ইসলামের কথা শুনলেই আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের মাথায় আগুন লেগে যায়।
লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:৪৫:৫৫ রাত
আমাদের এই উপমহাদেশ বিভিন্ন ধর্মের এক মিলনকেন্দ্র বলা যায়।আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ব্যবসাবানিজ্য ,চলাপেরায় , উঠা বসায় কোন সমস্যা হয়ে উঠেনি।সামাজিক আচার আচরনে কোন দৃষ্টিকটু দিক ও তেমন লক্ষ্য করিনি।গ্রাম গন্জের ডাক্তারদের সিংহভাগই ছিল হিন্দু।সামান্য অসুখ হলে ছুটে যেতাম।আজকালকার নামধারি মুসলমানের চেয়ে তারা ছিল আচার আচরনে বলিষ্ঠ।স্বাধীনতার পর শুরু হলো তাদের পালানোর মত অবস্হা।অনেকে নামমাত্র দামে যায়গা বিক্রি করে চলে গেছে বাকিরা অস্বস্তিতে জীবন যাপন করছে।অবশ্য হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখায় মুসলিমদের একান্ত বরন করে না নেয়ার ব্যাপারও এ অন্তদর্ন্দের কারন বটে।যাই হোক, মুসলিম নাম রাখলে বা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলে যে মুসলিম হয় না এটা আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের জানা নেই।মুসলমানের মুসলমানিত্ব ধরে রাখার অস্ত্র হলো দু'টি । একটি আল্লাহ প্রদত্ত কুরআন আর একটি হলো রাসূল সা: এর ছহি হাদিস।মুহাদ্দিসগন আসমানের নিচে ও জমিনের উপরে ছহি বোখারি ও ছহি মুসলিমকে কুরআনের পরে স্হান দিয়েছেন।এ দু'টি জিনিসকে চর্চা করে মুসলিম গন তাদের দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করবেন।মুসলিমের জন্য ৫টি মৌলিক বিষয় রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়।ঈমান ,নামাজ, যাকাত রমজানের রোজা ও বায়তুল্লাহর হজ্জ।যাকাত ও হজ্জের সাথে আর্থিক সামর্থ জড়িত।বাকি ৩টি বিষয় প্রত্যেকের জন্য ধনী বা গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য অবশ্য করনীয়।যে কোন ধর্ম যারা পালন করে থাকে তা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই পালন করে।কুরআন ও হাদিসে যা বর্নিত হয়েছে তা দুনিয়া ও আখেরাত ভিত্তিক।অর্থাৎ যে দুনিয়াতে এ দুটি বিষয়ের আইন মেনে চলবে সে পর জীবনে শান্তিতে থাকবে।এটা সম্পুর্ন বিশ্বাসের ব্যাপার।যিনি যে ধর্ম পালন করবেন সে ধর্মের প্রচার করা তার ধর্মিয় অধিকার। এ অধিকার খর্ব করার কেউ নেই এ আসমান ও জমিনে।আল্লাহ এখানে মানুষকে স্বাধীন হিসেবে তার কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন এজন্য আখেরাতে তিনি এ জীবনের কাজের বিচার করবেন।আর আল্লাহ তার রাসূল সা:কে কুরআনে বলে দিয়েছেন, আমি আপনাকে বল প্রয়োগকারি হিসেবে পাঠাইনি।সে জন্য কোন ধর্মের লোক একে অন্যকে বলতে পারবেনা তুমি আমার ধর্ম গ্রহন কর।সংখ্যা গরিষ্ঠ ও সংখ্যা লগিষ্ঠ সবাই সহনশীলতার সাথে যার যার ধর্ম পালন করবে।যদি বসবাসের এই ভিত্তি হয়ে থাকে তাহলে এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের উপর চড়াও হছ্ছে কেন? আজকে অন্য ধর্মের ভাইদের ব্যাপারে আমার কথা নয়।আমার কথা হলো আমরা বাংলাদেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান। অন্যদের জান মাল হেফাযত করার দায়িত্ব ও আমদের তথা আমাদের সরকারের।কিন্তু সরকার যেমনি ব্যার্থ তেমনি ব্যার্থ আমরা জন গন।এর প্রধান কারন হলো রাজনৈতিক অস্হিতিশীলতা।এ কজগুলো যে রাজনীতির ছত্র ছায়ার লোকজন করছে তা আমাদের জন গনের বুঝতে অসুবিধে হয় না।
আমাদের বুদ্ধিজীবিদের বলছি আল্লাহর ওয়াস্তে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলার আগে ইসলামকে জানুন কুরআন হাদিস অধ্যয়ন করে।আপনারা অনেকে অনেক সুন্দর মুসলিম নাম ধারন করে আছেন।মুসলিমের আচার অনুষ্ঠানও মাঝে মাঝে পালন করেন আবার কুরআন ও সূন্নাহের বিরোধিতা ও করেন এটা ঠিক নয়।জামাতে ইসলামকে দিয়ে যারা ইসলামকে মুল্যায়ন করে তাদের ইসলামি মুল্যবোধ সম্পর্কে ধারনা আছে বলে আমি মনে করিনা।আল কুরআনে সূরা আন'আমের ১৫৯ আয়াতে আল্লাহ তার নবীকে বলেছেন,যারা ইসলামকে বিভক্ত করেছে তাদের প্রতি তোমার কোন দায়িত্ব নেই।সেহেতু ইসলামের এ দলগুলো ইসলামের একটি খন্ডিত দল।ইসলামের দল হয়ে থাকলে তার মেনিপেষ্টো তো কোরআন ও হাদিস থেকেই তৈরি হবে এবং এটা একটা স্বাভাবিক কথা।গনতন্ত্র কোন ইসলামের পথ নয়।যারা ইসলামিক মডার্নিজমে বিশ্বাসী তারা এটা ধার করেছে ও গনতন্ত্রের পথে হাঁটছে।এতে ইসলামের কিছু উপকার হলেও অনেক অপকারিতা আছে।রাসূল সা: বলেছেন আমার উম্মত হলো একটি উম্মত।যিনি প্রকৃত মুসলিম হবেন তিনি এক উম্মত বানানোর কাজে মুসলিমকে একত্রিভূত করার জন্যই কাজ করবেন।রাসূল সা: আরো বলেছেন কেউ যদি একজন মানুষকে বাঁচিয়ে দেয় সে পুরো জাতিকে বাঁচিয়ে দিল আর কেউ যদি একজন মানুষকে হত্বা করে সে যেন পুরো জাতিকে হত্বা করে।তাহলে আমাদের দেশে যারা রাজনীতির নামে বা ইসলামের নামে যে মানুষ হত্বা করছে তারা কি রাসূল সা: এর উম্মতের আওতাভুক্ত কিনা ভেবে দেখতে পারেন?
আমি নাম না নিয়ে ঐ সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের বলছি,আপনারা যেহেতু ইসলামের আঙিনায়ই নাই সেহেতু ইসলাম সম্পর্কে বিতর্ক না করে ইসলামকে জানুন।বিদাআতিদের কাছ থেকে শুনে শুনে ইসলামের ব্যাখ্যা দিবেন না । এই ব্যাখ্যা আপনাদের একদিন বিরোধিতা করবে। রাসুল সা:বলেছেন , কাফের এবং মুসলিমের পার্থক্য হলো নামাজ। বর্তমান মুসলমানের কত % ৫ ওয়াক্ত নামজ পড়ে তা আমরা প্রত্যেকে পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারি। এই হাদিসের আলোকে যে নামাজ পড়ে না সে তো কাফের হতেই পারে।তবে আমাদের কারোই উচিত নয় কাউকে কাফের বলা।আমরা যারা দ্বীন সম্পর্কে জানি তারা তো সঠিক দ্বীন পৌঁছাতেই ব্যার্থ। আমি জানিনা হেফাজতে ইসলামের ভিতরের দিক কি।তবে তারা যে কাজটি করছে সেটা ইসলামের কাজ।গোটা মুসলিমকে যদি এক করতে পারে সেটা হলো ইসলামের কাজ।মানব রচিত সংবিধান কোন ইসলামিক সংবিধান নয়।যে সংবিধান আল্লাহর সংবিধান নয় সেখানে শুধু মাত্র বিসমিল্লাহ বা আল্লাহর নাম থেকেই কি লাভ।এটা তো বিসমিল্লাহ পড়ে একটা কুকাজ করার মত অবস্হা। যেমন করে থাকে সিনেমা ডাইরেক্টর রা।সিনেমা ডিসপ্লে করার প্রথমে অনেক সিনেমা্য় লিখে রেখেছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।আল্লাহর সাথে এ কুফরি করার অর্থ কি? আল্লাহ বিরোধী কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হতে পারে না।মুসলমানরা গনতান্ত্রিক দেশে নিজেদের ইসলামের মৌলিক কাজগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাবে।তবে সবাই মিলে ইসলামের সরল পথে কোন বিবাদ বিশৃংখলা না করে ইসলামকে অর্জন করার জন্য একসাথে কাজ করবে।সারা দেশের ইসলাম প্রিয় মানুষ যদি রাসূল সা: এর পথে কাজ করে তাহলে মদিনার ইসলাম কায়েম হতে সময় লাগবেনা।সে মানুষ তো দু'চারজন ও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।সমাজকে স্হিতিশীল রাখার একমাত্র উপায় হলো যতদিন মানুষ তৈরি না হবে ততদিন মানুষ তৈরিতে আমাদের আত্বনীয়োগ করতে হবে।যখন যে সরকার আসবে তখন তাদের ভাল কাজগুলোকে মেনে নিতে হবে আর খারাপ কাজগুলো তাদের সাথে বসে বা বিবৃতির মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে।আমাদের সবার জবাবদিহীতা আছে।সুতরাং দুনিয়ার জীবনে জান মালের ক্ষতি করে , সমাজকে অস্হিতিশীল করে ইসলাম কাম্য হতে পারে না।আর যেহেতু ইসলামি দেশ হলেও ফাসেক সরকার তাদের ও ইসলামকে কটাক্ষ করা বা ইসলামের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা অনুচিত।ইসলামের মুল যেহেতু এক সেহেতু জামাতে ইসলামই বলুক বা হেফাজতে ইসলামই বলুক বা অন্য কোন ইসলামিক সংগঠনই বলুক তাদের কথায় অবশ্যই মিল থাকবে।সূরা আরা'ফের ৬৫ আয়াত থকে পর পর কয়েকজন নবী দাওয়াত পেশ করেছিলেন তাদের কথা ছিল এক।তোমরা এক আল্লাহর আনুগত্য কর , আর তার সাথে কাউকে শরিক করো না।মানব রচিত কথার পরিবর্তন হয় কিন্তু আল্লাহর কথার কোন পরিবর্তন নেই এটা আমার সম্মানীয় বুদ্ধিজীবিদের বুঝে নেয়া দরকার।আমরা মানুষ আজ এক কথা বললে কাল আর এক কথা বলি।কিন্তু ইসলামের কোন কথা বললে তা এক হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
এদেশের একজন বয়োজেষ্ঠ নেত্রি ইদানিং জাতির উদ্দ্যেশ্যে বলেছিলেন চার কালিমার কথা । ইসলামে চার বা পাঁচ কালিমা নেই।ইসলামে কালিমা হলো একটি, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা'বুদ নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সা: আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ও রাসূল।ইসলামের সৌন্দর্য দেখতে নবী সা: এর চরিত্রের কাছে যেতে হবে।রাজনীতির জন্য ইসলামকে যারাই ব্যাবহার
করবে তারা হলো বড় কপোট এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত আগুন তৈরি করে রাখা হয়েছে।আমাদের কাজ মানুষের কাছে সত্য পৌঁছানো।আমরা যদি দুনিয়ার লোভ লালসা থেকে দূরে থাকতে পারি তাহলেই সুন্দর সমাজ বিনির্মান করতে পারবো।অনর্থক সমালোচনা,অন্যের ক্ষতির চিন্তা নিজেকে যেমন ক্ষতি করবে তেমনি অন্যের জীবনকেও বিষিয়ে তুলবে।আমরা আমাদের দৈন্দিন জীবনে প্রতিহিংসাই দেখতে পাছ্ছি যা সংঘাত বাড়িয়েই তুলছে।এর জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ি।সুস্হ চিন্তার মাধ্যমে এর অবসান হউক এ কামনাই করছি।
হেফাজত হঠাৎ করে ১৩ দফা দাবি তুলেছে। এ দাবিগুলোর কিছু বিভিন্ন সময় জামায়াতী নেতারা তুলেছেন। দেশে এখন এই ১৩ দফা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
দাবিগুলো হচ্ছেÑ
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল।
২. আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও. টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক সিনেমার নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিচয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারাদেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। [কালের কণ্ঠ.৭-৪-১৩]
দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলোতে সারবস্তু তেমন নেই। যারা এ দাবি তৈরি করেছেন তারা যে এদেশে ও তার মানুষজন সম্বন্ধে খুব কম জানেন এটি তারই উদাহরণ। এখানে লক্ষণীয়, তাদের ভাষায় শাহবাগের যে ‘নাস্তিক’দের বিরুদ্ধে আন্দোলন সেটি নেমে এসেছে তিন নম্বরে। ১ নং দাবির বিরুদ্ধে সংবিধানে কিছু নেই। ২ নং দাবি সম্পর্কে বলা যায় ধর্ম অবমাননাকারীর জন্য শাস্তির বিধান রেখে আইন আছে। ৩ নং দাবি মানা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার যাদের মনে করে ‘কুৎসা রটনাকারী তাদের ধরা হয়েছে। ৫ নং দাবির আংশিক ইতোমধ্যে মানা হয়েছে। আপনারা জানেন কিনাÑ কওমীদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য যে কারিকুলাম করা হয়েছে তাতে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা সব পর্যায়ে বাধ্যতামূলক। অথচ, কারিকুলামের প্রস্তাবনায় আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত করতে হবে।
এই কারিকুলাম থেকে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা সবসময় দাবি করে এসেছিলাম বাংলাদেশের (১৯৪৭-১৯৭০) ইতিহাস যেন সব পর্যায়ে সব শাখায় বাধ্যতামূলক করা হয়। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি, এই কারিকুলাম কমিটিতে আমাদের প্রিয় তিনজন সেক্যুলার ব্যক্তিত্ব আছেনÑ ড. খলীকুজ্জমান, ড. জাফর ইকবাল ও সচিব ড. কামাল চৌধুরী। যেদিন এটি অনুমোদিত হয় সেদিন তারা ছিলেন কিনা জানি না। না থাকলেও পরে তারা এর প্রতিবাদ করেননি। আপনারা কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন? নিজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাড়া তো উপায় দেখছি না। ধর্ম শিক্ষা দেয়া হোক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু জাতীয় ইতিহাস কেন পড়ানো হবে না? সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর হয়তো ইচ্ছা দেশে হেফাজতির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক।
৬নং দাবিটি প্রতিবছর জামায়াতীরা একবার করে। ৭নং দাবির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। হেফাজতের একজন নেতা সিলেটের উল্লিখিত সেই জঙ্গী মওলানা হাবিবুর রহমান এ আন্দোলন করেছেন এবং করবেনও। ৮নং দাবির বিরুদ্ধে সরকার কিছু করেনি। বরং জামায়াত মসজিদে আগুন দিচ্ছে, মসজিদকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে। হেফাজত আগামী শুক্রবার যে কর্মসূচী দিয়েছে তাও জামায়াতের অনুরূপ।
৯ নং ও ১০ নং দাবি প্রায়ই উত্থাপন করা হয়। ৯ থেকে ১৩ নং দাবির কোন সারবত্তা নেই। সরকার এখন অনায়াসে বলতে পারে হেফাজতের দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে, বাকিগুলোও বিবেচনা করা হবে।
হেফাজতের যে দাবি নিয়ে বিতর্ক চলছে তা হলো নারী সংক্রান্ত ও ব্লাসফেমি আইনের প্রবর্তন। প্রথমে বলে নেয়া ভাল এদের ২, ৪, ৫, ৬, ৭ দাবি মানতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বর্তমান সরকারের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। বিএনপি-জামায়াত জাতীয়পার্টি যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠ নিয়ে ক্ষমতায় আসে তা হলে হয়ত সংবিধান সংশোধন করে এ দাবিগুলো মেনে নেয়া হতে পারে।
হেফাজতের নারীনীতি আফগান তালেবানী সরকারের নীতির অনুরূপ। এ নীতি গ্রহণ করলে গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশের সমস্ত গার্মেন্টস সেক্টর, তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেক্টর, প্রাথমিক শিক্ষা, বিভিন্ন পেশা বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্ত প্রবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। লক্ষণীয়, এই দাবি মানলে বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিএনপির নেতৃত্বের কিছু আসে যায় না। তারা যথেষ্ট সম্পদ পাচার করেছে, ছেলেমেয়েরা তাদের বিদেশে থাকে। এরশাদ তো নারী ছাড়া থাকতে পারেন না; এটি তার প্রাক্তন স্ত্রী বিদিশাই তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন। সেই এরশাদও এখন এই দাবি সমর্থন করেন। কারণ, টাকা দিয়েও এখন আর নারী- বেষ্টিত থাকা যাচ্ছে না। টাকার জন্য আজকাল লোলচর্ম বৃদ্ধ কেউ আর পছন্দ করে না। জামায়াতের নেতৃবৃন্দের ছেলেমেয়েরাও নাছারাদের দেশে থাকে। তারা চাচ্ছে ধর্মীয় উম্মাদনা জাগিয়ে তুলে সরকার পতন ও ক্ষমতা দখল। দেশে নারীদের, গরিবদের কী হলো তাতে কিছু আসে যায় না। দেশের সম্পদ লুট করার সুযোগ পাবে এবং তা পাচার করে চলে যাবে। দেশ তাদের কাছে বড় ব্যাপার নয়, নিজে এবং নিজের পরিবার বড় ব্যাপার। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, হেফাজতের দাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের বিরোধী।
হেফাজত ঘোষণা করেছে তাদের ১৩ দফা না মানলে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। থাকতেও পারবে না। ইতোমধ্যে হেফাজতের মধ্যে ক্ষমতার মদমত্ততা চলে এসেছে। এর একটি উদাহরণ দিই। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনাসভায় হেফাজতের এক নেতা-বাচ্চা এক মৌলানা সদম্ভে শোলাকিয়ার ইমাম প্রবীণ মুহাদ্দেস আল্লামা ফরিদউদ্দিন মাসউদকে বললেন, মৌলানা মসউদ হচ্ছেন তসলিমা নাসরিনের মতো, বিতর্কিত।
নারী নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলÑ খালেদা জিয়ার স্থান কী হবে? হেফাজতের দাবি মানা হলে খালেদা কি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? সেই বাচ্চা মৌলভী টেলিভিশনে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, খালেদার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হবে। তবে, বিএনপি জামায়াত ও আওয়ামীবিরোধী মহিলাদের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া হবে না। ফ্যাশন প্যারেড করে ঘোরাফেরা বন্ধ। সিনেমা-ফ্যাশন তো বন্ধ হবেই। কিন্তু মূল কথা হলো, ক্ষমতায় যেতে হলে যদি ধর্মের ক্ষেত্রে খানিকটা ছাড় দিতে হয়, তা হলে দেয়া যাবে। জামায়াতও তাই মনে করে। তারা এও মনে করে, প্রয়োজনে মিথ্যা বলা জায়েজ।
ব্যতিক্রম আরো করা হচ্ছে। স্বঘোষিত নাস্তিক কবি ফরহাদ মাজহার যেহেতু জামায়াত-বিএনপি চিন্তা- আধারের [থিংক ট্যাংক] প্রধান সেহেতু জামায়াত-হেফাজত তার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। শুধু তাই নয় ইসলামের স্বঘোষিত ঠিকাদার মাহমুদুর রহমানের দৈনিক আমার দেশ ও যুদ্ধাপরাধী আলবদর মীর কাশেম আলীর নয়া দিগন্তে নিয়ত তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামী কি ফন্দিবাজ ইসলাম মনে হচ্ছে না? কারণ, জামায়াত বিএনপি প্রতিদিন শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক বলে উল্লেখ করছে। হেফাজত তাদের সভায় ‘শেখ হাসিনার গালে জুতা মার’ সেøাগান দিয়ে তাকে নাস্তিক ঘোষণা করছে, কিন্তু স্বঘোষিত নাস্তিক, লম্পট, চোর-ছ্যাচ্চড়দের বিরুদ্ধে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ। না, এখানেই শেষ নয়। আল্লামা শফি সমকালের সেই সাক্ষাতকারে যা বলেছেন তা আরও বিভ্রান্তিকর, অনেকাংশে পুরো সত্য নয়। আমি খানিকটা উদ্ধৃত করছিÑ
আল্লামা শফি : হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সংবিধান থেকে আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি তুলে দেয়া, নতুন প্রবর্তিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি, হিজাব পালনে নারীদের বাধ্য করা যাবে না বলে হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠা, ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেয়ার চেষ্টা, ঢালাওভাবে আলেম-ওলামা ও কওমী মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গীবাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অপপ্রচার, হাইকোর্টে কোরান সংশোধনের জন্য মামলা এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের চেষ্টার বিরুদ্ধে আগেও আন্দোলন করেছি আমরা। এখন আন্দোলন করছি আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে। খেয়াল করলে দেখবেন, হেফাজতের কোন আন্দোলনেই নেই রাজনীতির বীজ। হেফাজতে ইসলাম তার এই অরাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে। [ঐ]
এবার বিশ্লেষণ করা যাক-
১. ‘সংবিধান থেকে আল্লাহর...’-এটি ঠিক নয়, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম এখনও আছে।
২. ‘নতুন প্রবর্তিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি’-এটি ঠিক নয়। নতুন শিক্ষানীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ধর্মকে।
৩. ‘হিজাব পালনে’... এই রায় সম্পর্কে জানা নেই। যদি রায় আদালতের হয় তা হলে সরকারের কিছু করার নেই।
৪. ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি’... এটি আংশিক সত্য। তবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকায় এই নীতি কার্যকর নয়।
৫ ‘ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের...’ এখানে সরকারের করার কিছু নেই। তাছাড়া মাদ্রাসায় যারা পড়বে তারাই ফতোয়া দিতে পারবেÑ এমন ইসলামী আইন কোথাও নেই।
৬. ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেয়া’Ñ এটি ঠিক নয়।
৭. ‘ঢালাওভাবে কওমী...’ এটি অস্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কথাটা অসত্য নয়।
৮. ‘হাইকোর্টে কোরান সংশোধন...’ এটি সঠিক নয়।
৯. ‘ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ...’ এটি ঠিক নয়। জামায়াত নিষিদ্ধ মানেই ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধÑ এটি ভেবে নিলে অন্য কথা।
১০. ‘আন্দোলন করছি আল্লাহ...’ এটি বিভ্রান্তিকর উক্তি। এটি ঠিক হলে ব্যভিচারি, স্বঘোষিত কমিউনিস্ট, চোর হিসাবে খ্যাতদের মঞ্চে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করা হতো না এবং ইসলামী চিন্তা ট্যাংকির প্রধান হিসাবে স্বঘোষিত নাস্তিকদের মেনে নেয়া হতো না। আগে ফরহাদ মজহার বা শফিক রেহমানকে নাস্তিক ঘোষণা করে যদি অন্যদের ঢালাওভাবে নাস্তিক বলা হয়, তা হলে তার না হয় একটা যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে।
১১. ‘হেফাজতের কোন আন্দোলনেই নেই রাজনীতির...’ এটি ঠিক নয়। আল্লামা শফির সমস্ত বক্তব্যই রাজনৈতিক এবং জামায়াতধর্মী। লক্ষ্য করুন, মওলানা শফির সাক্ষাতকারে উল্লিখিত ১১টি পয়েন্টের মধ্যে ৮টি ঠিক নয়। বাকি তিনটি আংশিক সত্য। জামায়াত এসব ‘দাবি’ প্রায়ই তোলে। এই হচ্ছে জামায়াত। এই হচ্ছে হেফাজত। এরপরও যদি কেউ বলে বা বিশ্বাস করে জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের কোন সম্পর্ক নেই তাহলে সেই পুরনো প্রবচনটিই আবার উদ্ধৃত করতে হবে ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ।’ (চলবে)
হেফাজত হঠাৎ করে ১৩ দফা দাবি তুলেছে। এ দাবিগুলোর কিছু বিভিন্ন সময় জামায়াতী নেতারা তুলেছেন। দেশে এখন এই ১৩ দফা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
দাবিগুলো হচ্ছেÑ
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল।
২. আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও. টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক সিনেমার নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিচয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারাদেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। [কালের কণ্ঠ.৭-৪-১৩]
দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলোতে সারবস্তু তেমন নেই। যারা এ দাবি তৈরি করেছেন তারা যে এদেশে ও তার মানুষজন সম্বন্ধে খুব কম জানেন এটি তারই উদাহরণ। এখানে লক্ষণীয়, তাদের ভাষায় শাহবাগের যে ‘নাস্তিক’দের বিরুদ্ধে আন্দোলন সেটি নেমে এসেছে তিন নম্বরে। ১ নং দাবির বিরুদ্ধে সংবিধানে কিছু নেই। ২ নং দাবি সম্পর্কে বলা যায় ধর্ম অবমাননাকারীর জন্য শাস্তির বিধান রেখে আইন আছে। ৩ নং দাবি মানা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার যাদের মনে করে ‘কুৎসা রটনাকারী তাদের ধরা হয়েছে। ৫ নং দাবির আংশিক ইতোমধ্যে মানা হয়েছে। আপনারা জানেন কিনাÑ কওমীদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য যে কারিকুলাম করা হয়েছে তাতে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা সব পর্যায়ে বাধ্যতামূলক। অথচ, কারিকুলামের প্রস্তাবনায় আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত করতে হবে।
এই কারিকুলাম থেকে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা সবসময় দাবি করে এসেছিলাম বাংলাদেশের (১৯৪৭-১৯৭০) ইতিহাস যেন সব পর্যায়ে সব শাখায় বাধ্যতামূলক করা হয়। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি, এই কারিকুলাম কমিটিতে আমাদের প্রিয় তিনজন সেক্যুলার ব্যক্তিত্ব আছেনÑ ড. খলীকুজ্জমান, ড. জাফর ইকবাল ও সচিব ড. কামাল চৌধুরী। যেদিন এটি অনুমোদিত হয় সেদিন তারা ছিলেন কিনা জানি না। না থাকলেও পরে তারা এর প্রতিবাদ করেননি। আপনারা কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন? নিজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাড়া তো উপায় দেখছি না। ধর্ম শিক্ষা দেয়া হোক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু জাতীয় ইতিহাস কেন পড়ানো হবে না? সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর হয়তো ইচ্ছা দেশে হেফাজতির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক।
৬নং দাবিটি প্রতিবছর জামায়াতীরা একবার করে। ৭নং দাবির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। হেফাজতের একজন নেতা সিলেটের উল্লিখিত সেই জঙ্গী মওলানা হাবিবুর রহমান এ আন্দোলন করেছেন এবং করবেনও। ৮নং দাবির বিরুদ্ধে সরকার কিছু করেনি। বরং জামায়াত মসজিদে আগুন দিচ্ছে, মসজিদকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে। হেফাজত আগামী শুক্রবার যে কর্মসূচী দিয়েছে তাও জামায়াতের অনুরূপ।
৯ নং ও ১০ নং দাবি প্রায়ই উত্থাপন করা হয়। ৯ থেকে ১৩ নং দাবির কোন সারবত্তা নেই। সরকার এখন অনায়াসে বলতে পারে হেফাজতের দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে, বাকিগুলোও বিবেচনা করা হবে।
হেফাজতের যে দাবি নিয়ে বিতর্ক চলছে তা হলো নারী সংক্রান্ত ও ব্লাসফেমি আইনের প্রবর্তন। প্রথমে বলে নেয়া ভাল এদের ২, ৪, ৫, ৬, ৭ দাবি মানতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বর্তমান সরকারের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। বিএনপি-জামায়াত জাতীয়পার্টি যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠ নিয়ে ক্ষমতায় আসে তা হলে হয়ত সংবিধান সংশোধন করে এ দাবিগুলো মেনে নেয়া হতে পারে।
হেফাজতের নারীনীতি আফগান তালেবানী সরকারের নীতির অনুরূপ। এ নীতি গ্রহণ করলে গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশের সমস্ত গার্মেন্টস সেক্টর, তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেক্টর, প্রাথমিক শিক্ষা, বিভিন্ন পেশা বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্ত প্রবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। লক্ষণীয়, এই দাবি মানলে বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিএনপির নেতৃত্বের কিছু আসে যায় না। তারা যথেষ্ট সম্পদ পাচার করেছে, ছেলেমেয়েরা তাদের বিদেশে থাকে। এরশাদ তো নারী ছাড়া থাকতে পারেন না; এটি তার প্রাক্তন স্ত্রী বিদিশাই তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন। সেই এরশাদও এখন এই দাবি সমর্থন করেন। কারণ, টাকা দিয়েও এখন আর নারী- বেষ্টিত থাকা যাচ্ছে না। টাকার জন্য আজকাল লোলচর্ম বৃদ্ধ কেউ আর পছন্দ করে না। জামায়াতের নেতৃবৃন্দের ছেলেমেয়েরাও নাছারাদের দেশে থাকে। তারা চাচ্ছে ধর্মীয় উম্মাদনা জাগিয়ে তুলে সরকার পতন ও ক্ষমতা দখল। দেশে নারীদের, গরিবদের কী হলো তাতে কিছু আসে যায় না। দেশের সম্পদ লুট করার সুযোগ পাবে এবং তা পাচার করে চলে যাবে। দেশ তাদের কাছে বড় ব্যাপার নয়, নিজে এবং নিজের পরিবার বড় ব্যাপার। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, হেফাজতের দাবি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের বিরোধী।
হেফাজত ঘোষণা করেছে তাদের ১৩ দফা না মানলে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। থাকতেও পারবে না। ইতোমধ্যে হেফাজতের মধ্যে ক্ষমতার মদমত্ততা চলে এসেছে। এর একটি উদাহরণ দিই। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনাসভায় হেফাজতের এক নেতা-বাচ্চা এক মৌলানা সদম্ভে শোলাকিয়ার ইমাম প্রবীণ মুহাদ্দেস আল্লামা ফরিদউদ্দিন মাসউদকে বললেন, মৌলানা মসউদ হচ্ছেন তসলিমা নাসরিনের মতো, বিতর্কিত।
নারী নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলÑ খালেদা জিয়ার স্থান কী হবে? হেফাজতের দাবি মানা হলে খালেদা কি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? সেই বাচ্চা মৌলভী টেলিভিশনে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, খালেদার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হবে। তবে, বিএনপি জামায়াত ও আওয়ামীবিরোধী মহিলাদের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া হবে না। ফ্যাশন প্যারেড করে ঘোরাফেরা বন্ধ। সিনেমা-ফ্যাশন তো বন্ধ হবেই। কিন্তু মূল কথা হলো, ক্ষমতায় যেতে হলে যদি ধর্মের ক্ষেত্রে খানিকটা ছাড় দিতে হয়, তা হলে দেয়া যাবে। জামায়াতও তাই মনে করে। তারা এও মনে করে, প্রয়োজনে মিথ্যা বলা জায়েজ।
ব্যতিক্রম আরো করা হচ্ছে। স্বঘোষিত নাস্তিক কবি ফরহাদ মাজহার যেহেতু জামায়াত-বিএনপি চিন্তা- আধারের [থিংক ট্যাংক] প্রধান সেহেতু জামায়াত-হেফাজত তার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। শুধু তাই নয় ইসলামের স্বঘোষিত ঠিকাদার মাহমুদুর রহমানের দৈনিক আমার দেশ ও যুদ্ধাপরাধী আলবদর মীর কাশেম আলীর নয়া দিগন্তে নিয়ত তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামী কি ফন্দিবাজ ইসলাম মনে হচ্ছে না? কারণ, জামায়াত বিএনপি প্রতিদিন শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক বলে উল্লেখ করছে। হেফাজত তাদের সভায় ‘শেখ হাসিনার গালে জুতা মার’ সেøাগান দিয়ে তাকে নাস্তিক ঘোষণা করছে, কিন্তু স্বঘোষিত নাস্তিক, লম্পট, চোর-ছ্যাচ্চড়দের বিরুদ্ধে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ। না, এখানেই শেষ নয়। আল্লামা শফি সমকালের সেই সাক্ষাতকারে যা বলেছেন তা আরও বিভ্রান্তিকর, অনেকাংশে পুরো সত্য নয়। আমি খানিকটা উদ্ধৃত করছিÑ
