সমাজ সংস্কার কি শুধু আল্লামা ও মওলানাদের কাজ? না সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবি ও বিবেকবানদের ও দায় আছে।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:১৭:৪৪ বিকাল
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলিম পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।সে কারনে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ছোট বেলা থেকে প্রত্যেক বাবা মা সন্তানদের দেয়ার চেষ্টা করেন।যে বাবা মা দ্বীনের মৌলিকত্বে বেশি জ্গানী তারা তাদের সন্তানদের সেভাবে গড়ে তোলেন।সে কারনে পরিবারগুলোর আচার আচরন ও সমাজকে প্রভাবিত করে।আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে ধর্মের কারনে আল্লামা ও মওলানা শব্দ দু'টির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত।সমাজের একটা বড় শ্রেনী ইসলামের সঠিক জ্গান না থাকার কারনে এই শব্দধারি মানুষগুলো দেখলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।এর কারন হলো, একজন মুসলমান মাত্র তার ধর্মকে সবার উপর স্হান দেয়।সেজন্য কেউ যদি ধর্মের উপর কালিমা লেপন করতে চায় তারা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে।এটা সামজের একটা স্বাভাবিক রুপ এবং একজন মুসলমানের অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা: এর প্রাধান্য থাকবে সবকিছু থেকে বেশি নি:সন্দেহে।তবে তা হতে হবে আলকুরআন ও সূন্নাহের মাপকাঠিতে।কোন তথাকথিত আল্লামা বা মওলানাদের মাপকাঠিতে নয় যারা শির্ক ও বিদা'আতে আচ্ছন্ন হয়ে সমাজ সংস্কার করছেন।ইসলামকে যদি আমরা বুঝতে চাই তাহলে আমদের এর গোড়ার দিকে ফিরে যেতে হবে অর্থাৎ মক্কা ও মদিনায় যে ইসলাম আলকুরআন ও সূন্নাহের আলোকে প্রচার হচ্ছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।রাসূল সা: কিভাবে ইসলাম প্রচার প্রসার করেছেন,তার পরে তার সাহাবিগন ও যুগ যুগ ধরে মুহাদ্দেছিনগন কিভাবে ছহি সূন্নাহের ভিত্তিতে সমাজ সংস্কার করেছেন সে জ্গানে জ্গানী হতে হবে।যদি এই জ্গান সংগ্রহ করা যায় তখন একজন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব অন্য ধর্ম বা সমাজে যারা ধর্মের কাজ করছে তাদের ধর্মীয় কাজের তুলনা করা।
আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে- অধিক বিদ্যান বা অধিক জ্ঞানী মানুষ। এই শব্দটি কারো নামের আগে প্রয়োগ হতেই আমরা আল্লামা ইকবালের কথা স্মরণ করি, যিনি শুধু একজন যুগশ্রেষ্ঠ কবিই ছিলেন না, ছিলেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে জ্ঞানের মেলবন্ধন রচনাকারী চিন্তাবিদ; ভাষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্মচিন্তায় যার ছিল ব্যাপক পুঁথিগত জ্ঞান, প্রয়োগ চিন্তাও বিস্ময়করভাবে। বিশ শতকের মুসলমান সমাজ আল্লামা ইকবালকে সমাজ, ধর্ম, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তার একজন অসামান্য দিশারী হিসেবেই পেয়েছিলেন।তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও ইকবাল যথাযথ একজন আল্লামা হিসেবেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যসহ উন্নত দুনিয়ার একাডেমিক জগতে বহুলভাবে সমাদৃত হচ্ছেন। অসংখ্য গবেষণাকর্ম এবং লেখালেখি হচ্ছে ইকবালের জ্ঞানসাধনার স্বরূপ অন্বেষণে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে মওলানাদের মধ্যে অনেকের নামের সঙ্গেই আজকাল আল্লামা উপাধিটি ব্যবহার করতে দেখা যায় যাদের বেশিরভাগই ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রতত্ত্ব, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য বা বিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক কোন লেখা দেশ ও জাতিকে উপহার দেননি, সাধারণ কিছু ধর্র্মীয় বই-পুস্তক রচনা বা ওয়াজ মাহফিলে সুরেলা ওয়াজ করার মাধ্যমে এক ধরনের পরিচিতি অর্জন করেন, যার স্থায়িত্ব যুগ যুগ ধরে ধরে রাখার মত বিবেচিত হয় না।ভারত উপমহাদেশে ইসলামের যে প্রচার প্রসার হচ্ছে তার জন্য নিশ্চই ছহি আক্কিদার উলামাদের ভূমিকা রয়েছে এবং তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছেন।কিন্তু এক ধরনের বিদা'আতি আলেম উলামা সমাজে দ্বীনের কাজ করছেন যা কুরআন ও ছহি সূন্নাহের সাথে সংঘর্ষ বয়ে আনছে।তারা দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু ঢুকিয়ে ইবাদত হিসেবে প্রচার করে আসছে যাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারন নিরক্ষর মানুষ যারা দ্বীন হিসেবে তা পালন করে চলছে।এ গুলোর মধ্যে, মিলাদ ও ঈদে মিলাদুন্নবী পালন, মহররম মাসের তাজিয়া মিছিল,রবিউল আউয়াল আসলে বিদাআতি ইবাদত, রজব সা'বান মাসে বিদাআতি ইবাদাত,পিরতান্ত্রিক ইবাদাত যেমন-পিরের মাজারে গিয়ে কিছু চাওয়া ও সেজদা করা বা সেখানে বসে ঝিকির করা,সামিয়ানায় লাফিয়ে উঠা,মাজারে সেজদা করা,সূন্নতে খাতনার অনুষ্ঠান করা,জন্ম,মৃত্যু বা এ রকম আরো দিবস পালন করা,মহিলাদের কবর যিয়ারত,মৃতের চল্লিশা সহ এ রকম হাজারো ইসলামি কর্মকান্ড ইসলামী ইবাদতে ঢুকে পড়েছে।
আলকুরআন ও সূন্নাহের আলোচনা একটি মহত কাজ যার মাধ্যমে একজন মানুষকে মানুষে রুপান্তরিত করা যায়।চার জন ঈমামের অন্তর্ধানের অনেক পরে আমাদের এই উপমহাদেশে মাযহাবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দলে মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে যায় বিশেষ করে ইংরেজ শাসন আমলে দুষ্ট প্রকৃতির দু'জন কে তারা কাজে লাগিয়েছিল।একজন হলো বেরুলেভির প্রনেতা আহমদ রেজা খান যে হলো কবর পূজারি আর একজন হলো ক্কাদিয়ানির প্রনেতা গোলাম আহম্মদ ক্কাদিয়ানি যে ছিল হানাফি মাযহাবের একজন দুষ্ট আলেম যে নবী দাবি করেছিল।উপমহাদেশে এই বিভক্ত ইসলামগুলো তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ইসলামকে ব্যাবহার করে। এতে করে মুল ইসলামিক চর্চার দ্বার রুদ্ধ হতে থাকে।আলকুরআন ও ছহি সূন্নহাহের পরিবর্তে সেখানে স্হান করে নেয় মিথ্যা ও জাল হাদিস এবং যে যে যার যার মত করে ধর্মকে প্রচার করছে।এর একটি হলো বিভিন্ন ইসলামিক জলছা।রাসূল সা: বা তার সাহাবিরা এমনকি পরবর্তি সময়ে মুহাদ্দেছিনরা কখনো এ সমস্ত টানা ওয়াজ করেছেন কিনা তার কোন নজির নাই।ইসলামে মানুষকে দিতে হবে কুরআন ও হাদিছের তদৃছ।সেখানে থাকবে নিতান্তই শুধু মানব জীবনের সংস্কার ও রাসূল সা: এর আদর্শে মানুষ গড়ার দিক নির্দেশনা।কিন্তু আমাদের দেশে জলছার নামে যা হচ্ছে তা হলো রাজনৈতিক উসকানি মূলক বক্তব্য।একজন ইসলামিক বক্তা যখন তার বক্তব্য পেশ করেন তখন তার কন্ঠে উচ্ছারিত হয় রাজনৈতিক বক্তব্য ও অন্যের সমালোচনা।কুরআন ও হাদিসের ভাষাতে থাকবে নম্রতা ও ভদ্রতা যাতে মানুষ নিজেদের চরিত্রেকে সংযত করে নিতে পারে।আমাদের দেশে যাদের ধর্মীয় ক্যাসেটগুলো বিক্রি হচ্ছে ও যাদের আল্লামা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আমি অনুরোধ করবো আপনাদের ক্যাসেট শুনে তাদের সংশোধন করুন।কারো পিছনে কথা বলা নয় বরং যদি কোন আলেমের বক্তব্যে শির্ক বিদাআত জনিত কোন কথা থাকে যা থেকে জাতি বিভ্রান্ত হবে তা জানিয়ে দেয়া আমার ও আপনার জন্য ফরয দায়িত্ব।
হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব একজন কওমি আলেম যিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে কয়েকমাস আগে অনুষ্ঠিত একটি ধর্মীয় সভায় যে ওয়াজ করেছেন তার ভিডিও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।এখানে একটি বিষয় আমাদের জানা প্রয়োজন যারা সমাজ সংস্কার করবেন বা ধর্মীয় কথা বলবেন তাদের অনেক চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হবে।রাসুল সা: মহিলা সাহাবিয়াতদেরও শরিয়তের বিষয় শিক্ষা দিতেন।যিনি সর্বকালের শিক্ষক তার মুখ থেকে কি এমন কোন কথা প্রচারিত হয়েছিল? বরং যখন তিনি কথা বলতেন সাহাবারা তা নিমগ্ন হয়ে শুনতেন ও আমল করতেন।তিনি যে তেতুল তত্ত্বের কথা বলেছেন সেটাও সুন্দর ভাষায় বলতে পারতেন।যে ভাষাটি তিনি প্রচার করেছেন এটা আরো আবেগি করে তুলতে পারে নবযৌবনাদের।এটা আমি বলবো উনার দ্বীন বুঝার কিছুটা কমতি।বক্তাদের ওয়াজ মাহফিলে কখনো ‘কুরুচিপূর্ণ’, ‘নোংরা’, ‘কুৎসিত’, ‘অশালীন’, ‘নারীবিদ্বেষী’, ‘সভ্যতাবিরোধী’; ভাষা ব্যাবহার করা সমিচীন নয়।তার বক্তব্যে যা এসেছে ইসলামে নারী সম্পর্কে যে ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে তার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।যারা নিজেদের প্রকৃত উলামা ভাবেন তাদের কাজ হলো ইসলামের সত্য কথাগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা।এ দেশে ৯০% মুসলমান।এখানে যারা দ্বীনের কাজ করবে কোন আস্তিক- নাস্তিক,মুসলিম-কাফের এ রকম কোন মন্তব্য না করে ইসলামের মুল প্রচার করতে হবে যাতে করে তাদের কথায় মানুষ তাদের সমীহ করে ও মানুষ ধর্মের দিকে ধাবিত হয়।কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পক্ষে যদি উলামারা বিভক্ত হয়ে পড়েন তাহলে ইসলামকে ক্ষতবিক্ষতই করা হবে না বরং ইসলামের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে।
আমি বিনয়ের সাথে আবারো বলছি এদেশে যারা ইসলামকে টিকিয়ে রেখেছে তারা এই বিভক্ত ইসলামের কর্নধাররা নিশ্চই।তবে তাদের এভাবে বিভক্ত থাকলে চলবে না।তাদের নিজেদের সংস্কার করে অন্যান্য জাতীয় ইসলামিক বুদ্ধিজীবিদের সাথে নিয়ে যদি সঠিক ইসলামের বারতা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় তাহলে সরকার যেমন সচেতন হবে তেমনি সামাজিক অনেক কলন্ক গুছাতে সক্ষম হবে।তার সাথে আমি বলতে চাই-শুধু কোন উলামার কথা ধরে অন্য যারা হৈ চৈ শুরু করে দিবেন তাও সঠিক নয়।আমাদের কাউকে কোন কথা বললে সম্মানের সাথে কথা বলা উচিত।অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে এগুলো নিয়ে কথা বলতে দেখছি,লিখতে দেখেছি।তারা কি কখনো তাদের ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে দেখছেন কি পরিমান ব্যাভিচার হচ্ছে।ক্যাম্পাসের পাশে পার্কগুলোতে কি পরিমান অশ্লিলতা ছড়িয়ে পড়ছে।ঐ সমস্ত অধ্যাপকরা কি তাদের ছাত্র ছাত্রিদের নৈতিক শিক্ষাগুলো দেন যাতে এগুলো না হয়।তাদের অধিকাংশ এ দায়িত্ব পালন করেন না।তাহলে একজন আলেম যখন কথা বলেন তখন সেটা ভদ্রতার সাথে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন।আমাদের কারোরই সাংঘর্ষিক কথা বলা উচিত নয়।
আমাদের সরকারগুলো ও বুদ্ধিজীবিরা কাওমি ও আলিয়া মাদ্রাসা নিয়ে যত নেতিবাচক কথা বলেন তা না করে কিভাবে তাদের উন্নত শিক্ষা পদ্ধতির দিকে ধাবিত করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।যারা আমাদের দেশে মাদ্রাসায় পড়ে তারা প্রান্তিক গরীবদের সন্তান যারা তাদের সন্তানদের উচ্চতর ব্যায় ভার বহন করতে পারেন না।এ কারনে দেখা যায় রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় মাদ্রাসা নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে আর এদেরই নিয়ে যায় জন্গিদের আওতায়।এর জন্য দায়ী আমাদের বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলো।আমাদের মদ্রাসা শিক্ষা যেহেতু কোরানিক শিক্ষা দেয় সেহেতু মদিনার আদলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত যেন তারা ধর্মবিষয়ক জ্ঞান চর্চার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।ইসলামের প্রধান গ্রন্থ পবিত্র কোরান, হাদিসসহ নানা বিষয়ের বই-পুস্তক তারা অধ্যয়ন করবে। তাতে যুক্তি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং চিন্তার প্রচুর উপাদান থাকবে।
যেসব মওলানা ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করবেন তাদের ধর্মীয় বয়ান হবে অনেক বেশি যুক্তি, তথ্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ, তাদের ভাষা হবে সংযত, শিক্ষনীয় এমনটিই প্রত্যাশিত। কিন্তু সে ধরনের সুকুমার বৃত্তির ছাপ তাদের অনেকের বয়ানে থাকে না। আমাদের মনে রাখতে হবে মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের দেয়া পাঠ শোনে, অজানা বিষয় জানার চেষ্টা করে; শেখার নিরন্তর এই প্রক্রিয়াটি পৃথিবীব্যাপী শত শত বছর ধরে চলে আসছে। শিক্ষকগণ শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণে মহান ব্রত পালন করে আসছেন। শিক্ষকগণ সর্বত্রই যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীদের গুরু হিসেবে স্বীকৃত মানুষ। ওয়াজ মাহফিল মূলত শ্রেণীকক্ষের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ইসলামিক নিয়মকানুন, অনুশাসন এবং এগুলোর আদি ও যুগোপযোগী ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হিসেবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও এ ধরনের ধর্মসভা সব যুগে ছিল, এখনও আছে। তবে শিক্ষকদের মধ্যেও যেমন যথার্থ জ্ঞানচর্চা না করে অনেকে শিক্ষকতার পেশায় এসেছেন; পাঠদানের মেধা, মনন, রুচিবোধ, যুক্তি, তথ্য, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথা সৃজনশীলতার ছাপ তাদের মধ্যে থাকে না। যারা পঠন ও পাঠদানের মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষকতার মহান পেশাকে নেন কেবলমাত্র তারাই হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশা নিছক কোন চাকরি নয় যে, সকাল-বিকাল অফিসে যাব, রুটিন দায়িত্ব পালন করব, মাসের শুরুতে গত মাসের বেতন তুলব, বাজার করব, পরিবারের সুখ-সাচ্ছন্দ্য নিয়ে সারাক্ষণ ভাববো, বাড়িতে অফিসের কোন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। শিক্ষকতা পেশাটি এর ঠিক বিপরীত।
এটি একটি মিশন। এখানে প্রতিনিয়ত একজন শিক্ষককে পঠনপাঠনে থাকতে হয়, উচ্চতর স্তরে লেখালেখি ও গবেষণা করতে হয়। তবেই একজন শিক্ষক ক্রমে সবদিক থেকে নিজেকে পরিশীলিত করতে পারেন, শিক্ষার্থীদের কাছে একজন অনুকরণীয় শিক্ষক হতে পারেন। এ কারণে একজন শিক্ষকের জীবন চাকরিজীবী মানুষের মতো গতানুগতিক নয়, অফিসঘণ্টা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, নিজের পরিবারের সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিধানকেন্দ্রিক আবর্তিত হওয়ারও নয়। যিনি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও মানুষকে নীতি-নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে জ্ঞানদান করেন; এক কথায় ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করেন তিনিই তো একজন ধর্মগুরুর আসনে বসেন। তাকে প্রধানত ধর্মীয় বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, জানতে হয়, জানানোর মতো দক্ষতা অর্জন করতে হয়; একই সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে হয়। বিষয় উপস্থাপনে তাকে ভাষাজ্ঞান এবং শ্রোতাদের বোধগম্য উপযোগী করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে এমন সব নাম ধারি মওলানা এসব ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করেন তাদের মধ্যে সত্যিকার মওলানাসুলভ জ্ঞান নিয়ে খুব কমই প্রতিষ্ঠিত হন, যারা হতে পারেন তাদের সংখ্যাটি খুবই কম।
মওলানাদের অধিকাংশের সুরেলা কণ্ঠকে ওয়াজমাহফিলে প্রাধান্য দেয়া হয়; একইসঙ্গে নারী-পুরুষের নানা চটকদারি বিষয় নিয়ে কথা বলা, শ্রোতাদের আকর্ষণ করার কিছু প্রবণতা থাকতে হয়,এ রকম অনেক আলেম রয়েছেন যাদের আমরা সবাই জানি ও চিনি। তাদের ওয়াজের কতগুলো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুরেলা কণ্ঠ, রাজনীতির নানা ইস্যুকে সুকৌশলে ব্যবহার করতে পারা, সাধারণ মানুষ যেসব বিষয় নিয়ে তেমন গভীর-অগভীর কোন জ্ঞানই রাখে না সেগুলোকে টেনে এনে নিজেকে একজন ‘বিশেষভাবে জ্ঞানী’ হিসেবে উপস্থাপন করার দক্ষতা তারা অর্জন করতে পেরেছেন।তাদের পেছনে বিশেষ রাজনৈতিক দলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে কাজ করেছে; সেভাবেই গ্রামেগঞ্জে তাদের ওয়াজের ক্যাসেট-সিডি ব্যাপক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যাতে রয়েছে অনেক ইসলামিক ভুলভ্রান্তি যার কুফল অনেকে বুঝতে পারছে না তাদের ক্যাসেট শুনে।
কেননা, এসব ওয়াজের বয়ানে ধর্মশিক্ষার নামে এমন অনেক কিছুরই প্রয়োগ ও প্রসার ঘটানো হয়েছে যা মানুষকে ধর্মের শুদ্ধ চিন্তা ও চর্চার চাইতে বিভ্রান্ত হতে, নারীবিদ্বেষীসহ নানা ধরনের পশ্চাৎপদ বিশ্বাসে আবদ্ধ করে রাখতে অনেক বেশি সহায়তা করে। শিক্ষার মূল চর্চা ও চেতনা তাতে থাকে না। বিশেষত নিরক্ষর বা বই-পুস্তক পড়তে, বুঝতে বা বাছাই করতে না পারা, না জানা এবং অসমর্থ নানা প্রকারের মানুষের মধ্যে মুখে মুখে ধর্মের বয়ান শেখানোর সমস্যা বেশ গভীর ও জটিল। শিক্ষা সম্পর্কীয় ধারণা ও জ্ঞানের অভাবের সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন অনেকে, যাদের মওলানাসুলভ জ্ঞান ততোটা পরিশীলিত বা সমৃদ্ধ নয়; যাদের সেই জ্ঞান আছে সেই সংখ্যাটি খুবই কম। আমাদের দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। আলিয়া এবং কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কোন কোন সূত্র এক লাখের কাছাকাছি দাবি করছে। দেশে আলিয়া এবং কওমি এসব মাদ্রাসায় কয়েক লাখ শিক্ষক আছেন, ছাত্রছাত্রীও কম নয়। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতেই যেখানে ইসলাম ধর্মের মৌলিক নানা দিক নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হতে শোনা যায় না, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরবী ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ক যে ক’টি বিভাগ রয়েছে সেগুলোতে কিছু গবেষণাকর্ম হচ্ছে; তবে গবেষণাগুলোর মান ও মৌলিকত্ব খুব একটা শোনা যায় না।
বেশিরভাগই বিভাগীয় শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্যই যতটুকু লেখালেখি বা গবেষণার প্রয়োজন হয় ততটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কিছু পত্র-পত্রিকা রয়েছে। তাতে এখন পর্যন্ত যেসব লেখালেখি হচ্ছে তাও আলেমদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পঠিত হতে শোনা যায় না। কওমি মাদ্রাসাগুলো পাঠদানে রক্ষণশীলতার অনুসারি। তাদের পঠনপাঠনের পরিধি অনেক বেশি সীমাবদ্ধ। ফলে বাংলাদেশে ধর্মশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর থেকেই নেয়া হচ্ছে না, সরকারের দিক থেকে কোন ধরনের উদ্যোগ নিতে গেলে বড় ধরনের বাধা আসে ভেতর থেকেই; যার অন্তর্নিহিত সত্য চাকরি রক্ষার মানসিকতা থেকে, ধর্মজ্ঞানকে যুগোপযোগী মানে নেয়ার পঠনপাঠনে ঢেলে সাজানো থেকে নয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন সীমাবদ্ধতারই ছাপ পড়েছে আমাদের ওয়াজ মাহফিলের বেশিরভাগ বয়ানে, যেখানে মানুষকে যথার্থ জ্ঞানে আলোকিত করার বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস নেই, সমাজের নারী, পুরুষের নানা বিষয় নিয়ে মুখরোচক কথা হয়, ওয়াজগুলোতে একদিকে পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যদিকে নারীদের দাসত্বের অবস্থানকেই তুলে ধরার প্রয়াস বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এতে প্রান্তিক অশিক্ষিত মানুষগুলো সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে না পেরে অত্যাচারের ষ্টিমরোলার চালায় তাদের পরিবারের উপর।
অর্ধশত বছর আগে মওলানারা যেসব বিষয় নিয়ে ধর্মসভা এবং মসজিদে বয়ান করতেন, এখনও প্রায় ক্ষেত্রেই তাই আলোচিত হচ্ছে, খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। না আসার কারণ হচ্ছে, দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং মওলানার সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়লেও প্রকৃত ইসলামের অনুসন্ধান ,আধুনিক ধর্মতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, দর্শন ইত্যাদি তত্ত্ব নিয়ে মৌলিক লেখাপড়া ও গবেষণা খুব একটা হচ্ছে না। ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কিভাবে পরিশীলিতভাবে ব্যবহার করতে হবে, বর্তমান জ্ঞানবিজ্ঞানের যুগে এর প্রয়োগ ও ব্যবহার কিভাবে যথাযথভাবে করতে হবে, সততা, ন্যায়নীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, রুচিবোধ ইত্যাদির চর্চা ও ধারণযোগ্যতা কিভাবে অর্জন করতে হবে সেই কঠিন, জটিল বিষয়গুলো ধর্মশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং আয়োজনগুলোতে খুব একটা দেখা যায় না।
তবে বাংলাদেশের সমাজের অভ্যন্তরে মানসম্মত জ্ঞান, ধর্ম ও রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে যে চরম দ্বিচারিতার সঙ্কট রয়েছে তাতে কোনটিই আপন ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। না শিক্ষা, না ধর্ম, না রাজনীতির আদর্শ বা গণতন্ত্র- কোনটিই যথাযথ জায়গা করে নিতে পারছে না। সর্বত্রই বাহ্যিক পরিচিতি ও প্রচারণা প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্তর্নিহিত শক্তি ও গুণাগুণকে উপেক্ষা করা হলে সেই সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা ও রাজনীতির কোনটিই শেষ পর্যন্ত লাভ করতে পারবে না। আমাদের ধর্ম চর্চার দুর্বলতাকে না কাটিয়ে উঠলে সমাজে সততা, ন্যায়নীতি, হালাল, হারাম, ঘুষ, দুর্নীতি সবই একাকার হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক; শিক্ষা, রাজনীতি ও গণতন্ত্রেও কোন মেধার স্ফূরণ ঘটবে না, দক্ষ, যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠবে না, রাষ্ট্র ও সমাজ কোনভাবেই আধুনিক হতে পারবে না। সমাজ চেতনা কখনও একুশ শতকের বাস্তবতা অনুধাবণে যোগ্য হতে পারবে না, বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ ঘটবে না, সৎভাবে ধর্ম চর্চারও সুযোগ ঘটবে না। এমন কঠিন ও জটিল অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে বাংলাদেশ এখন চলছে। এর শেষ গন্তব্য কোথায় তা সহজেই অনুমেয়।
বিষয়: বিবিধ
১৪২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন