছে বাদকদল যা আমাদের ইসলামি সংস্কৃতিকে পর্যুদস্ত করছে। এগুলো হলো ইসলাম ও সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে মনোযোগ হটানোর শয়তানি কৌশল। শয়তান জানে, বাঙালি মুসলমানদের পূজার নামে মন্দিরে ফুল দিতে হাজির করা যাবে না, কিন্তু সংস্কৃতির নামে একুশের স্তম্ভে ফুল দিতে বিপুল সংখ্যায় নেয়া যাবে। তাই মন্দিরের পূজামণ্ডপ বা বেদিমূল নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশের রাজপথে ও শিক্ষাঙ্গনে। গড়ে তুলেছে একুশে ফেব্রুয়ারির অসংখ্য স্মৃতিসৌধ। অথচ এমনটি কোনো কালেই ইসলামের রীতি ছিল না, সংস্কৃতিও ছিল না। তাছাড়া শহীদ তো তারাই যারা মহান আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে বা শত্রুর হামলা থেকে মুসলিম ভূমির ঐক্য-সংহতির হেফাজতে প্রাণ দেয়। একুশে ফেব্রেয়ারি স্মরণে যারা স্তৃতিস্তম্ভ গড়ে তারাও এ কথা বলে না যে, একুশে ফেব্রুয়ারির লড়াইটি ছিল আল্লাহর পথে। যারা প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছে তাদের জন্য দোয়া করা সমিচীন নয় কি? মুসলিম শক্তি খণ্ডিত করা যেমন হারাম, তেমন হারাম হলো দেশের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে ইসলাম সরানো। কারণ এতে দুর্বল হয় ইসলামের শক্তি। ফলে আল্লাহ তায়ালার কাছে তা অতি ঘৃণিত কাজ। কোনো ঈমানদারের কাছে তাই এমন আন্দোলন গুরুত্ব পেতে পারে না।একুশের স্মৃতিস্তম্ভগুলো পরিণত হয়েছে এখন তীর্থস্থানে। সেখানে হাজিরা দেয়াটি সাংস্কৃতিক আচারে পরিণত হয়েছে। তাই যতই বাড়ছে সেক্যুলারিজমের তাণ্ডব, ততই বাড়ছে একুশের স্তম্ভে ফুল দেয়ার হিড়িক। অথচ স্মৃতিস্তম্ভ গড়া জায়েজ হলে সবচেয়ে বেশি স্তম্ভ গড়া হতো মদিনায়। কারণ সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন মদিনার বুকে।
একমাত্র পথ-
নানা ধরনের বিপদ ও বিভ্রাট বাঙালি মুসলমানদের ঘিরে ধরেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদটি অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকও নয়, বরং সেটি হলো জাহান্নামে পৌঁছার। শয়তানের এজেন্ডা শুধু ইহকালকে বিফল করা নয়, আখেরাতকে বিফল করাও। ইসলামের শত্রুপক্ষ যেভাবে দখল জমিয়েছে তাতে কঠিন হয়ে পড়েছে জান্নাতের পথে পথচলা। জান্নাতের পথে পথচলার সামর্থ্যটি আসে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের জ্ঞানার্জন থেকে। সেটি অর্জিত হয় ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ এবং সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। অথচ সেটিই বাংলাদেশে আজ অসম্ভব করা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে কোরআনের জ্ঞানার্জন যেমন বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, তেমনি অসম্ভব করা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও শরিয়তের প্রচলন। ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের মূল লক্ষ্যটি হলো, ইসলামের আন্তর্জাতিক শত্রুশক্তির পদতলে আত্মসমর্পণে দেশবাসীকে বাধ্য করা। অথচ এমন আত্মসমর্পণের বিপদ ভয়াবহ। সেটি জাহান্নামপ্রাপ্তির। ইসলামের শিক্ষা এ ধরনের দাসত্ব মেনে নেয়া নয়, নবীজি (সা.)-এর সেটি সুন্নতও নয়। জান্নাতে চলার পথটি সরলতার সাথে শুধু জীবন চালানো নয় বরং ইসলামের বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করা। এই সংগ্রাম অকারনে মানুষকে মারা নয়।অধিকাংশ মুসলিম ধর্মবেত্তার দৃষ্টিতে জিহাদের নামে এলোপাতাড়ি বোমা হামলা এবং আতংক সৃষ্টির জন্য নিরীহ মানুষ হত্যা করা ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ও নির্দেশনার পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মে মানুষের জীবনকে অতিশয় মূল্যবান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, বা সৃষ্টির সেরা। বিনা কারণে মানুষ হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ, কবিরা গুনাহ। এই সংগ্রামের মূল লক্ষ্য, শয়তানি শক্তির দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি।মনে রাখতে হবে, ইসলামের ইতিহাসে এই কথিত জিহাদি চিন্তাভাবনার উপস্থিতি বরাবরই ছিল। কিন্তু কখনোই তা রাষ্ট্র বা সামাজিক শক্তিকে উপেক্ষা করে মূলধারা হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র বা সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে থেকেই তাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জিহাদ শব্দটিই যেন মূর্তমান আতংক। কোনো কোনো দেশে তাদের কর্মকাণ্ড শাসকশ্রেণীর ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। আর ইসলাম ধর্ম চিহ্নিত হয়েছে আতংকের ধর্ম হিসেবে।
এতে কার লাভ হচ্ছে? কথিত জিহাদি কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইয়েমেন। বিব্রত হতে হচ্ছে অন্যান্য দেশের মুসলমান জনগণকে। ফলে ইসলাম বা মুসলমানের কোনো লাভ হচ্ছে না। নবী রাসূলগন যে জিহাদ করেছেন তা ছিল প্রতিরোধ।ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তনের সময় মহানবী (দ.)-কে অসংখ্যবার প্রাণঘাতী লড়াই-সংগ্রামের মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর সবই ছিল চারপাশের বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই। তৎকালীন আরবের সমাজ বাস্তবতায় সেই বৈরিতা মোকাবেলা করে টিকে থাকার জন্য সম্মুখ সমরের কোনো বিকল্প ছিল না। পরবর্তীকালে ইসলাম রাজধর্ম হয়েছে। কিন্তু খলিফা নাম ধারণ করলেও সেই মুসলমান রাজন্যবর্গ ধর্মরক্ষার চেয়ে সিংহাসন রক্ষা, রাজ্য জয় এবং জাগতিক ভোগবিলাসেই ব্যস্ত থেকেছেন।এ ধরনের লড়াই থেকে নবী-রাসুলরাও রেহাই পাননি। হাজার নবী-রাসুলকে যেমন দেশ ছাড়তে হয়েছে, তেমনি শহীদও হতে হয়েছে। মুমিনের জীবনমাত্রই জিহাদের। যে জীবনে জিহাদ নেই, সে জীবনে ঈমান বাঁচে না। তাই রাসুলে পাক (সা.)-এর হাদিস, ‘যে ব্যক্তি জিহাদ করল না এবং জিহাদের নিয়তও করল না, সে মোনাফেক।’
জিহাদের দুটি পর্ব — একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, অপরটি অস্ত্রের। অস্ত্রের জিহাদটি সব সময় আসে না, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির যুদ্ধটি মুমিনের জীবনে লাগাতার। মুমিনের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আকিদা-বিশ্বাস এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদের বিরুদ্ধে শয়তানি শক্তির গোলাবর্ষণটি লাগাতর। মুমিনের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি হলো মিথ্যার হামলা থেকে ঈমান বাঁচানোর। সে যুদ্ধে পরাজিত হলে কুফরি চেতনার ধারকেরা মুসলমানের গলায় নানা ধরনের ভ্রান্ত মতবাদের শিকল পরিয়ে দেয়। এমন শিকল-পরা ব্যক্তির পক্ষে অস্ত্রের যুদ্ধ তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি সম্মান দেখানোর সামর্থ্যও তারা হারিয়ে ফেলে। ইসলামি খেলাফাহ, শরিয়ত ও জিহাদের মতো ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়গুলো নিয়েও তখন তাদের মনে অবিশ্বাস বা সন্দেহ দেখা দেয়। জিহাদও সন্ত্রাস মনে হয় এবং শরিয়তের পবিত্র শাসন মনে হয় বর্বরতা। বাঙালি মুসলমানের জীবনে সে বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়টি বিশাল। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক দখলদারি চলে গেছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। বাঙালি মুসলমানের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি সত্যিকার অর্থে শুরুই হয়নি। তাই হাজি, নামাজি, রোজাদার ও ইসলামপন্থী দলের কর্মীদের পায়েও দেখা যায় জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের বেড়ি। তারা যেমন আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদদের হত্যাযোগ্য মনে করে, তেমনি ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে মুসলিম দেশ ভাঙাও প্রশংসনীয় বলে গণ্য করে। পবিত্রতা মনে করা হয় নগ্নপদে একুশের স্তম্ভে হাজিরা দেয়াকে। এগুলো হলো বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়ের আলামত। সমস্যা তাই শত্রুর কারাগারে বসবাস নিয়ে নয়, বরং গর্দানে গোলামির রশি নিয়ে বসবাস করা। এমন পরাধীন মানুষের ইবাদত কি বিশুদ্ধ হয়? ফলে ইস্যু এখানে জনগণের গলা থেকে শত্রুর পরানো এ রশি সরানোর। এখানে যুদ্ধটি বুদ্ধিবৃত্তির।
বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটির মূল হাতিয়ারটি হলো কোরআনের জ্ঞান। আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এ অস্ত্রটি ছাড়া এ যুদ্ধে বিজয় অসম্ভব। নবীজি (সা.) ও তাঁর সাহাবায়ে জীবনে সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি নবুয়তপ্রাপ্তির প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। অস্ত্রের জিহাদটি শুরু হয়েছিল হিজরতের পর। তবে বুদ্ধিবৃত্তির জিহাদে বিজয়ী না হলে স্রেফ অস্ত্রের জিহাদে ইসলামী দর্শন ও বিধান রাষ্ট্রের বুকে বিজয়ী করা যায় না। প্রতিষ্ঠাও পায় না। তখন অস্ত্রযুদ্ধের বিজয় নিছক সামরিক বিজয় থেকে যায়। ভারতে মুসলিম বিজয়টি সে পর্যায়েই রয়ে গেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা চান, প্রতিটি ঈমানদার বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের আমৃত্যু সৈনিকে পরিণত হোক। তাই ফরজ করেছেন কোরআনের জ্ঞানার্জনকে। নবীজি (সা.)-এর সাহাবারা শুধু যে অস্ত্রের জিহাদে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ শহীদ হয়েছেন তা নয়, বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও সবচেয়ে বড় বিজয়টি একমাত্র তারাই এনেছিলেন। ফিকাহ, তাফসির, ইসলামের আইন ও দর্শন নিয়ে বড় বড় গবেষণা তো হয়েছে তাদের দ্বারাই। ফলে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের ওপর যে অটল বিশ্বাস এবং শরিয়তি বিধানের প্রতি যে অনড় আস্থা সে আমলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেটি কি আজ ভাবা যায়?
বাঙালি মুসলমানের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক এ লড়াইটি শুরু থেকেই গুরুত্ব পায়নি। ফলে তাদের চেতনার মানচিত্রে বেড়েছে ইসলামের পরাজয়। সে পরাজিত ভূমিটুকু দখল করে নিয়েছে সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, ফেরকাবাদ, সুফিবাদ, পীরতন্ত্র, বিভিন্ন জামাততন্ত্র ও তাবলিগ জামায়াতের ধর্মবিশ্বাস। ফলে সুফি বা পীরের খানকায় বা তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হলেও বুদ্ধিবৃত্তির জিহাদে সৈনিক নেই। এর ফলে সৈনিক মিলছে অস্ত্রের জিহাদেও। ফলে বিজয় বেড়ে চলেছে শুধু শয়তানি শক্তির। অলস ও নিষ্ক্রিয়দের সহায়তা দেয়া মহান আল্লাহ তায়ালার সুন্নত নয়। মুসলমানদের শুরু থেকেই লড়াই করে বাঁচতে ও বেড়ে উঠতে হয়েছে। যে কোনো লড়াই বিপুল কোরবানি চায়। জান-মাল, শ্রম ও মেধার বিপুল বিনিয়োগের বরকতেই মুসলমানরা বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং ভেঙেছিল নানা ধরনের জাহিলিয়াতের শিকল। বিজয়ের জন্য গ্রামে গন্জে , শহরে মানুষকে দিতে কোরআন ও হাদিসের তদৃছ।গড়ে তুলতে হবে সাহাবাদের অনুকরনে চরিত্র। এটিই তো সিরাতুল মুস্তাকিম তথা জান্নাতের পথ। বাঙালি মুসলমানদের সামনেও কি এছাড়া ভিন্ন পথ আছে?
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন