"সুখের সন্ধানে সোবহান----"
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:২৪:৩৬ দুপুর
দেশে কি হচ্ছে তা দেখার কোন ফুরসৎ নেই সোবহানের।পড়ালেখা যৎসামান্য যা দিয়ে মোটামুটি নিউজ পেপার পড়তে পারে।অটোরিকশা চালায়।স্ত্রী ও দু'সন্তান নিয়ে সংসার।শহরের অনতিদূরে মাদারটেকের শেষ সীমায় থাকে যেখানে ভাড়াটা কম।স্ত্রী জরিনা নাস্তা জাতীয় খাবার বানাতে পারে সংসারের পাশে আর তা কয়েকটি ছোট হোটেলে সরবরাহ করে সোবহান।প্রতিদিন সোবহানফজরের আজান দিলেই বেরিয়ে যায়।নামাজ শেষ করে সোজাসুজি চলে যায় কমলাপুর স্টেশনে ভাড়া মারার জন্য।সোবহান গরীব হলেও নিয়মনীতি মেনে চলে।নোয়াখালীর লক্ষীপুরে তার বাবার বাড়ি।পাঁচ ভাই বোনের সংসারে বাবা খুব বেশি পড়াতে না পারলেও প্রাথমিক দ্বীনি তালিম দিয়েছেন।সে জন্য ভাল মন্দ বুঝতে পারে।স্টেশনের কাছেই টেলু নামে এক টংএর দোকানের মালিকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় পত্রিকা পড়ার কারনে।প্রথমে একদিন এসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ভদ্রভাবে সোবহান বলে, ভাইজান একখান পেপার দেহন যাইবো নি,যেমুন আছে এমুনই থাকবো।এভাবে যখন টেলু দেখলো প্রতিদিনই সে পেপার পড়তে চায় নিজে থেকেই তাকে বললো আপনার পেপার পড়ার যহন সখ আমি একটি পেপার আপনাকে দিমু।সোবহান হেসে বললো,' ভাইজান আনডা গ্রামগন্জের মানুষ,আন্নের মত দিলদরাজ দেইখ্যা খুব খুশি অইলাম,তয় আন্নে যহন আঁরে এত ভাল বাইস্যা হালাইছেন টাহাটা লওন লাগবো।আঁর পকেটে যহন টাহা অইবো দিয়া দিমু।টেলু বললো দেওন লাগবো না।আপনের মত মানুষ যদি এ দেশে সব অইতো তাহলে দেশ আন্দারে থাকতো না।
প্রতিদিন সকাল আটটায় স্টেশনে আসে সোবহান।ট্রেন আসলে কিছুক্ষন আগের অবস্হান আর থাকে না, স্টেশনের চেহারাই বদলে যায়।পিলপিল করে গেট দিয়ে মানুষ বের হতে শুরু করে। তাদের ব্যাগ নেওয়ার জন্য পিছে পিছে ঘোরে কুলিরা। তখন রিকশা-সিএনজিচালিত অটোরিকশার দরদামও শুরু হয়।সোবহান সকালের এই ট্রিপটা মিস করতে চায় না। এ সময় যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছার জন্য মরিয়া থাকে। এক 'শ' টাকার ভাড়া ঝগড়াঝাঁটি না করেই দুই 'শ' টাকাতেও উঠে যায়। তবে স্টেশনে দিনে আরও কয়েক দফা ট্রেন এলেও তখন এদিক থেকে ট্রিপ নেয় না সোবহান। দাঁড়ালেই প্রতিবার ১০ টাকা ফি, তার ওপর ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে দুই মিনিট দেরি হলো তো পাহারাদার বদমাশগুলো এমনভাবে হাতের ডান্ডা দিয়ে অটোরিকশায় বাড়ি দেয়, মনে হয় পুরো কলকবজাই খুলে পড়বে। অটোরিকশার কেমন লাগে জানে না কিন্তু তার নিজের বুকে কষ্ট লাগে। পৈতৃক সম্পত্তির শেষটুকু বিক্রি করে এই অটোরিকশা রাস্তায় নামিয়েছে। প্রতিদিন ফেরার সময় চাল-ডালের বরাদ্দ, মাদারটেকের ঘর ভাড়া, দু'ছেলে মেয়ের স্কুলের বেতন , সবকিছুর জোগানদার এই বাহন ও সত্রীর সামান্য কিছু উপার্জন। তাই লাঠির বাড়ি পড়লে মনে হয়, নিজের শরীরেই লাগছে। এরপর যদি জানত টাকাটা সিটি করপোরেশনে যাচ্ছে, কথা ছিল না। কিন্তু এখানকার সব ড্রাইভারই জানে টাকা যায় কোথায়? শাহজাহানপুর সহ ঐ এলাকায় রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ,তারাই দেখে কমলাপুরের এরিয়া। এত কষ্টের টাকা যায় গ্রুপের প্রধানদের পকেটে। সে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নানা মাপের দল রাখে হাতে। নিশ্চয়ই সেই টাকা দিয়ে রাতে জুয়ার আসর বসে। এসব ভাবলে মনটাই খারাপ হয় সোবহানের। তার ওপর এই ঠিকাদারগুলোর ব্যবহার অন্য জায়গার তুলনায় বেশি খারাপ। টাকা ভাংতি না থাকলে ২০ টাকার নোটটা ভাঁজ করে পকেটে চালান করে। পান খাওয়া দাঁতের ভেতর কাঠি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, ‘কাইল নিস।’ অথচ সেই কাল আর কখনো হয় না।অবাক লাগে সোবহানের। রাস্তায় পুলিশরা গাড়ির চাকা ঘোরা দেখেই বলে দেয়, কোনটার লাইসেন্স নেই। সঙ্গে সঙ্গে আটকে ৮০০ টাকার কেস ঠুকে দেয়। আর সেই পুলিশই হাতের নাগালের একটা মানুষকে ধরতে পারছে না বছরের পর বছর! তবু স্টেশনে ট্রিপ নেওয়া ড্রাইভারগুলো এ জায়গার এক নেশায় পড়ে যায়। একে ভাড়া বেশি, তার ওপর সারা রাত ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষেরা বেশ অন্য রকম হয়। কেউ কেউ গন্তব্যের জায়গার নাম ছাড়া কিছুই চেনে না, ঘুরতেই থাকে অটোরিকশা নিয়ে। এই তো গতকালও ট্রেন থেকে নেমে এক লোক উঠল তার গাড়িতে। বোকা-বোকা দেখতে মানুষ, ড্রেসটি কম দাম হলেও ফুলহাতা শার্ট ও টাই পরা। হাতল-ছেঁড়া কাপড়ের একটা কালো ব্যাগ হাতে। গ্রাম্য টানে বলল, ‘ভাইসাব, অনেকগুলা কাজ। সব জায়গায় দশ-বিশ মিনিট। ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়ায় যাবেন?’
‘পয়সা দিলে যামু না ক্যান?’
ঘণ্টাপ্রতি দুই 'শ' টাকা চুক্তিতে অটোরিকশায় উঠেই লোকটা প্রথমে গেল মতিঝিলের এক অফিসে। প্রায় ৩০ মিনিট দেরি করে ফিরে বলে, ‘বেশি দেরি করলাম?’ সোবহান হেসে ফেললো এ কথায়, ‘কিয়ের দেরি, আন্নে তো ঘণ্টায় টাকা দিবেন।’ তারপর আবার পল্টনের দিকে কোনো অফিসে যাওয়ার মাঝপথে থেমে বলল, ‘ভাইসাব, চলেন, দুজন নাশতা করি।’ ততক্ষণে সোবহান বেশ আগ্রহ পেয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষগুলোর ভেতরে এখনো মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এরা মানুষ ভালোবাসে, তমিজ করে কথা বলে। নয়তো এই লোক তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই একা একা নাশতা করতে পারত অথবা বেশি চালাক হলে কিছু একটা কিনে সিএনজিতে বসেই খেতে পারত। এমন অনেক ঘটেছে এই গাড়িতেই। পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান, তুই-তোকারিও করে মাঝেমাঝে। বেতড়িপাত পোলাপান আদব শিখে নাই! সেই তুলনায় গ্রাম থেকে আসা এই যাত্রী বেশ সরল। মানুষটা তার চেয়ে বয়সে কত ছোট, তাও আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইসাবের পরিবার কি ঢাকায় থাকে?’
‘জি।’
‘সদস্য কয়জন?’
‘আল্লায় দিলে দুই ছেলে মেয়ে আর আমার স্ত্রী।’
‘সিএনজি দিয়ে খরচ চলে?’
‘গরিব মানুষের প্রয়োজনও গরিব। তাই ঠেইকা থাকে না।’
‘ভালোই বলছেন। তা শাদি কি একটাই করেছিলেন?’
যাত্রীর রসিকতায় হেসে ওঠে সোবহান। বাঁ পাশের আয়নায় দেখল, লোকটাও হাসছে। পুরুষ মানুষের হাসিতে দেখার কিছু নাই কিন্তু এই লোকের হাসি সুন্দর। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পাশ কেটে যাওয়ার সময় সোবহান জিজ্ঞেস করে, ‘আপনে কোন অঞ্চল থেইক্যা আইছেন?’
‘বাড়ি ভাই, উত্তরবঙ্গ। তবে আপনাদের এই ঝকমারি শহরে আসার জন্য দিনাজপুর থেকে রওনা হয়েছি।’
‘এইভাবে বললেন?’
‘কষ্ট থেকে বলছি। সারা রাত ট্রেনে ঝিমিয়ে সকালে দুই জায়গায় গেলাম, একটারও কাজ হলো না। এই শহরের মানুষ স্মৃতিশক্তিহীন।’ সচিবালয়ের দিকে অটোরিকশা ঘুরিয়ে নিতে নিতে সোবহান জিজ্ঞেস করল, ‘চাকরির জন্য আইছেন স্যার?’
‘জি, চাকরি একটা হওয়ার কথা কিন্তু ইন্টারভিউ বিকালে।আমার এমপি পাঠিয়েছে চাকরি হবে তবে দিতে হয়েছে ৫ লাখ টাকা। দু'জনের সাথে দেখা করার কথা কারো সাথেই দেখা হলো না , কেমন করে চাকুরি হবে?‘মন খারাপ কইরেন না। ইন্টারভিউর জন্য মন শক্ত রাখেন।’সোবহান আবার যাত্রীকে নিয়ে গেল ফার্মগেটের দিকে। এখানে যদিও লোকটা তাকে একটু বিরক্ত করেছে। ১০ মিনিটের কথা বলে ঢুকেছে এক বাসায়।ঢাকা শহরে শৌচাগারে ঢুকার মত অবস্হা নাই।এর আগেও ভদ্রলোক এ রকম বিপদে পড়েছিল।তাই দূরে হলেও তার এক পরিচিত মেছে গেল প্রাকৃতিক কাজটা সারার জন্য। মাছি মারতে মারতে সকালের পেপার মুখস্থ করে ফেলল সোবহান, তবু লোকটার আসার নাম নেই। বাসার উল্টো দিকে একটা গাছের নিচে অটোরিকশা রেখে পাশের দোকানে গেল ফোন করতে। বউয়ের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলে মেয়ের খবর নিল। এই এক সমস্যা তাদের, একটাই মোবাইল। মেয়েটার শরীর ভালো না, তাই ফোনটা বউয়ের হাতে দিয়ে আসা। কথা বলে ফিরতে ফিরতে দেখে, লোকটা তাকে খুঁজছে। হেসে বলল, ‘রাগ করেছেন? একটু বেশি দেরি করে ফেললাম। আপনি ভাড়া নিয়ে ভাববেন না।’ সোবহান নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘অসুবিধা নাই। তয় চার ঘণ্টা তো অনেক আগেই শেষ। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে।’
‘গাড়ি জমা দিবেন?’
‘তা না, আমার মা্য়্যাডার অসুখ তো। ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা ট্রিপ দিলে ভাড়া বেশি পাই।’
‘মেয়ের কী হয়েছে?’
‘কথা শুনে না, রোইদে রোইদে ঘুরে জ্বর বাঁধাইছে।’
‘বয়স কত?’
‘সাত।’
‘মাশাআল্লাহ। দুশ্চিন্তা করবেন না। সুস্থ হয়ে যাবে আর ভাড়া বাড়িয়ে দেব। আর একটা কাজ শেষ করতে ঘণ্টা খানেক লাগবে। যাবেন?’
‘চলেন।’
অটোরিকশা এবার এল নিউমার্কেটের দিকে।সোবহান এক পাশে দাঁড়াল। লোকটা বেশ কিছু বইপত্র কিনেছে। কাগজের প্যাকেটে এক কেজি আপেল ও দুই কেজি কমলা। প্যাকেটটা সোবহানের কাছে দিয়ে বলল, ‘সকাল থেকে অনেক কষ্ট দিলাম।এটা মেয়েকে দিবেন।’তখন আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা সোবহানের।এই লোক পাগল নাকি! কথাবার্তায় শান্ত হলেও সকাল থেকে যেভাবে রাস্তায় ঘুরছে, খুবই অস্থির লাগছে।তাই বলে চারশ টাহার ফল কিনে ফেলল! আবার ভয় হলো, আপেল দিয়ে লোকটা ভাড়ার টাকা কমাবে না তো! অবশ্য অমন অইলে নিউমার্কেটে ঢুকে না-ও বাইর অইতে পারত অথবা উল্টা দিগের গেইট দিয়া বাইর অইয়া গেলে কারো বাপেরও সাধ্য নাই তারে খুঁইজ্যা বাইর করনের। সংশয় নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য জিজ্ঞেস করল সে,‘আপনি তো কমলাপুরের দিগেই যাইবেন, তাই না?’‘জি।’‘দুপুর তো হয়ে গেল, চলেন নীলক্ষেতে খাওয়াটা সেরে নেই।’এবার সোবহান মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই লোকের মনে হয় সত্যিই মাথায় ঝামেলা আছে, ‘ভাই, আপনার না ইন্টারভিউ?’‘জি, সেটা তো বিকেলে।’‘এইখানে আত্মীয়স্বজন কেউ নাই?’‘না, সে রকম কেউ নেই। অনেকগুলো কাজ নিয়ে এসেছি। তার দু-একটাই সারলাম। ইন্টারভিউ দিয়েই আবার রাতের ট্রেনে উঠব।’
অচেনা যাত্রীর জন্য মায়া লাগছে সোবহানের। বোঝাই যায় বেচারার পকেটে টাকাকড়ি আছে কিছু। নয়তো অটোরিকশা ভাড়া করে দিনভর কাজ সারত না। কিন্তু এই শহরে একটাও আপন মানুষ নাই, যার কাছে গিয়ে একটু কাপড়চোপড় বদলে বিশ্রাম নিতে পারে।সোবহান নীলক্ষেতের দিকে অটোরিকশা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,‘চাকরি হবে কোথায়?’
‘সচিবালয়ে দ্বিতীয় শ্রেনির একটি পোস্টের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে পত্রিকায়। যদিও এভাবে হয় না, তবু অ্যাপ্লাই করায় ডেকেছে দেখে আসলাম।তাছাড়া এমপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ না করতে পারলে এত দূরে আসার সাহস পেতাম না। ’‘হাতে বইপত্র দেইখাই বুঝছি, আপনি শিক্ষক হইবেন।’হো হো করে হেসে উঠল লোকটা, ‘বইপত্র থাকলেই মানুষ শিক্ষক হয়?’‘আপনি খুব সহবৎওয়ালা মানুষ।’ শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল।এর পূর্বে তিন-চার বার এই শহরে ইন্টারভিউ দিয়েছি।মামা না থাকলে কোথাও চাকুরি হয় না।লোকটা আবারও হাসছে—কী সুন্দর হাসি! নীলক্ষেতের তেলের স্টেশনের পাশে গাড়ি সাইড করতে করতে আবারও সিএনজির ছোট আয়নায় চুরি করে হাসি দেখে নিল সোবহান।ভদ্রলোক বললেন, যদি আপনার আপত্তি না থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কিছুক্ষন রেষ্ট নিব। সোবহানের বাড়ির অবস্থা একটু ভালো হলে নিয়ে যেতে পারত। গ্রাম থেকে আসা একটা মানুষ যদি গায়ে পানি ঢেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে পারত, তার নিজেরও স্বস্তি হতো। কিন্তু অসুস্থ মানুষ ঘরে, আবার প্রস্তাব শুনে লোকটাই বা কী মনে করে ভাবতে ভাবতে বলল, ‘তাই অইবো,আপনি আমগো মেহমান।’
পথিমধ্যে হঠাৎ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেই গ্যাস নিয়েছে। নিশ্চয়ই তাহলে ইঞ্জিনে কোথাও গোলমাল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিব্রত হয়ে গেল সোবহান। আবার মনে মনে ভয়ও হচ্ছে ভাড়া নিয়ে। প্রায় মিনিট পনেরো চেষ্টার পর লোকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। দেরি না করে খুব হুড়োহুড়ি করে নেমে গেল।যদিও ভদ্র ভাষায় বলল, ‘ভাই সাহেব, ভেবেছিলাম বিকেল পর্যন্ত আপনার সিএনজি দিয়েই কাজ সারব, কিন্তু অপেক্ষা করা সম্ভব না। ভাড়া কত দিব?’সোবহান হিসাব করে বলল, ‘বারো শ টাকা।’
লোকটা অবাক করে তাকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে দিয়েছে।
‘ভাংতি হবে না, ভাই।’
‘ফেরত চাইনি।’
সোবহান এবার 'থ' হয়ে গেল। এত অদ্ভুত যাত্রী সে আগে দেখতে পায়নি। লোকটার দিকে পরম মমতা নিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার ইন্টারভিউ তো আমাগো ওই দিকেই। জায়গাটা নিরাপদ না।দেখেশুনে যাইবেন, সাবধানে থাইকেন।’
হাসি দিয়ে বিদায় নিয়েছে অচেনা যাত্রী। পাশের এক গ্যারেজে ঠেলে ঠেলে গাড়ি নিয়ে ঠিক করাল সোবহান।বাড়ি ফিরে আপেল ও কমলা দিল মেয়েকে।এতগুলো ফল দেখে মেয়ে বললো বাজান,আগেও তো আঁর অসুখ অইছিল এত ফল আনেননি।সোবহান বললো সব তোরে খুইলা বলমু।নোট দুটো আলমারির ভিতর রাখলো সোবহান।এখনই খরচ করতে ইচ্ছে করছে না নোট দু'টি।এক হাজার টাকার একটা নোট ভাংতি করলেই শেষ।রাতেও অনেকবার মনে মনে মানুষটার কথা ভেবেছে সে। মানুষটার চাকরিটা হলে কত ভালো হতো।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জ্বরের মেয়েটাকে কোলের ভেতর নিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছে সে।মেয়ে একটা আপেল খেয়ে বাকিটা রেখে দিতে বলেছে।সে আরও পাঁচ দিন খেতে পারবে। হিসাব শুনে সোবহান বলেছে, ‘আম্মা, আপনার আব্বা কি কোনো দিন আপেল কিনে খাওয়ায় না?’ মেয়ে কী সুন্দর হাসি হেসেছে, ‘খাওয়ায়, শুধু অসুখ হইলে। আর সেইগুলা তো লাল আপেল, স্বাদ এত মিডা না।’ মেয়ের জন্য মায়া লেগেছে সোবহানের। যাক, পকেটে এখনো টাকা আছে, সে আবার এক কেজি সবুজ আপেল কিনবে। সকালে নতুন ক্ষ্যাপ মারলে আর এখনই নোট ভাঙাতে হবে না ভেবে খুশিমনে আজও অন্য দিনের মত পেপার পড়তে পড়তে স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল সোবহান।কিন্তু পত্রিকার শিরোনামটা দেখার পরই সব তোলপাড় হয়ে গেল। যার কথা বলা হয়েছে, এই লোক তাদের আয়-রোজগারের ভাগীদার।এই এলাকার ফুটপাতের কাগজ বিক্রেতারাও বখরা না দিলে বসতে পারে না। অটোরিকশার পেছনে যখন বখাটে ঠিকাদারগুলা বাড়ি দিয়ে খিস্তিখেউড় করে, প্রায়ই মনে হয় স্টেশনের সব অটোরিকশার ড্রাইভারকে বলে, ‘চলেন, গুন্ডাডারে আচ্ছা ধোলাই দেই।’ সেই শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত।এতে তার একটু হলেও স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু শিরোনামের নিচে যে বীভৎস ছবি, তা বড় মর্মান্তিক। লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। মাথার নিচ থেকে রক্ত এসে ভাসিয়ে নিচ্ছে কাগজের ঠোঙা, টুকরো ইট। ছবিটা বোধ হয় মৃত্যুর অনেক পর তোলা। রক্ত জমাট বেঁধে কালচে আর মাছি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শার্ট-প্যান্ট পরিচিত লাগছে! পায়ের জুতা জোড়া, বাঁ হাতে ঘড়ির বেল্টও দেখা যাচ্ছে। এই ঘড়িটাই উল্টে কি বলেছিল, ‘ভাইসাব, দুপুর হয়ে গেছে। চলেন একসাথে...।’ লাশের পাশে বক্স করে ছাপানো কালো ব্যাগের ছবি। তার পাশে বইগুলো ছড়ানো ছিটানো। এই ব্যাগটাই কি দেখেছে সে! ঝাপসা চোখে অটোরিকশার ড্রাইভার সোবহান খবরের অক্ষরগুলোর ওপর চোখ রাখছে।দেরি না করে থেমে থেমে অটোরিক্সা টা নিয়ে ঘরে ফিরেই পেপারটির দিকে তাকিয়ে বললো 'আন্নের চাকুরির আর দরকার নাই, আল্লাহ আন্নেরে বেহেস্তে যায়গা করে দিবেন' এই বলে সজোরে কেঁদে ফেললো--
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন