রোজার মাধ্যমে একজন মানুষ ধৈর্যশীল ও উদারতার চরমশিখরে পৌঁছতে পারে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৪ জুলাই, ২০১৩, ০১:০৮:০২ দুপুর

মাহে রমজান ধৈর্যধারণের মাস। মানুষের কথাবার্তায়, কাজেকর্মে ও চলাফেরায় ধৈর্যধারণের মাধ্যমেই সিয়াম সাধনা পরিপূর্ণ হয়। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করে সব ধরনের পাপকাজ, পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন। এটি সমবেদনা প্রকাশের মাস। এ মাসে মুমিন বান্দাদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, উদারতা, সততা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। ধৈর্যধারণের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয় শান্তির আবাস বেহেশত। তাই এ মহান মাসটির পরিচয় তুলে ধরে ধৈর্য-সংযমের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা সবর বা ধৈর্যের মাস, আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত)

আরবি ‘সবর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ধৈর্যধারণ, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সহ্য করা প্রভৃতি। ইসলামের পরিভাষায় বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, রোগশোক, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অন্যায়-অত্যাচার যাবতীয় বালা-মুসিবতে কোনো রূপ বিচলিত না হয়ে এবং আনন্দিত ও সুখে আত্মহারা না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে যথাসম্ভব শান্তভাবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী চলার নাম সবর। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনায় রোজাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতা প্রদর্শনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে থাকেন। ফলে রোজা মানুষকে সংযমী ও সহনশীল করে এবং ত্যাগী বানায়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কুপ্রবৃত্তি মানুষকে ইবাদত করা থেকে সর্বদা বিরত রাখতে চেষ্টা করে। সুতরাং সহনশীলতার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তিগুলোকে দমন করে আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন করা উচিত। নতুবা মানবজীবনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই ধৈর্য ধারণ করে মৌলিক ইবাদত করতে হবে আর এরই নাম ইবাদতে সবর। নামাজ প্রতিষ্ঠায়, রোজা পালনে ও হজ আদায় করতে যথেষ্ট ধৈর্য ধারণ করতে হয়। ফরজ, সুন্নত, নফল, জুমা, তারাবি, তাহাজ্জুদসহ বিভিন্ন নামাজে ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। রমজান মাসে সারা দিন পানাহার পরিত্যাগ করে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে রোজা রাখতে হয়।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বৈধ জিনিসগুলো ও আবৈধ হয়ে যায়। এমনিভাবে প্রচুর অর্থসম্পদ ব্যয় করে, শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে এবং যথেষ্ট সময় ব্যয় করে হজ সম্পাদন করতে হয়।

মাহে রমজান ধৈর্যের মাস। সারা দিন পানাহার বর্জন করে রোজা রাখতে কষ্ট হবেই; বিশেষত গরমের দিনে সেই কষ্ট আরও অধিক অনুভূত হয়। আল্লাহ তাআলার অগাধ ভালোবাসা ও সওয়াব লাভের আশায় অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। মসজিদে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে খতমে তারাবি নামাজ আদায় করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে। ঈমাম সাহেব বা হাফেয সাহেবগন ধীরস্থিরভাবে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করলে একটু অধিক সময় লাগে এবং দণ্ডায়মান থাকতে বেশি কষ্ট হয়। কিন্তু সওয়াবের আশায় এ কষ্টও রোজাদারদের সহ্য করতে হয়। বস্তুত কষ্টের অনুপাতেই সওয়াব নির্ণীত হয়। দ্বীনের কাজে কষ্ট যত বেশি হবে, সওয়াবও তত বেশি হবে। এ মাসে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান পালনসহ ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। অনেকের মেজাজ কড়া থাকায় ধৈর্যচ্যুত হয়ে সামান্য কারণেই অন্যের সঙ্গে বাদানুবাদ ও ঝগড়া-বিবাদে তারা লিপ্ত হয়। এটা সম্পূর্ণ অনুচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, রোজার দিনে কেউ যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল না করে। তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে সে যেন (অধৈর্য না হয়ে) বলে, ‘আমি রোজাদার।’ (বুখারি)

ইমান ও সৎ কর্ম চালু রাখা এবং সত্য-ন্যায়ের সংরক্ষণ ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ কঠিন কাজ সম্পাদনের জন্য যে ধৈর্য ও সহনশীলতা বা সবরের প্রয়োজন, তা মাহে রমজানের দীর্ঘ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। আর এ সবর জান্নাতের পথ সুগম করে। যারা মাহে রমজানে সবর করেন, আল্লাহ তাআলা তাদের বেহেশত দান করবেন। হাদিস শরিফে রোজাকে ‘শরীরে জাকাত’ আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে ‘রোজা ধৈর্যের অর্ধেক এবং ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ধৈর্য জান্নাতের ভান্ডারসমূহের একটি ভান্ডার।’

মাহে রমজানে কঠোরভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ও সহনশীলতার যে মানবিক গুণটি অর্জিত হয়, তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের গুণই নয়, বরং এ মহৎ গুণটি কারও মধ্যে সৃষ্টি হলে ইমানদারের সমষ্টিগত জীবনে অপরের জন্য তা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, মানুষকে কঠিন ও দুর্গম পথ পরিক্রমায় চলতে শক্তি জোগায়। রোজা পালনের মাধ্যমে অর্জিত ধৈর্য ও সহনশীলতা ইমান ও তার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাধনায় প্রচুর নিয়ামক শক্তি সঞ্চার করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত সহনশীলতা তাই শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণই নয়, বরং মুসলমান সমাজের জন্য একটি দলগত কল্যাণ বয়ে আনে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা সূরা আয যুমারের ১০ আয়াতে ইরশাদ করেছেন, 'তুমি বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের প্রভুকে ভয় ভক্তি কর।যারা এই দুনিয়াতে ভাল কাজ করে তাদের জন্য ভাল রেয়েছে।আর আল্লাহর পৃথিবি সুপ্রসারিত।নি:সন্দেহে অধ্যবসায়িদের পারিশ্রমিক দেয়া হবে হিসেব বেতিরেকে।'

সুতরাং রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের মধ্যে যে ধৈর্য , সহনশীলতা ও উদারতা তথা সবরের গুণাবলি সৃষ্টি হয়—ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সুখ-দুঃখে, বালা-মুসিবতে ও অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুরূপ ধৈর্যধারণের প্রয়োজন রয়েছে। মাহে রমজান প্রকৃত অর্থেই যেন মানুষের মনের পশুত্ব, আত্মঅহমিকা, হিংস্রতাসহ সব অমানবিক দোষ-ত্রুটি জ্বালিয়ে ভস্ম করে ও ধৈর্য-সহনশীলতা বিকশিত করে। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা-হূদ্যতা সব মানবিক গুণাবলি অর্জন করে আমরা যেন মুত্তাকি হয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে জীবনের সর্বস্তরে পরিমিতিবোধ, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি—আল্লাহ পাক সবাইকে এ তাওফিক দান করুন।

বিষয়: বিবিধ

১১৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File