আমি ওদের কে 'পথ শিশু' বলব না
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:৪৫:৪৯ দুপুর
ওদেরকে আমি পথ শিশু বলব না, বলতে পারব না। কারণ আমি মনে করি 'পথ শিশু' শব্দটি বৈশম্যমূলক, উঁচু নীচু ভেদাভেদকারী। আজকে যাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে এনে একটি খানার প্যাকেট দিচ্ছেন, একটি টুকটুকে লাল জামা দিচ্ছেন অথবা কিছু বই খাতা কলম দিচ্ছেন, তাদেরকে আপনি নিজেই এই অনুভুতির সৃষ্টি করে দিচ্ছেন যে তারা অন্য দশজন সাধারণ শিশুর মত নয়। এতে করে তাদের মনে যে হীনমন্যতা সৃষ্টি হবে তার জন্য আপনিও কিন্তু কম দায়ী নন। হীনমন্যতা একটি শিশুর অন্তরে হিডেন বা লুকায়িত ক্রিয়েটিবিটি বা সৃষ্টিশীলতার গুণকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে পারে। তাদেরকে যখন 'পথ শিশু' নাম দিয়ে আলাদা কাতারে কিছু দেবার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা হবে তখন তাদের মনের প্রতিক্রিয়া হবে 'আমাদের মনে হয় জন্ম হয়েছে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে অপরের হাত থেকে কিছু নেবার জন্য'।
একটি ঘঠনা বলি,
একদিন টমাস আলভা এডিসন ঘরে এসে তাঁর মাকে একটি কাগজ দিলেন । তিনি তাঁকে বললেন, "আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধুমাত্র আমার মাকে দিতে বলেছেন।"
চিঠিটি পড়ে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। এরপরে মা জোরে জোরে চিঠিটি পড়ে ছেলেকে শোনালেন "আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মত যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।"
তাঁর মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। তখন তিনি শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। একদিন তিনি তাঁর পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়্যারের কোণায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলেন। কাগজে লেখা ছিলঃ "আপনার সন্তান স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।"
এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন এবং ডায়েরীতে লিখলেনঃ "টমাস আলভা এডিসন একজন স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন শিশু ছিলেন। একজন আদর্শ মায়ের দ্বারা তিনি শতাব্দীর সেরা মেধাবী হয়ে উঠলেন।"
ঘটনাটি আমি ফেসবুকে পড়েছি, এর সত্যমিথ্যা যাইহোক না কেন এতে কিন্তু আমাদের জন্য একটি শিক্ষা রয়েছে আর তা হচ্ছে ছেলে-মেয়েদেরকে হতাশামূলক নেগেটিভ কথা না শুনিয়ে সবসময় পজেটিভ কথা বলা। এতে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আর আত্মবিশ্বাসী মানুষ সাগর-নদী-পাহাড় সবকিছুই জয় করতে পারে।
চলতি রমজানে মানব কল্যান ফাউন্ডেশন দরিদ্রদেরকে ইফতার বিতরণ করবেন, অনুষ্ঠানে আমাকে থাকার জন্য দাওয়াত করলেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্টাতা ও পরিচালক মাওলানা হোসাইন মুরাদ। তিনি ব্যানারটি প্রিন্ট করিয়ে আমাকে দেখাতে আনলেন। আমি দেখলাম তিনি সেখানে দরিদ্র কথাটি লিখেননি। তিনি ব্যানারে লিখিয়েছেন, 'মানবকল্যাণ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রোজাদারদের সম্মানে ইফতার সামগ্রী বিতরন'১৬'। আমি যখন তাঁকে দরিদ্র কথাটি লিখেননি কেন প্রশ্ন করলাম তখন তিনি বললেন, 'এতে মানুষের মাঝে বৈষম্যের সুষ্টি হয়। ঐ অনুষ্ঠানের নিউজ দৈনিক পূর্বদেশ এর ২১ জুনের সংখ্যায় ২য় পৃষ্টায় ছাপানো হয়েছে।
সম্ভবত ২০১৩ সালে আমাদের একটি ব্যবসায়ী সংগঠন কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে যাবার সময় পথে লোহাগাড়ার মল্লিক চোবহান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০জন অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছিলাম। এতে আমার উদ্দেশ্য ছিল আমরা যে হাজার হাজার টাকা অপচয় ও বিলাসিতা করব তার কাফফারা দেয়া। পরের বছর সাতকানিয়া আমার এলাকায় আমরা 'সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ফাউন্ডেশন' এর ব্যানারে ৬টি স্কুলের প্রায় ১৯০ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছিলাম। এসব বলার কারণ হচ্ছে আমি ঐ সব বিতরণ অনুষ্ঠানের ব্যানারে অসহায়, দরিদ্র, মজলুম এসব কথা লিখিনি। কারণ আমি মনে করি এসব শব্দ মানুষের মাঝে শ্রেণীভেদের সৃষ্টি করে, গ্রহিতাদের নিজেকে ছোট মনে হয়। আমি ব্যানারে লিখেছিলাম, 'অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের মাঝে শিক্ষাসামগ্রী বিতরন'।
যাই হোক, শুরু করেছিলাম পথ শিশুদের কথা নিয়ে। আমরা তাদেরকে পথশিশু না বলি, বড় জোর সুবিধা বঞ্চিত শিশু বলা যেতে পারে। তাদের সাথে আমরা বছরে, ছয় মাসে একবার স্বাক্ষাত না করে আরো ঘন ঘন সম্পর্ক রাখি। তাদের সুবিধা অসুবিধায় কাছে থাকি, পারলে যার যার সাধ্যমত দু-এক জনের পড়ালেখার খরছ বহন করার চেষ্টা করি। তাদের ভিতর ঘুমন্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে দিই। জাগো ফাউন্ডেশনের মত বিত্তবানদের সহযোগিতা নিয়ে তাদেরকে পড়ালেখার দায়িত্ব নিতে পারলেতো আর কথায় নেই।
[একটি একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য পথশিশুদের উপর লেখা দিতে বলায় লিখলাম। আপনার সুন্দর পরামর্শে লেখাটি পূর্ণতা পাবে বলে আশা করি।]
লিখাটি পত্রিকায় প্রকাশের লিংক:
http://epurbodesh.com/index.php?date=05-07-2016&page=9
বিষয়: বিবিধ
২৭৩৩ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন