মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ত্যাগী জীবন (আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত)
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ২৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৪৬:২৫ দুপুর
(আজকে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর ৬৬তম মৃত্যু বার্ষিকী)
চট্টগ্রামের ইতিহাসের কালজয়ী মহাপুরুষ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, এদেশে বাংলায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক, কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গীয় আইন পরিষদের প্রাক্তন সদস্য মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী । ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগঠক, বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক ও লেখক। ছোট পরিসরের একটি লেখায় মাওলানার জীবনের সবগুলো দিক তুলে আনা সম্ভব নয়। গত বছর (২০১৫ সালে) আমার একটি লেখায় আমি মাওলানা ইসলামাবাদীর লেখক হিসেবে যে ভূমিকা তার উপর আলোকপাত করেছিলাম। লেখাটি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকাসহ অন্যান্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। এবার আমি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উপর কিছু লিখতে চাই।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন সংগ্রামী সৈনিক। প্রথম দিকে তিনি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় থেকে কারাবরণ করেছিলেন। তিনি তখন পাঞ্জাবের মানওয়ালী জেলে আটক ছিলেন। তিনি এক সময় চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন তবে পরে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতিতে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালের ১১ই এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মৌলবী এসোসিয়েশনের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।
বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হয়েও ইসলামাবাদীর রাজনৈতিক জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য ছিল গরীব দু:খী মানুষের দুঃখ মোচন। তিনি ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পার্টির ২২ জন পরিষদ সদস্যের মধ্যে মাওলানা ব্যতীত অন্যদের মধ্যে ছিলেন জনাব আবু হোসেন সরকার, জনাব শামসুদ্দীন, জনাব জালালউদ্দীন হাশেমী, সৈয়দ নওশের আলী, জনাব হুমায়ূন কবির প্রমুখ।
মাওলানা ইসলামাবাদী যে কোন মূল্যে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এজন্য পরে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি দেশের আজাদীর জন্য সশস্ত্র সংগ্রামেরও পক্ষপাতী ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সুভাষ বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয় তখন তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও সে ফৌজকে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করেছিলেন।
ইসলামাবাদী ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে কংগ্রেসে যোগদান করেন, এরপর মুসলীম লীগেও যান। কিন্তু কৃষক প্রজা পার্টিতেই তাঁর রাজনীতি একটি মধ্য বিন্দুতে আসে এবং নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানের মাধ্যমে তার চুড়ান্ত পরিনতি। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার উত্থান-পতনের অন্তরালে মূল সুরটি সর্বদা অভিন্ন ছিল। তা হচ্ছে মুক্ত ভারতে মুসলমানদের উত্থান। আর এর প্রথম শর্ত বৃটিশ খেদানো। তিনি কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ এর উপর অনেকটা আস্থাহীনতার জন্যই নেতাজী সুভাষ বসুর আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন।
মাওলানা মনিরুজ্জামান শুধু খিলাফত আন্দোলনেই সক্রিয় অংশ নেন নি, ১৯০৮ সালে লিবিয়ায় ত্রিপলী যুদ্ধ ও ১৯২২ সালে বলকান যুদ্ধের সময় তিনি দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সুভাষ বসুর চট্টগ্রাম সফরকালে পটিয়ার দেয়াঙ পাহাড়ে ইসলামাবাদীর সাথে গোপন বৈঠক করেন। ইসলামাবাদী ঐখানে বিশাল জায়গা স্বজাতিয় ছাত্রদের জন্য আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য দান করেছিলেন। ১৯৪২-৪৩ সালে স্বাধীনতার মন্ত্রে পূর্ণ দীক্ষিত ইসলামাবাদী নেতাজীর সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের সিতাকুন্ড এলাকায় বিপুল পরিমাণ জায়গা জমি নিয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের একটি গোপন দূর্গ স্থাপন করেছিলেন। এখানে স্থাপিত হয়েছিল একটি খামার বাড়ি। এ খামার বাড়ি থেকেই তিনি নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতা ও কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাঁদেরকে আর্থিক সাহায্য দিতেন। স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্রেরও এ খামার বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিল। আরেকটি ঘাঁটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় চকরিয়া থানার বদরখালী মৌজায় সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে তিনি আরেকটি খামার স্থাপন করেছিলেন। এ খামার স্থাপনের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন স্বল্প সময়ে যোগাযোগ রক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। তাঁর বংশের অনেকে এখনও সেখানে আছেন। পরবর্তী কালে কারারুদ্ধ হওয়ায় সে জমি তাঁর হাত ছাড়া হয়ে যায়। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে মাওলানা মরিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে ইসলামাবাদী সম্মানের পাত্র ছিলেন। স্বয়ং মহাত্মাগান্ধী মাওলানা ইসলামাবাদীকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। একবার আসামে কংগ্রেস সম্মেলনে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী সাহেবকে মাওলানা ইসলামাবাদী বেশ কিছু দুর অগ্রসর হয়ে অভ্যর্থনা জানান। আসামের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রবরদুলই এ বিষয়টির প্রতি মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মহাত্মাগান্ধী স্মিত হেসে শ্রবরদুলইকে বলেন, ‘‘মাওলানা ইসলামাবাদীর হৃদয় প্রশান্ত মহাসাগরের মত। মাওলানা মাদানীকে সম্মান প্রদর্শনের অর্থ নিশ্চয় আমাদের কারো প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়।’’
শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা দলের সহ-সভাপতি এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের উপ-নেতা হিসেবে সর্বদা তিনি শেরে বাংলাকে উত্তম পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে মাওলানা ইসলামাবাদী মুসলিম লীগে থাকাকালেও লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। আগেই বলেছি তিনি চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করেন। নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে ‘দিল্লী চলো’ শ্লোগান তুলে এগিয়ে চলছিলেন ভারতের দিকে ঐ সময় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাথে পরিচয় ঘটে বেংগল ভলান্টিয়ার্স এর সুবোধ চক্রবর্তীর। সুবোধের সাথে আলাপ করে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এত বেশি মুগ্ধ হন যে শেষ বয়সে একটা ঝুঁকি নেবার জন্য রাজি হয়ে পড়েছিলেন। সুবোধকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে। চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে আরাকানের পথ ধরে আবারো নেতাজীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে যখন পথ চলছিলেন তখন সীমান্ত এলাকায় ছিল সতর্ক পাহারা। আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলে থাকার কারণে সতর্কতা যেন সীমাহীন হয়ে পড়েছিল।
মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তখন বীরকণ্ঠে তার সহচরকে বলেছিলেন- আমার জীবনের মাত্র কয়েকদিন বাকি, এই চরম ঝুঁকি নিতে আমার অসুবিধেও নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিলেন- শ্যালক মোর্শেদকে নিয়ে একেবারে ফকির সেজে নেতাজীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মাওলানার সমস্ত বিপ্লবী কার্য টের পায়। সে কারণে তার শহরস্থ বাড়ি, তৎকালীন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ) বাড়ি, সীতাকুন্ডের বাড়ি, কলকাতার বাসভবনে ইংরেজ সার্জেন্টের নেতৃত্বে বিপুল সৈন্যের মাধ্যমে তল্লাশি চালানো হয়। ঐ সময় মওলানাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জহরলাল নেহরু প্রভৃতি নেতার সাথে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকেও দিল্লীর লালকিল্লায় বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাঁকে সেখান থেকে পাঞ্জাবের মানওয়ালী জেলে স্থানান্তর করেন। সেখানকার জেলের ছাদের বিমের সঙ্গে রজ্জু দিয়ে ৬৫ বছর বয়স্ক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর দু’পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে তাঁর উপর অশেষ নির্যাতন চালানো হয়েছিল গোপন তথ্য জানার জন্য।
জন্ম: ইসলামাবাদী ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা আড়ালিয়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বংশ: পিতা মতিউল্লাহ পন্ডিত, মাতা রহিমা বিবি, পিতামহ খান মোহাম্মদ, তৎপিতা খোষাণ মোহাম্মদ তৎপিতা আঁখিল মোহাম্মদ তৎপিতা মুহাম্মদ ফতেহ শাহ, আদি বাড়ি হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ। তিনি ছিলেন নসরত শাহের বংশের লোক। ফতেহ শাহের পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ নসরত শাহ জ্ঞানের আলোক দানের জন্যে আড়ালিয়া পুকুরিয়া ও সাতকানিয়ার চরতি গ্রামের জায়গীর দেন। কাছারী ছিল পুকুরিয়া পাহাড়ে। তাঁর পূর্বপুরুষদের জায়গীরদারীর অহংকার ছিলনা। তাঁরা পুঁথিপত্র ব্যাখ্যা করতেন। তাঁদের বংশের শেষ পন্ডিত আকাম উদ্দিন।
মৃত্যু: ১৯৫০ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না…..রাজেউন) । চট্টগ্রাম কদম মোবারক এতিমখানার পাশে তাঁকে কবর দেয়া হয়।
লেখক: সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগী,
মেইল:
Link: http://epurbodesh.com/index.php?date=24-10-2016&page=6
সূত্র:
# মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী
# মাওলানা ইসলামাবাদী, সম্পাদনা- সৈয়দ মোস্তফা জামাল
# উইকিপিডিয়া
# দৈনিক পত্রিকা
# ইন্টারনেট
বিষয়: বিবিধ
১৬৪১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন