সাফল্যের কোনো কোন সহজ রাস্তা নেই-দুর্গম রাস্তা ফেরোনো ছাড়া।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৩:০৪:১৩ দুপুর

যতদূর মনে পড়ে ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের সময় আমার বয়স ৯ বছর।৭১ এর সময় পাড়াগাঁয়ে কঠিন জীবন ফাঁড়ি দিতে হয়েছিল। বাবা ছিলেন একজন প্রাথমিক শিক্ষক।উপজেলার পাশেই আমাদের আবাস।নিরন্তর ভীতির মধ্যে সময় কাটতো আমাদের।আমাদের বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরে হিন্দুদের আবাস।রাজাকার , আলবদর ও পাকিস্তানি ট্রুফ মিলে দুবার তাদের বাড়িগুলো পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল।শেষ যেবার এলো হিন্দু এক বুড়ো আর বাড়ি থেকে বের হতে পারে নি।তারা বন্দুকের নল দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিল।আর এক অশিতিপর বুড়ো তার একাদশ বছরের নাতনিকে জড়িয়ে বসেছিল, হয়ত তারা ছিনিয়ে নিতে ছেয়েছিল নাতনিকে কিন্তু দাদি এমন করে আঁকড়ে ধরেছিল যে তারা গুলি করে দু'জনকে হত্মা করেছিল।আমি এ দৃশ্যগুলো দেখে অনেকদিন রাতে ঘুমুতে পারিনি।মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম।আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি সৈনিকরা যেত তাদের সাথে থাকতো কয়েকজন রাজাকার।একবার আমার বাবা ও আমার ছোট মামা বের হচ্ছিলেন বাড়ি থেকে।তাঁদের দেখা মাত্র ওরা জিজ্গেস করলো " ইঁদুর কিদার হায় , হামারা সাথ চলো" এই বলে দু'জনের মাথায় তাদের অস্ত্রের সরন্জামের দু'টো বস্তা তুলে দিল।প্রায় তিন মাইল রাস্তা তাদের যেতে হয়েছিল।আমার মা তো শুনে প্রায় অজ্গান হয়ে গেল।তিন ঘন্টা পর তারা যখন ফিরে এলো আমরা স্বস্তি পেলাম। 'ন' মাস কেটেছে আমদের এ রকম ভীতিকর অবস্হায়।

উপরের এ কথাগুলো না বলে উপায় ছিল না এজন্য যে,আজকে যখন ভাবি সেই অজপাড়া গাঁ থেকে বড় হয়ে উঠে আসলাম অত্যন্ত চড়াই উৎরাই করে।আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবার একমাত্র সন্তান।বাবার প্রায় ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কত ছাত্র যে আসতো বাবার কাছে।কেউ ডাক্তার,কেউ ইন্জিনিয়ার,কেউ সিভিল সার্ভেন্ট,কেউ আর্মি অফিসার, কেউ ব্যাংকার আবার অনেকে ছিল শিক্ষক।আমার বাবা শুধু একজনের কথা বলতেন যিনি ছিলেন আমাদের পাশেরই গ্রামের ঈষ্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভেন্ট- যাকে আকরামুদ্দিন ডেপুটি হিসেবে সবাই চিনতো।তিনি ছিলেন রিলিফ কমিশনার।বলতেন তার মত হবে।এর কারন ছিল তিনি এতই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন যে , বাড়ি আসলে যখন ভাইরা আর মাঠে যেত না তিনি হালের বলদ আর জোয়াল নিয়ে মাঠে নেমে যেতেন।এ দেখে মানুষ বিস্মিত হয়ে যেত যে, একজন অফিসার যাকে উপজেলার মানুষ ঘোড়ায় চড়িয়ে বেড়িয়েছে তার ইপিসিএস পাশের পর সে নাকি মাঠে হালের বলদ নিয়ে চাষ করতে কুন্ঠিত হতো না।আজ আমাদের সামান্য বেড়ে উঠা নিয়ে আমরা অনেকে গ্রামে যেতেও লজ্জাবোধ করি।আমি একজন হিসাব বিজ্গানের ছাত্র।বাবার কথা রাখতে পেরেছি কিনা জানি না তবে গত ২১ বছর আগে যখন প্রথম সৌদি বিনলাদিন গ্রুফে একজন সিনিয়র হিসাব নীরিক্ষক হিসেবে যোগদান করার প্রাক্কালে যখন জেদ্দা পৌঁছলাম সরাসরি আমার এক আত্মিয়ের সাথে চলে গেলাম মক্কায় যার বাসনা অনুভব করতাম ছোটবেলায় যখন দেখতাম আমার আশে পাশের কেউ ছুটিতে এসে মক্কা বা মদিনার গল্প করতো।মক্কায় ওমরাহ করে আল্লাহর কাছে অনেক কিছু চেয়েছিলাম, ধীরে ধীরে আল্লাহ তার অনেক কিছুই দিলেন।মক্কা এবং মদিনা হারামের সাথে বা তার আশে পাশে যত আধুনিক কাজ হয়েছে ও হচ্ছে তার সাথে আল্লাহ যে আমাকে সম্পৃক্ত রেখেছেন একজন লেটার ওফ ক্রেডিট কর্মকর্তা হিসেবে তার জন্য শুকরিয়া আদায় করি।সে সুদূর অজপাড়া গাঁ যে আমার জীবনের স্হাপত্যের কেন্দ্র বিন্দু তাতে কোন সন্দেহ নেই।সূরা ইসরার ৮০ আয়াতে আল্লাহ তার নবীকে শিখিয়ে দিয়েছেন আর তুমি বলো,'আমার প্রভু! আমাকে প্রবেশ করতে দাও মংগলজনক প্রবেশ করনে,আর আমাকে বের করে আন মংগলময় নির্গমনে,আর তোমার কাছ থেকে আমাকে দাও এক সহায়ক কতৃত্ব।"

এখন যখন আমার ক্যারিয়ারের পেছনে ফিরে তাকাই, অনেক মজার ঘটনা, অনেক উত্থান-পতন মনের মনিকোঠায় ভেসে আসে।গভীর রাতে ১৭ তলায় জানালার পর্দা খুলে ৩ কিলোমিটার দূরে রেড সি'র দৃশ্য বা আকাশে নীলাভ আভা দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।কি অদ্ভুত জীবন মানুষের? কোথায় জন্মালাম আবার কোথায় কর্মক্ষেত্র তৈরি হলো, এসব-ই মনের পর্দায় আলো ফেলে। কতটুকু জিতলাম বা হারলাম সে কথা বড় নয় তবে ভাবি হয়ত আমি খুবই সৌভাগ্যবান একজন, কারণ গত ২১ বছরে হজ্জে গিয়েছি ৩ বার অসংখ্য ওমরাহ করেছি।যারা এ দেশে আমার মত একজন নাখান্দা বান্দার মত তারা সবাই এর চেয়ে অনেক বেশী অর্জন করেছেন।তবে প্রশ্ন হলো এই যে হ্জ্জ বা ওমরা আমরা করছি খুব কম মানুষের মধ্যেই দ্বীনের পরিবর্তন এসেছে।ইসালামের কাজগুলো করছে আবার খারাপ কাজগুলোও করছে।আবার অনেক এখানে দীর্ঘ জীবন যাপন করছে কিন্তু একটা হজ্জ ও পালন করেনি। আবার অনেকে বছরে একবার ওমরাহ করারও সময় পান না।এত বড় একটা নেয়ামত আমাদের জন্য যারা মক্কা ও মদিনার আশে পাশে থাকি একটু ইচ্ছে করলেই যেতে পারি।আমাদের হয়ে উঠে না কারন আমরা এ পৃথিবীর মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি।

অনেক পরিশ্রমের পর যখন সফলতা আসে তখন মনে নিশ্চয়-ই আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।সততা,কর্মদক্ষতা ও গভীর জ্গান মানুষকে সাফল্য এনে দিতে পারে।তবে এর জন্য দরকার ফোকাস ও সাথে সাথে সময়ের সৎব্যাবহার।একজন সৎ মানুষ জীবনে সফল।পার্থিব জীবনে হয়ত অনেকে সফল নন তবে নিশ্চিত আখেরাতে সফল।কারন আল্লাহ আলকুরআনে অনেক আয়াতে বলেছেন,আমি কাউকে দেই আবার কাউকে মেপেজোখে দেই।সুতরাং একজন মানুষকে দুই অবস্হায়-ই সৎ থাকতে হবে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।আমি সত্য বলছি, যারা আমার মত শিক্ষকের ছেলে তাদের অনেক কষ্ট করে বড় হতে হতে হয়।আমার ছাত্র জীবনে অনেক সময় বাবার সামান্য টাকায় বই কিনে ফেলেছি কিন্তু আমাকে কখনো ক্ষুদার্থ থাকতে হয়েছে কিন্তু পড়া ছেড়ে দেই নি।আমার এক বন্ধু এখন সুপ্রিম কোর্টের বড় উকিল।সেও ছিল শিক্ষকের ছেলে।'ল' এর ক্লাস শেষ করে রাস্তায় কলের পানি পান করে কত যে সময় কাটিয়েছে কিন্তু পড়া বন্ধ করে দেয় নি।এ রকম জীবন আমরা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত পার করেছি কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হই নি।প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা আদর্শ থাকে, চাই সে ভাল বা মন্দ।ভাল আদর্শের মানুষগুলো চিত্তে সবল থাকে,কোন ভয় তাদের হৃদয়ে কাজ করে না।হতে পারে জীবনে কোন ঝড় আসে সাময়িক,যদি তা মেনে নেয় এ আমার জন্য পরীক্ষা তাহলে সে উত্তির্ন।আর যে কপট তার জন্য ও পরীক্ষা যদি সে অনুশোচনা করে তার অতীত কৃতকর্মের জন্য।

আমি আমার দর্শনকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করেছিলাম।আমি যে পড়াশুনায় খুব ভাল মনযোগী ছিলাম তা নয় তবে জীবনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চলার চেষ্টা করছি।ইসলামের মৌলিক জ্গান আহরন করে সে পথে চলার চেষ্টা করেছি।যদিও আজ বাংলাদেশে ইসলামকে বিভিন্ন দল তাদের কায়েমি স্বার্থের কারনে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করছে।সময় মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় উপাদান যা আজ মানুষ ব্যাবহার করছে ভিন্ন খাতে।প্রতিটি মানুষের মেধা আছে আর তা পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল করতে পারে।আর এর সাথে প্রয়োজন ধৈর্য।অনেক সময় মনে হয় বার বার একটি জিনিস অনুশীলন করছি কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না।রবার্ট ব্রুস ৭ বারে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন।আজও পত্র পত্রিকা গুলো দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই।কেউ অন্যের ঘরের আলোতে পড়ে জিপিএ পাচ্ছে।আবার কেউ রিক্সা চালিয়েও জিপিএ পাচ্ছে।আমাদের সরকার ও ধনাড্য ব্যাক্তিদের উচিত এদেরকে বিভিন্ন স্কুল বা কলেজে স্হান করে দেয়া।যাই হোক, আমি সব সময় নিজের জন্য সেরা পরিশ্রম দিতে চেষ্টা করতাম। আমি মনে করি, নিজের সামর্থ্য আর দুর্বলতার জায়গাগুলো বুঝতে পারা একজন মানুষর জন্য খুবই দরকার ও উন্নতির জন্য ক্রমাগত পরিশ্রম করে যাওয়া এবং সেটা করতে চেষ্টার ক্রুটি করিনি। জীবনে সাফল্যের জন্য কোনো সহজ রাস্তা নেই, তাই একজন মানুষকে ভালো করতে হলে সামর্থ্যের পুরোটুকুই দিতে হবে। আমার মনে আছে স্কুল জীবনে আমার পরীক্ষার সময়ে বাবা আমার কাছে বসে থাকতেন এবং পড়ার টেকনিকগুলো বলে দিতেন।তার মধ্যে একটি ছিল লাইন বাই লাইন পড়া ও বুঝতে চেষ্টা করে।

পরবর্তী সময়ে বুঝলাম পরীক্ষায় আনসিন কোন প্রশ্ন আসলে আমাকে কখনো বেগ পেতে হতো না অর্থাৎ ১০০% প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে আসতাম।আবার বাবা ঠিক ঐ প্রশ্নগুলো জিজ্গেস করে কনফার্ম হতেন আমি সঠিক কাজটি করেছি কিনা।

ছোটবেলার আমার স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই।বাবা চেয়েছিলেন আমি একজন ডাক্তার হই কিন্তু আমি ভীষন বেয়াড়া ছিলাম আমার পারিপার্শিক অবস্হা থেকে উত্তরনের জন্য।বাবার আর্থিক সন্কট আমাকে একজন এ্যাকাউন্টান্ট জেনারেলের জীবনের দিকে তাড়া করলো।আমি তার পরিবেশের অবস্হান দেখেছিলাম চমৎকার।এটা নিতান্ত ছোটবেলার আক্ষেপ ও চাওয়া যা সবারই হয়ে থাকে।স্টেটাস এ ততটুকু পৌঁছতে না পারলেও টাকার অন্কে পৌঁছেছি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাবার কথাটা রাখা শ্রেয় ছিল তাহলে বাবার কথার আনুগত্য ঠিক থাকতো।এ ও অদৃষ্টেরই পরিহাস।তবে যতই দুর্গম রাস্তা পেরিয়েছি স্মরন করছি তাদের যারা স্কুল ও কলেজ জীবনে আমাকে দীক্ষা দিয়েছেন,পরামর্শ দিয়েছেন,ভাল রাজাল্ট করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন সে সমস্ত বরেন্য শিক্ষকদের।আমি শুধু পরিশ্রম করেছি আর আল্লাহকে স্মরন করেছি মাত্র।আমি আবারো মনে করি একজন মানুষেকে প্রকৃত মানুষ করার জন্য বাবা মা, শিক্ষক , ভাল বন্ধু হতে পারে পথিকৃৎ আর সাফল্যের জন্য সহজ কোন রাস্তা খুঁজতে যাওয়া উচিত নয় বরং দুর্গম রাস্তা অতিক্রম করার মধ্যেই নীহিত রয়েছে প্রকৃত আনন্দ।

বিষয়: বিবিধ

১২৪০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

162439
১৪ জানুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৪
জেদ্দাবাসী লিখেছেন : জিবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখাটা পড়ে অনেক জানতে পারলাম । অনেক ধন্যবাদ

যাজ্জাকাল্লাহ খলায়ের
162445
১৪ জানুয়ারি ২০১৪ বিকাল ০৪:২৯
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File