দেশ ও মাটির টানে ফিরি বার বার।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০১:৪৪:৩০ দুপুর
ডিসেম্বর এলে আমাদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ৩০ লক্ষ্য মানুষের আত্বাহুতির বিনিময়ে।সেই সময়ের বিভিষিকার কথা মনে পড়লে আবেগি হয়ে না উঠে পারা যায় না।যারা যুদ্ধ দেখেনি তারা এর মর্মজ্বালা কিভাবে বুঝবে। স্বজন-হারানোর বেদনা , তখন চারদিকে কেবল ধ্বংসের স্তূপ।লাশের উপর লাশ ডোবায় ,নদীতে , রাস্তার পাশে,আবার কোথায়ও শকুনের ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে যারা লাশগুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করছে।মা ও যুবতীদের অসংখ্য মৃতদেহ রাস্তার ধারে বা রেল লাইনের পাশে। রেললাইন, সাঁকো, পথঘাট বিধ্বস্ত; বাড়িঘর বিপর্যস্ত। বিমানবন্দর অকেজো, বন্দরে মাইন, রেলস্টেশন দুর্গম। হেঁটে হেঁটেই পথ চলছে অসংখ্য মানুষ।কোটি মানুষ যারা আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে হেঁটে হেঁটে আবার তাদের অনেকে ফিরে এসেছে একইভাবে। কেউ কেউ দেশের অন্য কোথাও তাদের লক্ষ্যে চলছে।খেয়ে না খেয়ে, নির্ঘুম , ক্লান্ত শ্রান্ত এত কষ্ট স্বত্বেও কারো মুখে নালিশ নেই , মাথায় বোঝা নিয়ে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে আসছে বরং রয়েছে পরিতৃপ্তির হাসি।
যতদূর মনে পড়ে আমার বাবার মুখ থেকে শুনেছি, বাংলাদেশের বিজয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনা কমিশন বসে অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় রসদের হিসাব নিকাশ করেছিল। তখন তো ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের কাছ থেকে এ-ব্যাপারে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের চাহিদা ব্যক্ত করা হলো। যখন বলা হলো, হালের বলদ চাই ২০ লাখ, তাঁরা কপালে চোখ তুলে বললো, কী! বলা হলো, ভারতে শরণার্থী এসেছে প্রায় এক কোটি, কিছু কম বেশি হতে পারে।জরিপে দেখা গেছে, ষাট শতাংশ শরণার্থী কৃষক পরিবারের লোক। যদি ছজনে এক পরিবার ধরা যায়, তবে ১০ লাখ পরিবার। তাদের গরুছাগল তো আর বাড়ির গোয়ালে নেই। পরিবারপ্রতি এক জোড়া হালের বলদ দিলে ২০ লাখ বলদ লাগবে। তারপর এদের ঘর বানাতে বাঁশ লাগবে বিপুল পরিমাণে, জ্বালানির জন্যে কেরোসিন লাগবে যথেষ্ট। রাস্তাঘাট, সেতু, সাঁকো ইত্যাদির পুনর্নির্মাণে উপকরণ লাগবে অনেক। সব কথা শোনার আগেই বন্ধুরা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য! একটা যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ,যেখানে হাহাকার থাকার কথা তা দেখা গেল না।স্বাধীনতার স্বপ্নের মোহে মানুষ মনে হয় নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। কীভাবে যেন ঘরদোর দাঁড়িয়ে গেল, চাষবাস চলতে থাকল, পথঘাট মেরামত হলো, সেতু হলো, ফেরি চলল, রেল চলল, ব্যবহারের উপযোগী হয়ে গেল বন্দর।শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার নয় মাসে সংবিধান তৈরি করে ফেলল, পরিকল্পনার দলিল লেখা হলো। একটা সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল দ্রুত। ৭২ থেকে ৭৫ সময়ে কিছু দুর্বৃত্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে ছায়ার মত ঢেকে ফেললো। তারপর একদিন দুর্ভিক্ষ হানা দিল, রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে গেল।বিদেশ থেকে যে সাহায্য এসেছিল তা লুটপাট হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যাঁরা তাঁরা খুন হলেন কারাগারের অভ্যন্তরে। মানুষ আনল হত্যা ও অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সামরিক শাসন, দেশব্যাপী দুর্নীতি। প্রকৃতি আনল ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক উচ্ছ্বাস, বন্যা। সংবিধানের মূল চরিত্র হারিয়ে গেল, মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি বদলে গেল। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিত হলো দুর্যোগের দেশ হিসেবে।
যে-জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তাদের সন্তানরা কিন্তু সবকিছু নীরবে মেনে নেয়নি। গণতন্ত্রের জন্যে তারা আবার লড়াই করেছে। নূর হোসেনের মতো গণতন্ত্রের সৈনিক কটা দেশ তৈরি করেছে? নিরস্ত্র মানুষের প্রতিরোধে যেসব দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নাম কি বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকবে না? মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের যে-স্বপ্ন এদেশের মানুষ দেখেছিল, তা আজও রূপায়িত হয়নি। অনেক অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। তার পরও চড়াই উৎরাই করে এদেশ সামনে এগিয়েছে।সাড়ে সাত কোটি থেকে আজ ষোল কোটি মানুষ। আমরা কি একবার হিসাব করে দেখেছি, বাংলাদেশ হওয়ায় কী কী সুবিধা আমরা অর্জন করেছি—স্বদেশে কিংবা বিদেশে, শিক্ষার ক্ষেত্রে কি চাকরিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবা পেশায়? শুধু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের কথা নয়। চাষির গায়েও এখন জামা আছে, পায়ে স্যান্ডেল।গ্রাম অন্চলে কৃষকের হাতে এখন মুঠোফোন। শহরেই কেবল অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে না, মাটির ঘরের জায়গায় টিনের ঘর উঠছে গ্রামাঞ্চলে।প্রবাসে কর্মরত শ্রমজীবীরাও অসাধ্য সাধন করেছে। প্রতিকূল পরিবেশে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তারা টাকা পাঠায় দেশে। তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ে, দেশের নানা ক্ষেত্র লাভবান হয়। তাদের বঞ্চনা কম নয়, তার পরও তাদের পরিবার স্বস্তিতে থাকে।এরা এদেশেরই সন্তান যারা দেশ স্বাধীন হওয়ায় বহির্বিশ্বে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।তাদের রেমিটেন্স দেশের আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করলেও তাদের জন্য সরকার তেমন কিছু করে নি। বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ও শতাংশ কমেছে, ধনীদরিদ্র-নির্বিশেষে গড় আয়ু বেড়েছে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, তবু জনসংখ্যা তো ক্রমবর্ধমান। তার পরও দেশটা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল, পুষ্টির অভাব চোখে পড়ার মতো। তার পরও তো শিশু ও প্রসূতির মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে কমেছে, কিছু কিছু সংক্রামক ব্যাধি দূর করা সম্ভবপর হয়েছে। শিক্ষার মান আশাব্যঞ্জক নয়, বিদ্যালয় থেকে ঝরে-পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল। তার পরও তো প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা ও হার ক্রমবর্ধমান। এই স্তরে আবার মেয়েদের সংখ্যা বেশি, এটাও গর্ব করে বলার মতো বিষয়।মেয়েদের বিষয়ে আমরা সত্যিই গর্ব করতে পারি। ফতোয়ার শিকার হয় প্রধানত মেয়েরা, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতিত হয় তারা, অ্যাসিড হামলার শিকার হয়, যৌন হয়রানি থেকেও রেহাই পায় না। সেই চিত্র কীভাবে বদলে গেছে! শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে কত এগিয়েছে মেয়েরা।দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত এখন মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অবলম্বন। সেখানকার চাকা সচল রেখেছে মূলত মেয়েরাই।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দানও উল্লেখযোগ্য। ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্রঋণ-কর্মসূচির সাফল্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ড মোহাম্মদ ইউনুছ ও তার ক্ষুদ্রঋণ-কর্মসূচিও গ্রামীণ ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, গ্রামীণ ব্যাংকের আদর্শ অনুকৃত হচ্ছে পুঁজিবাদী ইউরোপে ও সমাজতান্ত্রিক চীনে। অন্যদিকে, ব্র্যাকের উদ্যোগ এশিয়া ছেড়ে বিস্তৃত হয়েছে আফ্রিকায়।যদিও ইসলামি অর্থনীতির সাথে এর ব্যবধান অনেক, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির আওতায় ক্ষুদ্রঋণ-কর্মসূচি হলেও বাংলাদেশকেই সেসব দেশ মান্য করেছে পথ দেখানোর জন্য।ইসলাম প্রিয় মানুষ অবশ্যই সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি পছন্দ করবেন না এটা স্বাভাবিক।কিন্তু আমাদের দেশ তো ইসলামি শাসনে শাসিত নয়।আর ড মুহাম্মদ ইউনুছ তো ইসলামের মুয়াল্লেম নন যে তিনি সেদিক থেকে বিবেচনা করবেন। তিনি যা পড়েছেন চর্চা করছেন তার উপর ভিত্তি করে তিনি মানুষের কল্যান করার চেষ্টা করেছেন।তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি দেশের সম্মান বয়ে এনেছেন এবং বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে পরিচয় করে দিয়েছেন সে সম্মান তিনি পাওয়ার যোগ্য। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ এমনই সুনাম অর্জন করেছে যে কোনো দেশে সড়কের নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশের নামে, কোনো দেশে বাংলা ভাষা গৃহীত হয়েছে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলে।
আমাদের কৃষিব্যবস্থা মান্ধাতার আমলের বললে চলে। কিন্তু তারই মধ্যে ধানচাষের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও আমাদের বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে যে-কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে।আগে যেখানে মানুষ না খেয়ে থাকতো তা আর এখন নেই তবে দারিদ্রতা বাড়ছে রাজনৈতিক অস্হিতিশীলতার কারনে।অনেক কিছুর ঘাটতি আছে আমাদের, অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে সামনে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে চারটি দশক ধরে আমরা কিছুই অর্জন করিনি। আমাদের নিত্যকার হানাহানি, রুচিহীন ঝগড়াঝাটি, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি আঘাত বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করে। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি, সেসব ক্ষেত্রের কথা সহজে আমরা মনে করি না। বাংলাদেশের সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলায় উন্নতি হলেও ইসলামি ঐতিহ্যে পিছিয়ে আছে যেখানে ৯০% মুসলমান বসবাস করে।
বাংলাদেশের কথা বললে আমাদের স্মরন করতে হবে সেই মুক্তি যোদ্ধাদের কথা যারা মাঠের হাল ছেড়ে পরিবার ভুলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে আর ফিরে আসেনি,সেই কালো রাত্রির ভয়াবহ বিকৃত লাশের কথা,লাখ লাখ মা বোনের ইজ্জ্বত লুন্ঠনের কথা,বুদ্ধিজীবিদের বিকৃত লাশের কথা।আর যারা এখনো বেঁচে আছে বিকলাংগ হয়ে, তারাই ছিল এদেশের স্বাধীনতার স্হপতি।আমরা কি সমস্বরে বলে উঠতে পারি না,
বাংলাদেশ মানে ক্রমাগত দৈবদুর্বিপাক নয়, শুধু বিদ্বেষ আর সংঘাত নয়, আমাদের বাংলাদেশ মানে কোটি কোটি মানুষের হূদস্পন্দন, কঠোর জীবনসংগ্রাম, স্বার্থত্যাগ ও আত্মদান, বাংলাদেশ মানে চরিতার্থতার জন্যে অপেক্ষমাণ স্বপ্ন, অশেষ সম্ভাবনা, নতুন সূর্যোদয়।প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে যে সূর্যদয় দেখি, ভোরের শিশিরে পা ভেজাই,চারদিকে যে সবুজের সমারোহ দেখি,দেশীয় শিল্পের যে উত্থান দেখি , মাঠের পর মাঠে কৃষকের শষ্য ফলানোর সম্ভাবনা দেখি তাতে কি আমাদের মনে হয় না আমাদের দেশ ক্ষুদ্র হলেও আমরা স্বাধীন একটি জাতি।এই স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে হলে ছাত্র- শিক্ষক,কৃষক- শ্রমিক,কামার- কুমার, শাসক-বিরোধী,ফকির - মিসকিন,আমলা - সাধারন চাকুরিজীবি সবাইকে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে।আমাদের সমস্যা নীতির ও ভালবাসার যা আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি।আসুন আমরা নতুন উদ্যমে ভালবাসার মাধ্যমে , হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সামনে এগিয়ে যাই।এই স্বাধীনতার মাসে অংগিকার করি এদেশকে আবার সুজলা সুফলা ও শস্য শ্যামলায় ভরিয়ে তুলবো।আমাদের সন্তানরা আবার বলে উঠবে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।আমরা সবাই আবার ফিরে যাব সে গ্রামগুলোতে মাটির টানে।
বিষয়: বিবিধ
১১২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন