মুসলিম মনিষীদের নজরুলকে নিয়ে চর্চার সময় এসেছে।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ২৮ মে, ২০১৩, ০৫:০০:৩৪ বিকাল
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি ও মুসলমানদের কবি এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।জয়ন্তী পালন এগুলো ইসলামে নেই। এগুলো এসেছে অন্যান্য ধর্ম থেকে।যারা ইসলামকে অনুশীলন করেন না তাদের কাছে যে কোন দিন ক্ষন পালন করা কোন ব্যাপার নয়।আমরা আমাদের জীবনে রাসূল সা: কে আদর্শ হিসেবে লালন করি আর তার জীবনে বা তার পরে তার সাথীদের যেহেতু এগুলো পালন করতে দেখিনি সেজন্য আমাদের এগুলো থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। তবে ভাল মানুষদের জীবন চরিতের উপর চর্চা করা ও ইতিহাসকে তারুন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া পূর্বশুরিদের একটা মহান দায়িত্ব।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো দীর্ঘ সময়ে নজরুলের উপর যে সাহিত্য চর্চার দরকার ছিল তা আমাদের কবি সাহিত্যিকরা সফলভাবে করেন নি দু'চারজন ছাড়া। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেভাবে আলোড়িত এ সমাজ সেভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নজরুলকে শুধু হেয়ই করা হয়নি তার অবদানকে যথারীতি উপেক্ষা করা হছ্ছে।আজ থেকে বহু বছর পূর্বে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন থেকে ৬ দফা আন্দোলন পর্যন্ত নজরুল ছিলেন বামপন্থিদের রক্ষাকবচ।তখন মুসলিম লীগ ছিল ক্ষমতায় আর আওয়ামিলীগ ছিল বিরোধি দলে।রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন,যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন,আয়ুবখানের সামরিক শাসন জারি,৬২ তে সোহরাওয়ার্দির গ্রেফতার, মাউলানা ভাসানির জন নেতা হওয়া ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জার রোষানলে পড়া, শেরে বাংলার পতিত হওয়া ও বামপন্থি নেতা কর্মিদের গ্রেফতার ছিল ঘটনা।আওয়ামিলীগ ও শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি ৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়ই এ অবতীর্ন হয়।তখন জনমত গঠনের হাতিয়ার ছিল গন আন্দোলন সৃষ্টি।এই গন আন্দোলনের হাতিয়ার ব্যাবহার হয়েছিল নজরুলের বৈপ্লবিক কবিতা ও সংগীত।তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ,'কারার ঐ লৌহ কপাট,ভেংগে ফেল কররে লোপাট,রক্তজমাট শিকল পূজার পাষান বেদী,ওরে ও তরুন ঈশান বাজা তোর প্রলয় বিষান ধ্বংস নিশান উড়-ক প্রাচীর ,প্রাচীর বেদী।লাথি মার ভাংরে তালা যতসব বন্দীশালায় আগুনজ্বালা আগুনজ্বালা ফেল উপাড়ি।
তিনি যে কত বড় কবি ছিলেন তা বুঝা যায় কবি রবীন্দ্র নাথের মন্তব্য থেকে।তিনি হাবিলদার থাকা কালে তার লিখা কবিতা সওগাত পত্রিকায় যখন পাঠাতেন তখন কলকাতায় তাকে নিয়ে সাহিত্য অঙনে কথা বার্তা চলতে থাকে।একটা সময় এলো যখন রবীন্দ্রনাথ তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন।তখন বাংলা সাহিত্যের যারা সম সাময়িক কবি ছিলেন তারা রবীন্দ্রনাথকে বললেন তিনি কেন নজরুলকে গুরুত্ব দিছ্ছেন।এর কারন হিসেবে তারা বলতে চাইলো, সে আবার কেমন কবি হলো, তাকে তো গুরুত্বপূর্ন কবি বলে মনে হয় না,তার মধ্যে উছ্ছাস উল্লাস এগুলো ছাড়া কাব্য রচনার কোন কিছুই দেখা যাছ্ছে না।রবীন্দ্রনাথ বললেন নজরুল যে বয়সে কবিতা লিখছে আমি যদি ঔ বয়সে কবিতা লিখতাম তাহলে এ রকমই লিখতাম।কারন তার যে বয়স এ বয়সে সে যে অসাধারন কাব্যরুপ দিয়েছে তা বিস্ময়কর।সে জন্য আমি মনে করি সে শুধু কবি নয় মহাকবি বললেও অত্যুক্তি হবে না।' সেকালে অন্যরা যেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে সন্কোচবোধ করতেন কিন্তু নজরুল চিৎকার করতে করতে কবিগুরু কোথায় বলে তার কাছে যেতেন।এ থেকে বুঝা যায় তার সাহস ও অদম্য প্রতিভা কেমন ছিল।আর একটি বিশেষ ব্যাপার হলো সাধারন মানুষের কথাগুলো তার কবিতায় তীরের মত স্ফুরন ঘটেছিল।আমরা যদি ঐতিহাসিক দিক থেকেও নজরুলকে দেখি তাহলে দেখবো কমিউনিষ্টরা যখন স্হায়ি নিবাস গড়েছিল বাংলার হিন্দু সমাজ ও জমিদাররা যখন সম্পদশালী হলো এবং গোটা সমাজের উন্নয়ন হলো না আর বিশেষ করে মুসলিম সমাজ উপেক্ষিত হলো এই অসম উন্নয়নে তখন তিনি ইসলামের কথা আনলেন,মুসলিমদের কথা আনলেন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা আনলেন।মোটকথা একটা সামগ্রিক প্রতিফলন আমরা দেখতে পেলাম।নজরুল আসার পরই সেই মুসলিম সমাজে একটা সমতা এসেছিল।কাব্য চর্চায় মুসলিমরা একটা অনুপ্রেরনা পেল ও নতুন একটা অধ্যায়ের সূচনা হলো।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এত কাল পেরিয়ে গেলেও জাতির মধ্যে তাকে সঠিকভাবে মুল্যায়ন করা হয় নি শুধুমাত্র জন্ম বা মৃত্যু জয়ন্তী পালন ছাড়া আর এটা নিতান্তই একটা ধার করা জিনিস যা মুসলিম ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বীতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ এই ২৩ বা ২৪ বছরে যে কাব্য সাহিত্য মুসলিম জাতিকে নজরুল উপহার দিয়েছে তার যথাযথ চর্চা থেকে বন্চিত থেকেছে আমাদের কবি সাহিত্যকরা সামান্য দু'চারজন ছাড়া।এই দেউলিয়াত্বে কি কারন থাকতে পারে? আমরা সাধারন মানুষরা তো এতটুকু বুঝি যে এ হতে পারে মুসলিম বিদ্বেষ বা কেউ কাউকে ছোট করে দেখা।মাত্র ২২ বছর বয়সে যে " বিদ্রোহী" কবিতা বা আরো এ ধরনের গন জাগরনের কবিতা তিনি জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন তা অবিস্মরনীয়।আজ নব্বই বছর পরও কবিতাটি কেউ আবৃতি করলেই মনে হয় নতুন কিছু এসেছে সমাজ জাগরনের জন্য।তার সাহিত্য শিল্পকলার একটা সামগ্রিক দিক রয়েছে যা অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না।আধ্যাত্মিক গান,শ্যামাসংগীত,শাঁওতাল,ফোক গান,ইসলামি গান,হামদ নাত,ইরান তুরানের গান তার সাধনায় যা ফুটে উঠেছে তা যদি চর্চা বা সাধনা হতো তাহলে বাংলা সাহিত্য আরো উজ্জিবিত হতে পারতো।
