ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ : অতীত ও বর্তমান

লিখেছেন লিখেছেন সত্যবাক ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৩:০৫:২৯ দুপুর

পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪ ফেব্র“য়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বলা হয়। এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লার্ভাস ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয় না। অথচ আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর অনুবাদ করে বলা হচ্ছে ‘ভালবাসা দিবস’। এরূপ অনুবাদের কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। ‘ভালবাসা’ একটি জনপ্রিয় শব্দ। ‘ভালবাসা দিবস’ বলায় এটা যে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে সেটা তারা সহজে বুঝতে পারছেনা। একইভাবে আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তার নিজ নামের পরিবর্তে অনুবাদের ছদ্মাবরণে প্রবেশ করছে। ফলে এ দিবসের প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস তাদের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে। অনেকটা হুজুগের বশবর্তী হয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি-নীতিতে লালিত ও পরিপুষ্ট একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনকে আমাদের দেশের তরুণ ও যুবকরা নিজেদের একটি অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করছে!



সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর আসল পরিচয়

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর প্রথম শব্দ “সেন্ট” এ দিনটির আসল পরিচয় বলে দিচ্ছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে “সেন্ট” শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: এমন ব্যক্তি, খৃষ্টান গীর্জা কর্তৃক যাকে তার গুণাবলী বা ভাল কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ভ্যালেন্টাইন শব্দের অর্থ ভালবাসা নয়। ভ্যালেন্টাইন মূলত একজন ব্যক্তির নাম। খ্রীস্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কারণে যাকে গীর্জা কর্তৃক “সেন্ট” (পবিত্র সত্তা) ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, গীর্জা কর্তৃক ‘পবিত্র সত্তা’ হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্মযাযকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ দিনটি উদযাপনের মূল কারণ।

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর ইতিহাস

বিভিন ইনসাইকেপেডিয়া অধ্যয়ন করলে সহজেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাবে। আরো জানা যাবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর উৎপত্তির কারণ। ২৭০ খৃষ্টাব্দের কথা। তখন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কডিয়াস নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনীহা সৃষ্টি হয়। সে সময় রোমের খৃষ্টান গীর্জার পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গোপনে নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এ ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার পর তাকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে আসা হয়। ভ্যালেন্টাইন রাজাকে জানালেন, খৃস্ট ধর্মে বিশ্বাসের কারণে তিনি কাউকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বারণ করতে পারেননা। রাজা তখন তাকে কারাগারে নিপে করেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় রাজা তাকে খৃষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন এবং বিনিময়ে তাকে মা করে দেয়ার কথা বলেন। উল্লেখ্য, রাজা দ্বিতীয় কডিয়াস প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন এবং তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যে এ ধর্মের প্রাধান্য ছিল। যা হোক, পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন রাজার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং খৃস্ট ধর্মের প্রতি অনুগত থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন। তখন রাজা তাকে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেন। অতপর রাজার নির্দেশে ২৭০ খৃস্টাব্দের ১৪ ফেব্র“য়ারী ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

১৪ ফেব্র“য়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা

পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রীস্ট ধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে খ্রীস্টান গীর্জা ভ্যালেন্টাইনকে “সেন্ট” (পবিত্র সত্তা) হিসেবে ঘোষণা করে। ৩৫০ সালে রোমের যে স্থানে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল সেখানে তার স্মরণে একটি গীর্জা নির্মাণ করা হয়। অবশেষে ৪৯৬ খ্রীস্টাব্দে খীস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু পোপ গ্লসিয়াস ১৪ ফেব্রয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ দিনে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গীর্জায় খ্রীষ্টান ধর্মমতে পবিত্র সত্তা নিবার্চনের জন্য একটি লটারীর আয়োজন করা হত। লটারীতে যার নাম আসত সে সংশ্লিষ্ট বছর থেকে গীর্জা ও খ্রীস্ট ধর্মের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করত।

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ এর প্রেম প্রসঙ্গ

কথিত আছে, ভ্যালেন্টাইন কারাগারে থাকা কালে কারারীর যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। ২৭০ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্র“য়ারি তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিন সে কারারীর যুবতী মেয়েকে একটি চিরকুট লিখে যায় যার শেষে লিখা ছিল, অর্থাৎ ‘তোমার ভ্যালেনটাইনের প থেকে’। ভ্যালেন্টাইনের প্রেম সম্পর্কে এর চেয়ে বেশী কিছু জানা যায় না।

১৪ ফেব্র“য়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণার মূল কারণ

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারারীর যুবতী মেয়ের প্রেমে ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালবাসার কারণে কি খ্রীষ্টান পোপ গ্ল্যাসিয়াস ১৪ ফেব্রয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করেছিলেন? নিশ্চয়ই না। কারণ, খ্রীস্ট ধর্মে পুরোহিতদের জন্য বিয়ে করা বৈধ নয়। পুরোহিত হয়ে কারো যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্তি খ্রীস্ট ধর্মমতেও অনৈতিক কাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ভালবাসার কারণে ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে যেতে হয়নি। কারণ, সে কারারীর যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়েছিল কারাগারে যাওয়ার পর। সুতরাং, ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিপে ও মৃত্যুদন্ডদান এর সাথে ভালবাসার কোন সম্পর্ক ছিলনা। তাই ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালবাসা ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর মূল বিষয় ছিল না। বরং খ্রীস্ট ধর্মের প্রতি গভীর ভালবাসাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ডের কারণ ছিল। কারণ নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজার নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে তিনি গোপনে নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনের কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তার ধর্মীয় বিধান পালন করেছিলেন এবং অবশেষে তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আর খ্রীস্ট ধর্মের প্রতি তার এহেন গভীর ভালবাসার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই মূলত তার মৃত্যুদন্ডের দিনটিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

প্রেম দেবতাদের পুঁজা: ১৪ ফেব্রয়ারির প্রাচীন ইতিহাস

খৃস্টান সম্প্রদায়ের একটি নিরেট ধর্মীয় উৎসব কিভাবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসবে পরিণত হল এটা জানার জন্য আমাদেরকে প্রাচীন রোমানদের ধর্মীয় উৎসব ‘লুপারকেলিয়া’ সম্পর্কে জানতে হবে। খ্রীষ্টান পোপ গ্ল্যাসিয়াস কর্র্তৃক ৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত এদিনটি প্রাচীন রোমানরা তাদের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করত। রোমানরা খ্রীস্টের জন্মের ২৫০ বছর পূর্বে মধ্য ফেব্রয়ারি (১৩ থেকে ১৫ ফেব্রয়ারি) ‘লুপারকেলিয়া’ উৎসব পালন করত। তারা জন্মের দেবতা, মৃত্যুর দেবতা, মেষপালের দেবতা, মেঘের দেবতা, প্রেমের দেবতা, আলোর দেবতা, অন্ধকারের দেবতা, বৃরে দেবতা, পানির দেবতা ইত্যাদি অসংখ্য দেবতায় বিশ্বাস করত। এসব কাল্পনিক দেবতাকে তারা বিভিন্ন নামে ডাকত ও তাদের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য পুঁজা-অর্চনা ও উৎসব পালন করত। প্রাচীন রোমানদের একটি দেবতার নাম ছিল ‘লুপারকাস’। তাদের বিশ্বাস ছিল দেবতা ‘লুপারকাস’ তাদের মেষপালকে নেকড়ের আক্রমন থেকে রা করে থাকে। তাদের মেষপালের যাতে কোন তি না হয় সে জন্য তারা দেবতা ‘লুপারকাস’ এর সম্মানে উক্ত ‘লুপারকেলিয়া’ উৎসবের আয়োজন করত। এ উৎসবের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে প্রধান ছিল লুপারকাস দেবতার উপাসনা। এ উৎসবে তারা আরেক দেবতা ‘কিউপিড’ এর আশীর্বাদ কামনা করতো। এরূপ বিশ্বাস করা হত যে, দেবতা কিউপিড ভালবাসার অনুভূতি জাগ্রত করার জন্য যাদুকরী তীর ব্যবহার করে থাকে। এ তীর নারী-পুরুষের হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত করে। সে বিশ্বাসের সূত্র ধরে আজও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ কার্ডে ‘কিউপিড’ এর প্রতীক ব্যবহার করা হয়। ‘লুপারকেলিয়া’ উৎসবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ছিল, প্রেমের দেবী জুনু ফেব্রয়াটা এর আশীর্বাদ কামনায় যুবকদের মধ্যে যুবতীদের বণ্টনের জন্য লটারীর আয়োজন। তারা যুবতী মেয়েদের নাম লিখে একটি বাক্সে রাখত এবং যুবকেরা এসে বাক্স থেকে নাম তুলতো। লটারীতে যে যুবকের হাতে যে যুবতীর নাম উঠে আসত তাকে সে যুবকের সাথে পরবর্তী এক বছর লিভিং টুগেদার করতে হত। এভাবে ‘লুপাকেলিয়া’ উৎসবে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বন্টন করে দেয়া হত। তারা বিশ্বাস করত, প্রেমের দেবীর আশীর্বাদে এসব যুগল ধন্য হবে এবং তারা ভবিষ্যতে সন্তান ধারণে সম হবে। এ ধরণের নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে লটারীর মাধ্যমে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বণ্টনের ঘৃণ্য রীতি ফ্রান্স সরকার ১৭৭৬ সালে নিষিদ্ধ করেছিল। ক্রমান্বয়ে এটি ইটালী, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী ও জার্মান থেকেও উঠে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডেও এক সময় এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’যেভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতার এ যুগে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর নামে প্রকারান্তরে প্রাচীন রোমানদের ‘লুপারকেলিয়া’ উৎসবের অন্যতম কর্মসূচি প্রেমের দেব-দেবীর পুঁজা আবার শুরু হল কিভাবে? তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সর্বপ্রথম ইস্টার এ হল্যান্ড নামক একটি কার্ড বিক্রেতা কোম্পানী বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকান ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড’ তৈরী করে এবং প্রথম বছরই ৫০০০ ডলারের কার্ড বিক্রি হয়। উল্লেখ্য, সে যুগে ৫০০০ হাজার ডলার বিক্রি হওয়া ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবর্তীতে সুযোগসন্ধানী মিডিয়া কোম্পানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সুযোগসন্ধানী নীতিহীন ব্যবসায়ী ও সস্তা জনপ্রিয়তাকামী একশ্রেণীর মিডিয়া ২৫০০ বছরের পুরনো লটারীর মাধ্যমে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বণ্টনের মত একটি ঘৃণ্য রীতিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে‘ এর মোড়কে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসবে পরিণত করেছে।

ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর প্রকৃত ইতিহাস জানুন

তথাকথিত ‘ভালবাসা দিবস’ উদযাপন পরিত্যাগ করুন

অশ্লীল ও উচ্ছৃঙ্খল সংস্কৃতি বর্জন করুন

চারিত্রিক অবয় থেকে দেশের যুবসমাজকে রা করুন

লেখাটি নিজ দায়িত্বে ছড়িয়ে দিন এবং ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর সঠিক ইতিহাস জানতে সহায়তা করুন

বিষয়: বিবিধ

১৩৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File