ব্লগে ব্লগারদের মান সম্মত ও সৃষ্টিশীল সাহিত্ব রচনা ও মন্তব্য জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে।

লিখেছেন লিখেছেন মহিউডীন ০৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:০৬:০৬ দুপুর

কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।যে জিনিস যত সহজে পাওয়া যায় তার মুল্যায়ন হয় কম।আবার কোন বস্তু কঠিন ঘাম ঝরিয়ে অর্জিত হলে তা মুল্যায়িত হয়।আমাদের স্বাধীনতা যারা নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে অর্জন করেছিল তারা এর মুল্য বুঝে কিন্তু তাদের ৫% এর স্বাধ পেয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।যারা যুদ্ধ করেছিল তাদের বয়স ষাটউর্দ্ধ।এর মধ্যে অনেকে পরপারে চলে গেছেন।গত ৪১ বছরে তারা যে তেমন কিছুই পায়নি তা তাদের আর্তচিৎকার দেখলেই বুঝা যায়।আমাদের পাড়াগাঁয়ের আর একটি কথা আছে বাবার শাল পুত্রের জুতোর পলিশ।স্বাধীনতার পর নিজের চোখে দেখেছি যারা ছিল স্বাধীনতা বিরোধী বা যারা যুদ্ধে যাওয়ার ভয়ে গর্তে ঢুকে ছিল তারা রাতা রাতি ধন সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিল।যারা মুলসৈনিক তাদের দেখেছি উপাদি বা সনদকেও প্রত্যাখ্যান করেছিল।এরাই ছিল আসল দেশ প্রেমিক।যাই হোক যে বিষয়টির অবতারনা করেছিলাম তার দিকে ফিরে যাই।আমাদের সামনে বৈজ্গানিক যত উদ্ভাবন আমরা দেখছি অনেকে এগুলোর কুফলের কথা বলেন।এগুলোর মধ্যে যে সুফল আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন একটি পত্রিকা পড়ার দেড় মাইল পথ অতিক্রম করতে হতো।আর এখন একটু বাটুন ক্লিক করলে সারা পৃথিবী আপনার আমার সামনে চলে আসে।বলা যায় পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়।আমি সব সময়ই বলি এ পৃথিবীটা ভাল ও মন্দের সমন্বয়ে তৈরি।এ দুটোর যদি একটি থাকতো তাহলে মুল্যায়ন করা সম্ভব হতো না।কাল থাকাতে সাদার যেমন মর্যাদা তেমনি মন্দ থাকায় ভালর মর্যাদা আমরা বুঝতে পারি।

মিডিয়াকে যদি আমরা আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে গ্রহন করতাম তাহলে অশ্লিলতা আসতোনা।যারা এর ব্যবসায়িক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন তারা ব্যবসা সফল করার জন্য ভালর সাথে মন্দ ঢুকিয়ে দিয়েছে।কিন্তু আমি আর আপনি যদি খারাপটাকে বর্জন করে ভালটা নিতে শিখি তাহলে আমরা ভালটাই অর্জন করতে সক্ষম হব।ব্লগে আমার জানা অনেক ব্লগার আছেন যারা লিখেন জাতির স্বার্থে।নতুন প্রজন্মকে কিছু দেয়ার জন্য।সূরা আল ইমরানের ১০৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন,'আর যা কিছু আছে মহাকাশমন্ডলিতে ও যা কিছু আছে পৃথিবীতে সবই আল্লাহর।আল্লাহ যেহেতু আমাদের পরিক্ষার জন্য আখেরাত রেখেছেন সেজন্য এখানে ভাল মন্দ সবকিছুই রেখেছে।এখন আমাদের চয়েছ কোনটা আমরা গ্রহন করবো আর কোনটা বর্জন করবো।যারা এ মিডিয়াকে আমাদের সামনে থ্রো করেছেন আমার জানা নেই তাদের উদ্দ্যশ্য কি? তবে আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য একটা নেয়ামত যার মাধ্যমে আমরা জাতির সাথে একে অপরে ভাবের আদান প্রদান করতে পারি।আমরা শিখতে পারি শিখাতে পারি।যদি আমরা সবাই একে আপরের প্রতি শুভাকাংখি হই তাহলে জাতি হিসেবে সামনে এগুতে পারবো।আমরা জাতি হিসেবে অনেক পিছিয়ে আছি কারন আমরা এখনো ভাল জিনিসের চর্চা করতে শিখিনি।একে আপরকে ভালবাসতে শিখিনি।কুরআন আমাদের শিখিয়েছে মন্দের জবাব ভাল দিয়ে দিতে হবে।ধরুন কেউ আপনাকে গালি দিয়েছে যদি আপনি সে জিনিসটিই তাকে ফিরিয়ে দেন তাহলে সে কি শিখবে বরং বিবাদের সৃষ্টি হবে।ইসলামে এজন্য সালামের প্রচলন হয়েছে।যিনি আগে সালাম দিবেন তিনি মর্যাদার দিক থেকে উপরে।আর সালামের অর্থ হলো,আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।আপনি তার জন্য দোয়া করলেন।

ব্লগে অনেক রকমের রচনা পোষ্ট করা হয়।প্রতিটি মানুষের মেধা আছে।আর মেধাটা লালনের ব্যাপার।চিন্তাশিল ব্যাক্তি কখনো হুট করে কিছু লিখে ফেলবে না।তিনি ভাল মন্দের ফারাক করবেন।তিনি ভাববেন আমার যে লিখাটা লিখছি তা কি মানুষের মনের গভীর পৌঁছবে বা তা কি কারো কল্যান বয়ে আনবে? যদি কল্যান বয়ে না আনে তাহলে এ লিখাটা তার বিরুদ্ধে একদিন প্রতিবাদ করবে।জাতিকে সচেতন করার এটা একটা বড় মাধ্যম।দেখুন আপনাদের সমানেই আসছে,যারা খারাফ কথা গুলো লিখছে তারা কি সম্মান নিতে পারছে। বরং প্রতিবাদের ঝড় এসে তাদের উপর নিক্ষেপিত হছ্ছে।আপনি যদি সৃষ্টিশীল লেখা ও সুমন্তব্য করেন আপনার মধুর ঘ্রান অন্যকে মোহিত করবে।আপনার সুন্দর আছরন অন্যকে জীবন চলার পথে সহায়তা করবে।আপনার পরামর্শ অন্যের জীবনকে পাল্টিয়ে দিবে।বিশ্ব সাহিত্বের রচয়িতাদের দেখুন যুগ যুগ চলে যাছ্ছে তাদের কদর বেড়েই চলছে।আমার আপনার আছরন দিয়ে যদি আমরা কাউকে শিখাতে না পারি তাহলে আমাদের জীবনের কি কোন মুল্য আছে? আপনি যদি একজন সমাজ সেবক বা সাহিত্বের শিক্ষক হন তাহলে আপনার সমালোচনা থাকতেই পারে।কারন আমি আগেই বলেছি আল্লাহ এখানে মানুষকে দুধরনের বিবেক দিয়েছেন। যিনি যেভাবে চিন্তা করবেন তার প্রতিফলনও হবে সেভাবে।আমি যদি আমার অবস্হানটাকে সত্য দিয়ে গড়ে তুলতে পারি তাহলে অন্যে গাল মন্দ করলেও আমার কিছুই যায় আসে না।আমার ও আপনার ব্রত হলো জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা আর সে নিরিখে আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের অবদান রাখবো।

সাহিত্যের শিক্ষক ও সমালোচক এ দু’জাতের সাহিত্যসেবীর ভাবনা ও সাধনার ফলেই সাহিত্য-শিল্পটা বিকশিত হয়।উভয়ের চিন্তনশৈলী ও সাধনক্ষেত্র ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য কিন্তু প্রায়ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। বিশেষ করে সাহিত্যের শিক্ষক যদি একজন সৃষ্টিশীল লেখক-সমালোচকও হন, তখন তো মনজিল একই হয় এবং তা সাহিত্যের জন্য খুবই কল্যাণকর।মানুষের ভেতর নিহিত সাহিত্যমানস, সাহিত্যরুচি, সাহিত্যমেধা ও সৃষ্টিপ্রতিভা মানুষকে অবিকশিত থাকতেই দেয় না কোনোদিন। প্রতিভার জগতে স্বভাবসাহিত্যপ্রতিভার খেলাই ভিন্ন রকম। আমরা একেবারে কাছের মানুষদের ভেতরও দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করে, কর্মজীবনের প্রতিষ্ঠাপর্বে অনেকে এখন সাহিত্যাঙ্গনের অবিস্মরণীয় ব্যক্তি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, চিকিত্সাবিজ্ঞান, পৌরনীতি ও অর্থনীতির মতো বিষয়ে মাস্টার্স ও থিসিস করেও অনেকে এখন অসাধারণ গল্পকার, কালজয়ী ঔপন্যাসিক ও খ্যাতিমান কবি। এমনকি সমালোচনার মতো গবেষণা ও সীমাহীন পঠননির্ভর শিল্পেও অনেকে পণ্ডিতের আসন দখল করে আছেন। অন্যদিকে এমন উদাহরণেরও অভাব নেই, যারা বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ও থিসিস করেও কর্মজীবনে একজন ব্যবসায়ী, সংগঠক বা অন্যকিছু, যাদের কলম থেকে দু-চারটি লাইনও কোনোদিন বের হয়নি। আবার উভয়বিধ পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ও ঘটে অসাধারণ সাযুজ্যে। সাহিত্য বিষয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করে কর্মজীবনে সাহিত্যাঙ্গনের সর্বশীর্ষ ব্যক্তি হওয়ার নজির অন্তত এ যুগে কম নয়। সুতরাং প্রতিভাখেলার দমাকা অপ্রতিরোধ্য—এ কথা মানতেই হবে। এ প্রতিভার স্বভাবদাবি অস্বীকার করার জো নেই কারও। প্রতিভার প্রতিরোধ করা যায় না কখনও। প্রতিভার গতিপথ রুদ্ধ হলে সমাজ-বিবেকের অবরুদ্ধতাও অনিবার্য।

সাহিত্য নিয়ে কথা বলার জন্য কিংবা সাহিত্য নিয়ে কাজ করার জন্য সাহিত্যের ডিগ্রি থাকা জরুরি নয়। জরুরি অবশ্যি একটা জিনিস, আর তা হলো প্রতিভা। মানুষের প্রতিভা প্রতিষ্ঠানের দান নয়। দান একমাত্র মহান আল্লাহর। প্রতিষ্ঠান কখনও প্রতিভার ঠাণ্ডা কাঠিতে আগুনটা জ্বালিয়ে দেয়। নিথর সাগরে একটু তরঙ্গ সৃষ্টি করে। দিয়াশলাইয়ের বাক্সে কাঠি না থাকলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা কল্পনা করা যায় না, তেমনিভাবে সাগরে পানি না থাকলে তরঙ্গ সৃষ্টির কথাই ওঠে না। জ্ঞানের অগ্রগতির যুগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আক্ষরিক ও শাস্ত্রীয় জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরি, অপরিহার্য। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকলে ভালো এবং তা খুবই নিরাপদ। কিন্তু না থাকলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে, তেমন নয়। এ জ্ঞানের অধিকারী না হয়েও সাহিত্যের স্রষ্টা ও সমালোচক হওয়া যায়। কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষক হতে হলে অবশ্যি এ জ্ঞান জরুরি। এমনকি সর্বোচ্চ ও সম্যক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য।

অথচ দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো কোনো সমালোচকের মানসদৃষ্টি খুবই বক্র ও ভিন্নপথগামী। তারা কখনও সেসব ব্যক্তিকে সাহিত্যের সমালোচনার অধিকার দিতে রাজি নন, যারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের শিক্ষাদানে রত আছেন। যে বা যারাই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন বা বাজারজাত করেছেন, তারা সাহিত্যের প্রতি সমবেদনার শিরোনামে স্বয়ং সাহিত্যেরই সমূহ ক্ষতি করেছেন এবং নিজেদের হীনস্বার্থ পূরণ করার খেলায় মেতে উঠেছেন। আমাদের সমাজের অসত্ অর্থব্যবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে সাহিত্যব্যক্তিকেও চাকরি করতে হয়। উপার্জনচিন্তা ও উপার্জনকর্মকে সঙ্গে নিয়েই তারা সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। ফলে সাহিত্যিকদের অনেকেই সরকারি চাকরিজীবী, দোকানদার, সাংবাদিক কিংবা কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অথচ দেখা যায়, সরকারি চাকরি, সাংবাদিকতা, ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা সাহিত্যপ্রতিকূল সাংগঠনিক তত্পরতার সঙ্গে জড়িত সাহিত্যিকদের সমালোচনা প্রশ্নবিদ্ধ নয়। প্রশ্নবিদ্ধ একমাত্র সাহিত্যের শিক্ষকদের সমালোচনা। ভাবখানা এমন যে, সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে কেন সাহিত্য-এলাকায় অনধিকার চর্চা! সাহিত্যের শিক্ষককেই শিকার হতে হচ্ছে অশিক্ষক সমালোচকদের তির্যক সমালোচনার। এমনকি কোনো কোনো দলবাজ সাহিত্যিকদের মাঝে এ নিয়ে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করার ফ্যাশনও চালু আছে। অথচ নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, সাহিত্যের জ্ঞানপকস্ফ শিক্ষকদেরই তো বেশি অধিকার থাকা উচিত সাহিত্যের সমালোচনা করার। কারণ সাহিত্যশাস্ত্রের বাঁকমোড় ও অলিগলি সম্পর্কে তারা সম্যক ওয়াকেবহাল। মজার ব্যাপার হলো, সাহিত্যের (অশিক্ষক) সমালোচকদের অনেকে জীবনের একপর্যায়ে সাহিত্যের শিক্ষক হয়েছেন, আবার সাহিত্যের শিক্ষকদের অনেকেও (অধ্যাপনা ছেড়ে) সাহিত্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তখন পরস্পরের প্রতি তির্যক তর্জনী-উঁচানোর অভ্যাস কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তারাই ভালো করে জানেন।

সাহিত্যের শিক্ষকের কাজই হলো সাহিত্যের ইতিহাস, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্, সাহিত্যের সম্ভাবনা এবং তার ভালো-মন্দ নিয়ে পর্যালোচনা করা। সাহিত্যের শিক্ষকরাই প্রতিনিয়ত সাহিত্যের মেধাবী যুবকদের মুখোমুখি হন। মেধাবী গবেষক ছাত্রদের নানামাত্রিক প্রশ্নের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছেন। সাহিত্যের ছাত্র বা শিক্ষক যেই হোন, অনেক সময় তাদের আরামের ঘুম হারাম হয়ে যায় ছোট একটি বিষয় সন্ধান করতে গিয়ে। সাহিত্যগবেষণার গলদঘর্মতায় লুকিয়ে আছে সাহিত্যক্ষেত্রে তাদের মূল্যায়নের সবটুকু রোমাঞ্চ। তাদের জ্ঞানসাধনার একটি মূল্যবান অংশ জড়িয়ে আছে প্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে। সাহিত্যসাগরের অতল গভীরে ডুব দিয়ে তারা বের করে আনেন সাহিত্যের অমূল্য রত্নমানিক। সাহিত্যিক বা সাহিত্যের সমালোচক চাই তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোন, চাই সাংবাদিক, বা সরকারি চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী-সংগঠক, এমনকি চাই হোন তিনি একজন কর্মহীন ব্যক্তি—আমাদের দেখার বিষয় হলো তার কর্ম, কর্মের শিল্পোত্তীর্ণতা। আমরা তার কর্মকে বিচার করতে পারি না তার পেশার আলোকে। সাহিত্যের কোনো কোনো সমালোচকের ওপর প্রফেসরগিরির ধুয়া তুলে যারা তাদের সাহিত্যসমালোচনাকে ছোট করতে চায়, তাদের বেশিরভাগই ওই চিন্তাকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত যারা মনে করে, সাহিত্যে কী বলা হলো তা-ই দেখার বিষয়, কীভাবে বলা হলো তা খুবই তুচ্ছ। অথচ সাহিত্যে যে উভয়টাই অপরিহার্য, সে কথা বুঝেই না বোঝার ভান করে। কী বলা হলো, কীভাবে বলা হলো—সাহিত্যে উভয়টাই অপরিহার্যবিবেচন। বিষয় ও বয়নশৈলী উভয় দিকই সাহিত্যে নির্বিকল্প। বলা হয়, ‘সাহিত্যের বিচার হচ্ছে সাহিত্যের ব্যাখ্যা, সাহিত্যের বিশ্লেষণ নয়। এই ব্যাখ্যা মুখ্যত সাহিত্য বিষয়ের ব্যক্তিকে নিয়ে, তার জাতিকুলকে নিয়ে নয়।’ জাতিকুল নিয়ে নয়—এ কথা ঠিক, কিন্তু শুধু ব্যক্তিকে নিয়ে কেন? ব্যক্তির বুদ্ধি ও মস্তিষ্কপ্রসূত কর্মকে নিয়েও তো বটে।

তবে উল্লেখ্য, সাহিত্যের সব শিক্ষক ভালো সমালোচক নন। তারা যদি নিজেদের দক্ষ শিক্ষক ও অনুসরণীয় সমালোচক ভাবেন, তা হলে সেটা হবে অতি আত্মমুগ্ধতা। একজন মানুষের আত্মমুগ্ধতা থাকতেই পারে। আত্মমুগ্ধতার তো কোনো সীমা-সরহদ নেই। ধরাবাঁধা ছকব্যাকরণ নেই। অন্যদিকে এমন ব্যক্তিও আছেন, যিনি কোনোভাবেই শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। অথচ তার কলম থেকে এমন সমালোচনার জন্ম হয়, যার সামনে তাবত্ সমালোচনা লজ্জায় সেজদাবনত হয়ে পড়ে। কোনো দুর্বল সমালোচনার পেছনে অভিযোগ এমন হতে পারে না যে, সমালোচক একজন শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রফেসর কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকতাহীন সাহিত্যপণ্ডিত। পেশার আলোকে প্রতিভা-প্রতিরোধের যে ধারা চালু হয়েছে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে, (এমনকি অন্যান্য অঙ্গনেও) তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের সাহিত্যনৈতিক কর্তব্য। তবে সাহিত্যের স্বভাবদাবির আলোকে আমরা বলতে পারি, একজন সাহিত্যিক, যিনি পেশায় সাংবাদিক, তিনি যেন নিজের সমালোচনায় সাংবাদিকতা ঢুকিয়ে না দেন। সাহিত্যের রসকে যেন কষে পরিণত না করেন। আবার একজন শিক্ষক যেন এমনভাবে সমালোচনা না লেখেন, যেভাবে তিনি ক্লাসরুমে সাহিত্য পড়ান ছাত্রদের। কিছু কিছু সাহিত্যশিক্ষকের এমনসব গ্রন্থও বাজার পেয়ে যায়, যেগুলোকে বেশিদূর বলা যায় ভালো ফলপ্রার্থী মেহনতি ছাত্রের নোটমাত্র। পরীক্ষার খাতায় কী লিখতে হবে, এর উত্তরই—বলতে গেলে। আবার তারাই জিদ ধরে বসেন যে, এগুলোকে সমালোচনার সম্মান দেয়া হোক।

জগাখিচুড়ি মার্কা সমালোচনাও কেউ কেউ লেখেন। তাই বলে প্রকৃত সমালোচকদের মাথাব্যথার প্রয়োজন নেই। কারণ সাহিত্যের সোনালি জমিতে কত মানুষই না চাষ করে যাচ্ছে। সবার শ্রম কিন্তু ফসল হয়ে গোলায় উঠছে না তেমন। কতশত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া ও নাটক লেখা হচ্ছে আজকাল। এসব নিয়ে গড়ে উঠছে সাহিত্যের উঁচু-উঁচু টিলা ও পাহাড়। কিন্তু কোনো নাখান্দা সনদ দিচ্ছে যে, এগুলোর সবটাই উন্নত সাহিত্য! এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা শুধু আমাদের সাহিত্যে বা দেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ও সাহিত্যেও ঘটছে। তাই বলে প্রকৃত সাহিত্যব্যক্তিরা গাল ফুলিয়ে বসে নেই। তারাও সমানভাবে সৃষ্টি করে যাচ্ছে উন্নত সাহিত্য। তা হলে ওই যশোপ্রার্থী বর্ণচোরাদের প্রতিবাদ তো হয়েই যাচ্ছে নীরবে। ঘাবড়ে গিয়ে হাত গোটাবার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই বিশেষ কোনো পেশাকেও অভিযুক্ত করার। প্রয়োজন শুধু এতটুকু যে, কে কী লিখল এবং কীভাবে লিখল—তারই সুষ্ঠু বিচার করা। সে বিচার ও পর্যালোচনার জন্য চাই অনেক কিছু। এই ‘অনে কিছ’ু কিন্তু এমনি হয় না। এজন্য দরকার ত্যাগ ও আত্মত্যাগ, চিন্তা-চেতনা এবং সাহিত্যের প্রতি নিখুঁত নিষ্ঠা। নিজেকে তিলে তিলে ব্যয় করে, দিন-রাতকে এক করে এবং মন-মস্তিষ্কের সবটুকু ঢেলে দিয়ে দখল করতে হয় এ ‘অনেককিছু’র কলকব্জা।

সাহিত্যের পাঠদান ও সমালোচনার ক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যশিক্ষকদের দায়িত্বটা খুবই স্পর্শকাতর। পিচ্ছিল পথে হাঁটতে গিয়ে যেন নিজের ও সাহিত্যের হাত-পা ভেঙে না যায়, সেদিকে খেয়াল তো রাখতেই হবে; উপরন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তাদের সহযাত্রী ছাত্ররাও যেন পিচ্ছিলতার পঙ্কিলতায় লেপটে না যায়। সাহিত্যের পাঠদান করতে গিয়ে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং সে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি একচেটিয়া মননটানকে সর্বশক্তি নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছাত্রদের ওপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেয়ার মানসে যদি কোনো শিক্ষক আলোচনায় মেতে ওঠে, তা হলে সাহিত্যের জীবন ও যৌবন যে বিপন্ন হবে—সেটা লেখাই বাহুল্য। তখন মানবতা ও মানবজীবনের সঙ্গে সাহিত্যের কোনো ইতিবাচক সম্পর্ক থাকার কথাই থাকে না। অথচ সাহিত্য-শিল্প মানুষের জীবন ও জগত্ উপলব্ধিরই জীবন্ত বিগ্রহ বলে প্রমাণিত। একজন শিক্ষক যদি সাহিত্য বা সাহিত্যিকদের বিশেষ কোনো দৃকভঙ্গি বা দর্শন ছাত্রদের মননে খোদাই করে দিতে চান, তা হলে তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে অপর দর্শনধারীদের সমূহ দলিলদস্তাবিজকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে। কিন্তু পৃথিবীর বুকে এ পর্যন্ত কেউ কি তা করতে পেরেছে? করাটা কি উচিতও?

অধ্যাপনারত সাহিত্যব্যক্তিদের দরকার—তারা নিজেদের রচনায় যা ইচ্ছা লিখলেও ছাত্রদের সাহিত্য পড়ানোর সময় যেন প্রকৃত সত্যটা উদ্ঘাটন করেন এবং তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ফলে ছাত্ররা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অধ্যয়নলব্ধ পাণ্ডিত্যের আলোকে অনেককিছু গ্রহণ ও আবিষ্কার করতে পারবেন। কোনো ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গি যদি তার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত হয়, তা হলে জ্বলে ওঠার দরকার নেই। বরং সৃষ্টি-উল্লাসের মজাটা তাকে উপভোগ করতেই দেয়া উচিত। তাকে উত্সাহিত করা দরকার। কারণ সৃজনের আর সত্যের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে সংঘর্ষে সংঘর্ষে, ধাক্কাধাক্কিতে। একজন উদীয়মান ছাত্র নিজের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে ও প্রকাশনে বাধাগ্রস্ত হলে সে অবশ্যি দিকভ্রান্ত ও উদ্ভ্রান্ত হবেই। তাই বলে আবার শিক্ষকরা সাহিত্যের ওপর কিছু লিখলেই যদি অন্যরা চটে যান, তা হলে এর অর্থ দাঁড়াবে, তারা কেন সাহিত্যের প্রফেসর হলেন? আমরা নিজেরা কেন হতে পারলাম না?

চরম দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশে সাহিত্যের শিক্ষকরাও খামোকা নিজেদের সাহিত্যের কোনো না কোনো আন্দোলন বা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। হ্যাঁ, একজন ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষকও জড়িয়ে যেতে পারেন কোনো সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে। তার স্বাধীনতা আছে। এ আকাশে বিচরণের অধিকার রয়েছে তারও। তবে তিনি যখন সে আন্দোলনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, তখনই সমূহ সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাহিত্যের হৃদয়মন তখনই ফুঁসে ওঠে তার বিরুদ্ধে। সাহিত্যের জগত্ হলো দরবেশ-ফকিরের জগত্, যেখানে শিল্পের প্রশংসাবিচার শিল্পীদের সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে করা হয় না। হয় শুধু শিল্প এবং শুধু শিল্পেরই আলোকে। এটা এমন এক জগত্, যেখানে প্রত্যেক দরবেশই স্ব-স্ব নগরীর বাদশা। তাই ক্লাসরুমে প্রবেশের আগে বিশেষ সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতার কথা ও খেয়াল নিজের রুমেই রেখে যাওয়া উচিত শিক্ষকদের। এটা সম্ভব না হলে অন্তত ছাত্রদের নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনার স্বাধীনতা দেয়া দরকার। একজন শিক্ষকও বিশেষ কোনো সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা মোটামুটি স্পষ্টভাবে বলতে পারবেন তখনই, যখন ছাত্ররা বিভিন্ন সাহিত্য-আন্দোলন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করার পর স্বয়ং নিজেদের শিক্ষকদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলবে। তা যদি না হয়, তা হলে অবস্থা হবে চরম বেগতিক। শিক্ষক নিজেকে, নিজের মতামতকে ভালো করেই তুলে ধরলেন ঠিক, কিন্তু নতুন প্রজন্মকে হাতিয়ারবিহীন অবস্থায় এমন এক রণক্ষেত্রের দিকে ঠেলে দিলেন যাতে পদে-পদে ভুগতে হবে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও পরাজয়ের গ্লানিতে। কারণ, তার মন-মানস তো পক্ষপাতদুষ্ট পাথুরে পথ বেয়ে উঠতে যাচ্ছিল পাহাড়চূড়ায়। অথচ পাহাড়চূড়া স্পর্শ তো দূরের কথা, শক্ত পাথরের ধাক্কায়-ধাক্কায় তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় গড়িয়ে পড়ে যেতে হলো গভীর পাদদেশে। এ কথা কল্পনাবিলাস নয়। আমাদের চারপাশে এর উদাহরণসিরিজের অভাব নেই।

সাহিত্যের পথচলায়, সাহিত্যের জীবনরক্ষায়, সাহিত্যের লক্ষ্যসাধনায় শিক্ষক ও সমালোচক উভয় সাহিত্যসেবকের ভূমিকা স্বীকার্য, অনিবার্য। উভয় জাতের সাধকই আমাদের শেখান, পথ দেখান। অহিংস-নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে উভয়েই হাত ধরাধরি করে চলতে পারে একই পথে, পৌঁছতে পারে একই গন্তব্যে। এজন্য দরকার নৈতিকতা। এখানে বলছি, একজন মানুষের স্বভাবসমর্থিত নৈতিকতার কথা। সঙ্গে সাহিত্যিক নৈতিকতার কথাও। এ সাহিত্যিক নৈতিকতার অভাবেই আমাদের সাহিত্য আজ ভ্রান্ত-বিপথগামী। এ নৈতিকতাকে যা কিছুর বিনিময়ে বর্জন করা আজ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তথাকথিত সাহিত্যিক ফ্যাশন। ফ্যাশন তো নয়-ই, বলা যায় প্রফেশন। এ ফ্যাশন ও প্রফেশন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে আমাদের সাহিত্য। এখন প্রয়োজন একদল আত্মত্যাগী বীর মুক্তিসেনার যারা দেশকে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বিষয়: বিবিধ

১১৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File