তালুত ও জালুতের যুদ্ধ ۩একটি আসমানী মেসেজ পরিবেশনা۩
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ২৫ জুলাই, ২০১৫, ০২:০১:০৮ দুপুর
হযরত ঈসা আলাইহিসসালাম আসারও প্রায় হাজার বছর আগের কথা । বনী ইসরাঈল তাদের হারানো সিন্দুক ফিরে পাওয়ার ফলে তালুতকে বাদশা হিসেবে মেনে নিল । তখন আল্লাহ মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আদেশ দিলেন । এরও আগে যখন মুসরিকরা একে একে বনী ইসরাঈলের ভূমি দখল করে নিয়ে তাদেরকে বের করে দিচ্ছিল তখন তারা বৃদ্ধ সামূয়েল নবীর কাছে এই আরজি নিয়ে গিয়েছিল যে তাদের জন্য যেন একজন বাদশা নির্বাচন করে দেন যেন তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে হারানো ভূমি উদ্ধার করতে পারে ? তখন তাদেরকে নবী বলেছিল তোমরা বিষয়টি আবার ভেবে দেখ, কারণ তখন আল্লাহ তোমাদের উপর জিহাদ ফরজ করে দিতে পারেন । ঘটনা যেন এমন না হয় যে তোমরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবে ।
তখন তারা বলেছিল আমাদের কি হয়েছে যে আমরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাব ? অতচ শত্রুরা আমাদের ভূমি দখল করে আমাদেরকে বের করে দিয়েছে, আমাদের সন্তান ও নারীদের দখল করে নিয়েছে । আমরা ওয়াদা করছি যে আমরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাব না । এরপর তালুতকে তাদেরকে বাদশা হিসেবে মনোনীত করা হয় । তারা প্রথমে তালুতকে মেনে নিতে না চাইলেও পরে হারানো সিন্দুক ফিরে পেয়ে তাদের মনে দৃঢ়তা ফিরে পায় এবং তালুতকে বাদশা হিসেবে মেনে নেয় । একদিকে তারা তালুতের মত প্রজ্ঞাবান যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী বাদশা পেল অন্যদিকে এখন তাদের সাথে আছে বিজয়ের প্রতিক সিন্দুক । এটি তো সেই সিন্দুক যার মধ্যে আছে হযরত মূসা আলাইহিসসালাম ও হযরত হারূণ আলাইহিস সালামের স্মৃতি বিজড়িত বরকতপূর্ণ নিদর্শনসমূহ । [সিন্দুকের ঘটনা জানতে আমার ‘রহস্যময় সিন্দুক’ লেখাটি পড়ুন]
বনী ইসরাঈল তাদের হারানো এলাকা ও সম্পদ ফিরিয়ে পাবার আকাংখা নিয়ে দলে দলে লোক যুদ্ধে যাবার জন্য তালুতের সাথে যোগ দিল । এ সময় তালুতের বাহিনীতে প্রায় আশি হাজার সৈন্য প্রস্তুত ছিল । এই বিশাল বাহিনী নিয়ে বিজয়ের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় । কিন্তু এখানে প্রকৃতপক্ষে কতজন যুদ্ধবাজ ত্যাগী লোক আছে তা আল্লাহর হুকুমে তালুত পরীক্ষা করতে চাইলেন । কারণ জানবাজ না হলে জালুতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর নিকট বেশীক্ষণ টিকতে পারবেনা ।
তাছাড়া তালুত জানতেন যে এ জাতির নৈতিক সংযমের মাত্রা অনেক কম । তাই তাদের মধ্য থেকে কর্মঠ ও অকর্মন্য লোকদের আলাদা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ।তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীর নিকট ঘোষণা দিলেন, তোমাদেরকে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন- সামনে যে নদী আছে তোমরা তার পানি পান করবে না । এটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য একটি পরীক্ষা । যদি কেউ পানি পান কর তাহলে সে আমার সহযোগী হতে পারবেনা । যে নিজের পিপাসাকে নিবৃত করতে পারবে সেই আমার সহযোগী হতে পারবে । উল্লেখ্য যে সে সময় প্রচন্ড গরমের সময় হওয়ায় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে পানি পানের প্রচুর তৃষ্ণা ছিল । তবে আল্লাহর পথে সৈনিক হতে হলে তৃষ্ণার মত চাহিদাকে জয় করেই এগিয়ে যেতে হবে । বিশেষ করে যেখানে স্বয়ং আল্লাহর ঘোষণা থাকবে সেখানে তা মানাই মোমিনের কর্তব্য ।
তালুত বনী ইসরাঈলদের আরো জানাল, তবে কেউ যদি এক আধ আজলা পানি পান করতে চাও তাহলে তা করতে পার । নদীর কিনারায় এসে দেখা গেল স্বল্প সংখ্যাক লোক ছাড়া বাকী সবাই সেই নদীর পানি আকণ্ঠ পান করল । ফলে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার মত শক্তি সাহস তাদের (আকণ্ঠ পানি পানকারীদের) অবশিষ্ট রইল না । তারা নদী পার হতেই পারল না ।
অত:পর তালুতের সাথে নদী পার হবার পর দেখা গেল স্বল্প সংখ্যাক লোক নদী পার হতে পেরেছে । তাদের মাঝে অনেকে বলতে লাগল আজ তো জালুত ও তার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই । কিন্তু তাদের মাঝে এমন লোকও বর্তমান ছিল যারা আল্লাহর সাথে মোলাকাত হবে একথা দৃঢ়তার সাথে অন্তরে বিশ্বাস পোষণ করত । তারা বলল: অনেকবারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যাক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের উপর বিজয় লাভ করেছে । মূতল: আল্লাহ তো সবরকারীদের সাথেই আছেন ।
তারা যখন বিশাল জালুত বাহিনীর মুখোমুখি হল তখন তারা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করল এই ভাবে, ‘হে আমাদের রব, আমাদের সবর দান কর, আমাদের অবিচলিত রাখ এবং এই কাফের দলের ওপর আমাদের বিজয় দান কর ।
উভয়পক্ষ মুখোমুখি হলে শক্তিশালী জালুত সম্মুখ যুদ্ধের আহবান করল । জালুতের মত শক্তিশালী বাদশার সাথে লড়ার জন্য তালুত বাহিনীর কেউ সাহস করল না । এদিকে তালুতের বাহিনীতে এক পরিবারের পিতাপুত্রের পনের সদস্যের একটি টিম ছিল । চৌদ্দ পুত্রের সর্বকণিষ্ট পুত্রের নাম ছিল দাউদ । তিনি চারণ ভূমিতে ছাগল চরিয়ে বেড়াতেন । তারা সকলেই নদী পার হয়ে তালুতের সহগামী হয়েছিলেন । জালুতের আহবাণে যখন কেউ সাড়া দিচ্ছিল না তখন যুবক দাউদ বলল, আমিই জালুতকে হত্যা করব । দাউদের সাহস দেখে তালুত দাউদকে ঘোড়া, তলোয়ার ও জেরা দিতে চাইলেও তিনি তা নিলেন না । দাউদ বলল: আল্লাহপাক যদি আমাকে সাহায্য না করেন তাহলে এগুলো কোনই কাজে আসবেনা ।
দাউদ আসার সময় পথিমধ্যে তিনটি পাথর দাউদকে বলেছিল তুমি জালুতের জীবন সংহারক । দাউদ পাথর তিনটি ঝুলিতে করে নিয়ে এসেছিল । এখন শুধুমাত্র ঝুলিটি সঙ্গে নিয়ে বীরদর্পে জালুতের সামনে দাঁড়ালেন হযরত দাউদ । তিনি ছিলেন খর্বাকৃতি, রোগাটে ও হরিদ্রাভ বর্ণ বিশিষ্ট । আর জালুত ছিল প্রচন্ড শক্তিশালী, ক্ষিপ্ত ও উদ্ধত । অনেক সৈনিককে একাই তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারত সে । কিন্তু দূর্বল দাউদকে দেখে কেন যেন ভিত হয়ে পড়ল সে । বলল: কে তুমি ? পাথর নিয়ে কুকুর তাড়াতে এসেছ নাকি ? দাউদ বলল: তুমি কুকুর অপেক্ষাও নিকৃষ্ট । তারপর একে একে তিনটি পাথর ছুঁড়ে মারলেন তিনি । ছুঁড়ে মারলেন ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের প্রতিপালকের নামে । পাথরগুলো জালুতের মস্তিস্কের সম্মুখ দিকে প্রবেশ করে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেল । এভাবেই জালুত পরাজিত হল ।
দাউদের উপর খুশি হয়ে বাদশা তালুত দান করলেন নিজ কন্যা । আল্লাহ খুশি হয়ে দান করলেন রাজ্য আর নবুয়ত । সেই সাথে দান করলেন আসমানী কিতাব যবুর শরীফ এবং কিছু অলৌকিক নিদর্শনসমূহ ।
ইহা একটি আসমানী মেসেজ পরিবেশনা
আলোচ্য ঘটনাটি আল্লাহপাক কোরআনের সূরা বাকারার ২৪৯, ২৫০ ও ২৫১নং আয়াতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :
[সূত্র: তাফসীরে তাফহিমুল কোরআন, তাফসীরে মারেফুল কোরআন, তাফসীরে মাযহারী ]
(২৪৯) তারপর তালুত যখন সেনাবিহনী নিয়ে এগিয়ে চললো, সে বললোঃ “আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নদীতে তোমাদের পরীক্ষা হবে। যে তার পানি পান করবে সে আমার সহযোগী নয়। একমাত্র সে-ই আমার সহযোগী যে তার পানি থেকে নিজের পিপাসা নিবৃ্ত্ত করবে না। তবে এক আধ আজঁলা কেউ পান করতে চাইলে করতে পারে। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া বাকি সবাই সেই নদীর পানি আকন্ঠপান করলো। অতঃপর তালুত ও তার সাথী মুসলমানরা যখন নদী পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তখন তারা তালুতকে বলে দিল, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যারা একথা মনে করছিল যে, তাদের একদিন আল্লাহর সাথে মোলাকাত হবে, তারা বললোঃ “অনেক বারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের ওপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথি।”(২৫০) আর যখন তারা জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলায় বের হলো, তারা দোয়া করলোঃ “হে আমাদের রব! আমাদের সবর দান করো, আমাদের অবিচলিত রাখ এবং এই কাফের দলের ওপর আমাদের বিজয় দান করো।”(২৫১) অবশেষে আল্লাহর হুকুমে তারা কাফেরদের পরাজিত করলো। আর দাউদ জালুতকে হত্যা করলো এবং আল্লাহ তাকে রাজ্য ও প্রজ্ঞা দান করলেন আর সেই সাথে যা যা তিনি চাইলেন তাকে শিখিয়ে দিলেন। এভাবে আল্লাহ যদি মানুষদের একটি দলের সাহায্যে আর একটি দলকে দমন না করতে থাকতেন, তাহলে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হতো। কিন্তু দুনিয়াবাসীদের ওপর আল্লাহর অপার করুণা (যে, তিনি এভাবে বিপর্যয় রোধের ব্যবস্থা করতেন) ।
ইতিপূ্র্বে প্রকাশিত আসমানী মেসেজ এর সবগুলো পোষ্ট একটি মাত্র লিংকে:
ইতিপূ্র্বে প্রকাশিত আসমানী মেসেজ এর সবগুলো পোষ্ট
বিষয়: বিবিধ
৩১৬৩ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
০ এগুলো আল্লাহর দান করা মোজেজা । দাউদ (আঃ) এর সাথে পাহাড় পর্বতও আল্লাহর জিকির করতো ।
আল্লাহ দাউদ (আঃ) এর সন্তান সুলাইমান (আঃ)কেও একই রকম মোজেজা দিয়েছিলেন ।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি ।
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ উৎসাহ দেবার জন্য ।
শিক্ষ নিয় লেখাটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদনিন
জাজাকাল্লা খায়ের
খুব সুন্দর পোস্ট, আল্লাহ্ আপনাকে যাযাহ ও খায়ের দান করুণ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান.....।
আমার জন্য দোয়া করবেন
আপনাকে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন