আমার লংমার্চ অভিজ্ঞতা
লিখেছেন লিখেছেন সত্য সবার উপর ০৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:২১:৩৫ বিকাল
হেফাজতে ইসলামের ডাকা লংমার্চএ যোগ দেবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা আসলেই আমার জন্য কঠিন তারপরও কিছুটা শেয়ার না করে থাকতে পারছি না।
গত পরশু এশার সলাতের পর আমরা পরিচিত কয়েকজন মসজিদের বাইরে আলোচনা করছিলাম কীভাবে লংমার্চে জয়েন করা যায় কেননা সরকার এখানে হরতাল ডেকেছে এবং আমরা নিশ্চিত যে সব ধরনের গাড়ি বন্ধ থাকবে, যা হোক ফজরের সলাত শেষে দেখি এক ভাই দুইটি মাইক্রোবাস নিয়ে এসে হাজির । যাক ভালোই হল যাতায়াতের একটা ব্যবস্থা হল। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে স্ত্রীকে বললাম ঘরে শুকনা খাবার কি কি আছে, সে আমাকে তাড়াতাড়ি কিছু বিস্কিট, চানাচুর আর একটা জায়নামাজ দিয়ে দিল, আমরা সবাই মাইক্রোতে চেপে রওনা হলাম উত্তরা থেকে।
যখন এয়ারপোর্ট রোডে উঠলাম তখন দেকি এলাহি কাণ্ড দলে দলে লোক হাঁটছে এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে, গন্তব্য মতিঝিল, নিজের ভিতরে একটা শিহরণ অনুভব করলাম। মাইক্রো ছেড়ে দিয়ে হাটা শুরু করলাম মিছিলের সাথে।
যখন আমরা মোটামুটি খিলখেতের কাছাকাছি তখন আমার সাথের একজন বলল ভাই আমি তো আর হাঁটতে পারছি না একটা রিক্সা নিই, তো তিনি একটা রিকশা নিলেন এবং আমিও তার সহযোগী হলাম, খিলখেত পৌঁছে দেখি মিছিল বরং আমাদের থেকে এগিয়ে গেছে আর আমরা ট্রাফিক জ্যামের ভিতরে পড়লাম মিছিলের কারনে, আমি বললাম ভাই আপনি রিক্সায় আসতে থাকেন আমি হাটা ধরলাম।
জ্যামের কারনে আমার হাটতেও একটু সমস্যা হচ্ছিল আর দেখি মিছিলও বেশী এগিয়ে গেছে, আমি দিলাম দৌড়। দৌড়ে গিয়ে মিছিলে শামিল হলাম বিশ্বরোডের মাথায় । ওখানে দেখি এক এটিএন'এর ক্যামেরা ম্যান আর রিপোর্টার দাড়িয়ে আছে, আমাদের এক সঙ্গির সাথে কথা বলতে চাইল কিন্তু সে পাত্তাই দিল না রিপোর্টারকে। এগিয়ে চলেছি বিশ্বরোড দিয়ে রামপুরা অভিমুখে।
ইতিমধ্যে আমার সাথে ঐ সঙ্গি দেখি অন্য একটি রিক্সা নিয়ে যাচ্ছে, ইতিমধ্যে আমার পায়ে হাল্কা ব্যাথা অনুভব করছি তাই তাঁকে থামিয়ে আবার তার রিক্সায় উঠলাম।
পথে পথে দেখি বিভিন্ন জায়গায় মানুষের জটলা মিছিল দেখছে এবং সাথে হাত নাড়িয়ে সমর্থন জানাচ্ছে, কেউ কেউ বা অপেক্ষা করছে মিছিল আসলে যোগদান করবে, তাঁদেরকে বললাম অপেক্ষা করুন পিছনেই মিছিল আসছে ।
রিক্সা যখন রামপুরা ব্রিজ ছেড়ে চলে এসেছে দেখি পরপর দুইটি বড় মিছিল, এবার আর আমি রিক্সায় বসে থাকতে পারলাম না, মন আনচান শুরু করল মিছিলের সাথে যাবার জন্য, নেমে পড়লাম রিক্সা থেকে। শুরু করলাম হাটা মিছিলের সাথে আর স্লোগান চলছে মুহুর্মুহু, নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর ইত্যাদি সহ আরও অন্য স্লোগান।
এগিয়ে চলেছি মিছিলের সাথে, মাঝে এক বোতল পানি কিনলাম কেননা গলা শুকিয়ে আসছে, একটা জিনিস দেখলাম কোন বিশৃঙ্খলা নেই মিছিলে, দলনেতারা মিছিলের আগে আগে চলেছে এবং এটা দেখে আমার যে কি ভালো লাগছিল বোঝাতে পারব না।
আমরা যখন মালিবাগ রেলগেট পেরিয়ে চলে এসেছে বেইলী রোডের মাথায় তখন দেখি ওখানে এক মেয়ে হাতে একটি খাতা আর কলম নিয়ে কি যেন টুকে নিচ্ছে। ঐ মেয়ের পরনে টাইট ফিট জিন্স এবং সাথে টপস, ওড়না ছিল কি না মনে নেই, পরে প্রথম আলো ওরফে পচা আলু পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম সে ছিল একজন সাংঘাতিক সাংবাতিক (সাংবাদিক বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না) এবং তাঁকে নাকি কোন এক মিছিল থেকে কমেন্ট করা হয়েছে "‘ওই মাইয়্যা, মাথায় কাপড় নাই ক্যান?’" আর তার নাম "জাকিয়া আহমেদ" । এটা নিয়ে দেখলাম পচা আলুর সে কি কান্নাকাটি করা রিপোর্ট (এখানে পচা আলুর রিপোর্ট)
মিছিল এরপর চলে আসল নাইটিংগেল মোড়ে, দেখি আমাদের ঐতিহাসিক পুলিসের সর্দার জনাব মেহেদি সাহেব একটা সাধারণ পোশাক পরে তার বাহিনী নিয়ে দাড়িয়ে আছেন বীরের ভঙ্গিতে। আমার পাশের একজনকে ডেকে বলছে, এদিকে আসেন দেখি আপনার ব্যাগে কি আছে, বোমা টোমা আছে নাকি, এ কথা শোনার সাথে সাথে সে ব্যাগ নিয়ে গিয়ে খুলে ধরল আর আসে পাশে যারা আসছে পিছনে তারাও নিজের ইচ্ছাতেই ব্যাগ খুলে ধরল, তখন মেহেদি সাহেব বললেন, না না সমস্যা নেই, আপনার জান জান । আমাদের অনেকেই আসার পথে অবশ্য পুলিশ এবং র্যাব বাহিনীর ভাইদেরকে সালাম দিলেন এবং তার প্রতিউত্তর দিল এবং কেউ কেউ হাত নাড়িয়ে অভিনন্দন জানাল। মূল কথা হল পুলিশ এবং র্যাব ধারে কাছে আসে নাই মিছিলের তেমন একটা।
( মেহেদি সাহেবের বাহিনী যখন ব্যাগ তল্লাশি চালাচ্ছেন। )
হাঁটতে হাঁটতে ইতিমধ্যে আমরা চলে এসেছি ফকিরাপুল মোড় ছেড়ে দৈনিক বাংলার কাছাকাছি, দেখি একটা হলুদ পিকাআপ এর থেকে খুব সুন্দর গানের আওয়াজ আসছে, কাছে আসতেই দেখি একদল শিল্পী ইসলামী গান পরিবেশন করছে, আহঃ কি যে বলব সেই গানের সুর আর কথা মনে হল যেন অনেক দিন পর হৃদয় ছুয়ে গেল আর কণ্ঠ কি তাদের, মাশাআল্লাহ।
ইতিমধ্যে চলে এসেছে দৈনিক বাংলা মোড়ে, সেখানে হাত ধরে অপেক্ষা করছে হেফাজতে ইসলামের কর্মীগণ, আমাদের অভ্যারথনা জানাল আর আমরা হেঁটে চললাম শাপলা চত্তরের দিকে।
বেলা বাড়ছে এবার সাথে সাথে বেড়ে চলেছে সূর্যের তাপ, প্রখর তাপে আমরা আশ্রয় নিলাম একটি বিল্ডিংএর ছায়ায়, বেশ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারনে কিছু কাগজ বিছিয়ে আর জায়নামাজ বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম । এবার একটু বিশ্রামের পালা, আমরা হাল্কা কিছু খাবার, আইসক্রিম, খেজুর, শসা ইত্যাদি খেলাম ।
আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম এত মানুষ কিন্তু টয়লেটের কি অবস্থা হতে পারে? কারন সব অফিস আদালত বন্ধ কিন্তু লাখ লাখ মানুষ তাদের টয়লেটের কোন ব্যবস্থা নেই। আসলে গরম ছিল অত্যাধিক কিন্তু যে পানি আমরা খাচ্ছিলাম সেটা আর বের হবার প্রয়োজন বোধ করে নাই তাই কোন বেগ নেই আর গরম ছিল কিন্তু কোন ঘাম ঝরছিল না। এই কারনে তেমন কষ্ট লাগে নাই। আমি দেখছিলাম মানুষ কীভাবে রাস্তায় বসে আছে কিন্তু কোন সমস্যা নেই তাদের, ছেলে বুড়ো যুবক সবাই বসে আছে নিশ্চিন্তে । আসলে আল্লার অপার মহিমা বোঝা বড়ই ভার ।
ইতিমধ্যে রোদ বেড়ে যাবার কারনে আমাদের জায়গা ছেড়ে উঠে পড়লাম আর হাটা শুরু করলাম একটু ছায়ার জন্য, মাথার উপর জায়নামাজ দিয়ে ছায়া করে চলেছি, গেলাম একটা হোটেলে যে ওখানে টয়লেট আছে কি না দেখার জন্য যদিও তেমন কোন বেগ নেই আর অজু করেছি সেই ভোর রাতে কিন্তু অজু অব্যাহত আছে এতক্ষন কোন সমস্যা ছাড়াই।
হোটেলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম টয়লেট আছে কি না, বলল আছে তবে যেতে হবে রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে, গেলাম গিয়ে দেখি টয়লেটের সামনে এক মহিলা বিভিন্ন তরকারি কাটছে সাথে ছোট ছোট মাছ সহ, যা হোক টয়লেটে গিয়ে স্বল্প সময়ের কাজ শেষ করে এসে অজু করে নিলাম এবং সবার জন্য খিচুড়ির অর্ডার করলাম ।
খুচুড়ি খেয়ে বের হলাম কেননা ১২টার বেশী বাজে এবং ইতিমধ্যে আমাদের নিয়ে আসা পানি সব শেষ, পানির খোঁজে বেশিদূর যেতে হল না দেখি অনেকেই পানি দিচ্ছে ড্রামে করে, জারে করে বা বোতলে এবং শুধু পানি না সাথে আছে লেবু পানি, স্যালাইন পানি, শরবত ইত্যাদি ।
বোতল ভরে নিলাম পানি দিয়ে, এগিয়ে চলেছি বাইতুল মোকাররম মসজিদের দিকে এবং ইতিমধ্যে দেখি বিভিন্ন ভাই শরবত খান ইত্যাদি বলে সবাইকে আহ্বান করছে, অত্যাধিক তাপের কারনে গলা শুকিয়ে আসছে তাই আমার সাথি গিয়ে একগ্লাস খেয়ে এসে বললেন, বেশ ভালো, আমিও পরে একগ্লাস খেয়েছিলাম।
যোহরের সলাত শেষে একটু শুয়ে আবার বিশ্রাম নিলাম এবং বের হয়ে দেখি এক ভাই ডাকছেন ভাই বাঙ্গি খান গরমে, টাকা লাগবে না, তিনি এক বাঙ্গিওয়ালা কে ঠিক করে নিয়েছেন সবাইকে বাঙ্গি খাওয়াও টাকা দিবেন তিনি,
চলে আসলাম দৈনিক বাংলা মোড়ে, এখানে দেখি এক ভ্যান ভরে কেউ একজন নিয়ে এসেছে শসা আর গাঁজর, একটা শসা নিলাম কারন গরমে আবার গলা শুকিয়ে এসেছে ।
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম শাপলা চত্বরের দিকে আর মাঝে মাঝে ফোনের বাঁটন চাপছি কিছু ছবি তোলার জন্য।
অবশেষে বসে পড়লাম রাস্তার বিল্ডিংএর ছায়ায় এবং শুনতে লাগলাম মন দিয়ে নেতাদের বক্তব্য আর মুহুর্মুহু স্লোগান এবং সম্মিলিত সমর্থন বিভিন্ন দাবির প্রতি। ইতিমধ্যে সময় হয়ে গেল আসরের, পাশের একটি বিল্ডিঙের চার তলায় দেখলাম সুন্দর অজু এবং সলাতের জায়গা, সলাত শেষ করে মোবাইলে একটু চার্জ দিলাম যাতে বাসা পর্যন্ত ফেরত যেতে পারি।
সময় হল বিদায়ের, হাটা শুরু করলাম কিন্তু দেখি আমি হাঁটতে পারছি না কারন আমার দান পায়ের কুঁচকিতে ব্যাথা শুরু হয়েছে, অনেক কষ্ট করে যখন ফকিরাপুলের মোড়ে আসলাম দেখি রাস্তায় একটা বাঁশের টুকরা, তুলে নিলার ভর দিয়ে চলার জন্য, এভাবে আমরা চলে আসলাম বেইলি রোড পর্যন্ত আর আল্লাহ্কে বলছি আল্লাহ্ একটা বাহনের ব্যাবস্থা করে দাও, অবশেষে একটা সিএনজি পেলাম ৪০০ টাকা ভাড়া, যাক হাফ ছেড়ে বাচলাম এবং আল্লাহ্র রহমতে ভালো ভাবে উত্তরা পৌঁছলাম যখন মাগরিবের সময়, ৩ নম্বর মসজিদে সলাত শেষে ফিরে গেলাম নিজের বাসায়।
রাতে দেখি সারা বডি প্রচণ্ড ব্যাথা, একটা ব্যাথা নাশক ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম তবে এখনো অনেক ব্যাথা সারা গায়ে । গায়ে ব্যাথা তবে মনে বড় আনন্দ যে আমি সেই লক্ষ মানুষের কাতারে শামিল হতে পেরেছি আর নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে করছি কেননা বাংলার মুসলিমদের ঐক্যমতের এমন নিদর্শন আমি এর আগে দেখি নাই, কি যে ভালো লাগছে বোঝাতে পারব না আসলেই। সবচেয়ে বড় কথা এই ঐক্য আমার প্রানের চেয়ে প্রিয় রাসুল (সঃ) এর বিরুদ্ধে যারা কুৎসা এবং যারা আজ এই দেশ থেকে ইসলামকে বিদায় করতে চাই সেই নাস্তিক ভন্ডদের বিরুদ্ধে।
সেদিন আমার থেকে মনে হয় কেউ বেশী খুশী হবে না যেদিন এই দেশে ইসলামী হুকুমাত কায়েম হবে । আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি হে আল্লাহ্ তুমি আমাদের এই আকুল আবেদনকে কবুল করুন। আমীন।
আর লিখতে পারছি না, এলোমেলো লেখা, আপনারা আমার ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন আশা করি।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন