কৈশরের বিড়ম্বনা নি:শ্বেষ ও জীবন নির্বাপিত করতে পারে।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০১:১২:৩২ দুপুর
জীবনের কয়েকটি ধাপ-শিশু , কৈশোর , যৌবন ও বৃদ্ধাবস্হার সাথে আমরা সবাই সম্পৃক্ত।এক একটি ধাপ জীবনের জন্য খুব-ই গুরুত্বপূর্ন।প্রতিটি বাবা মাকে সন্তানের এই সময়ের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি।এ সময় যদি সন্তান ঠিকমত গড়ে না উঠে বা হোঁছট খায় তাহলে জীবন বিপন্ন হতে বাধ্য।সমাজের পরিবারগুলো পর্যালোচনা করলে এটি সহজে অনুমান করা যায় কেন সন্তানটি বিপথগামি হয়েছে বা সন্তানটি চরম ভালভাবে বেড়ে উঠেছে।আমরা অধিকাংশ পিতা মাতা সন্তানদের যে পরিবেশ দেয়া দরকার তা দিতে ব্যার্থ হওয়ার কারনে তাঁদের জীবন ও ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়। বিশেষ করে সন্তান যখন দশের পরে যেতে থাকে এ সময় আত্মমর্যাদাবোধ থাকে টনটনে।এ সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে হয় অপরিণামদর্শী। টলমলে আবেগ দিয়েই দেখে সে জীবনকে। সামান্য কিছুতে আপ্লুত হওয়া, খুব কষ্ট পাওয়া, অপমানিত হওয়া এবং সহজেই প্রভাবিত হওয়ারই বয়স এটা।
কৈশোরের এই টালমাটাল সময়ে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে (যেমন পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করা, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, বড়দের তিরস্কার ইত্যাদি) মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম থাকে। কাজেই খাপ খাওয়াতে না পেরে তারা যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ফেলতে পারে। আর সহজে ‘ভুল পথে’ প্রভাবিত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে এ বয়সে।
অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারেন না, এ সময় ছেলেমেয়ের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত। ‘বিপথগামী’ এই সময়টা কি তাঁরা কঠিন অনুশাসনে বেঁধে ফেলবেন, নাকি তাদের শুধু সময়ের হাতে ছেড়ে দেবেন?অবাধ্য হলে সরাসরি বকা দেওয়া বা হেয় করা ঠিক নয়।তাঁদের সাথে বাবা মাকে বেশী মিশতে হবে।তার অভিযোগ গুলো শুনতে হবে।তার কাছে সুন্দর করে রিজন গুলো তুলে ধরতে হবে।আসুন কিছু তথ্য জেনে নেই যাতে করে এই কচি জীবন গুলোকে আমরা দুর্বল না করে জাতির জন্য সবল করে গড়ে তুলতে পারি:
কঠিন অনুশাসন কেন করবেন না?
এই বয়সে সমালোচনা, গায়ে হাত তোলা, প্রতিটি কাজে বাধা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কার্যকর হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নেতিবাচক। যেমন—
এসব অনুশাসনে কিশোর মনে হীনম্মন্যতাবোধ তৈরি হয়। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব গঠন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।ঠিকভাবে নিজের প্রতি আস্থা তৈরি না হতে পারে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে পারে। অন্যের সঙ্গে মিশতে পারার সামাজিক দক্ষতাগুলো তৈরিতে সমস্যা হতে পারে।অতিরিক্ত অনুশাসনের কারণে নানা ধরনের নেতিবাচক আবেগ যেমন—রাগ, জেদ, খিটখিটে ভাব, হিংস্রতা ইত্যাদি স্থায়ীভাবে স্বভাবের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে।বকা দেওয়া, গায়ে হাত তোলা, কটু কথা বলা ইত্যাদি আচরণ অজান্তেই তারা নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করে।অতিরিক্ত শাসন কিশোর মনে আপনার প্রতি রাগ, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা এবং মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে, যা বাইরে থেকে আপনি হয়তো বুঝতেই পারছেন না।
তাহলে কেমন হবে বড়দের আচরন:
অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা, আবেগপ্রবণতা, অতি স্বাধীনচেতা মনোভাব কৈশোরের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে এসব কমে আসে। কাজেই এসব আচরণে খুব বেশি উদ্বিগ্ন না হয়ে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুন। কঠিন শাসন বা অবাধ প্রশ্রয়—কোনোটাই ঠিক নয়। এ দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে বয়স অনুযায়ী সীমারেখা নির্ধারণ প্রয়োজন।
মনোবিজ্ঞানের একটা নিয়ম হলো, যেমন আচরণে আপনি মনোযোগ দেবেন, সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাকে উৎসাহ জোগাবে। তিরস্কার বা প্রশংসা—দুভাবেই সে মনোযোগ পায়। কাজেই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে মনোযোগ না দিয়ে বরং সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন এবং তার কাঙ্ক্ষিত আচরণে মনোযোগ বাড়িয়ে দিন।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন:
বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক, যেখানে নির্দ্বিধায় আমরা মনের কথা বলতে পারি। যেখানে কোনো চোখ রাঙানির ভয় থাকে না। সুতরাং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন। নিজের মতো করে তার মতামত প্রকাশে সাহায্য করুন। সেখানে কোনো ভুল থাকলে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে তাকে বুঝতে সাহায্য করুন।
সমালোচনা না করা এবং কারও সঙ্গে তুলনা না করা:
সরাসরি সমালোচনা বা আত্মমর্যাদায় আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলবেন না। অন্যদের সামনে সন্তানদের হেয় করে কথা বলা অথবা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই উচিৎ নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে হীনম্মন্যতাবোধ ও নিজের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়।আমরা অনেকে এ কথাগুলো বুঝলেও সন্তান আপত্তিকর কোন কাজ করলে তখন আমাদের নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা।আমরা অনেকে এতে অভ্যস্ত যে, পাশে কেউ ভাল করলে নিজের সন্তানদের তিরষ্কার করি। এটা করলে নেতিবাচক ফলাফল আসবে।বরং বলুন তোমার অনেক ভাল মেধা আল্লাহ দান করেছেন।দেখ না তুমি অল্প পড়ে কত ভাল রেজাল্ট করলে।এতে আপনার সন্তানের আত্মমর্যাদা বেড়ে যাবে ও সে পড়াশুনায় আগ্রহি হয়ে উঠবে।আমাদের সবার এগুলোতে সব সময় মনযোগ দেয়া উচিত।
কোনো অবস্থাতেই জেদে ‘প্রশ্রয়’ না দেয়া:
জেদ করলে সেই দাবি পূরণ না করার দৃঢ়তা বজায় রাখুন। জেদের কারণে তার যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন।এ সময় তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলুন বা তাকে এমন কোথাও নিয়ে যান যেখানে গেলে তার মানুষিক স্বস্তি আসবে ও নিজেকে উৎফুল্ল করে নিতে পারবে।
বন্ধুবান্ধব ও খেলাধুলায় উৎসাহ:
কৈশোরে সমবয়সী বন্ধুরা তার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কাজেই বন্ধুদের নিয়ে কটূক্তি করবেন না। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। জানুন, আপনার সন্তান কার সঙ্গে মিশছে।পড়ুয়া ও ভাল চারিত্রিক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশতে ও খেলতে উৎসাহ দিন। এতে সমস্যার সমাধান, সম্পর্ক তৈরি করার মতো সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয়।যারা ঘরে বসে থাকে,কারো সাথে মিশে না সে সমস্ত ছেলে মেয়ে দক্ষ হয়ে গড়ে উঠে না।
পরীক্ষার ফলাফল বিষয়:
ফলাফল বেরোলে যেসব বিষয়ে সে তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে, সেসব নিয়ে আগে কথা বলুন। প্রশংসা করুন। এতে ভালো ফল করায় সে উৎসাহিত হবে। যেসব বিষয়ে ফলাফল খারাপ হয়েছে, সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকুন। পরে অন্য কোনো সময়ে খারাপ ফল করা বিষয়গুলোতে তার দুর্বলতার কারণগুলো আন্তরিকভাবে জানতে চান ও তার সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য ভাল শিক্ষক দিন ও পরামর্শ দিন।আমরা অধিকাংশ বাবা মা ধৈর্য হারিয়ে ঐ সময় বকা দেই সে কারনে তারা যে টুকু ভাল করছে সেটাও হারিয়ে যায়।
অনাকাঙ্ক্ষিত আচরনে নিজেকে সংযত রাখুন:
অবাধ্য হওয়া, পড়াশোনা না করা, স্কুল পালানো ইত্যাদি যেকোনো আচরণে সরাসরি বকা দেওয়া বা হেয় করা থেকে বিরত থাকুন। বরং প্রয়োজনে সাময়িকভাবে এ সময়ের জন্য তার কিছু সুবিধা কমিয়ে দিন। যেমন কথা বলা, আদর করা, খরচের টাকা, উপহার দেওয়া সাময়িকভাবে কমিয়ে দিন।তাদের বুঝতে দিন কেন এ গুলো কম করলেন।সাথে সাথে বলুন এ কম করাটা স্হায়ি নয়, তোমরা ভাল করলেই আবার এগুলো পেয়ে যাবে।
যেকোনো কাঙ্ক্ষিত আচরণে উৎসাহ দিন:
পড়াশোনা করলে, কথা শুনলে প্রশংসা করুন এবং উৎসাহ দিন। আপনি যে খুশি হয়েছেন, তা নানাভাবে প্রকাশ করুন।মনে রাখবেন এগুলো করার জন্য আপনাকে কোন খরচ করতে হবে না শুধু আপনার মেধাটাকে কাজে লাগাতে হবে।সন্তানের মনকে বুঝা বাবা মা'র জন্য অতি জরুরি।
হঠাৎ আচরণ পরিবর্তন হলে:
হঠাৎ যদি আচরণের কোনো পরিবর্তন দেখেন, যেমন চুপচাপ হয়ে যাওয়া, অস্থির থাকা, পড়ালেখায় হঠাৎ অনীহা, খাওয়া-ঘুম কমে যাওয়া, বাইরে আড্ডা দেয়া,বাবা মা'র সাথে স্বাভাবিক আচরন না করা,পরিবারকে অবহেলা করা ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে নিন। তার সঙ্গে কথা বলুন।কারন গুলো জানার চেষ্টা করুন ও প্রয়োজনে মানসিক বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
মনে রাখবেন, কিশোর বয়সে নিজের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলে পরবর্তী জীবনে ইতিবাচক হওয়া কঠিন। অভিভাবক ও শিক্ষকের সঙ্গে শৈশব ও কৈশোরের চমৎকার অভিজ্ঞতা জীবনের নানা জটিলতা মোকাবিলা করতে যে মানসিক শক্তি জোগায়, তার কোনো তুলনা নেই।
বিষয়: বিবিধ
১১৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন