রোজা মুসলমানদের ইবাদাত ও আত্মিক উন্নয়নের মাস।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৬ জুলাই, ২০১৩, ০১:১১:২৬ দুপুর

রোজা ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ এবং সর্বাপেক্ষা তাত্পর্যপূর্ণ ইবাদত। মানবদেহ জড় উপাদানে সৃষ্ট। এর চাহিদাও বিচিত্র। সে কারণে পাওয়া এবং ভোগ করার নেশা সর্বক্ষণ মানুষের সূক্ষ্ম আত্মিক অনুভূতিগুলোকে বিপর্যস্ত করে রাখে এবং আত্মাকে অনুভূতিহীন করে দেয়। ফলে উন্নততর মানবিক গুণগুলো দুর্বল এমনকি প্রাণহীন হয়ে পড়ে। মনুষ্যত্বের এ স্বভাবজাত পতন প্রতিহত করে বিবেক এবং হৃদয়-বৃত্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই বছরে এক মাস সিয়ামের সাধনা অপরিহার্য করা হয়েছে।

সিয়ামের সর্বপ্রথম শিক্ষা ভোগস্পৃহা নিয়ন্ত্রণ করে দেহমনকে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। সুবহে সাদিকের পূর্বমুহূর্ত থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সম্ভোগ থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত থাকার নাম সিয়াম সাধনা। এইসঙ্গে শরীর এবং মনকেও আল্লাহতায়ালার নাফরমানি থেকে সচেতনভাবে দূরে রাখা সিয়ামে পরিপূর্ণতা লাভ করার শর্ত।

সিয়াম ফরজ হয়েছে হিজরতের প্রায় দু’বছর পর, যখন মুসলমানরা মক্কার বৈরী পরিবেশ থেকে সরে এসে শঙ্কামুক্ত ও অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল জীবনে প্রবেশ লাভ করেছিলেন। তাদের ওপর তখন নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পিত হচ্ছিল। সমগ্র মানবজাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তখন তাদের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছে। এ গুরুভার পালন করার জন্য যে নৈতিক বল এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন, তা অর্জন করার পন্থারূপে আল্লাহপাক তাকওয়ার গুণ অর্জন বিধিবদ্ধ করেছেন। আর সে তাকওয়া অর্জনের প্রকৃষ্ট মাধ্যমরূপে চিহ্নিত করেছেন রমজানের রোজাকে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মুমিনরা! তোমাদের জন্য সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হলো, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার (আল-বাকারা ১৮৩ আHappy।'নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থগুলোয় তাকওয়া শব্দের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, সহজ কথায় তা হচ্ছে এমন একটা চারিত্রিক শক্তি, যার মাধ্যমে নিজেকে সর্বক্ষণ মহাপরাক্রান্ত সৃষ্টিকর্তার সামনে সমুপস্থিত থাকার অনুভূতি জাগ্রত থাকে। আর এ অনুভূতির আলোকেই সব ধরণের অনাচার থেকে আত্মরক্ষা সম্ভব হয়। আগের যুগেও যেসব নির্বাচিত জনগোষ্ঠীকে আল্লাহপাক মানবজাতির নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেছিলেন, তাদের জন্যও সিয়ামের সাধনা বিধিবদ্ধ ছিল বলে উপরোক্ত আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বস্তুত সিয়াম ফরজ করা সম্পর্কিত আয়াতটি এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যা দ্বারা বোঝা যায়, এটি কোনো শাস্তি কিংবা চাপিয়ে দেয়া কঠিন কোনো পরীক্ষা নয়। বরং একটি বৃহত্তর কল্যাণ লাভ করার একটা সোপান মাত্র। ফলে আগের জমানার অনুগ্রহপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মতোই আমাদের জন্যও এটি একটি বিশেষ অনুগ্রহের দান ছাড়া আর কিছু নয়।

রমজান এমন একটা মাসের নাম, যে মাসে আল্লাহতায়ালা মানবজাতির জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহরাজি বর্ষণ করেছেন। এ মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে। বলা হয়েছে, রমজানই সেই তাত্পর্যপূর্ণ মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানবজাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য (আল-বাকারা ১৮৫ আHappy

এ মাসের মধ্যেই এমন একটি রাত লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম (সূরা আল ক্কদর আ: ৩)।' এ রাতের সন্ধান লাভ এবং পূর্ণ আদবের সঙ্গে তা উদযাপন করার ফজিলতও এত ব্যাপক যা বর্ণনা করার ভাষা কারও জানা নেই। চার ধরনের পাপে লিপ্ত ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবাইকে আল্লাহপাক এ রাতে ক্ষমা করে দেন। যারা শরাব পানে অভ্যস্ত, যারা মাতা-পিতার অবাধ্য ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রয়েছে এবং যাদের অন্তরে অপরের প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ ক্রিয়াশীল।

হাদিস শরিফে রমজান মাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমার এবং তৃতীয় দশ দিন দোজখের আগুন থেকে মুক্তির। তত্ত্বজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী রোজাদাররা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত, যারা পাপ থেকে মুক্ত এবং অধীর আগ্রহে রমজানের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। রমজান এদের জন্য অফুরন্ত রহমতের বার্তা নিয়ে উপনীত হয়। দ্বিতীয়ত, যারা পাপে লিপ্ত, তবে রমজানের আগমন উপলক্ষে তওবা করতে থাকেন এবং পাপ থেকে দূরে সরার জন্য আল্লাহর কাছে তৌফিক ভিক্ষা করতে থাকেন। রমজানের প্রথম দশ দিন রোজা রাখার পর দ্বিতীয় দশ দিন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা শোনানো হয়।

তৃতীয়, ওইসব লোক, যাদের পাপের বোঝা অত্যন্ত ভারি। কিন্তু রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা তওবা করেন ও ভক্তিভরে রোজা রাখতে শুরু করেন। শেষ দশ দিনে উপনীত হওয়ার পর এসব লোকের জন্যও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নছিব হয়ে যায়।

সহিহ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রমজানুল মোবারককে আল্লাহপাক নিজের মাসরূপে আখ্যায়িত করেছেন। ব্যাখ্যাকারদের ভাষায়, এ মাসে আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত বৃষ্টি ধারার ন্যায় বর্ষিত হতে থাকে। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তেই এমন মূল্যবান, যার বিকল্প চিন্তাও করা যায় না।

সাহাবি হজরত আবু হোরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একখানা হাদিসে রয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়া যদি কেউ রমজান মাসের একটা রোজাও ভঙ্গ করে, তবে অবশিষ্ট সমগ্র জীবন রোজা রেখেও তার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হবে না (তিরমিযি, আবু দাউদ)।

কারণ রমজান মাসে রহমতের যে প্লাবনধারা প্রবাহিত হয়, বছরের অন্য কোনো সময় তা কল্পনাও করা যায় না।

রোজাদার ব্যক্তির অনুভূতিতে সর্বক্ষণ আল্লাহপাকের সজাগ অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। দারুণ তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েও সে নির্জন গৃহকোণে এক ফোঁটা পানিও গলাধঃকরণ করে না। অন্য কোনো ইবাদতের মধ্যে এমন সার্বক্ষণিক ও সতর্ক আত্মনিবেদন লক্ষ্য করা যায় না। অপরপক্ষে রোজা এমন একটা ইবাদত, যা রোজাদার ব্যক্তি নিজে প্রকাশ না করা পর্যন্ত অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। এজন্যই বোধহয় আল্লাহপাকের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রমজান আমার মাস এবং এর প্রতিদান আমি নিজের হাতেই দিব (বোখারি)।

রমজান আমল করার মাস। এর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করার এক মহা মৌসুম। হজরত সালমান ফারেসি (রা.) বর্ণিত একখানা হাদিসে বলা হয়েছে, রমজান মাসে প্রতিটি নফল ইবাদতের সওয়াব ফরজ আদায়ের সমান হয়ে যায়। আর প্রতিটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব সত্তর গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয় (মেশকাত শরিফ)।

হজরত আবু হোরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে মকবুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের একিনসহ রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমজানের রাত জাগরণ করে ইবাদতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমান ও একিনের সঙ্গে ইবাদত করে তারও সব গোনাহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন (বোখারি ও মুসলিম)।

হজরত আবু হোরায়রা (রা.) আরও বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষের সব নেক কাজের সওয়াব ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। রমজানের এবাদত তার ব্যতিক্রম। আল্লাহতায়ালা বলেন, রোজা একান্তভাবে আমারই জন্য রাখা হয়। এ জন্য আমিই তার বদলা দেব। বান্দা আমার সন্তুষ্টির আশাতেই খাদ্য, পানীয় এবং সম্ভোগ বর্জন করে থাকে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটা ইফতার করার সময় এবং অন্যটা যখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্ করবে। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও সুগন্ধযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। সবপ্রকার পাপ এবং অনাচার থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য রোজা ঢালস্বরূপ। তোমরা রোজা রেখে অশালীন এবং অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকবে। বকাঝকা করবে না। কাউকে গালি দেবে না। কেউ যদি গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে তবে তাকে এই বলে বিরত করবে যে, আমি রোজা রেখেছি (বোখারি মুসলিম)।'

আত্মিক উন্নয়নের একমাত্র পথ হলো কোরআন ও সূন্নাহের অনুসরন করা।আর এ আনুসরনের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া।শরিয়তের প্রতিটি বিষয় নিজের জীবনে নিয়ে আসার মাধ্যমে আত্মিক উন্নয়ন সম্ভব।রোজার মাস আসলে মসজিদগুলো ভরে যায় এতে আমরা সবাই আনন্দ লাভ করি।আবার রোজা গেলে মসজিদে নির্দিষ্ট মুসুল্লিতে নামাজ আদায় হয়।এতো আমারা আমাদের সাথে প্রহসন করছি।আল্লাহ নিয়মিত ইবাদাত গুজারদের ভালবাসেন।আর যারা নিয়মিত ইবাদাত করেন তাদের জন্য মৌসুমগুলোর ইবাদাত আরো বেশী লাভবান করে।যেমন-রমজান মাস,হজ্জের দিন গুলো,মহররমের প্রথম ১০ দিন,শা'বান মাস ,এ মাসে অধিকাংশ দিন রাসূল সা: রোজা রাখতেন।এ ছাড়া সপ্তাহে সোমবার ও বৃহসপতিবার রোজা রাখা।যারা সারা বছর ইবাদাত করে তাদের জন্য মৌসম গুলো আরো বেশী আত্মিক পরিচর্যায় উদ্বুদ্ধ করে।সারা বছর রোজা নামাজ নেই আর মৌসুম এলে মুসল্লি সেজে যাওয়া আবার মৌসুম গেলে আগের যায়গায় ফিরে যাওয়া হলো মুনাপেকির কাজ।আল্লাহ যেন আমাদের প্রতিটি সময় আল্লাহর কাজে ব্যায় করার ও রাসূল সা: এর সূন্নত অনুযায়ি চলার তাওফিক দান করেন।আমিন-

বিষয়: বিবিধ

১১৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File