যেভাবে এক ব্যবসায়ীর ৮৬ লাখ টাকা নিলেন মোল্লা নজরুল (কপি-পেস্ট)

লিখেছেন লিখেছেন পোস্টম্যান ০৫ জুন, ২০১৩, ০৭:৪৯:১০ সকাল

লায়েকুজ্জামান: অভিযান চলতো মাঝরাতে, ফিল্মি স্টাইলে। আচরণ ছিল ডাকাতের মতো।

ঘরে ঢুকেই স্ত্রী-সন্তান পিতামাতার সামনে চড় থাপ্পড় ঘুষি লাথি। পুরো ঘর ওলটপালট করে তল্লাশি। ঘুমন্ত শিশুদের পর্যন্ত বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে বিছানা সরিয়ে তল্লাশি শেষে বলা হতো, তুই অবৈধ ব্যবসা করিস্‌। জঙ্গিদের টাকা দিস্‌। স্যারকে টাকা দিতে হবে। কে আপনাদের স্যার, কে আপনাদের পাঠিয়েছে? জানতে চাইলে বলা হতো ডিবি ডিসি মোল্লা নজরুল আমাদের পাঠিয়েছেন। স্যারকে টাকা দিতে হবে। সে সময়ে বলা হতো টাকার পরিমাণ। বাসায় ঢুকে মহিলাদের গয়না নিয়ে টানাটানির ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। নজরুল বাহিনীতে বেপরোয়া ছিল এসআই হাসনাত ও আজহার।

এক ব্যাবসায়ীর ৮৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে অভিযান হয় গত বছর ১৬ই ডিসেম্বর। রাত তখন ১২টা কয়েক মিনিট। ব্যবসায়ী কাইয়ূমের মিরপুর ৬ নম্বর সড়কের বাসায় নক করে কিছু সাদা পোশাকের লোক। পরিচয় দেন তারা ডিবি পুলিশের লোক। দরজা খুলতেই বলেন, আপনার নাম কি কাইয়ূম? তিনি ‘হ্যাঁ’ জবাব দিতেই পুলিশের লোকেরা বলে ওঠে, তোকেই তো খুঁজছি। কাইয়ূমের কলার চেপে ধরে এসআই হাসনাত সোফায় বসাতে গেলে পেছন থেকে ঘুষি মারতে থাকে এসআই আজহার। চোখের পলকে অন্যরা ঘরের আসবাপত্র ওলটপালট করে তল্লাশি শুরু করে। কাইয়ূমের স্ত্রীকে দিয়ে জোর করে খোলানো হয় আলমারি। সেখানে পাওয়া ২ লাখ নগদ টাকা তুলে এসে হাসনাতে কাছে জমা দেয় অন্যরা। এক পুলিশ সদস্য আলমারি থেকে গয়নার বাক্স বের করে এনে সেটা নেয়ার চেষ্টা করে। কাইয়ূমের স্ত্রী প্রতিবাদী হয়ে উঠলে আবার গয়নার বাক্সটি ফেরত দেয়ার পর কাইয়ূমের ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। চড়-থাপ্পড় কিল-ঘুষি চলতে থাকে। কাইয়ূম জানতে চান, কি আপরাধে এমন করা হচ্ছে? এসআই হাসনাত বলে, তুই অবৈধ ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিস্‌। আমাদেরকে টাকা দিতে হবে। মোল্লা নজরুল স্যার পাঠিয়েছেন তাকে ৩ কোটি টাকা দিতে হবে। কাইয়ূম জানায়, এত টাকা আমি কোথায় পাবো? এত টাকা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওই সময় আরও রূঢ় হয়ে ওঠে এসআই হাসনাত। চিৎকার করে গালি দিয়ে বলে, চল ডিবি অফিসে সেখানে গেলে সব দেয়া সম্ভব হবে। কাইয়ূমের কলার চেপে গাড়িতে উঠিয়ে আনা হয় মিণ্টো রোড়ে ডিবি অফিসে। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন ডিসি ডিবি মোল্লা নজরুল। মোল্লা নজরুলের কক্ষে প্রবেশ করামাত্র পেছন থেকে কাইয়ূমকে সজোরে লাথি মারতে মারতে এসআই হাসনাত বলে, স্যারের রুমে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঢুকেছিস ক্যান? কাইয়ূমকে রুম থেকে বের করে এসআই হাসনাত আজহারের হাতে তুলে দেন মোল্লা নজরুল। তারা অন্য রুমে নিয়ে যান কাইয়ূমকে। সেখানে নিয়ে বলেন, স্যার বলেছেন তোর ৩ কোটি দেয়া লাগবে না। স্যার ১ কোটি মাফ করে দিয়েছেন। তুই ২ কোটির ব্যবস্থা কর। আবারও কাইয়ূম বলে, এত টাকা দেয়া সম্ভব নয়। বলার সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতন শুরু হয় তার ওপর। আধা ঘণ্টার মতো মাধরের পর আবার নেয়া হয় মোল্লা নজুরুলের রুমে। এবার মোল্লা নজরুল বলেন, টাকা না দিলে তোর নামে অস্ত্র মামলা হবে, অবৈধ ভিওআইপির ব্যবসার মামলা হবে। মাদকদ্রব্যের মামলা হবে। ওই সকল মামলায় তোকে তিন মাস আমাদের রিমান্ডে থাকতে হবে। এখন বুঝে দেখ কি দশা হবে তোর। সোজা পথে টাকাগুলো দেয়ার ব্যবস্থা কর। কথাগুলো বলে কাইয়ূমের কেড়ে নেয়া মোবাইল ফোন তাকে ফেরত দিয়ে মোল্লা নজরুল বলেন, টাকার জন্য ফোন দেয়ার প্রয়োজন হলে এখানে বসে ফোন কর।

ফরিদপুরের ছেলে ঢাকার কাওরান বাজার এলাকার ব্যাবসায়ী কাইয়ূম তার ওপর চালানো নির্যাতন এবং জোর করে টাকা আদায়ের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাইয়ূম জানান, ওই সময় তিনি মনোবল হারিয়ে ফেলেন, তিনি যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ আওয়ামী-যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মাদ ফারুক হোসেনের সঙ্গে, তার কাছে সহযোগিতা চান। ফারুক হোসেন বার কয়েক অনুরোধ করেন মোল্লা নজরুলকে কিন্তু তিনি কোন পাত্তা দেননি। টাকা ছাড়া ছাড়তে রাজি হয়নি। সকাল ১০টা পর্যন্ত কাইয়ূমকে বসিয়ে রাখা হয় ডিবি অফিসে। শেষে রফা হয় ১ কোটি টাকায়। সকালে ২০ লাখ নগদ টাকা দেয়ার পর যুবলীগ নেতা ফারুক হোসেন বাকি টাকা দেয়ার জামিনদার হলে মুক্তি দেয়া হয় কাইয়ূমকে। ছাড়া পাওয়ার দু’মাসের মধ্যে ধারদেনা করে মোট ৮৬ লাখ টাকা মোল্লা নজরুলের হাতে তুলে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পান ব্যবসায়ী কাইয়ূম।

ব্যাবসায়ী আবিদুল ইসলামের কাছ থেকে একই কায়দায় সমপ্রতি ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রকাশিত হয়ে পড়ায় আবার নতুন করে ঝামেলায় পড়েছেন ব্যবসায়ী কাইয়ূম। মোল্লা নজরুলের চাঁদাবাজির ঘটনা তদন্ত করতে একটি পুলিশি কমিটি গঠিত হয়েছে। এখন মোল্লা নজরুল বিভিন্ন সময়ে তার কিছু সুবিধাভোগী প্রভাবশালী লোকদের মাঠে নামিয়েছেন, যাদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছেন তাদের চাপ দেয়ার জন্য। ওইসব লোক এখন আবার ভুক্তভোগীদের বাড়িতে গিয়ে নতুন করে চাপ দিচ্ছে তারা যাতে তদন্ত কমিটির কাছে গিয়ে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে। সমপ্রতি সময়ে আমেরিকা থেকেও একজনকে দেশে আনা হয়েছে মোল্লা নজরুলের বিষয়টি ম্যানেজ করার জন্য। মোল্লা নজরুলকে বাঁচাতে চাঁদাবাজির শিকার লোকদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন শহীদ চৌধুরী নামের এক লোক। ফরিদপুর এলাকায় বাড়ি ওই শহীদ চৌধুরী জোট সরকার আমলে ছিলেন দাপুটে মানুষ। একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন তার চাপাচাপির কথা। তারা জানিয়েছেন, এ কোন দেশে আছি আমরা জোর করে টাকাও নিয়ে যাবে আবার তদন্ত কমিটির কাছে গিয়ে তা অস্বীকার করতে হবে। কেবল ব্যবসায়ী কাইয়ূমই নন এমনিভাবে মোল্লা নজরুল টাকা আদায় করেছে ব্যবসায়ী জিয়া, আবিদুল, স্বপন, তপন, বেলালসহ আরও অনেকের কাছ থেকে। কারও কাছ থেকে কোটি টাকার নিচে ধরেননি তিনি। টাকা দিয়েও অনেকে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। অনেক ভুক্তভোগী বলছেন, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে মুখ খোলার সাহস পেতো ভুক্তভোগীরা। সত্যিকারে বেরিয়ে আসতো মোল্লা নজরুলের চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর সব চিত্র। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজীর অভিযোগ ওঠার পর ডিবি ডিসি পদ থেকে সরিয়ে ডিসি প্রটেকশন করা হয়েছে। অন্যদিকে মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সূত্র:মানবজমিন

বিষয়: বিবিধ

১৩৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File