“নিঃসঙ্গ নির্বাসন”(ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন শাহাবউদ্দিন আহমেদ ২০ মার্চ, ২০১৭, ০৫:২১:০০ বিকাল
পাঞ্জাবীতে বুক পকেট দেখেছেন কেউ? দেখার কোন কারণ নেই, পাঞ্জাবীতে বুক পকেট হয় না। এটা ঝর্ণার গিফ্ট। ঝর্ণার গিফ্ট মানেই বিচিত্র কিছু। ফাউন্টেন পেন এখন আর কেউ ব্যাবহার করে না। এখন বলপেনের যুগ। কিন্তু ঝর্ণা আমাকে তার নামের সাথে মিলিয়ে একটা ঝর্ণা কলম (ফাউন্টেন পেন) গিফ্ট দিয়েছিল। সেই ঝর্ণা কলম এখন আমার বুক পকেটে শোভা পাচ্ছে।
সকাল থেকেই আকাশটা অপরিস্কার, যেন হাতে ঘষা ব্লাক বোর্ড। আকাশে খন্ড-খন্ড মেঘেদের পদচারণা। বৃষ্টি হয় হয় তবুও হয় না, এমন ভাব। এখন দমকা হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়া বেশ শীতল। অদূরে কোথাও যেন বৃষ্টি হয়েছে মনে হচ্ছে। কাছা-কাছি কোথাও বৃষ্টি হলে এমন শীতল হাওয়া বয়। আবহাওয়ার এই পরিস্থিতিতে আমি টি,এস,সি, থেকে বেরিয়ে ডাস্ (কেন্টিন) এর সামনে এসে দাড়ালাম। ঝর্ণা বলেছিল দশটার মধ্যে টি,এস,সিতে থাকতে। কি যেন জরুরী কথা বলবে। ওর জরুরী কথা কি, আমি তা কিছুটা আঁচ করতে পারছি। আমার অনুমান শক্তি খুব একটা খারাপ না। ওকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। কিংবা এংগেজমেন্টের কথা চলছে। ছেলে বিরাট বড় লোক, আমেরিকা বা লন্ডন প্রবাসী, বিয়ের পর বিদেশেই সেটেল্ড। এ জাতীয় কিছু কথা বলার সম্ভাবনাই বেশী। বেকার জীবনে এ পর্যায়ে এসে প্রেমিকার(!)মুখ থেকে এই টাইপের কথা শোনার এটাই মোক্ষম সময়। বেশ ক’দিন ধরেই সে এসব বলে আসছিল। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে, ঝর্ণা এলো না। ডাস্ এর সামনে দাড়িয়ে এক কাপ চা হাতে নানান কথা ভাবছি। ইদানিং একা হলেই নানান চিন্তা মাথায় ভর করে। ভাবতে ভাবতে মাঝে মধ্যে দার্শনিক টাইপ মনে হয় নিজেকে।
আগুন গরম চা আমি খেতে পারি না, চায়ের কাপ পিরিচ বাম হাতে ধরা, চা-টাকে একটু ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি, এমন সময় ঘটল এক ঘটনা। সুন্দর মত একটা মেয়ে পরণে সাদা থ্রী পিস্, ওড়নাটা মাফ্লারের মত করে গলায় প্যাঁচানো। আজকাল কছিু মেয়েরা ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে রাখ, কেন রাখে আমি বুঝি না!
ইদানিং কিছু কিছু ময়েরো বোরকাকেও ফ্যাশনের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তারা জর্জেটের এত পাতলা আর ফিটিং বোরকা পরে যে, নারী দেহের বিশেষ-বিশেষ অংশ সহজেই দৃষ্টি গোচরীভুত হয়। এই বোরকা পরে লাভ কি হল? প্রকৃত অর্থে বোরকা তথা পর্দা প্রথাকে হেয় করার জন্যই কি এই ফ্যাশন?
মেয়েটি মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে বলল,
“এক্সকিউজ মী প্লীজ,ক’টা বাজে?” আমার বাম হাতে কম দামী কেসিও ঘড়ি। আমি অন্য মনস্ক ভাবে হাতের কব্জি উল্টালাম। গরম চায়ে ঝর্ণার দেয়া খদ্দরের পাঞ্জাবীটা ভিজে গেল। আগুনের একটা ছ্যাঁকার মত লাগল পেটের কাছে, কাপ পিরিচ মাটিতে পড়ে যথা নিয়মে ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো। আমি কিছু একটা বুঝে উঠার আগেই দেখলাম ফর্সামত মেয়েটি বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে হাসছে। আমি অন্য মনস্ক ভাবে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে ছিলাম বলে আমাকে ‘মফিজ’ বানানো হলো। মেয়েগুলো খুব হাসছে, একটা উপভোগ্য ব্যপার হয়েছে বটে। আমার খুব রাগ লাগছে। কিন্তু রাগ করে লাভ কি? মেয়ে গুলো মজা পাচ্ছে, পাক না। ভার্সিটিতে পড়া মেয়েরা মজা করবে নাতো কারা মজা করবে।
ফর্সা মেয়েটি কাছে এসে বলল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আমি দুঃখিত আপনার পাঞ্জাবীটা নষ্ট হয়ে গেল, চায়ের দাগ সহজে উঠে না।”
আমি মুখে হাসি-হাসি ভাব এনে বললাম, “না না দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই, আপনার ব্যানিটি ব্যাগে নীল ফুল তোলা যে রুমালটা আছে ওটা একটু বের করে দিন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে একটু মুছে দেই, তাহলেই আর দাগ পড়বে না।”
সাথের মেয়েগুলো বিষ্মিত হল, ফর্সা মেয়েটি একটা নীল ফুল তোলা রুমাল এগিয়ে দিল, ব্যানিটি ব্যাগ খুলে। আন্দাজে নীল রুমালের একটা ঢিল ছুড়ে ছিলাম লেগে গেল। মেয়েগুলো আমার ইনট্যুইশন পাওয়ারে বিব্রত। আমি হাত বাড়িয়ে রুমাল নিলাম। মেয়েরা হাঁটা শুরু করেছে
টি এস সির দিকে, মজা শেষ হয়ে গেছে।
ফর্সা মেয়েটির নাক লাল হয়ে গেছে, একটু ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে, ভয়ার্ত মানুষকে আরও ভয় পাইয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিছু একটা বলতে যাব দেখি মেয়েটা হাঁটা ধরেছে, বান্ধবীরা যেদিকে গেছে তাদের পিছনে পিছনে চলে যাচ্ছে, রুমালের জান্যও দাড়ালো না। ভাবটা এমন যেন, কে জানে কি থেকে আবার কি হয়। কিন্তু মেয়েটার রুমালটা রয়ে গেল, রুমালটা একদিন তাকে ফেরৎ দিতে হবে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে আমার আবার দেখা হবে।
আমি আর অপেক্ষা করার কারণ দেখছি না। ঝর্ণা হয়তো আজ আর আসবেই না। দেখা করার কথা বলে ঝর্ণা দেখা করেনি, এমন হয় না। একটা কিছু হয়েছে নিশ্চয়। সে যাই হোক, দোকানীকে কাপ পিরিচের দাম দিতে গিয়ে সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার পেলাম। হঠাৎ মনটা ভাল হয়ে গেল। মন ভাল হওয়ার কারণ হল, পকেটের তাপমাত্রা খুবেই নীচের দিকে, আমার কাছে কাপ পিরিচের ভর্তুকি দেয়ার মত টাকা ছিল না। শুধু চায়ের দামটা মিটিয়ে দিয়ে ভাল লাগা মনটা নিয়ে হাঁটা ধরলাম। আজিমপুরের মেসে ফিরবো। কাঁটাবন মোড়ের দিকে হাঁটছি। হাঁটছি আর ভাবছি আমদের প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা। ঝর্ণার সাথে আমার পরিচয় এক রকম নাটকীয় ব্যাপার। “নিঃসঙ্গ নির্বাসন” নামে সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটা গল্প লিখেছিলাম, বছর দুয়েক আগে। গল্পের বিষয়বস্তু ছিল হৃদয়বিদারক ও বিয়োগান্ত। পত্রিকার ঐ গল্পটাই ঝর্ণার সাথে আমার যোগাযোগের সূত্র। একদিন বিকেলে টিউশনিতে যাব বলে বেরুচ্ছিলাম। এমন সময় এক তরুণী আমার মেসের রুমে ঢুকে পড়ল। পরনে নীল রঙের একটা থ্রী পীস। ওড়নাটা কায়দা করে মাথায় টানা, সম্ভবত উনিশ কুড়ি বছরের একটা মেয়ে আমার ঘরে। সুন্দরী রুপবতী বলতে কি বোঝায়, আমি তার সঠিক ব্যাখ্যা জানি না। আর মেয়েদেরকে খুব কাছ থেকে দেখিওনি, খেয়ালও করিনি। এই মেয়েটিকে খেয়াল করতে হল। কারণ আচমকা একটা সুন্দরী মেয়ে আমার ঘরে! যে মেয়েরা আজকাল সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে, তারা এর কাছে ঘেষতে পারবে না। সহসা বুড়ো রবীন্দ্রনাথের মত অনুভূতি হল আমার।
“মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে, বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা।”
রুমে কেউ ছিল না। আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় কিছু বলতেও পারছি না, তরুণী একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “আপনি-ই তাহলে কবি ভাই?”
আমার মুখে কোন কথাই অসছে না। দুই কান দিয়ে মনে হচ্ছে শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে।
---চলবে--
বিষয়: বিবিধ
১০৯১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন