আমার সাইকেল ভ্রমণ এবং একটি কবিতার পিছনের কথা
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ১০ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৫৫:৪৯ দুপুর
একটি সাইকেল ভ্রমন এবং একটি কবিতার পিছনের কথা
#
ছোট কাল থেকে আমার মধ্যে কতগুলো হুজুগে অভ্যেস ছিলো। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- হঠাৎ হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে অজানা গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়া। এমন একটি হুজুগে অভ্যাসের কথা আজকে শেয়ার করবো।
বহুদিন পিছনের কথা বলব আজ। স্কুল জীবনের ঘঠনা। গত শতাব্দীর নব্বই দশকের যে কোন একদিনের ঘঠনা।
আমার লেখা একটি কবিতার ইতিকথা। ৭০ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমনের কথা।
অবশেষে স্কুলের শেষ পরীক্ষাটিও শেষ হলো। সময়টা ছিল রমজান মাস।একদিন দুপুরে আমার ভাঙ্গা সাইকেলটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম বাড়ী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরে মির্জাখীল বাংলাবাজার।
আমরা এটাতো জানি যে এক সময়ের সব পাকিস্তান বাজার, দেশ স্বাধীনের পর বাংলা বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাজারে কয়েকজন স্কুল বন্ধুর সাথে দেখা হলো, কথাও হলো। অত:পর ওখানে আর সময় ব্যয় করাটা ভালো মনে করলাম না। বাংলা বাজারের আরো এক কিলোমিটার পর আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস বা বোর্ড অফিস। সেখানেও স্কুল বন্ধু থাকায় সাইকেল নিয়ে ওদিকে চলে গেলাম।
ওখানে গিয়ে বন্ধুর দেখা পেলাম না। এখন কি করা যায় কিছুক্ষন ভাবলাম। কেন জানি পেছনে যেতে ইচ্ছা করছে না।অবচেতন মনের ঈশারায় সামনেই গেলাম।আরো প্রায় দেড় কিলোমিটার যাবার পর একটা বাজার আছে। আমি সাইকেল চালিয়ে ঐ বাজারে চলে গেলাম। না, এখানে এসেও সামনে যাওয়ার নেশা কমেনি। অত:পর একটু চিন্তা করে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ঐ বাজার থেকে আরো ৩ কিলোমিটার যাওয়ার পর আরাকান রোড অর্থাৎ কক্সবাজার রোড। যেখানে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম ওটাকে হয়তো চুনতি বাজার বলে। একটি পুলিশ ফাঁড়িও আছে সেখানে। আমার বাড়ী থেকে প্রায় ৮/৯ কিলোমিটার চলে এসেছি। কিন্তু এতদুর আসার পরও যেন তৃপ্তি মিটছে না। আরো সামনে যেতে ইচ্ছে করছে।
হায় আল্লাহ, আজকে আমার এই কি হল ! বাড়ীতে যে কাউকে কিছু বলে আসিনি সে চিন্তা আমার নেই। আমাকে যেন সামনে এগুবার নেশায় পেয়েছে আজ। যেন এগিয়ে যেতেই হবে, যেন কিছু জয় করতে হবে, যেন ইতিহাস তৈরী করতে হবে।
পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বড় রাস্তার পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এরপর কোথায় যাওয়া যায়।হঠাৎ মনে পড়ল চকরিয়ায় তো ইসলাম ভাইয়ের দোকান আছে। আমাকে কয়েকবার যেতে বললেও কোনদিন যাওয়া হয়নি। সেখানে চলে গেলে কেমন হয় ? লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীনভাবে এতদুর আসার পরও যে আরো যেতে ইচ্ছে করছে! অবাধ্য মন যে বাধা মানছে না। তাহলে কি চকরিয়া চলে যাবো? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম।রমজানের রোজা রেখেছি, সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই।
আমার ভ্রমনের সাথী ভাঙ্গা সাইকেলটির দিকে থাকালাম। ভাঙ্গা বললাম এই জন্য যে ওর সারা গায়ে অসংখ্যা জখম আর ঝালাই/বেন্ডেজ এর অভাব নেই।সাইকেলটি যেন আমাকে মৌন সম্মতি জানাচ্ছে।যেন বলছে –
বন্ধু তুমি এগিয়ে চলো,
আমি আছি তোমার সাথে।
প্রভূ ভক্ত ঘোড়ার মত আমার সাইকেলটিও আমার কাছে বিশ্বস্ত।অন্যকেউ সাইকেলটি চালাতেই পারেনা। হয়তো হাটুতে ব্যথা পাবে অথবা চালাতে গিয়ে বার বার চেইন পড়ে যাবে। হাঁপিয়ে উঠবে।কিন্তু আমার কাছে সে পঙ্খীরাজের মতো। অনেক সময় আমার মনে হয় আমি পেডেল না মারলেও ৫৫০ টাকা দামের পুরনো সাইকেলটি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।যাই হোক সেদিন শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেশক্তিরই জয় হয়েছিল।‘বিছমিল্লাহ' বলে আরাকান রোড দিয়ে কক্সবাজার গামী দক্ষিণ দিকে সাইকেল চালিয়ে দিলাম। আল্লাহ ভরসা!
ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বড় বড় চেয়ার কোঁচ আমাকে পাশ কাটিয়ে কক্সবাজার টেকনাফ চলে যাচ্ছিলো। আমি সাইকেল চালিয়ে চলছি তো চলছিই। কোন ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। ম্যারাথন স্টাইলে সাইকেল চালাচ্ছিলাম।
আমার জীবনে নদী-ভ্রমন, সাগর-ভ্রমনের পাশাপাশি কয়েকটি সাইকেল ভ্রমনও আছে।
হাঁপিয়ে উঠে দম বন্ধ হবার উপক্রম হবার মত সাইকেল আমি কোন সময়ই চালাতাম না। চট্টগ্রাম কলেজে এমএ রেজিষ্ট্রেশন করার শেষ দিন কারফিউ থাকায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসেছিলাম গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজে। সে গল্প আরেকদিন বলবো।
আমি কচ্চপের গতিতে সাইকেল চালিয়ে একে একে আজিজ নগর, হারবাং, কাকারা পেরিয়ে চিরিঙ্গা পৌছলাম।
কিন্তু ইসলাম ভাইয়ের দোকান চিরিঙ্গা থেকে আরো প্রায় তিন কিলোমিটারের মত ভিতরে। সম্ভবত ঐ জায়গার নাম ছিল লামার বাজার। চকরিয়া থানারও সামান্য পরে।
আমাকে দেখে তো ইসলাম ভাই রীতিমত হতভম্ব! বিশেষ করে সাথে পুরনো সাইকেলটি থাকায় বেশী অবাক হয়েছে।ইসলাম ভাই অতিশয় আশ্চর্য হলেও আমাকে স্বাদরে গ্রহন করলেন এবং আপ্যায়ন ও নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। রাতে উনার দোকানেই থাকলাম।
পরদিন সকালে সাইকেল নিয়ে বাজার পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আরো মফস্বলের দিকে গিয়ে মাতামুহুরী নদী ঘেষে গড়ে উঠা চিংড়ী মাছের প্রজেক্ট ও লবনের মাঠ দেখে আসলাম। এসে ইসলাম ভাইকে জিঙ্গেস করলাম বদরখালী কোন দিক দিয়ে যায়? সে বলল ঐ দিকে থানার পাশ দিয়ে কিছুদুর গেলেই মাতামুহুরী নদী। নদী পেরিয়ে পশ্চিমমুখী যে রাস্তা গেছে ঐ রাস্তায় গেলেই বদরখালী যাওয়া যাবে।
আমি ইসলাম ভাইকে কিছু না বলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইসলাম ভাইয়ের দেখানো পথে মাথামুহুরী নদী পেরিয়ে লোকদের জিঙ্গেস করলাম বদরখালী কোন দিকে? ওরা বলল- সোজা চলে যান।মাতামূহুরী নদীর ঐ জায়গায় এখন ব্রীজ হয়েছে। তখন নৌকা দিয়ে পার হতে হতো।
আমি প্রথমে মনে করেছিলাম বদরখালী খুব বেশী দূরে নয়। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে যতই যাচ্ছি পথ যেন শেষ হতে চায়না। বদরখালী আর দেখা যায় না। ইটের তৈরী খাদো খাদো আধভাঙ্গা রাস্তায় যাচ্ছি তো যাচ্ছিই...। ৪/৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর আর জনবসতি নেই। কাঁচা রাস্তা। রাস্তার একপাশে ছোট খাল অপর পাশে মাছের প্রজেক্ট। মাঝে মাঝে বিস্তৃর্ন লবনের মাঠ।
খালে যখন জোয়ার আসে তখন লবনের মাঠে সাগরের লবনাক্ত পানি ঢুকানো হয়। তারপর ঐ পানি-বন্ধী করে রোদে শুকিয়ে তা দিয়ে লবন তৈরী করা হয়। আমার চলার পথ যেন শেষ হতে চাচ্ছে না। কতদুর গিয়ে যতই জিঙ্গেস করি ভাই বদরখালী কতদুর? লোকেরা বলে ঐ সামনে ! কিন্তু ঐ সামনে আর শেষ হয়না।
আমি গরমে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছের ছায়ায় সাইকেলটি রেখে একটু জিরিয়ে নিতে চাইলাম।পাশেই মৎস্য প্রজেক্ট এর স্বচ্চ পানি দেখে মনে করলাম মুখ হাত ধুয়ে একটু পানি পান করি। পানিতে নেমে কুলি করার জন্য মুখে পানি দিয়েই ওয়াক থু করে তাড়াতাড়ী মুখ থেকে পানি ফেলে দিলাম। হায় হায় এ-তো পানি নয়, লবনের শরবত।পানি এত কড়া লবনাক্ত ছিল যে আমার গলাটা খার হয়ে গেল। আবার রাস্তায় উঠে এলাম। রাস্তাটি একসাথে বেড়ীবাধ হওয়ায় অনেক উঁচা।
অনেক ঢেপার মত জলাশয়ে অনেক অনেক মহিষ দেখা যাচ্ছে যেগুলো পানিতে ডুবে শুধু নাকিটি দেখা যাচ্ছে।
গাছের ছায়ায় এক বুড়ী বিশ্রাম নিশ্চিলো। বুড়ীকে বললাম- নানী, ঐ সব মশৃন মাঠে কি হয়? নানী বললেন লবন হয়।
মূল রাস্তা থেকে বেড়ী বাধে উঠার পর উত্তর দিকে হচ্ছে উজানঠিয়া আর দক্ষিণে গিয়ে পশ্চিমে হচ্ছে বদর খালী। বেঁড়ী বাঁধের ডান পাশ বা পশ্চিম পাশে সুবিশাল মহেশখালী প্রনালী। আর প্রনালীর অপর পাশে মহেশখালী দ্বীপ।
এই প্রনালী দিয়েই এর ঠিক এক বছর পর আমি সাগর ভ্রমনে চট্টগ্রাম থেকে কুতুবদিয়া, মহেশখালী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত এক জম্পেস সাগর ভ্রমন দিয়েছিলাম। প্রনালীর স্বচ্ছ নীল পানি ভেদ করে অনেক মাছ ধরা বোট, লঞ্চ ও সী কোস্টার, সী টেম্পু এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেসে মহেশখালী দ্বীপের অনেক উচাঁ উঁচা পাহাড় এখান থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।আমার মনে হলো গতকাল চুনতি বাজার থেকে চকরিয়া পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে আসতে যে সময় লেগেছিল আজকে যেন তার চেয়ে বেশী সময় লাগছে।তবু যাবার জন্য যখন বেরিয়েছি তার শেষ না দেখে পেছন ফিরে যাবার মত লোক আমি কখনই ছিলাম না। আবার নব উদ্যামে সাইকেল চালা শুরু করলাম।
প্রায় আধঘন্টা পর পর বদরখালী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত চাঁদের গাড়ী গুলো আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো। গাড়ীর ভিতরে বাইরে ছাদে বান্দরের মত মানুষ ঝুলছিল।অবশেষে আমি বদরখালী বাজারে পৌছলাম। আমি বাজারে গিয়ে মানিক নামের একটি ছেলেকে খুঁজলাম। যে সেখানে ওয়াপদা কলোনীতে থাকে এবং পল্লী বিদ্যুতে চাকরী করে। মানিকের বাবা পল্লীবিদ্যুতে চাকরী করা অবস্থায় অকাল মৃত্যু হলে মানিক ঐ চাকরি পায়। অল্প বয়সে মাত্র মেট্রিক পাশ করেই সে চাকরিতে ঢুকে মাসহ পরিবারের দায়িত্ব নেয়।
মানিকের বাড়ী বদরখালীই। আমার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি। সে বদরখালী স্কুলের ছাত্র। বদরখালীতে একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল আছে যাতে হোস্টেল আছে। খুবই নাম করা স্কুল। স্কুলের নামটা এ মূহুর্তে আমার মনে আসতেছে না। আর ছিল একটি সমিতি। সম্ভবত 'বদরখালী সমিতি'।এই সমিতিরও অনেক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি ছিলো। বদরখালীর সকল প্রভাবশালী লোকেরা ঐ সমিতির সদস্য ছিল।
এ সবই আমি খুব ভাল করেই জানি। এত জানি যে তোঁতা পাখির মতই বদরখালীর অনেক কিছুই আমার মুখস্থ ছিলো। এমন কি বদরখালীর অনেক পথঘাটও যেন আমার হৃদয় পটে অংকিত ছিল। অতচ এর আগে আমি কোনদিন বদরখালী আসিইনি।
কেন বা কিভাবে আমি বদর খালীর সাথে এত করে পরিচিত ছিলাম! আর কেনই বা আমি এতকষ্ট করে এতদুর পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে এলাম সে কথায় আরো পরে আসতেছি। যাই হোক, মানিককে খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হলো না। কারণ আমি আগে থেকেই জানতাম যে ঘন বসতি না হওয়াই বদরখালী ইউনিয়নের এক নম্বর দুই নম্বর তিন নম্বর ওয়ার্ডের সকল মানুষ এক অপরকে চিনতো।
মানিকদের কোয়ার্টারে গিয়ে বসলাম। মানিককে বললাম জহির ভাই আমাদের বাড়িতে থাকে, আমার নাম বাহার। সম্ভবত: মানিক জহিরের কাছে আমার নাম শুনেছিলো। আমাকে পেয়ে খুব খুশি হল এবং যারপরনাই আর্শ্চযান্বিত হল যখন জানলো যে আমি সাইকেল চালিয়ে প্রায় ৩০/৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে গেছি।
রোজা রাখিনি শুনে মানিক শরবত আর বিস্কিট দিল। গতকাল রোজা রেখে চকরিয়া পর্যন্ত আসায় হয়রান লেগেছিল তাই আজকে রোজা রাখিনি তাছাড়া চকরিয়া আসার পর থেকেই বদরখালী আসার ইচ্ছাটা মনথেকে উড়িয়ে দিতে পারিনি। রোজা না রাখার ওটাও একটা কারণ।
মানিককে বললাম জহির ভাইয়ের বাড়িতে যাবো। উনার আব্বা-আম্মাকে দেখে যাবো। মানিক বলল- বাজার থেকে সোজা বেড়ি বাঁধ বা বড় রাস্তা দিয়ে এককিলোর একটু বেশী হবে। তিন নম্বর এ ওদের বাড়ী।
জহির ভাইর বাবা তিন নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার। ওর চাচা চট্টগ্রামে সম্ভবত: ইষ্টিল মিলে নাকি কোথায় ভাল চাকরি করে। চাচীসহ চকবাজার ডিসি রোগ গনীকলোনী থাকে । ওদের সচ্ছল পরিবার ।
জহির ভাইয়ের আব্বা বাজারে যাবার জন্য বের হচ্ছিলেন। আমি ওদের উঠানে গিয়ে জহির ভাইয়ের আম্মাকে বললাম- খালাম্মা আপনার ছেলে জহির আমাদের বাড়িতে থাকে। আমি আপনাদেরকে দেখতে এসেছি।উনারা আমাকে পেয়ে এত খুশি হলেন যে কিভাবে আপ্যায়ন করাবেন, কোথায় বসাবেন হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিলেন।
বিশাল এরিয়া নিয়ে জহির ভাইদের বাড়ি ও ভিটা। মাটির বাড়ি, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, স্বচ্চলতার ছাপ লক্ষনীয়। বাড়ীর পেছনে একটি পুকুরের মত আছে যেখানে অনেক মাছ আছে। জহির ভাইয়ের আব্বা তাড়াতাড়ী জাল নিয়ে ঐ পুস্কন্ডিতে মাছ ধরতে গেলেন।কারন আমি আসার সাথে সাথেই বলে দিয়েছি, খালাম্মা আমি রোজা রাখিনি, ক্ষিদে লেগেছে ভাত খাবো। এসব ব্যাপারে আমি রাখডাক করতে একেবারেই অপছন্দ করি। কারণ আমি লুকোচুরি করলে নিজেই কষ্ট পাবো । তাছাড়া আমাকে তো আবার সাইকেল চালিয়ে চকরিয়া পৌছতে হবে।
অল্প সময়ের মধ্যেই ভাতের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। ভাত খেতে খেতে কথা হলো। দরজার আড়াল থেকে জহির ভাইয়ের আম্মা ছেলের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। জহির ভাই হচ্ছে উনাদের বড় ছেলে যে বদরখালী স্কুল থেকে পাশ করে আমাদের এলাকায় সরকারী কলেজে ভর্তি হয়েছে।আমাদের বাড়ীতে থেকে আমার জেঠাত বোন ও ভাইজি, ভাইপোকে পড়াশুনা করায় এবং নিজেও কলেজে পড়ে।
জহির ভাই ও আমি বাড়ীতে আমরা দু'তলায় একই রুমে থাকতাম। আমার দুই বছর সিনিয়র হলেও আমরা বন্ধুর মতই ছিলাম। জহির ভাই নিজ এলাকার ব্যপারে স্কুলের হোস্টেল জীবনসহ পারিপার্শ্বিক অবস্থার আমাকে এত এত বর্ণনা দিতো যে আমার বার বার মনে হতো ঐ এলাকায় আমি একদিন না একদিন যাবই।
জহির ভাই ভাল অংক বুঝতো। আমি জহির ভাইয়ের কাছে অংক করে করে মেট্রিকে আমার তিনটি গনিতেই লেটার ছিল। এই হচ্ছে জহির ভাই, যার বাড়িতে আমি তখন অবস্থান করছিলাম। যিনি বর্তমানে ফরেষ্ট বিভাগে বড় চাকরী করেন।
আমি ভাত খাওয়ার সময় জহির ভাইয়ের আব্বা আমার পাশে বসে আমাকে মেহমান দারী করতে লাগলেন। ততক্ষণে আসরের আজান হয়ে গেছে।জহির ভাইয়ের বাড়িতে ভাত খেতে গিয়ে একটি নতুন ব্যবস্থাপনা দেখলাম। জহির ভাইয়ের আব্বা ডালের ভিতর থেকে একটি ডিম বের করলেন যেটা ডাল সিদ্ধ হওয়া কালে ভেংগে ডালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।ডিমের অবয়বটা এমন হয়েছিল যেন ঘুরন্ত একটি চক্র।
বদরখালীতে যে সময়ে আমি জামাই আদরে আপ্যায়িত হচ্ছিলাম তখন মানে সে সময় কিন্তু আমার বাড়িতে আমার খোঁজে তুলকালাম কান্ড গঠে যাচ্ছিলো। আমার আম্মা ইতিমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন, আব্বা চারিদেকে সবাইকে পাঠিয়ে সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজ খবর নিচ্ছেন।
আমাদের এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান মুরব্বী যিনি আমাকে নিজ ছেলের মতই জানতেন, আমি মেট্রিকে স্কুল ফাষ্ট হয়েছিলাম বলে যিনি আমাকে ফাউন্টেন কলম গিফট করেছিলেন, তিনি ছিলেন আমার সম্মানীত জেঠা। তিনি মটর সাইকেল নিয়ে বাংলাবাজার গিয়ে লোকদেরকে জিঙ্গেস করলেন আমার লক্ষ্মীছাড়া ছেলে বাহারটাকে কেউ দেখেছো? বাজারে অনেকেই স্বাক্ষ্যদিলো যে বাহারকে গতকাল দুইটার দিকে বাংলাবাজার দেখা গিয়েছিলো। এরপর দক্ষিণ দিকে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু এর বেশীকিছু কেউ বলতে পারেনি ....।
এবার আসুন যে কবিতার পেছনের কথা বলতে গিয়ে লম্বা কিচ্ছা কাহিনী শুনতে হয়েছে সেই কবিতাটি দেখি:
#বদরখালী ভ্রমন #
গিয়েছিলাম বদরখালী
যাবো যাবো করে,
অনেক দিনের একটি আশা
পূর্ন হলো পরে।
রমজান মাসে যেতে হলো
একটি রোজা ছাড়ি,
বদরখালীর তিন নম্ভরে
জহির ভাইয়ের বাড়ি।
অর্ধ ভাঙ্গা ইট দিয়ে
বদরখালীর রাস্তা,
দিন দুপুরে মানিক দিল
শরবত আর নাস্তা।
মাছের ঘূণায় মুখহাত ধুয়ে
পেলাম লোনা পানি,
পাশের মাঠে লবণ হয়
বললো আমার নানী।
গর্তের ভিতর মহিষগুলো
নাকটি দেখা যায়,
পশ্চিম পাড়ে মহেশখালী
পাহাড় বয়ে যায়।
আসতে-যেতে সাইকেল ছিলো
চলার পথের সাথী,
বাজারের পাশে আছে
সমবায় সমিতি ।।
কবিতাটি লিখা হয়েছিল: ১১/০৫/১৯৮৭ ইং
বিষয়: বিবিধ
২১৮৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কবিতাও দারুন।
আমি সরবোচ্চ ১৪ মাইল একজনকে রডে বসিয়ে সাইকেলে গেছি এবং দাওয়াত খেয়ে তাকে নিয়ে ফিরেছি৷ সাইকেল যে বন্ধু হয় তা আমি জানি৷ অনেক সাহস যোগায়৷ ধন্যবাদ৷
এছাড়া সাতকানিয়া থেকে বাঁশখালী গহিরার চর সাগর পাড়ে বেড়িয়েছি ।
বান্দরবানের অর্ধেক পর্যন্ত গিয়েছিলাম ।
সাইকেলে করে ৩০/৩৫ কিলোমিটার??? ভয়ানক ব্যাপার!
পুরো ভ্রমণ কাহিনীটি পড়ে খুব লেগেছে, চমৎকার সাবলীল লিখা!
শুকরিয়া!
আসা যাওয়ায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার হয়েছিল ।
সাতকানিয়া থেকে যখন চট্টগ্রাম টাউনে এসেছিলাম তখন ১০০ কিলোমিটার ছাড়িয়েছিল ।
২) আপনি পরিবারের কাউকে না জানিয়ে অনেক বড় অন্যায় করেছেন, আপনার জন্য পুরা পরিবারে নেমে এসেছিল একটা ভিবিষিকাময় কালো ছায়া...।
তবে সত্য বলতে কি, আপনার ভ্রমণটা খুব ভাল লেগেছে..। ধন্যবাদ আপনাকে
বেড়ানোর নেশাটা আমার এখনও আছে ।
আমি বাংলাদেশের ৩৬ জেলাতে গেছি ।
আপনাকেও ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন