চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় বাণিজ্য-করন ও নীতি ভ্রষ্টতার কালো মেঘ জনসাধারণের মানসম্পন্ন সেবা লাভের অধিকারকে হরণ করছে।

লিখেছেন লিখেছেন শিশিরবাবু ১৭ মে, ২০১৩, ০১:২৯:১৪ দুপুর

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও নীতি ধ্বসের বিষয়ে আমাদের মনোযোগ এতখানি নিবদ্ধ যে সমাজের অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করা নীতি ভ্রষ্টতা ও প্রতারণা নিয়ে আমরা সে ভাবে আলোচনা করি না। এ'রূপ একটি স্থান হল চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা। চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যে এটা পেশা হলেও বর্তমানে মুনাফাখোর ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। এই পেশার বিভিন্ন উপাদান পর্যালোচনা করলে ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়।

১) চিকিৎসক নির্বাচন: স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে আমাদের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। ১৫/২০ বৎসর আগেও ডাক্তাররা নিজেদের যোগ্যতার (ডিগ্রী,মেম্বারশীপ, ফেলোশিপ ইত্যাদি) বিবরণ দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজস্ব চেম্বার খুলে বসতেন। জনসাধারণ তাদের চেম্বারে ফির বিনিময়ে পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতেন। এখন ডাক্তারদের নিজস্ব চেম্বার পাওয়া দুষ্কর। তারা এখন ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকের আঙ্গিনায় বসেন এবং ভাড়া খাটেন। এই সমস্ত ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স ও ক্লিনিক সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। তাদের বিরাট মার্কেটিং নেটওয়ার্ক আছে। পেইড দালালরা রোগী সংগ্রহে ব্যস্ত। সত্য-মিথ্যা রং চড়িয়ে তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে রোগীদের নিজেদের ডাক্তারদের কাছে ডাইভার্ট করে। চিকিৎসক এবং রোগীর সরাসরি সম্পর্ক বিনষ্ট করে একটি দালাল শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। যাদের উদ্দেশ্য চিকিৎসক নির্বাচনের চাহিদাকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন। বর্তমানে রোগীরা ডাক্তারের কাছে যায় না, যায় ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ডাক্তারদেরও স্বীয় যোগ্যতার সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখিয়ে পশার জমানোর তাগিদ খুব একটা নেই।

২) চিকিৎসকের ভাড়া খাটা: ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স বা ক্লিনিকে ডাক্তার বসেন ঐ প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহীত রোগীদের পাওয়ার জন্য। এই প্রাপ্তি বিনা পয়সায় হয় না। তিনি রোগী দেখেন ও প্রতিষ্ঠানের আয় উপার্জনের ব্যবস্হা করে দেন। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রোগী ভর্তি, ঔষধের প্রেসক্রিপশন, অপারেশন, ভিজিট-চার্জ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আয়ের ব্যবস্হা হয়। উপার্জিত অর্থের একটা বড় অংশ পায় দালালরা, কিছুটা চিকিৎসক ও অবশিষ্ট মালিকবৃন্দ। পাঠক ভুলেও ভাববেন না এটা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় ব্যয়। এর পুরোটাই অর্থ উপার্জনের ধান্ধা বাজী। সেবা গৌণ, বাই প্রডাক্ট। যেমন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে ১০ টাকাও খরচ হবে না, অথচ ১০০ টাকার(দশ গুণ) কমে কোথাও টেস্টটি করাতে পারবেন না।

৩) চিকিৎসকের অর্থলিপ্সা: সমাজের অন্যান্যদের মত আমাদের ডাক্তাররাও অর্থ উপার্জনের নেশায় মত্ত। একজন চিকিৎসক কি কি খাতে আয় করছেন তার একটি তালিকা

 রোগী দেখা বাবদ কনসাল্টেশান ফি।

 কোন চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় গেলে প্রতিটি প্রক্রিয়ায় আলাদাভাবে নির্ধারিত পারিশ্রমিক।

 প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয়িত অর্থের কমিশন। পাঠক এই কমিশন বাবদ আয় কম নয়।

 রেডিওলোজী/ ইমেজিং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয়িত অর্থের কমিশন।

 ক্লিনিকে রোগী ভর্তি করালে এবং ভর্তি থাকাকালীন প্রতিদিনকার রুম ভাড়া, বেডচার্জ, ও টি চার্জ ইত্যাদি খরচের একটি অংশ।

 যে কোম্পানির ঔষধ লিখবেন তাদের প্রদত্ত উপঢৌকন, আর্থিক সুবিধাদি। আজকাল ঔষধ কোম্পানিগুলি ডাক্তারদের বিদেশ সফর, দেশে বিদেশে সেমিনার-কনফারেন্সে অংশগ্রহণ, বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা প্রভৃতির ব্যবস্হা করে দেয় নিজেদের প্রডাক্টের বাজারজাতকরণ ও ব্যবসা সফলতা লাভের উদ্দেশ্যে।

উৎসগুলির মধ্যে প্রথম দু'টি ছাড়া অন্য সবই অনৈতিক।

৪) সেবা প্রদানে দায়বদ্ধতাহীনতাঃ আজ যদি কোন ব্যস্ত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন, দু'দিন পর উনি আপনাকে নাও চিনতে পারে। রোগ নির্ণয়, ব্যবস্থাপত্র প্রদান, অপারেশন, পোষ্ট অপারেশন, মৃত্যু কোন পর্যায়েই কোন জবাবদিহিতা আমাদের দেশে ডাক্তারদের করতে হচ্ছে না। তারা বেপরোয়া ভাবে চিকিৎসা বিষয়ক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন এবং অর্থ উপার্জন করছেন।

৫) মেডিকেল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বাণিজ্যিকীকরণ এবং মানের ক্রমাবনতি: প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে চলে ভর্তি বাণিজ্য, পাশ-ফেলের মধ্যে খুব একটা তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্রদের রোগ ও রোগীর সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় না বললেই চলে। বেশীরভাগ প্রাইভেট মেডিকেলের হাসপাতাল নামমাত্র। শয্যা রোগীশূণ্য। সরকারী মেডিকেল দলীয়করণের চাপে বিপর্যস্ত। মেধা, নিষ্ঠা ও সম্ভাবনা অবহেলিত। দলীয় লেজুরবৃত্তে অযোগ্যদের রমরমা অবস্থা। রাজধানীর বাইরের অনেক মেডিকেল কলেজেই শিক্ষকশূণ্যতা বিদ্যমান।

৬) মেডি মোগলদের উত্থান: আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্হা ব্যয়বহুল। চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিক নিয়মে রিটার্ন না পেলে বিনিয়োগ লাভজনক হবে না। সুযোগ বুঝে কালোটাকার মালিকরা মেডিকেল ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। এরা বিশাল বাজেটে রকমারি মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করছে। লালন পালন করছে হরেক রকমের দালাল গোষ্ঠী। উচ্চ কমিশন ও আর্থিক সুবিধাদির বিনিময়ে কিনছে পরিস্থিতির শিকার ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকদের। এই পরিবেশে ক্ষুদ্র, মাঝারী বিনিয়োগকারী কোন সৎ পেশাজীবী উদ্যোক্তার টিকে থাকা কঠিন।

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে জেঁকে বসা এই কালো ব্যবসা, নীতি ভ্রষ্টতা, প্রতারণার বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন ও প্রতিবাদী হওয়া সময়ের দাবী।

বিষয়: বিবিধ

১২৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File