প্রবাসীদের জন্য মন কাঁদে....
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ০২ মে, ২০১৪, ০৯:৪৩:২১ সকাল
এক সময় আমি দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়াটা মোটেই সমর্থন করতাম না। অনেকটা এক ঘুয়েমি করেই বলতাম যে, যাদের যোগ্যতা নেই দেশে আয়-রোজগার করবার তারাই বিদেশে যায়।
আমাদের নিজ নিজ যোগ্যতা দিয়ে নিজ দেশকেই সমৃদ্ধশালী করে তুলব, এটাই ছিল আমার স্বপক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি। আমার বন্ধু মহলে আমার সমর্থনে আরো কয়েকজন ছিল।
স্কুল লেবেল শেষ করেই অনেক বন্ধু বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। কেউ কেউ মাধ্যমিক লেবেল পর্যন্ত পড়ে বিদেশে পাড়ি জমায়।
আবার কেউ কেউ গ্রেজুয়েশন নেয়ার পর দেশে সুবিধা করতে না পেরে বিদেশে যেতে বাধ্য হয়।
আমি বরাবরই একটু পরিবার দরদী সন্তান ছিলাম। ছোটকাল থেকেই বাড়ি থেকে দূরে কোথাউ কয়েকদিন থাকলেই আমি রীতিমত কেঁদে দিতাম।
এ কারনে আমার ধারনা ছিল যে বিদেশে গেলে আমি থাকতেই পারব না । পালিয়ে আসতে হবে।
বিদেশে গেলে দেশের জন্য , পরিবার এবং আত্বীয় স্বজনের জন্য আমার কিভাবে কষ্ট লাগবে এটা মনে হতেই আমার পেঠের নীচের অংশে মোচড় দিয়ে উঠে। একবার বাড়ী থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম । তখন অনেক কেঁদেছিলাম বাড়ীর জন্য ।
আমি জানি দেশে ও অনেকে পরিস্থিতির কারনে প্রবাসীর মত জীবন যাপন করেন । তাদের অনুভূতি ও অনেকটা প্রবাসীদের মতই ।
বিদেশে যারা যায় , আমি জানি তারা প্রথম কয়েক সপ্তাহ শুধু কেঁদে কেঁদে কাঠিয়ে দেন । অনেকে থাকতে না পেরে পালিয়ে আসেন । জীবনের প্রথম ২৫/৩০ বছর যেখানে একটানা কাটিয়েছে সেখানে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক ।
অবশ্য কিছুদিন হয়ে গেলে আস্তে আস্তে গাঁ সওয়া হয়ে যায়।
আমি জীবনে অনেককে বিমান বন্দরে পৌছে দিতে গেছি। শেষ মুহূর্তে বিদায় বেলায় চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে কোনদিন পারিনি।
আবার বিদেশ ফেরত অনেককে রিসিভ ও করেছি । একবার হয়েছে কি , ঢাকা বিমান বন্দরে আনতে গেছি আমার ছোট ভগ্নীপতি মোবারক হোসেনকে । তো একটা টিকেট কেটে লাউঞ্জের ভিতর ঢুকছি উনাকে ভিতরে একটু আগে ভাগে দেখব বলে ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই উনাকে দেখতে পেলাম, আমি উনাকে গ্লাসের ভিতর দিয়ে ইশারা করে ডাকতেছিলাম । উনি আমার সামনে দিয়ে কয়েকবার গেলেন কিন্তু আমার দিকে তাকালেন না পর্যন্ত ।
হায় আল্লাহ, উনি কি আমাকে ভুলে গেলেন , তাহলে এখন কি হবে ?
শেষ পর্যন্ত উনি নিজে নিজেই বেরিয়ে গেলেন । আমি ও বের হয়ে যখন উনার সামনে গিয়ে উনাকে ডাক দিলাম উনি আমার দিকে কিছুক্ষন থাকিয়ে তাকলেন ।
কিছুক্ষন পর আমাকে চিনতে পেরে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমি বললাম - আমি তো লাউঞ্জের ভিতর ও আপনাকে অনেক ডেকেছি । সেখানে ও আমাকে চিনেন নাই , আবার এখানে এসে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ব্যাপার কি ?
উনি বললেন- আমার কি দোষ ? আমি তো আড়াই বছর আগে বিদেশ যাবার সময় কোন দাড়ী ওয়ালা ভাই সাহেব রেখে যায়নি ।
ও, এই কথা । তাইতো, উনি যাবার সময় ও আমি ঢাকা বিমান বন্দরে পৌছে দিয়ে গিয়েছিলাম । তখন আমার মুখে দাড়ী ছিল না। যাক ,
এমন এক সময় ছিল দেশ থেকে একটা চিঠি লিখলে সেটা ফিরতি জওয়াব আসতে এক মাস সময় লাগত ।
আর এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় কল্পনাতীত উন্নতী হয়েছে ।
আমি চিন্তা করি- একজন বাংলাদেশী বিদেশে গিয়ে কত কষ্টই না করেন ।
গাঁদা কে ও হার মানাবে তাদের কষ্ট।
কত পরিশ্রম কত ত্যাগ, এটা কেবল ভোক্ত ভোগিই বলতে বা বুঝতে পারবে।
দেশে যে ছেলে কোনদিন বাসন ধুয়ে ভাত খায়নি, বা নিজের গোসলের লুঙ্গিটা ধুয়েনি । যে কোন দিন বাজারে গিয়ে বাজার করে আনেনি।
যে কোন দিন গরুটা, ছাগলটা বিলে গিয়ে রেখে আসেনি বা সন্ধ্যায় বাড়ীতে নিয়ে আসেনি।
দু:খিনী মাকে দিয়ে যে ঝিঁ-চাকরানীর মত পরিশ্রম করিয়েছে সেই ছেলে আজকে বিদেশে গিয়ে পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে।
এমন পরিশ্রম করছে, সে কোন দিন কল্পনা ও করেনি যে তাকে এসব পরিশ্রম করতে হবে।
শুধু কি তাই ? অনেকে আছেন পরিশ্রমের কাজ ও পাচ্ছে না করতে। বসে বসে মাসের পর মাস হাওলাত করে করে চলছেন।
এত কষ্ট এত পরিশ্রম করার পর যখন দেশে ফোন করে দু:খীনি মায়ের গলার আওয়াজটা শুনতে পায় তখন তার কাছে তা শরবতের মতই মনে হয় । পরানটা জুড়িয়ে যায়।
ছোট ভাইটির কন্ঠ ,আদরের ছোট বোনটির ‘ভাইয়া’ ডাকটি শুনে কতই না মধুর লাগে কেবল সেই ব্যক্ত করতে পারবে তার অনুভূতি ।
যখন প্রিয় বাবার কণ্ঠে-‘ বাবা তুই কেমন আছিস ?’ শুনতে পায় তখন প্রবাসী ছেলে কান্নার লোনা জলে ভাসিয়ে দেয় চক্ষু যোগল । বাকরুদ্ধ হয়ে সে তখন অনেক্ষন পর্যন্ত কথাই বলতে পারেনা।
তার দু’ চোঁখ দিয়ে তখন নিরবে ঝরতে থাকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ।
দেশে যাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে তাদের অবস্থা আরো করুন ।
ছোট্ট সোহাগের ছেলেটি যখন মোবাইলে বলে- আব্বু তুমি কবে আসছো ? আমার জন্য গাড়ী আনতে ভুলবেনা কিন্তু।
কলিজার টুকরা মেয়েটি যখন বলবে - আব্বু, তুমি কেমন আছো, কিছু খেয়েছো । আমি আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে তোমার জন্য দোয়া করেছি । তখন কেমন লাগে একজন প্রবাসী বাবার !
হাঁয়রে নিয়তি ! তোমার এ কেমন লিলা যে তুমি আমাকে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কাছ থেকে এভাবে সরিয়ে রেখেছো ?
আমার যে ইচ্ছে হয় এ মুহূর্তে উড়ে গিয়ে সবার সাথে মিলিত হই।
প্রানের সহধর্মীনি , ভালবাসার উজ্জল নত্র , জীবনের বন্ধন , মোহাব্বতের শ্রুতশ্বীনি , সংসারের মায়াকানন , ঘরের লক্ষ্মীটি যখন মোবাইল ধরে বলে - হ্যাঁলো.......
তখন ? তখন ......কেমন লাগে. ?...কেমন লাগে সেটা যারা প্রবাসে আছেন তারাই মন্তব্য দিবেন আশা করি ।
এই অনুভূতিটি আমি ব্যক্ত করতে পারব না , কারন আমি কিন্তু প্রবাসী নই।
আমি হয়তো প্রবাসী হতে কোনদিন পারবো ও না ।
কারন মায়ের ব্যাকুলতা, বোনের উদগ্রীব চঞ্চলতা, ভায়ের উতকণ্ঠা, স্ত্রীর সোহাগ, মেয়ের অপেক্ষা , ছেলের আব্দার এসব পিছনে ফেলে........
আমি পারব না, আমি পারব না .. আমি দেশ ছেড়ে বিদেশ যেতে পারব না , আমি প্রবাসী হতে পারব না ।
আমি পারবনা বলেই প্রবাসীদের জন্য আমার প্রান কাঁদে। আমার অন্তর খানী তাদের ব্যথায় শরীক হতে চাই।
দু’হাত প্রসারিত করে চি:কার করে মহান আল্লাহর দরবারে প্রবাসীদের জন্য দোয়া করতে ইচ্ছে করে ।
-‘‘হে,আল্লাহ, তুমি আমার বাংলাদেশী ভাই এবং বোনদের কে যে যেখানে আছে , সেখানে ভাল রেখ, সুস্থ রেখ। তাদেরকে ধর্য্য দিও, সাহস দিও এবং কর্মের সংস্থান করে দিও। ”
-”হে আল্লাহ তুমি সমস্ত প্রবাসীদের কে আপদ, বালা, মুসিবত, এক্সিডেন্ট থেকে হেফাযত রাখিও।”
প্রবাসীরা এত কষ্ট করে ও অনেক সময় দেখা যায় নিজ বাড়ীতে কষ্টের স্বীকৃতি পায় না।
অনেক সময় কষ্টে অর্জিত রেমিটেন্স আত্বীয়রা মিস-ইউস করে ফেলে ।
আবার এই প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতির কাঠামো মজবুত করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে ।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রাখতে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কমে গেলে দেশের আমদানী রপ্তানীতে প্রভাব পড়ে এবং অনেক সময় সরকার পর্যন্ত বেকায়দায় পড়ে যায় ।
কিন্তু এই প্রবাসীদের জন্য সরকারী ভাবে তেমন উ:সাহ মূলক কিছুই করা হয়নি ।
আমার প্রায় সময় মনে হয় সরকারী ভাবে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট দেয়া দরকার যেটা দিয়ে তারা ‘ভিআইপি’র মর্যাদা পাবে।
আর প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সরকারের পক্ষ থেকে দেশে সমস্ত মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে এমন একটি মেজবানের আয়োজন করা যেখানে উপস্থিত হতে পারবে শুধু রেমিটেন্স পাঠানো সার্টিফিকেট ধারী প্রবাসী এবং দেশের আয়কর দাতারা । উতসাহ মূলক সৌজন্য সাক্ষাতকার ।
প্রবাসীরা এতসব পরিশ্রম করে যখন দেশে আসার সময় হয় , তখন প্রায় ৬ মাস আগে থেকে দেশের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা, ভাইবোনের জন্য কত কিছুই না কেনাকাটা করে ।
মনে মনে কত কল্পনা করে এ জিনিসটা পেলে বাবা কত খুশি হবে, মা ঐ জিনিস টা পেলে কত পুলকিত হবে ইত্যাদি ।
কিন্তু আসার সময় যখন নিজ দেশের বিমান বন্দরে ডাকাতেরা লাগেজ বা শান্তা খুলে খুলে ওদের পছন্দের জিনিস গুলো নিয়ে ফেলে তখন চিন্তা করুন তাদের মনের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাড়ায় ?
অবশ্য এখন আগের মত নেই , অনেক কমে গেছে । আগের মত তেমন অভিযোগ শুনা যায় না।
প্রবাসীরা আমার ভাই এবং বোন, প্রবাসীরা আমার বন্ধু, প্রবাসীরা আমার আত্বীয় - আমি প্রবাসীদের প্রানের চেয়ে ভালবাসি । আমি আমার দেশকে যেমন ভালবাসি, ঠিক তেমনি প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে ও ভালবাসি। প্রবাসীরা আমার প্রানের স্পন্দন । প্রবাসীদের জন্য আমার মন কাঁদে......
বিষয়: বিবিধ
২১৩৫ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার শৈল্পিক ছোয়ায় প্রবাসীদের জন্য লেখা আরো প্রানবন্ত হবে বলেই আমার বিশ্বাস ।
ভাল থাকবেন এবং দোয়া করবেন।
যার যার অবস্থান থেকে বুঝের ভিন্নতা থাকবেই। সূর্য উদয়ের পর থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সূর্যের প্রভাবে পৃথিবীতে হাজার রকমের পরিবর্তন আসে । মানুষের চরিত্রও সূর্যের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
আমার লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
আপাতত: প্রবাসী হিসেবে বিদেশে যাবার পরিকল্পনা নেই । আপনার যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে । কারন আপনি এখনও ’সন্তান’ । হা হা
বিদেশে এসে প্রথম ছয় মাস শুধু কেঁদেছি। মনে হচ্ছিল আমি এখনই দেশে চলে যাব। আগামী কাল নয়, এখনই চলে যেতে হবে।
আপনি প্রবাসী না হয়েও খুব সুন্দর ভাবে প্রবাসীদে অন্তরের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেক ধন্যবাদ।
মহান আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুন । আমীন।
আপনার মত আমিও প্রবাসিদের কষ্ট বুঝতে পারি কারন আমার কিছু নিকটাত্মীয়ও প্রবাসে থাকেন।
আমার ‘সাগর’লেখাটি পড়ার অনুরোধ থাকল ।
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/2668/rashic/44104
আমার জন্য এবং আমার আম্মার জন্যও দোয়া করবেন । আমার বাবার মৃত্যুকালে আল্লাহ আমাকে খেদমত করার সুযোগ দিয়েছেন । আম্মার বেলায় যেন সে সুযোগ দেন ।
আমি প্রবাস জীবন নিয়ে সিরিজ লিখতেছি আজ ৯ পর্ব শেষ করেছি পড়ে আসবেন কষ্ট করে আমার ব্লগ বাড়িতে গিয়ে।
প্রবাসীদের নিয়ে নাটক সিনেমা হয়তো পরিচালক প্রযোজকরা লাভজনক মনে করছে না বলেই এই নিয়ে নাটক সিনেমা হচ্ছে না ।
তবে আমি আপনার সাথে একমত । প্রবাসীদের বাস্তব চিত্র নিয়ে নাটক সিনেমা হওয়া উচিত । সরকারী ভাবে ভর্তূকি দিয়ে হলেও ......
আপনাকে ধন্যবাদ ।
[বি:দ্র:আমার লিখায় প্রবাসীদের বাঁশ দিয়েছি বলে আপনার মনে হলে আমি আন্তরিক ভাবে দু:খিত ।]
মন্তব্য করতে লগইন করুন