আমরা আমাদের স্বার্থে এই গবেষনাগুলো না করে তাকে যেমন হেয় করছি তেমনি বন্চিত করছি আমাদের প্রজন্মকে।তার কাব্য সাহিত্ব থেকে নতুন প্রজন্মকে দেয়ার অনেক সম্ভার রয়েছে।নজরুল ইনিষ্টটিউট,নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপিত হলেও সেখানে উন্নতমানের কোন চর্চা তেমন হছ্ছে না।এটা নি:সন্দেহে একটি দুর্বল দিক যা আমাদের চোখে ভেসে উঠেছে।আমাদের যে মনিষি আইকন থাকা দরকার এবং তা সৃষ্টি না হওয়ার কারনে আমরা মুসলিমরা নামে মুসলিম কবি সাহিত্যিক হলেও অমুসলিমদের সাহিত্য চর্চাই আমাদের কাছে প্রাধান্য পাছ্ছে।এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা।অথচ কবি গাইলেন,'বল বীর-বল উন্নত মম শির,শির নেহারী আমার,নত শীর ঐ শিখর হিমাদ্রির! মহা বিদ্রোহী রনপ্রান্ত,আমি সেইদিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা -অত্যাচারির খড়গ কৃপান ভীম রণ ভূমে রণিবেনা। অথবা জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার সেই গান-দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে! লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রিরা হুঁশিয়া.' আমাদের কবি
সাহিত্যিকদের সময় এসেছে তার কাব্য সাহিত্য নিয়ে গবেষনা করার।তার অনেক কিছুই এখন হারিয়ে গেছে।মহাকালের একজন কবি যদি এভাবে হারিয়ে যায় তাহলে মুসলিম ঐতিহ্যই হারাবে।তা সংরক্ষন করার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির,নজরুল একাডেমির ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের।অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম,আব্দুল ক্কাদির বা মান্নান সৈয়দের মত ক'জন ছাড়া খুব বেশি গবেষনা হয়েছে বলে মনে হয় না।নজরুলের কাব্য সাহিত্য হতে পারে আত্ম আবিষ্কারের হাতিয়ার।শুধু মাত্র জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে তার নামটি কি মানুষ মনে রাখবে? তার সাহিত্য সম্ভার থেকে গবেষনা করে নতুনদের হাতে তুলে দিতে হবে সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার।বাংলা একাডেমি রবীন্দ্রনাথের উপর বই ছাপলেও নজরুলের উপর এখনো বই ছাপেনি তবে বর্তমান মহাপরিচালক শামছুজ্জামান খান বলেছেন গবেষনা ধর্মী ও ছোটদের জন্য আগামী বছরের মধ্যে ৩০ টি বই জাতিকে উপহার দিবেন।তবে আমাদের আরো দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দরকার।কারন হলো যারা নজরুলকে কাছে থেকে দেখেছে তাদের অনেকে চলে গেছেন আর যারা বেঁচে আছেন তারা ও বয়োজেষ্ঠ।সুতরাং যেখানে যেখানে তার সাহিত্য সম্ভার অগোচালো আছে তা খুঁজে বের করে একটা বিশ্বসাহিত্বের ভান্ডার তৈরি করার প্রয়াস আমাদের চালানো দরকার হয়ে পড়েছে।আজকের প্রজন্মের বড় একটি অংস জানে না এই বাংলা জয়ের কথাটি তার ভাঙার জানের একটি কবিতায় তিনি রচনা করেছিলেন।যে রনসংগীত আমাদের সেটাও তার অমর দান।বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের সমানে যে অন্ন,বস্ত্র ও বাসস্হান তার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে নজরুলের কন্ঠে।যে বাম একসময় হুন্কার দিত গরীবের কথা বলে সে বাম এখন বুর্জুয়ার কাছে বিক্রি হয়েছে।কাস্তে , হাতিড়ি ও লালপতাকার নেতারা এখন আস্বাদন করছেন প্রাসাদের নিত্যপরিবর্তিত লোভনীয় খাবার ও ব্যবহার করছেন ঝকঝকে লেটেষ্ট মডেলের গাড়ি।এদেরই একটা অংস ঠেলে দিয়েছে নজরুলকে কালের অতলগর্ভে।তবে নজরুলের মত কালজয়ি কবিরা হেরে যায় না, হেরে যায় স্বার্থান্বেষি লোভাতুর চাটুকরেরা আর জাতির বিবেচনায় এরাই কলন্কিত থাকবে চিরকাল।
বিষয়: বিবিধ
২৮৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন