Good Luck ভাই .... (গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ০৫ মার্চ, ২০১৩, ০৭:১২:০৬ সন্ধ্যা

১৯৮৬ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর, শনিবার। বিকাল প্রায় তিনটার মত হবে। জাফর উদ্দিন রব্বানী স্কুল থেকে প্রথম কোচিং করে পরবর্তী কোচিং এর রুটিন ধরে বাড়ীতে এসে ভাত খেয়ে দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ কে যেন এসে ওকে ঘুম থেকে তাড়াহুড়া করে ডাকা শুরু করল।

রব্বানী ধড়মড় করে উঠে কি হয়েছে জিঙ্গেস করায় বলল- শাহীনুর সাইকেলে পা কেটেছে, মা কাঁদছে। রব্বানী বাহিরের উঠোন থেকে মেয়ে লোকের কাঁন্না শুনতে পেলো। সে তাড়াতাড়ী বাহির হয়ে দেখল মায়ের কোলে শাহীনুর। মায়ের এক হাতে শাহীনুরের একটি পা, তা থেকে ফুঁটা ফুঁটা রক্ত ঝরছে। রব্বানী দেখল ছোট বোনের পায়ের পিছনে ঘুচির দিকে কাটা। কতটুকু কেটেছে তা রক্ত মাখা পা দেখে বুঝার উপায় নেই।

রব্বানী তাড়াতাড়ি বাড়ীর ভিতর ঢুকে সার্ট গায়ে দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ফুফুর দেয়া প্রাইজবন্ডের টাকা গুলো নিয়ে বেরিয়ে আসল। উঠোনে বেরিয়ে এসে সে দেখল ফুফু, বোন আইনুন, দাদি, আম্মা সহ আরো অনেক ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। কেউ বলছে বোরকা লও, কেউ বলছে রিক্সা ডাকো ইত্যাদি....। তাদের হাকডাক ঐ 'লও' আর 'ডাকো' এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কে লচ্ছে আর কে ডাকছে তার কোন ঠিক নেই।

রব্বানী বলল কিসের মাধ্যমে কেটেছে? বলা হলো, সাইকেলে। হোছাইন শাহীনুর কে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে চালাচ্ছিলো। সাইকেলের চাকায় শিকার ভিতর পা ঢুকে গেছে।রব্বানী দেরী না করে শাহীনুর কে কোলে নিয়ে মফস্বল শহরের দিকে হাটা দিল.... তাড়াতাড়ী চিকিৎসা নিতে হবে।কিছুদুর যাওয়ার পর পেছন থেকে কে যেন বলল- দাঁড়াও, ওদিক দিয়ে রিক্সা আসছে।রব্বানী বলল- রিক্সা আসতে আসতে আমি ডাক্তারের কাছে পৌছে যাবো। আরো কিছুদুর যাওয়ার পর রব্বানী দেখল সামনের দিক থেকে বাবা আসছে বাজার করে।

রব্বানীকে দেখে বাবা জিঙ্গেস করল- কিরে, শাহীনুরের কি হয়েছে? রব্বানী বলল- সাইকেলে পড়েছে। কে ফেলেছে? হোছাইন।শয়তানের বাচ্চাকে মেরে ফেলবো বলে বাবা হোছাইনকে ধরতে গেলো। রব্বানীর পিছনে পিছনে ভিজা বিড়ালের মত হোছাইনও ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলো। রব্বানী তাড়াতাড়ী হোছাইনকে সামনের দিকে টান মারলো। বাবাকে ততক্ষনে ৩/৪ জনে ধরে ফেলেছে। বাবা তবু পায়ের জুতা খুলে হোছাইনের দিকে ছুড়ে মেরেছে.......।

রব্বানী বাবাকে বলল- যা হবার হয়েছে, এখন ওকে মারলে কোন লাভ হবে না। আগে শাহীনুরের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। এরপর সবাই স্থানীয় বড় নদী পেরিয়ে মফস্বল শহরে একজন বড় ডাক্তারের কাছে গেলো।

ডাক্তার সাহেব ঐ এলাকার প্রথম বড় দুই জনের মধ্যে একজন। রব্বানী ডাক্তার কে বললেন- স্যার আমার ছোট বোনের এই অবস্থা- তাড়াতাড়ী একটি ব্যান্ডেজ এর ব্যবস্থা করুন .....।ডাক্তার ক্ষত দেখেই বুঝতে পারল কিসের ক্ষত। তারপর রব্বানীকে বলল- বসো। এরপর ডাক্তার অন্য একজন লোকের সাথে কথা বলতে লাগলেন।

রব্বানী ডাক্তারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। ওর এক হাতে শাহীনুরের আহত পা, একটি বড় কাগজের টুকরা দিয়ে ঢেকে রেখেছে যাতে দেখা না যায়।পা-টি বিভৎস দেখাচ্ছিলো।

এমন শীতের দিনেও রব্বানীর শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। কিন্তু রব্বানী যেভাবে সিরিয়াস অবস্থায় আছে, মনে হচ্ছে ডাক্তার এর সামান্যতম গুরুত্বও দিচ্ছে না। ডাক্তার সাহেব অসম্ভব রকমের ঠান্ডা অবস্থায় আছেন। অবশ্য ডাক্তারের এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে বলছেন কম্পাউন্ডারকে ব্যান্ডেজ এর সরঞ্জাম আনতে। অতচ রোগী যেভাবে কষ্ট পাচ্ছে রব্বানীর কাছে প্রতিটি সেকেন্ড ঘন্টার মত মনে হচ্ছে....।

ডাক্তারের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। তারপর ডাক্তার এসে শাহীনুরের আহত পায়ের ক্ষতস্থানের ঝুলে পড়া অংশটি চিমটি দিয়ে এমন মামুলী ভাবে তুলে ধরল যেন সেখানে কিছুই হয়নি। শাহীনুরের সে কি চিৎকার। ডাক্তারের অন্তরে কি একটু রহম নেই? রব্বানী দেখল ছোটবোন শাহীনুরের পায়ের ঘুচির তিন চতুর্থাংশই কেটে গেছে। উহ; সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য....। রব্বানীর বাবা তা দেখে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। রব্বানী তাড়াতাড়ী বাবাকে ধরে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

শাহীনুরের পা ওরা তিন জনে চেপে ধরে রেখেছে। তিন জনে চেপে ধরে রেখেও পা-টিকে স্থির রাখতে পারছিলো না। শাহীনুরের আর্তচিৎকারে পা-টি বার বার স্থান চ্যুত হয়ে যাচ্ছিল। রব্বানী এক হাতে পা ধরে অন্য হাতে ছোট বোনটিকে বাতাস করছিলো।

বোনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রব্বানী ডাক্তারকে বলল- স্যার, আহত পা টিতে একটি ইনজেকশান দিয়ে অবচেতন করতে হবে। ডাক্তার বললেন- আমি কম বুঝি না, বেশি বুঝলে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও! এই এলাকার ডাক্তারদের এই এক সমস্যা, কোনো কিছু বুঝাতে গেলেই রেগে যায়। এলাকার অপর বড় ডাক্তারকে কিছু বুঝাতে গেলে উনি রুগিকে বলেন- তোমাদের কাছ থেকে শুনতে হলে আমি ডাক্তার হয়েছি কেন?

ডাক্তার যখন কটন দিয়ে ক্ষতস্থান ফাঁক করে কটন দিয়ে রক্ত মুছে নিচ্ছিলেন তখন শাহীনুরের সে কি কান ফাঁটা চিৎকার। তা রব্বানী কোন দিনই ভূলতে পারবে না...

রব্বানী ডাক্তারের কম্পাউন্ডার শাহজাহানকে বলল- অজ্ঞান করার মত কোন ব্যবস্থাই কি নেই? শাহজাহান হচ্ছে রব্বানীর বন্ধু যে কিনা ওখানে কাজ শিখছিলো। সে রব্বানীর দিকে অসহায়ের মত কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ডাক্তারের দিকে থাকালো ।

রব্বানী আবারো ডাক্তারকে বলল- স্যার আমার ছোট বোন কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বললেন- কষ্টতো পাবে, আঘাততো আর সামান্য নয়। তারপর ডাক্তার বাঁকা সুঁই আর চিমটা দিয়ে যখন জ্যান্ত চামড়া ফুঁড়ে ফুঁড়ে সেলাই করছিলো তখনকার কথা মনে পড়লে এখনও রব্বানীর শরীরের রক্ত পানি হয়ে আসে। ওর ছোট বোন শাহীনুর তখন ব্যথায় চিৎকার করে করে কেঁদে কেঁদে দুই হাতে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছিলো।

এক পর্যায়ে চামড়া চিড়ে সুতা সহ চলে এসেছে চিমটার সাথে! রব্বানীর অবস্থা তখন কাহিল। সে আর স্থির থাকতে না পেরে কঠিণ স্বরে ডাক্তারকে বলল- স্যার, ওকে অজ্ঞান করার মত কোন ব্যবস্থা-ই কী নেই? একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সামনে এভাবে উগ্র মেজাজে কথা বলার সাহস কোথায় পেলো রব্বানী নিজেই জানেনা। ডাক্তার কোন জবাব দিলেন না। চামড়ার জুতা সেলাই করছেন এমন মনোভাব নিয়ে শাহীনুরের পা সেলাই করতে লাগলেন। তা দেখে রব্বানীর মাথা চক্কর দিয়ে চারপাশটা ঘুরতে লাগলো।

জাফর উদ্দীন রব্বানীর অবস্থা দেখে শাহজাহান ওকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলো। রব্বানীকে বসতে দেখে ওর বাবা উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু বাবা সামান্যতেই ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। রব্বানী আবার উঠে দাঁড়ালো।

রব্বানীর আরেক ছোট বোন আইনুন এবং ছোট ভাই খাইরুল পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। ওদের কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রব্বানী বকা দিয়ে বের করে দিলো।

রব্বানী দেখল ডাক্তার সেলাই করে পায়ের নীচে চ্যাপ্টা করে যে চামড়াটি উঠে গিয়েছিল কাঁচি দিয়ে কেটে সেটাকে শরীর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। ওটা সেলাই করতে ঝামেলা হবে তাই এই ব্যবস্থা। ডাক্তারের এই কঠিন আচরণ আর অমানুষিক অত্যাচার দেখে রব্বানীর বুক ফেটে কান্না আসছিলো।ইচ্ছে হচ্ছিলো ডাক্তারের চাকুটি উনার পেঠের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।

রব্বানী ওর প্রিয় ছোট বোন শাহীনুরকে জড়িয়ে ধরে বোবা কান্নায় ফেঁটে পড়ে। চোঁখ ঝাপসা হয়ে চোঁখ দিয়ে টলটলিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।ডাক্তারের এই নির্মম আচরণ দেখে রব্বানীর ইচ্ছে হচ্ছিলো রক্ত শফৎ নিবে ভবিষ্যতে ডাক্তার হবে বলে। সে তখন স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র।আর মাস তিনেক পরে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা।

ডাক্তার হয়ে সে বেশী টাকা রোজগার করতে পারবে এই লোভে নয়। ওর মত ভাইকে যাতে আর কোন দিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে সুচিকিৎসার অভাবে বোবা কান্নায় জর্জরিত হয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসতে না হয় সে জন্যই সে ডাক্তার হতে চাই।

রব্বানীর বাবার গায়ে না হয় সাধারন পোষাক ছিলো।রব্বানীর পরনে না হয় অগোছালো কাপড় ছিলো। তাই বলে চিকিৎসা করে টাকা দিতে পারবে না এমন আশা ডাক্তার সাহেব করলেন কিভাবে? আর তা যাদি না করতেন রব্বানীর ছোট বোনটিকে অজ্ঞান না করে, অবচেতন না করে কি মনোভাব নিয়ে তিনি আহত পায়ে হাত দিলেন। রব্বানীর অশান্ত মাথায় বিভিন্ন চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে।

ডাক্তার সত্যিই তাই অনুমান করেছিলেন।টাকা দিতে পারবে না মনে করেই... অবচেতনের ব্যবস্থা করেন নাই। হায়রে টাকা!

চিকিৎসা শেষে শাহীনুরকে নিয়ে বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল রব্বানী। বাবা চলে যাবার সময় শক্ত কণ্ঠে হুংকার দিয়ে হোছাইনকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়িতে। রব্বানী চিন্তা করলো, বাবার এ রূপ সে চিনে। হোছাইনকে একবার ধরলে সহজে সে নিস্তার পাবেনা, আচ্ছামতো পিঠাবে।

এভাবে বাবার হাতে হোছাইনকে ছেড়ে দেয়া যায়না, চিন্তা করে রব্বানী। তাছাড়া বেচারা হোছাইন, দোষ একটা না হয় করেছে। এরপর কিন্তু অনেক কেঁদেছে। ডাক্তারের ওখানেও চেহারা মলিন করে বসে ছিলো। সে তো আর ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করেনি। রব্বানী চিন্তা করে হোছাইনকে ওখানে বসতে বললো। বাবা চলে গেলো শাহীনুরকে নিয়ে। সাথে গেল ছোট বোন আইনুন এবং ছোট ভাই খাইরুল।

বাবা চলে গেলে রব্বানী শাহীনুরের জন্য পাঁচটা ইনজেকশান কিনে চিন্তা করতে লাগলো হোছাইনকে নিয়ে কি করা যায়। আর যাই হোক ওকে এমূহুর্তে বাড়িতে নেয়া ঠিক হবেনা। কারণ রব্বানী জানে বাড়ীতে বাবা ওকে পেলে আস্ত রাখবে না। অন্তত দু'তিনদিন সতর্ক থাকতে হবে।

অনেক ভেবে চিন্তে রব্বানী হোছাইনকে নিয়ে সেজ ফুফুর বাড়ীতে নিয়ে গেলো। সেখানে ফুফাতো বোন মনজুমানকে সব বুঝিয়ে ওদের বাড়ীতে হোছাইনকে রেখে রব্বানী বাড়ীতে চলে এলো। ফুফু তখন বাড়ীতে ছিল না। ফুফার অসুখ ছিলো বলে শহরে ছিলেন।

রব্বানী বাড়ীতে আসলে মা জিঙ্গেস করল হোছাইন কোথায়? রব্বানী বলল- জানিনা। তখন মা আবার ছেলের জন্য ছটফট করতে লাগলেন। হাজার হলেও মায়ের মন। মায়ের ব্যকুলতা দেখে রব্বানী মাকে বলল বটে হোছাইনের অবস্থান কিন্তু বারণ করলো যাতে বাবাকে বলে না দেয় ।

হঠাৎ রব্বানীর মনে পড়লো হোছাইন তো ফুফুর বাড়ীতে কোন শীতের কাপড় নেয়নি। ডিসেম্বরের এই শীতের মাঝে প্রিয় ছোট ভাইটি শীতে কষ্ট পাবে এটা চিন্তা করে সে নিজের মনের মাঝে কিছুটা বিচলিত ভাব অনুভব করলো। ভাইটির উপর এমনিতেই অনেক বিপদ। হোছাইনের কথা মনে হতেই রব্বানীর কলিজার মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। হঠাৎ ওর জন্য ভীষন মায়া হলো জাফর উদ্দীন রব্বানীর।

অনেক চিন্তা করেও হোছাইনের জন্য কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলো না সে। ফুফুর বাড়ী ওদের বাড়ী থেকে অনেক দুরে। তাছাড়া দুইটা বড় বড় খাল পেরিয়ে তবেই যেতে হয়। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রব্বানী অনেক চিন্তা করে হোছাইনের জেকেটটি নিয়ে নিজের রক্তমাখা সার্ট টি ধুলাইতে নিয়ে যাচ্ছে এরকম ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ী থেকে।

যে করেই হোক, আমার ভাইয়ের কাছে জেকেট পৌছাতেই হবে- এই ছিল রব্বানীর দৃঢ় অঙ্গিকার। বাড়ী থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ দোকানের পথের দিকে হেটে কিছুদুর গিয়েই ফুফু বাড়ীর দিকে খুব দ্রুত বেগে হাটা দিলো রব্বানী। কারণ বাবা বুঝতে পারার আগেই ওকে আবার বাড়ীতে হাজির হতে হবে। পশ্চিমা আকাশে অন্ধকার তখন একটু একটু করে ঘনীভূত হয়ে আসছিল........।

বিষয়: বিবিধ

১৬৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File