কবি সাহিত্যিকদের সমালোচক ও নীতিনির্ধারক ছিলেন জাহেলিযুগে আগত মানবজাতির মুক্তির দূত নবী মোহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:২৫:৪৫ বিকাল

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আখেরি বা শেষ নবী। যে নবীর আবির্ভাবে এ পৃথিবী ধন্য হয়েছে,কলন্কিত সমাজ ব্যাবস্হা নিস্কলংকে রুপায়িত হয়েছে,সে নবীর পদাংক অনুসরন করতে দেখা যায় না আজকের সাহিত্য ও সমালোচকদের।এমনকি কি একজন সাহিত্যিক, আর একজন সাহিতিকের সু-গবেষনালব্ধ সাহিত্যকর্ম প্রচার করতেও ভ্রুকুন্চিত করেন।অথচ রাসূল সা: বলেছেন,'যদি একটি আয়াত ও জান আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর।' এর অর্থ হলো কুরআন-হাদিস তো আছেই,পার্থিব জীবনে যারা ভাল লিখেন মানব কল্যানের জন্য তাদের লিখা ও কথাগুলোও যদি কেউ প্রচার করে তাও কল্যানের কাজ।এখানে যদি হীনমন্যতা কাজ করে তাহলে জাতির উম্মেষ ঘটা সম্ভব নয়।মানুষের সৃজনশীলতার প্রতি আস্থা সহজে সৃষ্টি হয় না। সেটা আঙুল দিয়ে অনেক সময় দেখিয়ে দিতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন হিতাকাংখী হওয়া ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করা একে অন্যকে সম্মানের মাধ্যমে। সাহিত্যের শিক্ষক ও সমালোচক এ দু’জাতের সাহিত্যসেবীর ভাবনা ও সাধনার ফলেই সাহিত্য-শিল্পটা বিকশিত হয়।উভয়ের চিন্তনশৈলী ও সাধনক্ষেত্র ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য কিন্তু প্রায়ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। বিশেষ করে সাহিত্যের শিক্ষক যদি একজন সৃষ্টিশীল লেখক-সমালোচকও হন, তখন তো মনজিল একই হয় এবং তা সাহিত্যের জন্য খুবই কল্যাণকর।মানুষের ভেতর নিহিত সাহিত্যমানস, সাহিত্যরুচি, সাহিত্যমেধা ও সৃষ্টিপ্রতিভা মানুষকে অবিকশিত থাকতেই দেয় না কোনোদিন। প্রতিভার জগতে স্বভাবসাহিত্যপ্রতিভার খেলাই ভিন্ন রকম। আমরা একেবারে কাছের মানুষদের ভেতরও দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে, কর্মজীবনের প্রতিষ্ঠাপর্বে অনেকে এখন সাহিত্যাঙ্গনের অবিস্মরণীয় ব্যক্তি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিত্সাবিজ্ঞান, পৌরনীতি ও অর্থনীতির মতো বিষয়ে মাস্টার্স ও থিসিস করেও অনেকে এখন অসাধারণ গল্পকার, কালজয়ী ঔপন্যাসিক ও খ্যাতিমান কবি। এমনকি সমালোচনার মতো গবেষণা ও সীমাহীন পঠননির্ভর শিল্পেও অনেকে পণ্ডিতের আসন দখল করে আছেন। অন্যদিকে এমন উদাহরণেরও অভাব নেই, যারা বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ও থিসিস করেও কর্মজীবনে একজন ব্যবসায়ী, সংগঠক বা অন্যকিছু, যাদের কলম থেকে দু-চারটি লাইনও কোনোদিন বের হয়নি। আবার উভয়বিধ পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ও ঘটে অসাধারণ সাযুজ্যে। সাহিত্য বিষয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করে কর্মজীবনে সাহিত্যাঙ্গনের সর্বশীর্ষ ব্যক্তি হওয়ার নজির অন্তত এ যুগে কম নয়। সুতরাং প্রতিভাখেলার দমাকা অপ্রতিরোধ্য—এ কথা মানতেই হবে। এ প্রতিভার স্বভাবদাবি অস্বীকার করার জো নেই কারও। প্রতিভার প্রতিরোধ করা যায় না কখনও। প্রতিভার গতিপথ রুদ্ধ হলে সমাজ-বিবেকের অবরুদ্ধতাও অনিবার্য। প্রতিভাকে যদি ধর্মের আদলে গড়া যায় তাহলে তা থেকে বিচ্ছুরিত হতে পারে এমন আলোক রশ্মি যা দুনিয়াকে আলোকিত করতে পারে।আর যদি শুধু পার্থিব প্রগতিশীলতার পথে ধাবিত হয় তাহলে সে প্রতিভা হয়ে উঠতে পারে ভীতিকর যা আজকের পৃথিবীতে তথাকথিত কবি সাহিত্যকদের সাহিত্যকর্ম দেখে বুঝা যায়।

আমাদের প্রিয় নবী কবি নন, তিনি নবী। নবী কবি হতে পারেন না, এ কথা স্বয়ংপ্রকাশ, স্বতঃসিদ্ধ। নবী প্রত্যাদেশ বাহক, জীবন ব্যবস্থাপক ও মানবসমাজের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। নবী ও কবির মাঝে ঘোরতর বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। সে কথা আমরা কোরআন থেকেও পাচ্ছি। কোরআন বলছে, ‘আমি তাঁকে কবিতা শিক্ষা দেইনি এবং তাঁর জন্য তা শোভনীয়ও নয়। নবী (সা.) জাগতিক কোনো পাঠ গ্রহণ করেননি— না কোন বিদ্বান থেকে; না বিদ্যালয় থেকে। নবুওয়তপ্রাপ্তির আগে তাঁর শিক্ষক ছিল প্রকৃতি। তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, ঔদার্য ও বিবেচনাবোধ সমকালীন সমাজে তাঁকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে তুলেছিল। ভাষার বিশুদ্ধতা, সাংস্কৃতিক পরচ্ছিন্নতা ও মানবিক মূল্যবোধে তিনি ছিলেন মহিমান্বিত মহামানব। তিনি গর্ব করে বলতেন, ‘আমি শুদ্ধতম আরব। কারণ, কুরাইশদের ভেতর আমার জন্ম। কিন্তু আমি আমার শৈশব যাপন করেছি সা’আদ বিন বকর গোত্রে। যে সমাজ-পরিবেশে তাঁর আবির্ভাব, সেটি ছিল কবিতার শব্দ-ছন্দ, উপমা-উেপ্রক্ষা, বাণী ও রূপকল্পে প্লাবিত। আরবদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বপ্ন-বাস্তবতা ও দুঃখ-বেদনার বাহন ছিল কবিতা।নবীত্বের দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাহাবি-কবিদের কবিতার খোঁজ-খবর রাখতেন। ভালো ও সৎ কবিতা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল প্রসন্ন। প্রয়োজনে নিজে কবিতা আবৃত্তি করা, অন্যদের কবিতা শোনা, কবিতা আবৃত্তির নির্দেশ দেয়া, কবিদের প্রশংসা করা, তাদের জন্য দোয়া করা, পুরস্কৃত করা, কবিতার চরণ পাল্টে দেয়া, কবিতার প্রভাব ও আবেদনের স্বীকৃতি, সর্বোপরি কবিতার গঠনমূলক সমালোচনা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর ছিল স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতা। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এমন একটি যুগে, যখন সমালোচনাসাহিতের শিল্পরূপ গড়ে ওঠে নি, সমালোচনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের রূপ-রীতি প্রণীত হয় নি, তখনই নবী (সা.) সমালোচনার কিছু নীতি নির্ধারণ করে দিলেন। যে সমালোচনাসাহিত্যের কুঁড়ি এখনও মেলে নি, তাকেই তিনি এক অসাধারণ ফুটন্ত ফুলের রঙ-রূপ দান করলেন। এবং রচনার উত্কৃষ্টতার মানদণ্ড নির্ধারণ করলেন শৈলীর জাদুময়তা ও চিন্তার ধর্মমুখিতা। রাসুলের বাণী, রচনা ও কবিতাকে নতুন করে যাচাই-পরখ করার সুযোগ করে দিলেন এবং নতুন আঙ্গিকে সমালোচনার পথ দেখালেন। সেই জাহেলি যুগেই তিনি সমালোচনাসাহিত্যের পরিধি প্রশস্ত করলেন। কাব্যসমালোচনায় যোগ করলেন আধুনিকতা ও নতুন মাত্রা। শুধু তাই নয়, বরং আমরা তাঁর সমালোচনায় কিছু নতুন পরিভাষাও পাচ্ছি, যেগুলো তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যবহার করেছেন। যাতে সমালোচনাসাহিত্য সঠিক পথে চলতে পারে। তিনিই সর্বপ্রথম প্রচলন করলেন ‘আল-বয়ান’ শব্দটি, যা পরবর্তী যুগে আরবি ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্রের নাম হয়ে গেছে। এছাড়াও, তিনি সমালোচনার অঙ্গনে ব্যবহার করেছেন ‘বালীগ’—আলঙ্কারিক, ‘আল-উমূম, আল-ঈজায’—অর্থ সম্প্রসারণ ও অর্থসঙ্কোচন। এছাড়াও শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার নির্দেশকারী বিভিন্ন পরিভাষা। বিষয়টি অতলস্পর্শী গবেষণার দাবি রাখে।

প্রাক-প্লেটো যুগে কাব্যধারা যখন ছিল, বোধ হয় কাব্যতত্ত্বও ছিল নিশ্চয়। তবে তার লিখিত বিবরণ আমরা পাই না। প্লেটো ও অ্যারিস্টটল হয়ে জাহেলি যুগের আরবদের পর্যন্ত কাব্যতত্ত্ব ও কাব্যসমালোচনার শিল্প ও জ্ঞানভিত্তিক রীতি-পদ্ধতি পৌঁছেছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়া যায় না। তবু এ কথা মানতে হবে যে, সে-যুগে কবিতা যখন ছিল, তা হলে কবিতার সমালোচনাও ছিল কোনো না কোনোভাবে। যুগপারম্পর্যে কবি-সাহিত্যিকগণ স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, উন্মেষপর্বে সমালোচনার মূল ভিত্তি ছিল স্বভাবরুচি। ফলে জাহেলি যুগের একজন দক্ষ ভাষাবিদ ও কবি নিজের অসাধারণ প্রতিভাগুণেই বিচার করতেন কবিতার ভালো-মন্দ, সৌন্দর্য-অসৌন্দর্য, সাবল্য-দৌর্বল্য। এবং সেই বিচারক্রিয়া তারা তুলে ধরতেন কোনো ধরনের অন্যায়-গোঁড়ামি ছাড়াই। তাই দেখা যাচ্ছে, জাহেলি যুগের অগ্রজ পণ্ডিত কবিগণ অন্যদের ভুল-ত্রুটি ধরে দিয়েছেন, এবং তাদেরকে কবিতার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আরও বেশি সজাগ করেছেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে বহু তথ্য আমরা পাই। দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনার দিকে না গিয়েও বলা যায়, জাহেলি যুগে ওকায বাজার ছিল কবি-সাহিত্যিকদের মিলনকেন্দ্র, আসর ও আড্ডার তীর্থস্থান। সেই যুগের প্রখ্যাত শক্তিমান কবি নাবিগা জা’দীর (মৃ. ৮০ হি.) জন্য চামড়ার একটি লাল তাঁবু স্থাপন করা হতো। সেখানে এসে অন্য কবিরা তাঁর সামনে কবিতা আবৃত্তি করতেন। তিনি তাদের কবিতার সমালোচনা করতেন। সে আসরে সর্বপ্রথম কবিতা পাঠ করেন আল-আ’শা মাইমূন বিন কাইস আবূ বাসীর (মৃ. ৬২৯ খ্রি.), অতঃপর হাস্সান বিন ছাবিত আন-আনছারী (মৃ. ৫৪ হি.)। তাঁর কয়েকটি পঙিক্ত এরকম :

সুদর্শন পাত্র রয়েছে আমাদের,/ঝলসে ওঠে দুপুরের রৌদ্রে/তরবারিরা আমাদের/বীরত্বের রক্ত ঝরায় অঝোর ধারে।/জন্ম দিয়েছি আমরা সাহসী বীর সন্তান।

হাস্সান বিন ছাবিতের আবৃত্তিশেষে নাবিগা বললেন, বাহ্! আপনি তো দেখি বড় শক্তিমান কবি। তবে আপনি এখানে কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি। কারণ, আপনি নিজের পাত্র ও তরবারিকে ছোট করে দেখলেন। নাবিগার এই মন্তব্যের উদ্দেশ্য হলো, হাস্সান পাত্রের বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ‘আল-গুররু’—সুদর্শন, অথচ সে যুগে ‘আল-বীদু’—শ্বেত বলতে পারাটাই ছিল বড় বাহাদুরি। নাবিগা আরও বললেন, আপনি সন্তানদের নিয়ে অহঙ্কার করলেন, কিন্তু পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করতে পারলেন না। বোঝা গেল, নাবিগা এখানে প্রথমে বহিরঙ্গের সমালোচনা করলেন— বিশেষণ ব্যবহারের যাথার্থ্য নিয়ে। পরে সমালোচনা করলেন অন্তরঙ্গের—কবিতার মূলার্থের ঔচিত্য নিয়ে। রূপতত্ত্ব ও রসতত্ত্বের এই সমালোচনাকে বলা হয় বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা (Analytical Criticism)। (যাই হোক, উদাহরণ আরও দেয়া যায়। থাক। সেটা এ লেখার বিষয় নয়।)

ইসলামের আবির্ভাবকালে আরব সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল গণ্ডমূর্খ, অশিক্ষিত, বর্বর। সুতরাং তৎকালীন আরবি সাহিত্য ছিল লোকজ সাহিত্য। আর সেই লোকজ সাহিত্যকথা এতই উন্নত ছিল যে, আরবি কাসিদাগুলো হোমারের ইলিয়ড ও সফোক্লিসের ওডেসিকে হার মানাবার উপযোগী। ওকায মেলায় কবিতার লড়াই ছিল আশ্চর্যজনকভাবে বীরত্বপূর্ণ, যা আজ ভাবতেই অবাক লাগে। কবিতার সাহিত্যমান, বাগ্মী-গুণ, স্মৃতিশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব কবিকে সমাজে উচ্চ মর্যাদা পেতে সাহায্য করত। তবে তখন কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল প্রেমলীলা, মদ্যপান, জুয়া খেলা, বংশগৌরবগাথা, যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি উসকানির মতো এমন কিছু বিষয়, যা একটি সভ্য সমাজের জন্য কোনোমতেই শোভনীয় নয়। ইমরুল কায়েসের মতো কবির কবিতার বিষয়বস্তু ছিল নারী ও ঘোড়া। কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানের রণগীতি, প্রেমগীতি, রঙ্গব্যঙ্গ কবিতা বহু কুখ্যাত ও বিখ্যাত কবি যশ কামাত, যা তৎকালীন সব কাব্যকলাকে ছেড়ে গিয়েছিল। যদিও তা বল্গাহীন জৈবানুভূতির যৌনরসে উৎসারিত আদিম ও পাশবিক উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিল।

রাসুল (সাHappy এর সামনেই ছিল জাহেলি যুগের কাব্যসাহিত্যের চিন্তা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও জীবনের চিত্র। রাসুল (সা.) অবশ্যই ঐশী নির্দেশ ও ফর্মুলা অনুযায়ী জীবনের চিত্র ও মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিলেন, কিন্তু কবিতায় জীবনের প্রবাহ ও পরিবেশ বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। যেহেতু জীবনের প্রকৃত নিদর্শন একজন বিশ্বাসী মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু তিনি বিশ্বাসী ব্যক্তির জ্ঞান-বুদ্ধিকে কবিতার প্রাণসত্তা আখ্যায়িত করেছেন। আর যেহেতু যে কোনো শুদ্ধ শিল্পের জন্য বুদ্ধির সুস্থতা ও চিন্তার সততা অপরিহার্য বিষয়, তাই তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় কিছু কিছু কবিতা প্রজ্ঞাপূর্ণ।’ এ মন্তব্য মানবজাতির শিল্প-জীবনের জন্য এক অনন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে এখনও, এবং থাকবেও যতদিন শিল্পচর্চা থাকবে পৃথিবীর বুকে। রাসুল (সা.) কবিতার বিচার ও মূল্যায়ন করেছেন দু’টি ভিত্তি ও মানদণ্ডের ওপর।(এক)- ধর্মীয় মানদণ্ড, (দুই)- ভাষাগত (বা অলঙ্কারশাস্ত্রিক) মানদণ্ড। রাসুল (সা.)-এর সমালোচনা নিয়ে, যা তিনি কবিতা ও কবিদের সম্পর্কে করেছিলেন, আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম যা আমাদের নজরে আসে, সেটা হলো, ধর্মীয় দিকটি তাঁর সমালোচনার অন্যতম মূল ভিত্তি ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সমালোচনার কয়েকটি উদাহরণ হলো :

ইসলামের আবির্ভাব-পূর্বকালীন কবি লাবীদ বিন রবীয়ার (মৃ. ৪১ হি., ৬৬১ খ্রি.) কয়েকটি পঙিক্তর সমালোচনা করে রাসুল (সা.) বলেছেন, কবিরা যা বলেছেন, তার মধ্যে লাবীদের কথাটি সর্বাধিক সত্য। পঙিক্তগুলোর অর্থ এই—ধ্বংসশীল যা কিছু আছে পৃথিবীতে, আল্লাহ ছাড়া,/সুখ-ঐশ্বর্য-নেয়ামত ক্ষণস্থায়ী, সবকিছু হবে হাতছাড়া।৪

নাবিঘা জা’দীর কিছু পঙিক্ত শুনে রাসুল (সা.) মুগ্ধ হলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ তোমার মুখ বিনষ্ট না করুন’। (এ দোয়ার বরকতে, তিনি ১৩০ বছর জীবিত ছিলেন, অথচ তাঁর সম্মুখভাগের দাঁত মজবুত ছিল।) পঙিক্তগুলো ছিল এই :নেই কল্যাণ সে-সহনশীলতায়, /যা দমাতে পারে না প্রিয়তমের রাগ,/কল্যাণ নেই সে-মূর্খতায়,/যদি না থাকে কোনো সহনশীল ব্যক্তি/যে ছাড়ে না কোনো কাজ, যা শুরু করে একবার।কা’আব বিন যুহাইর (মৃ. ২৪ হি., ৬৪৪ খ্রি.) রাসুলের প্রশস্তিমূলক এক কবিতায় বললেন,নিশ্চয় রাসুল আলোক রশ্মি/আলো গ্রহণ করা হয় যার থেকে/তিনি তো তরবারি ভারতের /কোষমুক্ত, ধারালো, ঝকঝকে।এ পর্যন্ত শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘ভারতের তরবারি’ বল না, বরং বল, ‘আল্লাহর তরবারি’।

এখানে লক্ষ্য করতে পারি, রাসুল (সা.) কবিকথিত ঐতিহাসিক সত্য থেকে আরও নিগূঢ় সত্যতম বাস্তবতার দিকে তাকে নিয়ে গেছেন। কারণ, ক্ষণস্থায়ী জীবের তৈরি তরবারি থেকে চিরস্থায়ী সত্তার সৃষ্ট তরবারি যে সর্বদিক দিয়ে সফল ও উপযোগী, সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কা’আব বিন মালিক যখন রাসুল (সাHappy এর সামনে এই পঙিক্তদ্বয় উচ্চারণ করলেন, প্রতিরোধ করে আমাদের সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে/এমন সব বীরপুরুষ,/যাদের চকচকে ধনুকগুলো নিক্ষেপ করে তীর/যেন প্রতিপক্ষ কাপুরুষ।চরণদ্বয় শুনে রাসুল বলে উঠলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে’ না বলে ‘আমাদের ধর্মের পক্ষ থেকে’ কি বলা যায় না? কবি উত্তর দিলেন, অবশ্যই পড়া যায়। সেই থেকে তিনি এভাবেই পড়তেন। এবং আমরা প্রাচীন উত্সগ্রন্থগুলোতে ওরকমই পাই। সে যাই হোক, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাসুলের সমালোচনার উদাহরণ অনেক আছে। ধর্মের বাণীবাহক নবী ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করবেন, তাতে তেমন বিস্ময়ের ও কৃতিত্বের কী আছে?—এমনও কেউ মনে করতে পারেন। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা সমালোচনা-সাহিত্যের প্রধান দু’টি ধারা পাই : প্রাচ্যরীতি ও পাশ্চাত্যরীতি। পাশ্চাত্যরীতির উন্মেষের মূলে ছিল রাজনৈতিক-দার্শনিক অভিব্যক্তি—সেটা প্রমাণিত সত্য। তা হলে, সম্পূর্ণ একটি নতুন আন্দোলন, নতুন ধর্মের আবির্ভাবলগ্নে বিশেষ প্রকারের একটি সমালোচনাপদ্ধতির প্রচলন হলে, তাতে দোষের কী আছে? আমরা বলতে পারি, রাসুল (সাHappy এর উপরিউক্ত পর্যায়ের সমালোচনা ছিল জীবনধর্মী, জীবনবাদী ও আদর্শবাদী। তাছাড়াও সাহিত্যিক ও কাব্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তিনি সমালোচনা করেছেন। ভাষাগত ও অলঙ্কারশাস্ত্রীয় সমালোচনার উদাহরণও আছে কম-বেশি। সেগুলো খুব স্বল্প-সংক্ষিপ্ত হলেও, ‘বিন্দুতে সিন্ধু’র মতো সেগুলো খুবই ব্যাপক, মৌলিক ও নীতিনির্ধারক।

যেসব গুণ থাকলে একটি কবিতা বা কথাকে যথেষ্ট সুন্দর ও উত্তীর্ণ বলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে : বক্তব্য ও বর্ণনার বিশুদ্ধতা, সত্যের পক্ষ সমর্থন, কৃত্রিম অলঙ্কার বর্জন, উপযুক্ত শব্দচয়ন ও সুঠাম বাক্যবুনন ইত্যাদি। আর এসব গুণের আলোকে রাসূল (সাHappy সময়-সময় কিছু কথা ও কবিতার সমালোচনা করেছেন। তাই দেখা যাচ্ছে, এসব গুণসমৃদ্ধ কিছু কথা শুনেই তিনি উপর্যুক্ত দুই নীতিনির্ধারক বক্তব্য পেশ করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘কিছু কিছু কবিতা প্রজ্ঞার আধার’ এবং ‘নিশ্চয় কিছু বর্ণনা জাদুময়’।

কবিতা সম্পর্কে রাসুলের সমালোচনা-পর্যালোচনা খুবই সংক্ষিপ্ত, তবে সন্তোষজনক ও সর্বদিকপ্লাবী যেন ‘পেয়ালায় পৃথিবী’ বা ‘গোষ্পদে সাগর ।’ তাঁর সমূহ সমালোচনামূলক বক্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করলে সমালোচনা-সাহিত্যের একটি বিশাল গ্রন্থ প্রণীত হতে পারে। কবিতা সম্পর্কে তিনি যেসব প্রজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য পেশ করেছেন, তার একটি হলো, ‘কিছু কিছু কবিতা প্রজ্ঞার আধার’ , এটি খুবই ছোট একটি বাক্য—সহজ, সরলও। কিন্তু, এতে কবিতা-বিষয়ে, সমালোচনার সাগর-বিস্তৃতি রয়েছে। রয়েছে পাহাড়প্রমাণ প্রত্যয়ী প্রজ্ঞা। শিল্পদৃষ্টিকোণ থেকে কবিতায় দু’টি মৌলিক উপাদান থাকে : শব্দ ও অর্থ। কিংবা, বলা যায়, অর্থ ও শৈলী। কবিতাকে, শরীর ও আত্মা উভয় দিক থেকে, প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে হয়। রাসূল (সাHappy উপরিউক্ত বাক্যে কবিতার আত্মিক নিদর্শন ও অন্তর্গুণের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অন্তরাবস্থার সম্পর্ক মানুষের জীবনের সঙ্গে। আর মানুষের জীবনের সাফল্য-বৈফল্য, আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক মানুষের বৌদ্ধিক ও চৈন্তিক ফলাফলের সঙ্গে। আরবের প্রাচীন কাব্যসাহিত্যের অন্তর্বস্তুও জীবনের চিত্রে চিত্রায়িত, এবং নান্দনিক সুষমায় মণ্ডিত। প্রাচীন আরবি কাব্যে বেদুঈন-জীবনের এমন চমৎকার চিত্র ফুটে উঠেছে, যা প্রাকৃতিক ও স্বভাবানুকূল হওয়ার কারণে আরবদের কাছে খুবই প্রিয় ও সমাদৃত ছিল। প্রাচীন সেই কাব্যসম্ভারে ইমরুল কায়েসের আত্ম-ঐশ্বর্যহীন, দেহলাবণ্যসর্বস্ব কবিতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল যুহাইর বিন আবি সালমার কবিতা, যা বুদ্ধি-প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ এবং জীবনময়তায় ঋদ্ধ। সঙ্গত কারণেই, এই আকর্ষণীয় কাব্যশিল্প তাঁর কাছে এত প্রিয় ও চিত্তাকর্ষক ছিল যে, কিছুতেই তিনি এ-শিল্পকে বর্জন বা নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছেন, ‘আরবরা কবিতাকে ছাড়তে পারে না, যতক্ষণ না উট তার গর্ভস্থ বাচ্চাকে ছাড়ে।’

রাসুল (সা.) সাহিত্যের শরীর বা বাহ্যকাঠামো সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিশ্চয় কিছু বর্ণনা জাদুময়’ - বাক্যটিতে যে কোনো শিল্প বা কবিতার জন্য যে-মানদণ্ড নির্ণয় করা হয়েছে, সেটি সমালোচনা-নীতির খুবই উন্নত-সৃষ্টিশীল মানদণ্ড। কারণ, যে কোনো শিল্পের মূল্য ও মাহাত্ম্য মূলত তার প্রভাবশক্তিতে, শিল্পের সিদ্ধিতে। আর প্রভাবশক্তির জন্য প্রয়োজন বর্ণে-বর্ণনায় জাদুময়তা। অর্থের সততা ও যথার্থতার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের বাহ্যিক উপাদান ও শৈলী : ভাষা ও বর্ণনা, অলঙ্কার, বাহ্যনন্দনশৈলীতে গতি ও সঙ্গতি, সতেজতা, সজীবতা, মাধুর্য ও মিষ্টতা যেমন থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে : শব্দের সঙ্গে অর্থের সুদৃঢ় সাযুজ্য-বন্ধন, প্রকাশভঙ্গিতে অনুভূতির প্রাখর্য, চিন্তার শক্তিমত্ততা। বর্ণনাশৈলীর মিষ্টি-ঝাল-টক-তিক্ততা মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও প্রেরণা-প্রকৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করার যোগ্যতা সাহিত্যে থাকতে হবে, যাতে কবিতা বা গদ্য এক জ্বলন্ত জাদু বা জাদুবাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে। তবেই তো একটি শৈল্পিক রচনা সাহিত্যিক কৃতিত্ব এবং শিল্পের উচ্চতম আদর্শিক উদাহরণ হতে পারে।

নবী (সা.)-এর কথায় কৃত্রিমতা বা কৃত্রিম অলঙ্কারে কথার অপসৌন্দর্যবর্ধনকে অনুচিত মনে করা হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে, কঠিন শব্দের ব্যবহার ও বর্ণনাভঙ্গির জাটিলতা ছিল অপ্রাকৃতিক। ইসলাম ধর্মে যেহেতু কৃত্রিমতা বর্জনীয়, সেহেতু জীবনে ও সাহিত্যেও তাকে অশোভন মনে করা হয়েছে। এটাকে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অসুন্দর ও অপরাধ মনে করা হতো, তা নয়; বরং সে যুগে কৃত্রিম ছন্দাসক্তিকে গণকদের কাজ ও তাদের অন্ধানুকরণ বলে গণ্য করা হতো। এ কারণেও, বা এ কারণেই হয়তো, তিনি কৃত্রিমতা বর্জন করার লক্ষ্যে বলেছেন : ‘কৃত্রিমভাবে বাকচাতুর্যপ্রদর্শন আমাকে বর্জন করতে হবে।' হাদিসের কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে ‘তোমাদের দূরে থাকতে হবে।' ভাষার মৌলিক অলঙ্কার ও অধিকার রক্ষা না করে, কৃত্রিমভাবে শুধু ছন্দাসক্তিকে রাসুল (সা.) পছন্দ করতেন না। সেটাকেও তিনি এক ধরনের কৃত্রিমতাই মনে করতেন। কারণ, যারা কৃত্রিম ছন্দমিল ও অন্তর্মিলে আসক্ত, তারা অর্থের চেয়ে নিছক শাব্দিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে তাদের কথা ও রচনা মূলার্থের প্রাণৈশ্বর্য হারিয়ে শব্দসর্বস্ব বাক্যসমষ্টিতে পরিণত হয়। সেখানে মূল বিষয় বা মূলভাবের স্তর দ্বিতীয় পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। অথচ প্রাণবান ভাষার ব্যবহার তো হয়ে থাকে অর্থকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য, শুধু শব্দের কঠিন স্তূপ নির্মাণের জন্য নয়। উম্মতের শিরাজ্ঞানী ও সমাজসচেতন হওয়ার কারণে রাসূল (সা.) নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, মানুষ কৃত্রিমতা ও ছান্দসিকতার আড়ালে সত্যকে গোপন করার অপচেষ্টা চালাবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটেছেও তাঁর যুগে। রাসূল (সা.) এক ব্যক্তির ওপর এক ঘটনার প্রেক্ষিতে রক্তমূল্য আরোপ করলেন। ওই ব্যক্তি রাসূল (সাHappy এর কাছে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করল এবং ভাষায় সে ছন্দ সাধল। ইচ্ছা ছিল প্রকৃত ঘটনার ওপর অসত্যের প্রলেপ দেয়া। রাসুল (সা.) তার বাকচাতুর্যের বদমতলব বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, এ ব্যক্তি কি আমাকে গ্রাম্যদের মতো ছন্দের চমক দেখায়।বর্তমান সভ্যতায় কবি সাহিত্যিকদের একটা বিশেষ অংশ তাদের কাব্যসাহিত্যে এ রকম প্রলেপই দিছ্ছেনা বরং তাদের বাকচাতুর্যের মতলবের শীকার হচ্ছে যুবসমাজ।সেজন্য সূরা শূয়ারায় আল্লাহ যথার্থই এর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন এই সূরার ২২৪-২২৭ আয়াতে এভাবে," আর কবিগন- তাদের অনুসরন করে ভ্রান্তপথগামিরা।তুমি কি দেখ না যে তারা প্রত্যেক উপত্যকায় লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।আর তারা নিশ্চই তাই বলে যা তারা করে না।তবে তারা ব্যাতিত যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে,আল্লাহকে খুব করে স্মরন করে আর অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিরক্ষা করে."

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File