আল্লামা শফি : হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সংবিধান থেকে আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতি তুলে দেয়া, নতুন প্রবর্তিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি, হিজাব পালনে নারীদের বাধ্য করা যাবে না বলে হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠা, ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেয়ার চেষ্টা, ঢালাওভাবে আলেম-ওলামা ও কওমী মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গীবাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অপপ্রচার, হাইকোর্টে কোরান সংশোধনের জন্য মামলা এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের চেষ্টার বিরুদ্ধে আগেও আন্দোলন করেছি আমরা। এখন আন্দোলন করছি আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) অবমাননাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে। খেয়াল করলে দেখবেন, হেফাজতের কোন আন্দোলনেই নেই রাজনীতির বীজ। হেফাজতে ইসলাম তার এই অরাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে। [ঐ]
এবার বিশ্লেষণ করা যাক-
১. ‘সংবিধান থেকে আল্লাহর...’-এটি ঠিক নয়, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম এখনও আছে।
২. ‘নতুন প্রবর্তিত ধর্মহীন শিক্ষানীতি’-এটি ঠিক নয়। নতুন শিক্ষানীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ধর্মকে।
৩. ‘হিজাব পালনে’... এই রায় সম্পর্কে জানা নেই। যদি রায় আদালতের হয় তা হলে সরকারের কিছু করার নেই।
৪. ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি’... এটি আংশিক সত্য। তবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকায় এই নীতি কার্যকর নয়।
৫ ‘ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের...’ এখানে সরকারের করার কিছু নেই। তাছাড়া মাদ্রাসায় যারা পড়বে তারাই ফতোয়া দিতে পারবেÑ এমন ইসলামী আইন কোথাও নেই।
৬. ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেয়া’Ñ এটি ঠিক নয়।
৭. ‘ঢালাওভাবে কওমী...’ এটি অস্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কথাটা অসত্য নয়।
৮. ‘হাইকোর্টে কোরান সংশোধন...’ এটি সঠিক নয়।
৯. ‘ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ...’ এটি ঠিক নয়। জামায়াত নিষিদ্ধ মানেই ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধÑ এটি ভেবে নিলে অন্য কথা।
১০. ‘আন্দোলন করছি আল্লাহ...’ এটি বিভ্রান্তিকর উক্তি। এটি ঠিক হলে ব্যভিচারি, স্বঘোষিত কমিউনিস্ট, চোর হিসাবে খ্যাতদের মঞ্চে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করা হতো না এবং ইসলামী চিন্তা ট্যাংকির প্রধান হিসাবে স্বঘোষিত নাস্তিকদের মেনে নেয়া হতো না। আগে ফরহাদ মজহার বা শফিক রেহমানকে নাস্তিক ঘোষণা করে যদি অন্যদের ঢালাওভাবে নাস্তিক বলা হয়, তা হলে তার না হয় একটা যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে।
১১. ‘হেফাজতের কোন আন্দোলনেই নেই রাজনীতির...’ এটি ঠিক নয়। আল্লামা শফির সমস্ত বক্তব্যই রাজনৈতিক এবং জামায়াতধর্মী। লক্ষ্য করুন, মওলানা শফির সাক্ষাতকারে উল্লিখিত ১১টি পয়েন্টের মধ্যে ৮টি ঠিক নয়। বাকি তিনটি আংশিক সত্য। জামায়াত এসব ‘দাবি’ প্রায়ই তোলে। এই হচ্ছে জামায়াত। এই হচ্ছে হেফাজত। এরপরও যদি কেউ বলে বা বিশ্বাস করে জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের কোন সম্পর্ক নেই তাহলে সেই পুরনো প্রবচনটিই আবার উদ্ধৃত করতে হবে ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ।’ (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন