সন্তানকে যোগ্য নাগরিক করতে চাইলে দম্পতিদের নিজেদের চরিত্র গঠন ও সন্তানদের সাথে মানসিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০১:৪৯:১০ দুপুর

সংসারে বাবা মা'র সবচেয়ে প্রিয় হলো তার সন্তান।নিজের আদরের সন্তানটিকে ঘিরেই থাকে সমস্ত চিন্তা ভাবনা। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবেছি যে আমাদের সাথে সন্তানদের মানসিক যোগাযোগ কতটুকু? অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে সন্তানের সাথে মানসিক যোগাযোগের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ অভিভাবকেরই ধারণা সন্তানের চাহিদা মেটানোই সন্তানের প্রতি তাদের একমাত্র দায়িত্ব। কিন্তু এটা একটি ভুল ধারণা।বাবা মা দু'জনেরই ভূমিকা রয়েছে।তবে মা'র ভূমিকা ঘরে অতি গুরুত্বপূর্ন।বাবা যেহেতু বাইরে থাকে সে কারনে দিনের সিংহভাগ সময় সন্তান থাকে মা'র সাহচর্যে।আর একটি শিশুর নৈতিক বর্ধন শুরু হয় যখন সে শিশুটি থাকে মায়ের পেটে।মা'কে সে সময় থেকে চলাফেরায় কথা বার্তায় যত্নশীল হতে হয়।যে যে ধর্মের অনুসারিই হোক তাকে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলাই উত্তম।মুসলিম মা'কে অবশ্যই শিশু পেটে আসা এমনকি তার আগেই সুন্দর পরিকল্পনা নেয়া উচিত।মা'কে আলকুরান ও সূন্নাহ তথা পর্দার অন্তরালে চলা,ইসলামের মৌলিক কাজ গুলোর মাধ্যমে নিজেকে সংযত রেখে চলা,যথাযথ পর্দা করে চলা ইত্যাদি।নয় মাস সন্তানটি মায়ের পেটে থাকে।এ সময় মায়ের সব কর্মকান্ড সন্তানের উপর আচর পড়ে।বাবার যে ভূমিকা নেই তা নয়।বাবার কাজ হলো বাইরের কাজগুলোর মাধ্যমে মা'কে সহযোগিতা করা।মা যাতে সন্তানকে নিয়ে পর্দার মাধ্যমে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে সুব্যাবস্হা করা।সম্রাট নেপলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও,আমি একটি শিক্ষিত জাতির জন্ম দিব।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়,খুব কম মা ধর্মীয় আচার আচরন মেনে চলেন।শুধু যে মা'কে দোষী করবো তা নয়। এ ক্ষেত্রে বাবা'রা ও উদাসীন।সংসারে নেতৃত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহ পুরুষকে এক ধাপ উপরে স্হান দিয়েছেন।এ ধাপ কোন ডিকটেটরশিপ নয় বরং এ হলো নৈতিক দায়িত্ব যে, বাবা যেন সুন্দরভাবে সংসারের দায়ভার বহন করেন।দু'জনের সুন্দর আচরন ও বুঝাপড়ার মাধ্যমে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।কেস ষ্টাডি করলে প্রায় প্রতিটি দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু ইনফেরিওরিটি ও সুফিরিওরিটির মত সমস্যা বিরাজমান। এগুলো নিতান্ত ছোট ব্যাপার।কিছু উদাহরন দিলে জিনিসগুলো বুঝতে সহজ হতে পারে।ধরুন- বিবাহের ব্যাপারে দেখা যায় অনেক বাবা মা সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হলে নিজেরাই নিজের পছন্দমত মেয়ে দেখে সন্তানকে বিয়ে দিয়ে দেয়।এ ক্ষেত্রে সন্তানটি যদি বাবা মা'র সাথে ফ্রি হয় তাহলে তারা কথা বলতে পারে আর যদি ভীত থাকে তাহলে মেনে নেয়।পরবর্তি সময়ে সংসার জীবনে হয়ত কোন খুনসূটি বেঁধে যেতে পারে।হয়ত মেয়েটি বা ছেলেটি খুব সুন্দর নয় বা তাদের একজন আর একজন থেকে যে আচরন খুঁজে বেড়ায় সেটাও মনের সাথে মিলছে না।আবার দেখা যায় দু'জনের একজন পড়াশুনায় আগ্রহী এবং অন্যজন পার্থিব জীবনের ভোগে তৎপর অথবা একজন পুরুষ চায় স্ত্রী ফিটফাট থাকুক অথচ সে স্ত্রীটি সংসার নিয়ে ব্যাস্ত থাকে।আবার অনেক পুরুষ বা স্ত্রী স্বাধীনতার নামে তাদের নিজ নিজ কর্মের জীবন উপভোগ করে যা প্রতিফলিত হয় সংসার জীবনে আর তার প্রভাব পড়ে সন্তানদের উপর।সেজন্য যেভাবেই দাম্পত্য জীবন শুরু হোক না কেন দম্পতিদের নিজেদের বুঝাপড়া করে নেয়া উচিত আর তা জীবনের প্রথম দিন হলেই ভাল যাতে পরে দাম্পত্য জীবনে ক্ষতি বয়ে নিয়ে না আসে।এখানে আরো কিছু সামাজিক ব্যাপার আছে যা ইসলামের নৈতিক দিক গুলো না মানার কারনে মুসলিম সমাজে ঘটে থাকে।বেপোরোয়া চলাফেরা , পার্টি গেদারিং,উগ্র পোষাক,মোবাইল ফোনে অযথা কথপোকথন,ফেসবুকে চ্যাটিং ও পরিচয় করা একে অন্যের সাথে।মোটকথা দাম্পত্য জীবন শুরুর আগেই একটা সরল জীবনের কথা চিন্তা করা ও একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহন করা।এই পরিকল্পনাটা গ্রহন না করার কারনেই আজ সমাজ অস্হির।

সন্তানের সাথে মানসিক যোগাযোগ করে তুলতে না পারলে সন্তানের সাথে অভিভাবকের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে সন্তান তার সুবিধা অসুবিধাগুলো মা বাবার কাছে বলতে পারে না।এর ফলে নানান রকম সমস্যায় তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায়। সন্তানের সাথে মানসিক যোগাযোগ বাড়িয়ে তোলা তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়। বেশ সহজেই আপনার আদরের সন্তানের সাথে মানসিক যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে পারবেন আপনি।আসুন জেনে নেয়া যাক সন্তানের সাথে মানসিক যোগাযোগ বাড়িয়ে তোলার কিছু সহজ উপায়:

১-প্রতিদিনের খোঁজ খবর নিন:

আপনার সন্তানের খোঁজ খবর নিন প্রতিদিন।ভোর হলে দিনের প্রথমে আপনার সন্তানটি আজান দিলে নামাজ পড়লো কিনা।সময় থাকলে কুরআন তালাওয়াত করলো কিনা।সময়মত নাস্তা করলো কিনা।স্কুলে যাওয়ার আগে তার বই খাতা ও স্কুল ব্যাগ সব ঠিক আছে কিনা।অনেক মা এগুলো কাজের লোকদের উপর ছেড়ে দেন।কাজের লোক করলেও মাকে এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়া জরুরি কারন এর মাধ্যমে সন্তাণের সাথে মানষিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। স্কুল থেকে কিংবা প্রাইভেট টিচারের বাসা থেকে ফেরার পর তাকে জিজ্ঞেস করুন সারা দিন কী কী ঘটেছে। কীভাবে সারা দিন কাটিয়েছে আপনার সন্তান থেকে সেটা জেনে নিন।সম্ভব হলে কোন কোন বিষয় গুলোতে কেমন ফারফরমেন্স করেছে তাও জেনে নিতে পারেন। প্রথম প্রথম হয়তো সে বলতে চাইবে না অনেক কিছুই। কিন্তু প্রতিদিন জিজ্ঞেস করলে ধীরে ধীরে সে মন খুলে আপনার সাথে তার প্রতিদিনের খুঁটিনাটি বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করবে।এ ক্ষেত্রে নিজের জীবনের গল্প বলুন কিভাবে আপনার বাবা মা আপনাকে গড়ে তুলেছেন।আপনার সন্তানের সাথে নিজের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা গুলো আলোচনা করুন। সন্তানকে বলুন যে আপনিও এক সময় তার মতো ছোট ছিলেন। তার বয়সটা আপনিও পার হয়ে এসেছেন। সেই বয়সের ভুল ত্রুটি গুলো কিভাবে শুধরে নিয়েছিলেন সেগুলো আপনার সন্তানের সাথে আলাপ করুন। সেই সঙ্গে জীবনের মজার মজার ঘটনা গুলো তাকে বলুন। তাহলে সন্তানের সাথে আপনার মানসিক দূরত্ব কমে যাবে এবং আপনার সন্তান আপনার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।

২-নমনীয় আচরণ করুন:

সন্তানের সাথে সব সময়ে নমনীয় আচরণ করুন। তার ছোট ছোট শখ গুলো সাধ্যমত পূরণ করার চেষ্টা করুন। তার মতামত গুরুত্বের সাথে শুনুন এবং সেটাকে বিবেচনা করুন। তার ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলো ভালো খারাপ বিবেচনা করে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করুন। সন্তানের সাথে নমনীয় আচরণ করলে সন্তানও আপনার কথা গুলোর গুরুত্ব দেবে এবং তার সাথে আপনার মানসিক দূরত্ব কমে যাবে।অনেক বাবা মা অশিক্ষার কারনে সন্তানদের উপর তার কিছু অন্যায় কাজের জন্য মারধর করেন।এতে সন্তানের ব্যাক্তিত্বের উপর আঘাত আসে।আর সে কারনে সে সন্তান পরবর্তিতে বাবা মাকে এড়িয়ে চলে।সে জন্য চরম শাস্তি না দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করুন,রিজনগুলো তার মাথায় ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করুন।বড় বড় মনিষীদের ব্যাক্তিত্বকে তাদের সামনে তুলে ধরুন।মনে রাখবেন দম্পতিদের আচরন প্রতিটি শিশু মনে রাখতে সহায়ক হয় কারন শিশুদের মেধা অত্যন্ত প্রখর।সমাজে দেখা গেছে ছোট বেলার অনেক কথা তারা বড় হয়ে বাবা মাকে বা পরিবারের অন্যদের বলেছে এমনকি বাবা মা'র দাম্পত্য জীবনের অনেক কথাও তারা বলে দিয়েছে।ইসলাম সেজন্য শিশুদের বিছানা আলাদা করার ব্যবস্হা করার কথা বলেছে যা দম্পতিরা অনুসরন না করার কারনে শিশুটির সুপ্ত প্রতিভাবে জাগরিত করে এবং টিন এজে এই শিশুরাই বেশী নৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩-সন্তানের সাথে খেলাধূলা অন্যান্য সুস্হ বিনোদনে নিয়জিত থাকুন:

সন্তানকে সারাদিন পড়ায় ব্যাস্ত না রেখে পরিকল্পনা করুন কখন একটু খেলা বা শরীর চর্চার সময় বের করা যায়।খেলা বা শরীর চর্চার মাধ্যমে তার অবসাদগুলো কেটে যাবে ও পরের সময়গুলোতে নিয়মানুবর্তি হতে সহজ হবে।আর সবচেয়ে ভাল সবাই একসাথে যদি জয়েন করা যায়।এ কাজ করলে আপনার সন্তানের সাথে আপনার মানসিক দূরত্বটা কমে যাবে এবং আপনার সন্তান আপনাকে তার বন্ধু ভাববে।সন্তানের সাথে বন্ধুত্বের ভাব না করতে পারলে কখনো পরিবেশ ইতিবাচক হয়ে উঠবে না।সেজন্য দম্পতিকে এদিকে খেয়াল করতে হবে।সন্তানের পরীক্ষায় একবার খারাপ ফলাফল করলেই হতাশ হয়ে তাকে বকাঝকা করবেন না। বরং তাকে বুঝিয়ে বলুন যে এবার খারাপ হলেও পরের বার ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করতে হবে।অনেক সন্তান দেখা যায় ভাল ফলাফল করেও প্রথম শ্রেনীর প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে পারে না, সেক্ষেত্রে কটাক্ষ না করে যে প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেয়েছে সেখানে ভাল করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। সন্তানের প্রতিটি বিষয় নিয়েই ইতিবাচক আচরণ করলে সন্তানের সাথে আপনার মানসিক ব্যবধান কমে যাবে এবং আপনাদের সম্পর্ক আরো সুন্দর হবে।

৪-ব্যাক্তিত্ব বিকাশের অন্যান্য বিষয়গুলোর জন্য সন্তানের সাথে শেয়ার করা:

পড়ার পাশে এডিশনাল কিছু বিষয় যেমন-ডিবেট,কলাম লিখার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো,নিউজ রিডিং,কেলিওগ্রাফি,দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন, বিভিন্ন সুস্হ সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে আংশগ্রহন করা, এ ধরনের বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করার জন্য বাবা মাকে উদ্যোগী হয়ে পরামর্শ দেয়া ও সম্ভব হলে সাথে নিয়ে যাওয়া।

আর একটি গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হলো আজকাল অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে গিয়ে ছেলে মেয়েরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।যারা আধুনিকভাবে গড়ে উঠেছে বা পাশ্চাত্যের আদলে পড়াশুনা করে এসেছে।ইসলামি আচার আচরন না থাকার কারনে তাদের উগ্রতা প্রভাবিত করছে ছাত্র ছাত্রীদের।এদিকে বাবা মাকে খেয়াল রাখতে হবে কোথায় তারা তাদের সন্তানদের পাঠাচ্ছেন।অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক গন ছাত্র- ছাত্রীকে মানসিকভাবে গড়ে না তোলার কারনে ও সঠিক বুঝ না দেয়ার কারনে ও ভাল রেজাল্ট করার টেকনিকগুলো রপ্ত না করানোর জন্যই তারা পিছিয়ে যায়। তবে শিক্ষক ,অভিভাবক ও ছাত্র ছাত্রি যদি একযোগে শ্রদ্ধা ভক্তির সাথে মননিবেশ করেন তাহলে সব ছেলে মেয়েই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।অনেক অভিভাবক শিক্ষকের সাথে যেমন রুড় আছরন করেন তেমনি শিক্ষক ও রাগান্বিত হন এতে ছাত্র ছাত্রিদের মধ্যে অভিভাবক ও শিক্ষকের মধ্যে একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।সুতরাং আচরনের ব্যালেন্স ও সৌহার্দপূর্ন সম্পর্ক যাতে বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা অভিভাবক ছাত্র ও শিক্ষকের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

বিষয়: বিবিধ

১৪৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

165356
২১ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:২৫
সালাহ লিখেছেন : চরিত্রের প্রভাব যে কত প্রখর তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি । ধন্যবাদ দিলাম - সমাজ সংস্করণমূলক লেখনী দিবার জন্য
165372
২১ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:৪২
প্রিন্সিপাল লিখেছেন : অবশ্যই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File