অসাধু সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখা অসম্ভব

লিখেছেন লিখেছেন মোহাইমেন ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:৫১:১৩ সকাল

ইংরেজিতে কথাটা হচ্ছে ‘কুকিং দ্য বুক’Ñ হিসেবে কারসাজি কিংবা জোচ্চুরি করা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, তিনি এই কারসাজি করার পরামর্শই দেবেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির দায়ে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিচার করতে সরকার অস্বীকার করছে বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক যে স্বল্প সুদে প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে অস্বীকার করেছে, সে অর্থ অন্য কোনো খাতে বাংলাদেশকে দিতে তিনি বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করবেন। অর্থাৎ যে অর্থায়ন সদর দরজা দিয়ে আসার কথা ছিল সে অর্থ পেছনের দরজা দিয়ে আনার চেষ্টা করছেন অর্থমন্ত্রী।

এই জোচ্চুরির প্রস্তাবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রাজি হবেন কি না, সেটা তাদের ব্যাপার। বহু শর্ত বাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত মাত্র একটাই শর্ত দিয়েছিল : সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করুন, দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে শাস্তি দিন, তাহলে বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতুতে অর্থায়ন করবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে অস্বীকৃতির কারণ দর্শাতে গিয়ে যেমন বাইন মাছের মতো কসরত করেছেন, তাতে আর সন্দেহ থাকে না যে, শেখ হাসিনা আবুল হোসেন সম্বন্ধে তদন্তে আপত্তি করছেন।

মধ্যরাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় এ ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে, সরকারের বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতির বখরা ওপরের দিকেও যায়। আবুল হোসেনের ব্যাপারে অভিযোগ শোনা যায়, তিনি প্রক্সিতে অন্যের হয়ে দুর্নীতি করেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্তে সরকারের আপত্তির সম্ভবত এটাই কারণ এবং এ প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে আবুল হোসেন কার প্রক্সি হয়ে দুর্নীতি করছিলেন।

এই যেখানে অবস্থা সেখানে সরকার ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ কথাটা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে না লাগলেও পারত। খোদ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করেছেন। সরকার ও তাদের অনুগত মিডিয়া গত মাসে জোরগলায় ঢাক পেটায় যে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে ‘স্নাব’ (হেনস্তা) করেছে। আসল সত্য এই যে, বিশ্বব্যাংক তার আগের দিনই কার্যত বলে দিয়েছিল সরকারের কৈফিয়তগুলো তাদের গ্রহণযোগ্য হয়নি, সুতরাং ব্যাংক ঋণ দেবে না। পরের কয়েক দিন প্রধানমন্ত্রী ও অন্য কয়েকজন মন্ত্রী ‘নিজস্ব সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের দম্ভ করছিলেন, অর্থমন্ত্রী নিজেও সে মিথ্যা দম্ভোক্তি থেকে বাদ যাননি।

ইতোমধ্যে চড়া সুদেও অন্যান্য সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহের বহু চেষ্টা করেছে সরকার। আবারো এরা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানি উন্নয়ন সংস্থা, জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ আরো বহু ্সূত্রে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে। চল্লিশটি দাতা দেশ ও সংস্থার বৈঠক ডেকেছে ঢাকায়, কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি আমন্ত্রিত সে ডাকে সাড়া দেয়নি। যারা এসেছিল তারাও টাকা দিতে রাজি হয়নি। ভারত সরকারও অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে ‘বিশেষ সুবিধা হিসেবে’ ভারত বলেছে, ১০০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি থেকে অনুদান বাবদ যে ২০ কোটি ডলার ভারত দিয়েছিল প্রয়োজনবোধে বাংলাদেশ সে অর্থ সেতু নির্মাণকাজে ব্যয় করতে পারে। কে কাকে হেনস্তা করছে সবার জন্যই এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।

মন্ত্রীরা বলছিলেন, চলতি বছরেই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে এবং তিন বছরের মধ্যেই পদ্মার ওপর বহুমুখী সেতুটি তৈরি হয়ে যাবে। তবে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের অবশ্যি বলেছিলেন যে, নিজস্ব সম্পদ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রী বুয়েটের প্রকৌশলীদের সেতুর নকশা তৈরির জন্য ছয় মাস সময় দিয়েছেন। নকশাই এখনো তৈরি হয়নি কিন্তু অর্থমন্ত্রী চলতি মাসের শেষেই টেন্ডার আহ্বানের কথা বলেছেন। মন্ত্রীদের উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তারা বলতে চাইছেন, আরো এক মেয়াদে আমাদের গদি দাও, গত নির্বাচনের আগে দেয়া অন্য সব প্রতিশ্রুতির মতো সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতিও আমরা এ মেয়াদে পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, পরের মেয়াদে পূরণ করব। কিন্তু এ সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও ফেরেববাজি বাংলাদেশের মানুষ চিনে ফেলেছে, তারা আর ভুয়া প্রতিশ্রুতিতে ভুলবে না।

শাহবাগের মহাসমাবেশ

শাহবাগের মোড়ে কিছু দিন ধরে যে সমাবেশ-মহাসমাবেশ চলছে তার মধ্যেও সরকারের ধূর্তামি এবং অসৎ উদ্দেশ্য নিহিত আছে। মনে হচ্ছে, সমাবেশকারীরাও এখন সরকারের ছলচাতুরী ধরে ফেলেছে। ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট। সরকারের নিযুক্ত ট্রাইব্যুনাল আর বিচারপতিরা কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দণ্ড দেননি, দিয়েছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সরকার তাতে নাখোশ হয়ে থাকলে আপিল করতে পারত তারা, আপিলের বিধান ১৯৭৩ সালের আইনে না থাকলে সে আইন তারা সংশোধন করতে পারত, যেটা তারা এখন করতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা তাদের সৃষ্ট ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে (কার্যত নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেই) বিবৃতি দিতে শুরু করেন। কারোই কোনো সন্দেহ ছিল না যে, নিজেদের ক্যাডার ও আজ্ঞাবহ তথাকথিত সুশীলসমাজকে ব্যবহার করে গণ-হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। এরা আশা করেছিল, শাহবাগ মোড়ের সমাবেশের গরম গরম বক্তৃতা তাদের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে কিছু পরিমাণেও সাহায্য করবে।

অনেক ভুল ছিল সরকারের হিসাবে। প্রথমত, শাহবাগ মোড় বাংলাদেশ নয়। এখানের হিস্টিরিয়া দশ-এগারো মাস পরের বাংলাদেশ নির্বাচনে সামান্যই প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয়ত, বোতলের দানব একবার বের করে আনলে তাকে আবার বোতলে পোরা সম্ভব হয় না। ইতোমধ্যে সরকারও সেটা বুঝে গেছে। তারা গত শুক্রবারই (৮ ফেব্রুয়ারি) সমাবেশের সমাপ্তি ঘটাতে চেয়েছিল কিন্তু বহু লোক এখনো শাহবাগ মোড়েই অবস্থান করছে। রাজধানীর চলাচলব্যবস্থা এবং অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব গুরুতর হতে বাধ্য। এই অবাধ্য অংশ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে বলেই জানা গেছে। অর্থাৎ ছাত্রলীগ এবার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মনে হয়।

ফ্যাসিস্টপ্রবণতা

সরকার আইনের সংশোধন করতে যাচ্ছে। তারা হয়তো আপিল করবে এবং সুপ্রিম কোর্ট হয়তো সে আপিল মঞ্জুরও করবেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিচারপতিদের উদ্দেশে জনতার দাবি মেনে নিয়ে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, বিচারপতিরা কি মামলার সাক্ষী-প্রমাণ বিবেচনা করে রায় দেবেন, না জনতার আকার দেখে। সরকারের মন্ত্রীদের নির্দেশে যদি ফাঁসি দিতে হয় তাহলে মন্ত্রী নিজেরা কেন এজলাসে বসে ফাঁসির আদেশ দেন না? তাছাড়া শাহবাগের জনতা বাংলাদেশের একমাত্র জনতা নয়। দেশে আরো বহু জনতা, হয়তো শাহবাগের চেয়েও বড় জনতা হয়েছে এবং হয়। তাদের দাবিগুলোর কথা কিভাবে বিবেচনা করবেন বিচারকেরা? প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে কোথায়? গোটা দেশের মানুষই তো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে, তাদের দাবির কী করছে তার সরকার? জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলে আদালতের রায়কে প্রভাবিত করার চেষ্টায় দেশে এবং বিদেশে এ ধারণাই সৃষ্টি হবে যে, বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়া শাসক দলের অঙ্গুলী তাড়নে এবং সড়কের জনতার স্লোগান ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার বিচারপ্রক্রিয়াকে দলীয়করণ করে দেশে-বিদেশে সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছে। এখন আবার জনতার চাপে বিচারকে প্রভাবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার সম্ভবত নিজেদের অজান্তেই ফ্যাসিবাদের দানবকেও বোতল থেকে বের করে দিয়েছে।

শাহবাগের পরিণতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত তিনটি পত্রিকার বিক্রিতে বাধা দেয়া হয়েছে, এসব পত্রিকার কপি পোড়ানো হয়েছে, কোনো কোনো টেলি-চ্যানেলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার দুপুরে। ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী মতিঝিল এলাকায় দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ওপর হামলা করে। তারা একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়, জুরাইনে ছাপাখানা ভাঙচুর করে এবং ১০ টন নিউজ প্রিন্ট পুড়িয়ে দেয়। এরা কারা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কাদের নির্দেশে এধরনের ঘটনা তাও সহজবোধ্য।

আগুন নিয়ে খেলবেন না

বহু ভাষাতেই সুপ্রাচীন প্রবাদবাক্য ‘আগুন নিয়ে খেলা অত্যন্ত বিপজ্জনক’। সংবাদপত্রের অফিসে কর্মচারী ও সাংবাদিকেরা ছাড়াও বাইরের বহু লোক আনাগোনা করেন। বেপরোয়া আগুন লাগানোয় নিরীহ লোকদের প্রাণহানির আশঙ্কা সব সময়ই থেকে যায়। সম্পত্তির কিংবা আত্মরক্ষার খাতিরে যদি সবলে প্রতিরোধ করা হয় তাতেও প্রাণহানির আশঙ্কা বাদ দেয়া যায় না? সরকার কি সেসব প্রাণহানির দায়িত্ব নেবেন?

সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পত্রিকা পোড়ানো, পত্রিকার অফিসে অগ্নিসংযোগÑ এ জাতীয় অপরাধ অত্যন্ত ভয়াবহ কিছু প্রবণতার পরিচয় দেয়। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলো ঘটেছিল বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। অ্যাডলফ হিটলার অসাধু পন্থায় ক্ষমতা লাভের জন্য ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করেছিলেন। তার আগুন ঝরানো বক্তৃতায় সৃষ্ট হিস্টিরিয়ার বশবর্তী হয়ে ফ্যাসিস্টরা প্রথমে পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে আগুন লাগিয়েছে, লোকের বাড়ি এবং লাইব্রেরি থেকে বই এনে স্তূপাকৃতি করে পুড়িয়েছে, মুক্ত-মন লেখক ও চিন্তাবিদদের ধরে ধরে মারপিট করেছে, তাদের এবং ইহুদিদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, এমনকি জার্মান রাইখস্ট্যাগও (পার্লামেন্ট ভবন) পুড়িয়ে দিয়েছিল এরা। এরই জের ধরে জার্মানিতে পূর্ণাঙ্গ নাৎসিবাদ আসে। বিশ্বজয়ের বাসনা থেকে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেন, কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে সে যুদ্ধে এবং মানব সভ্যতাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু অন্যায় কখনো চিরস্থায়ী হয় না। ফ্যাসিবাদের কবর রচিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই এবং সস্ত্রীক আত্মহত্যা করে হিটলারকেও প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছিল।

ক্ষমতার অন্ধ লোভে বর্তমান সরকার একের পর এক ভুল করে চলেছে। এসব ভুলের খেসারত একদিন না একদিন তাকে দিতেই হবে। কিন্তু তত দিনে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশ ও দেশের স্বাধীনতাকে যদি প্রধানমন্ত্রী বাঁচাতে চান তাহলে সরকারের উচিত হবে এখনই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সাধারণ নির্বাচনের দাবি মেনে নিয়ে, দেশে ফ্যাসিস্টপ্র্রবণতাগুলো পরিহার করে এবং অন্য সব দলের সহযোগিতায় দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির নির্বাচনে পরাজিত হলেও দেশবাসী এ সরকারকে ক্ষমা করবে এবং আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কেউ বাদ দেবে না। কিন্তু বর্তমানে যে পথে সরকার চলেছে সে পথে এ সরকারের জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকবে না।

বিষয়: বিবিধ

১০৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File