উত্তাল সাগরে আমি
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ৩০ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:২৩:৫২ বিকাল
ভূমিকা : ( ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল ' ১৯৯১ ইং স্বরণে )
১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বরনীয় দিন। স্বরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণীঝড়ের কবলে এদিন বাংলাদেশের জনমানুষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। এ সময়ের ঘঠনায় আমার থলেতে কিছু স্বরনীয় ঘঠনা জমে আছে.... তা এখন শেয়ার করবো। আশা করা যায় আমার বিবরণে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।........সে দিন জাহাজে আমার সাথে যারা ছিল এবং জাহাজের প্রত্যেক্ষদর্শি যারা, তারা সবাই আমাকে ঘটনাটি লিখে রাখার জন্য উৎসাহিত করেছিল (এখানে ঘটনা বলতে মাঝসাগরে নিক্ষেপ করা একজন লোককে উদ্ধার অভিযানের কথা বলা হয়েছে)। বলতে গেলে তাদের উৎসাহেই পরবর্তীতে আমি এই লেখায় হাত দিয়েছিলাম। এই লেখায় সেদিনের ঘূর্ণীঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতির যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবিকই প্রেকটিক্যাল। ঐতিহাসিকদের জন্য এখানে কিছু উপকরন থাকতেও পারে। ঐ ভয়াল রাতের অন্ধকারে যারা জীবন যুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি ..................।
৬ মে ১৯৯১ ইংরেজী, সোমবার। গভীর বঙ্গোপসাগরের মাঝ দিয়ে উত্থাল ঢেউয়ের তরঙ্গ মালা ভেদ করে দানবের মত ছুটে চলছে একটি জাহাজ। জাহাজের নাম ‘মহেশখালী। গন্তব্য স্থান কুতুবদিয়া।
বিরাট তিন তলা জাহাজে প্রায় দুইশ যাত্রী। নীচ তলার প্রথম শ্রেণীর মহিলা কেবিনের এক পাশে আমাদের ত্রাণসামগ্রীর বস্তা রেখে অন্য পাশে সারিবদ্ধ চেয়ারে আমরা বসেছি। সমুদ্র খুবই গরম। ঢেউয়ের পর ঢেউ আঘাত হানছে জাহাজের গায়ে। মস্ত বড় জাহাজ ঢেউয়ের আঘাতে হেলে দুলে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। জাহাজ নৈশ কোচের পাখার মত উপর নীচে এবং ডানে বায়ে কাত হয়ে অনেকটা লাঠিমের মত ঘূর্ণন গতিতে এগিয়ে চলছে। আঁকা বাঁকা রাস্তায় চলন্ত ট্রেন যেভাবে যাত্রীদের হয়রানী করে, জাহাজের আরোহীদেরও সেই একই অবস্থা। মনে হচ্ছিল যেন প্রতি মুহুর্তে ভূমিকম্প হচ্ছে।
মনে পড়ে ঐদিন থেকে ঠিক সাত দিন আগের সোমবারে ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ইংরেজী চট্টগ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য ছিল দশ নাম্বার বিপদ সংকেত। সে রাত এগারটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে এবং আশ পাশের এলাকায় যে ভয়ংকর ঘূর্ণীঝড় বয়ে গিয়েছিল তাকে বলা হয়েছিল ‘ম্যারি এন’।
ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে দানব রুপি ড্রাগনের নি:শ্বাসের মত যে তপ্ত ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস বয়ে গিয়েছিল তা শত বৎসরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। কবির কল্পনা, সাহিত্যিকের ভাষা, সাংবাদিকের কলম, শিল্পীর তুলি সব বোবা প্রমানিত হয়েছিল ঐ ‘ম্যারি এন’র কাছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি জেলা একে অন্যের অস্থিত্বের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে পড়েছিল। পরের দিন অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল স্থানীয় পত্রিকা অনুমান করে লিখেছিল দুই সহস্রাধিক নিহত। কিন্তু পরবর্তীতে এই সংখ্যা দুই থেকে তিন লাখের মাঝামাঝি ছিল। শুধু কুতুবদিয়া উপজেলায় মোট আশি হাজার লোকের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ নিহত হয় বলে পত্র-পত্রিকায় ধারণা করা হচ্ছিল।
মহেশখালী, বাঁশখালী, হাতিয়া, কক্সবাজার, আনোয়ারা, পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি ইত্যাদি এলাকায় পাইকারী হারে মানুষ, জন্তু নিহত হয়েছিল। এমনকি সাতকানিয়া, পটিয়া, রাউজান ইত্যাদি এলাকায় ক্ষতি হয়নি এরকম প্রতি দশ হাজার ঘরের মধ্যে একটি ঘর খুঁজে পাওয়া রীতিমত মুসিবত হয়ে গিয়েছিল।
আজকে পঁচিশ বৎসর পর (২৯ এপ্রিল ২০১৬ ইং ) এসে আমি এ দিনকে স্বরণ করছি আর ঐ দিনের সমস্ত নিহতের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। সেদিন দেশের এমন পরিস্থিতিতে নিজের উপর কিছু দায়িত্ব অনুভব করলাম। দু’এক জন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম দূর্গত এলাকার সাহায্যার্থে এগিয়ে যাব। যদিও আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। এই উদ্দেশ্যে ঘূর্ণিঝড়ের দু’দিন পর থেকেই আমরা আমাদের এলাকা থেকে ঘরে ঘরে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করেছিলাম। প্রথমে উদ্দেশ্যে ছিল বাঁশখালী যাব। অবশ্য অন্যান্য এলাকার মত আমাদের গ্রামেও ক্ষতি হয়নি এ রকম একটি বাড়িও পাওয়া যাবেনা। আমাদের পুরনো দ্বিতল মাটিয়া ঘরের অনেকগুলো টিন শূন্যে উড়িয়ে নিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়। এরকম আশ পাশের সবাইরই কমবেশী ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের দরদ, ভালবাসা, সহানুভূতি আর কাকে বলে। যখন বললাম- বাঁশখালীর জন্য সাহায্যে এগিয়ে আসুন তখন পুরুষ মহিলা সবাই সাধ্যমত দুই হাতে সাহায্য করল। এদিকে আমাদের কাছে খবর পৌছল, কুতুবদিয়ায় যেমন অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে তেমনি গত ছয় সাত দিনে কোন সাহায্যই ওখানে পৌছেনি।
সেখানে যে কয়জন লোক কোন রকমে বেঁচে আছে তারাও না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। অত:পর আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কুতুবদিয়ায় যাব স্থির করলাম। কিন্তু বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে ঝুকি পুর্ণ এই অভিযানে আমাদের সাথে যাবে কে? বিশেষ করে আবহাওয়া এখনও ঘোলাটে। সমুদ্র খুবই গরম, প্রতি দিনই থাকছে সতর্কবাণী, নৌ-যোগাযোগ বন্ধ।
শেষ পর্যন্ত অনেককে বলে কয়ে গ্রাম থেকে একজন ও শহর থেকে তিনজন পাওয়া গেল। আমরা আগে থেকেই চার জন ছিলাম। কিন্তু বাঁশখালীর পরিবর্তে যখন কুতুবদিয়া যাব মনস্থ করলাম তখন দুই জন সরে পড়েছিল। ওরা হয়ত ভয় পেয়েছিল। তবে এই পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়াটা দোষনিয় বলা ঠিক হবে না। তা যাই হোক এক্ষনে আমাদের দলে জাহাজে আমরা মোট ছয় জন। আমি, মোস্তফা কামাল ভাই, সেলিম ভাই, ফেরদৌস ভাই, আরো দুই জনের নাম এখন আমার মনে পড়ছে না। সেখান থেকে একজনের বাড়ী ছিল সম্ভবত লোহাগাড়া থানার পদুয়ায়। জাহাজের হেয়ালী পূর্ণ গতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে আমার চার জন সাথী ইতিমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওরা সবাই দ্বিতলার ডকের মধ্যে কেউ বমির টেবলেট খেয়ে কেউ লেবুর টুকরা মুখে দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। জাহাজে স্বাভাবিক হাঁটা যাচ্ছিল না। লোকেরা হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল যেন মাতাল হয়ে চলাফেরা করছে। কিছু না ধরে হাঁটা কষ্টকর ছিল।
সমুদ্র গরম এবং ঝুকিপূর্ণ বলে মহিলার সংখ্যা তেমন নেই। দুই চার জন যারা ছিল তারা কেউ এক পাশে চেয়ারে এবং বাকীরা মেঝেতে বসেছিল। সমুদ্র পথে এর আগে আমি একবার লঞ্চে ভ্রমণ করেছিলাম। সেবারও আমরা দলে ছিলাম ছয়জন। চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে কুতুবদিয়া, সেখানে একদিন থেকে পরদিন মহেশখালী এবং সর্বশেষ কক্সবাজার। উদ্দেশ্য ছিল ভ্রমণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে আমি কিছুটা সুস্থ ছিলাম। অন্যদের কোন অভিজ্ঞতা নেই বলে ওরা প্রথম ধাক্কাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাদের অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লাগছিল। আমি একটা টেবলেট খেয়ে টেবিলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকলাম।
বেশ কিছুক্ষণ থেকে একজন লোককে জাহাজে গণপিঠুনি দেয়া হচ্ছিল। লোকটি নাকি কার পকেট মারতে চেয়েছিল এবং একজন ভদ্র মহিলার কান থেকে স্বর্ণের দুল টানার চেষ্টা করছিল। তাই লোকটিকে জাহাজের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে আর পিঠানো হচ্ছে।
হই হুল্লোড় শুনে আমি কেবিনের বাইরে এসে দেখি ২৪/২৫ বছরের এক যুবক গণ পিঠুনি খাচ্ছে আর নিজের নাম বলছে মোহাম্মদ মুহসিন এবং বাড়ি বলছে পটিয়া। আমি নিজের জায়গায় ফিরে আসলাম। অকেক্ষণ পর জাহাজের পিছনে টয়লেটে গেছি। দেখি পিছনের ডকে ঐ লোকটিকে শুইয়ে কানের ভিতর সমুদ্রের লোনা পানি ঢেলে দেয়া হচ্ছে। লোকটিকে আগেই মারতে মারতে পরনের সমস্ত কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছিল। সমস্ত শরীরে একটা জাইঙ্গা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
লোকটির গায়ের অনেক জায়গায় কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। ব্যাপারটা দেখে আমার তেমন ভাল না লাগলেও আমি চলে আসলাম আমার কেবিনে। আগেই বলেছি যাত্রীদের অবস্থা দেখে আমিও অসুস্থ বোধ করছিলাম। টেবলেটতো আগেই খেয়েছি এখন টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।
আমার পাশের আসনে কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল। তিনি একজন ভদ্রলোকের কাছে ঝড়ের ক্ষতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। জাহাজের অনেক যাত্রীই বসে বসে ঝিমুচ্ছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল মরুভূমির বুক চিরে উঠের কাফেলার গতির মত করে। এমন সময় হঠাৎ খবর আসল মুহসিন নামের ঐ যুবকটিকে সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে।
এ খবরে সবাই চমকে উঠল, নিমেষেই দুর হয়ে গেল আমার তন্দ্রা। বলে কি? এত মারধর করার পরও লোকটির শাস্তি হল না? একেবারে পানিতে ফেলে হত্যা? তাও এই বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ মালায় নিক্ষেপ করে? হত্যা করার মত অপরাধ সে করেছে বলে তো মনে হয়না। আমি তাড়াতাড়ি কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি সবাই পেছনের রেলিং থেকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। জাহাজ কিন্তু তখনও সামনের দিকে বিরামহীন গতিতে ছুটে চলছে। তখন সময় বিকাল প্রায় চারটার মত হবে।
আমাদের জাহাজ গহিরার প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার মাঝ সাগর দিয়ে এগিয়ে চলছিল। বাঁশখালীর ছনুয়া আসতে আর বেশী দেরি নেই। চট্টগ্রামের সদর ঘাট থেকে সকাল দশটায় জাহাজ যাত্রা শুরু করেছিল। আমি ডকে বেরিয়ে মানুষের জন্য কিছুই দেখতে পেলাম না। তাড়াতাড়ি তিন তলায় উঠে গেলাম। উঠে দেখি বেশ অনেকখানি পেছনে কালো ধরনের কি একটা যেন ঢেউয়ের সাথে উঠানামা করছে। লোকেরা বলাবলি করছে ওটাই মানুষ।
ততক্ষণে জাহাজের মাষ্টারের নিকট খবর পৌছে গেছে। উনি বিজ্ঞ লোক, দেরি না করে সাথে সাথে জাহাজের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছেন। জাহাজ ধীরে ধীরে ঘুরে এবার উল্টা উত্তর মুখি চলতে আরম্ভ করল। জাহাজ ফিরতি পথে লোকটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাতেই হবে।
যাত্রী মহলের মধ্যে বলবলি হচ্ছে- লোকটিকে যে ফেলেছে তাকে ধরে রাখ। এত মারার পরও সাধ মিটেনি! আমিও বুঝতে পারছিলাম না মানুষ এখনও এরকম মুর্খ রয়ে গেছে কিভাবে। আরে! সে যদি কাউকে খুনও করে বসত তাহলে আইন আদালত থানা পুলিশ কি জন্য রয়েছে? তাকে নিয়ে এমনিতেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার আরো খারাপ লাগছিল, আমরা ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলাম কিছু দুস্থ লোকের সাহায্যার্থে। আর যাবার পথেই যদি একজন সুস্থ মানুষকে খুন করে যাই, তাহলে আমাদের সাহায্যের সার্থকতা কোথায়? জাহাজ লোকটির কাছাকাছি এসে বন্ধ হয়ে গেছে।
সব মানুষ একদিকে ঝুকে পড়েছে লোকটিকে দেখতে। জাহাজ লোকটির প্রায় সাত-আট হাতের মধ্যে চলে এসেছে। তার হাত দুটো একটু একটু নড়ছে, তবে জ্ঞান আছে বলে মনে হয়না। তাকে উদ্দেশ্য করে জাহাজ থেকে একটি রঙ্গিন জেকেট ফেলে দেওয়া হল। জেকেটটাকে পানির ঢেউ অন্য দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তারপর রশি বাধা একটা টিউব খুব কাছেই ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু, লোকটির তো হুসই নেই, সুতরাং সে কিছুই ধরতে পারলনা। উলট-পালট ঢেউয়ের আঘাতে আবার সে জাহাজ থেকে দুরে সরে যেতে লাগল।
প্রথম থেকেই ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগছিল। একটি লোক চোঁখের সামনে এভাবে মারা যাবে আর আমরা জাহাজের প্রায় দু’শ মানুষ দিব্যি তামাশা দেখব? এটা কেমন কথা! অথচ লোকটিকে বাঁচানোর কার্যকর কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করা হচ্ছে না। লোকটি আবারো ঢেউয়ের আঘাতে ভেসে যাচ্ছে দেখে আমি মোস্তাফা কামাল ভাইকে বললাম- কামাল ভাই, আমি সাগরে ঝাঁপ মারতেছি। কামাল ভাই, হচ্ছেন আমাদের ত্রাণ কমিঠির লিডার (বর্তমানে মরহুম, আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুন, আমিন)। তিনি আমাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বললেন- আপনি কি পাগল হয়েছেন? দেখছেন না সমুদ্র কি গরম! আপনাকে খুঁজতে আরো পনের জন লাগবে। আমি বললাম- কিন্তু চোঁখের সামনে একটা তরতজা জিবন এভাবে অসময়ে ঝরে যাবে অথচ আমাদের করার কিছুই নেই? আমার তো নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কামাল ভাই বললেন- জাহাজ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে, দেখেন না কি হয়।
ততক্ষণে সমুদ্রের হিংস্র ঢেউ লোকটিকে জাহাজ থেকে আবারও একশ গজের মত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জাহাজ আবার ষ্টার্ট নিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে লোকটির দিকে। আমি কামাল ভাইয়ের অজান্তে জাহাজের নীচের তলায় চলে আসলাম। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। তখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছিলাম। তবে আমার মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমুল ছিল যে লোকটিকে বাঁচাতেই হবে। কেবিনে এসেই ব্যাগ থেকে জরুরী প্রয়োজনে আনা জাইঙ্গাটা বের করে পড়ে নিলাম। জাইঙ্গাটা কেন পড়লাম তা হয়ত আমার অবচেতন মনে জানে অথবা জানেনা। আমি আসার সময় ফূল প্যান্ট পড়ে আসিনি কারণ কুতুবদিয়ায় হয়ত আমাদেরকে বস্তা কাধে নিয়ে পানি এবং কাদার মধ্যে অনেকটা পথ হাটতে হতে পারে। আমি কেবিনের মধ্যে আনমনে পায়চারি করছিলাম।
এক ফাঁকে কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি, লোকটির অনেকটা কাছে চলে এসে জাহাজটি আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। আবার রশি বাধা টিউব ছুড়ে মেরে টেনে আনা হচ্ছে। লোকটির তখন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। জাহাজের উপর-নীচের তিন সারি লোক আফসোসের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে, একটা তরতজা প্রান অকালে ঝরে যাচ্ছে। সকলেই মর্মাহত, বেদনাহত, এবং চিন্তাক্লিষ্ট। মনে হচ্ছে বোবা দৃষ্টিতে অস্তরবি দেখা ছাড়া কারো যেন কিছুই করার নেই। শোকাতুর দৃষ্টিতে উপভোগ্য দৃশ্যপটই বটে! আমার বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করছে। কোন ভয় বা শংকার লেশ মাত্র সেখানে নেই। আছে বিবেকের দংশন আর সিদ্ধান্তহীনতার যাতনা।
আমি রেলিং থেকে যখন দ্বিতীয় বার কেবিনে ঢুকি তখন আমার গায়ের সাফারী হাতে চলে এসেছে। গায়ে আছে হালকা সবুজ রংয়ের হাফহাতা গেঞ্জি। কেবিনে পায়চারি করতে করতে হাতের ঘড়ি খুলে পকেটে রেখে গায়ের অবশিষ্ট গেঞ্জিও খুলে নিলাম। এভাবে নিজের অজান্তেই নিয়ে ফেললাম চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন মোটাসোটা এক ভদ্র লোক। ক্লিন সেভড। যাবেন বাঁশখালীর ছনুয়ায়। এ মুহুর্তে রুমে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। তিনি এতক্ষণ আমাকে লক্ষ্য করছিলেন। ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে চোঁখ বিস্ফারিত করে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি সমুদ্রে ঝাপ মারবেন নাকি? আমি বললাম- হ্যাঁ, লোকটিকে যে বাঁচাতে হবে। দেখছেন না, মরে গেলই বলে!
আমার শরীর তখন উত্তেজনায় কাঁপছে। তারপর উনাকে বললাম- দয়া করে আমার কাপড় ও ঘড়ি আপনি রাখবেন, বলেই কেবিন থেকে বের হয়ে পড়লাম। তখন আমার পুরো শরীর উদোম, পরনে একটা লুঙ্গি। খালি গায়ে দেখে কয়েকজন যাত্রী এসে আমাকে ঘিরে ধরল। একজন বলল- উনি মনে হয় সাগরে লাফ মারবেন। আমি বললাম- হ্যাঁ, আমি লাফ মারব। দেখছেন না ভাই, ওর জ্ঞান নেই; রশি, টিউব কিছুই ধরতে পারছে না। এমন সময় জাহাজের একজন কর্মচারী কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে বলল- আপনি কি ঝাপ মারবেন? আমি বললাম- হ্যাঁ। সে বলল- তাহলে একটু দাঁড়ান, লুঙ্গি নিয়ে সাঁতরাতে পারবেন না। আমি একটা জাইঙ্গা নিয়ে আসি। আমি কিছু বলার আগেই লোকটি চলে গেল এবং মুহুর্ত পরে একটা জাইঙ্গা নিয়ে এল।
‘আমি জাইঙ্গা পড়েছি’- বলেই পরনের লুঙ্গি খুলে ছেড়ে দিলাম। এখন আমার জাইঙ্গা ছাড়া সমস্ত শরীর উদোম। গা দেখা যাচ্ছিল বলে লজ্জায় আমার শরীরটা সংকুচিত হয়ে আসছিল। আমি লাফ দেওয়ার জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এক পা সামনে বাড়িয়েছি- এমন সময় পেছন থেকে একজন লোককে, ‘দাঁড়ান’, ‘দাঁড়ান’ বলে হাত তুলে চিৎকার করে করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকেরা আগন্তুক কে পথ ছেড়ে দিতে লাগল। কাছে আসলেন যিনি তাঁকে তিন তলার কন্ট্রোল রুমে নাবিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিতে দেখেছিলাম। অর্থাৎ জাহাজের মাষ্টার আথবা ক্যাপ্টেন না কি যেন বলে, তাই। উনি কাছে এসে আমাকে বললেন- আপনি সত্যি ঝাঁপ দিবেন? আমি বলালাম- হ্যাঁ ! বলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম. . . . .।
মাষ্টার তাড়াতাড়ি বললেন- দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটা লাইফ জেকেট পড়ে নেন। বলেই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন। আমি যে লাফ মারতে যাচ্ছিলাম, মাষ্টারের ডাকে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য রেলিং এর একটা লোহার হাতল ধরে ফেললাম। কয়েক মিনিট পরেই মাষ্টার একটা লালে গোলাপী লাইফ জেকেট নিয়ে আসলেন এবং তা আমাকে পরিয়ে দিতে লাগলেন। মাষ্টার সহ আরো কয়েক জনে আমাকে যখন জেকেটের ফিতা বেধে দিতে লাগলেন তখন আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই জন্য যে সবাই আমাকে ভাবছে ‘হিরু’।
নিজেকে কোন বিদেশী সিনেমার রঙ্গিন পর্দার দু:সাহসী ডুবুরীর মত অনুভূত হচ্ছিল। ছোট কালে আমার শখ ছিল ডুবুরী হয়ে সাগরের তলা থেকে মুক্তা সংগ্রহ করব অথবা নাবিক হয়ে মাসের পর মাস অথৈ সাগরে হারিয়ে যাব। ছোট কালের সেই শখের কথা এ মুহুর্তে আমার মনে পড়ে গেল। সব মিলে সময় পাঁচ মিনিটও দেরী হয়নি। তৈরী হওয়ার পর আমাকে একটা রশি দেওয়া হল এবং রশির মাথা সব সময় হাতে রাখতে বলা হল। অত:পর আল্লাহর নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সু-বিশাল তরঙ্গ মালার ভিতর। সাগরের বুকে পড়েই নিজেকে পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমাকে সহ ঢেউ একটা চক্কর খেল। অত:পর স্থির হয়ে থাকালাম ঐ মূমূর্ষ লোকটির দিকে। উপর-নিচে ভাসতে ভাসতে জাহাজ থেকে আবার প্রায় বিশ-পঁচিশ গজ সরে গিয়েছিল লোকটি। আমার সাথের রশিটা কোমরের সাথে গিট দিয়ে নিলাম। এরপর প্রি-ষ্টাইলে সাঁতার দিলাম লোকটির উদ্দেশ্যে। সাঁতারের অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। স্কুল জীবনে একবার গ্রাম্য ক্লাবের আয়োজিত সাঁতার প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছিলাম।
আমার শরীরের সামনে বুকের সাথে এবং পিছনে পিঠের সাথে লম্বালম্বী লাগানো দুইটা করে এবং মাথার পিছনে পাশাপাশি একটাসহ মোট পাঁচটি শূলা। প্রত্যোকটি শূলার প্রস্ত ও বেধ তিন ইঞ্চি করে এবং দৈর্ঘ্য প্রায় বার ইঞ্চি। দুই শূলার মাঝখানে পাঁচ ইঞ্চির মত ফাঁক। এক শূলার সাথে অন্য শূলা আর্মী কালারের চওড়া ফিতা দিয়ে সংযুক্ত। অনেকটা বাচ্চা ছেলের স্কুল বেগের মত গঠন। গলার দিকে তিন ফুটের মত একটা চিকন সুতা। সুতার সাথে একটি শক্তিশালী বাঁশি বাধা থাকে যদিও এখন নেই। এই হচ্ছে সুইমিং জেকেট বা লাইফ জেকেট। যত বড় ঢেউই আসুক, এই জেকেট একজন লোককে ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম।
আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। ঢেউয়ের বিপরীতে আমাকে যেতে হচ্ছে বলে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছিল। বড় ঢেউ আসলেই নিজেকে ঢিলে করে দিই। ফলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয় এবং পরক্ষণেই আবার এগুতে শুরু করি। আমি লোকটিকে দেখতে পাচ্ছি। তবুও জাহাজ থেকে সবাই চিৎকার এবং ইশারা করে লোকটিকে দেখিয়ে দিচ্ছিল। বিরাট জাহাজের সমস্ত যাত্রী এক পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। মানুষের ভারে দানবাকৃতি জাহাজটি এক পাশে কাত হয়ে আছে। যাত্রীদের চেহারায় উৎকন্ঠার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আমি তখন তরঙ্গ মালা ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে।
অবশেষে লোকটি আমার নাগালের মধ্যে এসে গেল এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম। অত:পর লোকটিকে আমার বুকের উপর টেনে নিলাম। মাথার পিছনের শূলা আমার মাথাকে ভাসিয়ে রেখেছিল। লোকটি এখন আমার বুকের উপর সম্পুর্ন নিরাপত্তায় আছে। কিন্তু কোন হুসতো নেই-ই বরঞ্চ নাক-মুখ দিয়ে ফাঁনা বের হচ্ছে। চেহারা হয়ে গেছে মরা সাপের মত হলুদাভ। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে লোকটির নাক মুখ পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। ফলে চোঁখ, নাক এবং মুখের ভিতর লবণাক্ত পানি ঢুকে যাচ্ছে। আমি বাম হাতে ওর মাথাটি উপরের দিকে তুলে ধরে জাহাজে ইশারা করলাম ধীরে ধীরে রশি টানার জন্যে।
আমার গ্রীন সিগনেল পেয়ে জাহাজ থেকে রশি আস্তে আস্তে টানা শুরু করল। আমি তখন নিজেকে সম্পূর্ন পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমি জাহাজে থাকতেই আমার কানের প্রবেশ পথ কটন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলাম যাতে লবণাক্ত পানি মাথার ভিতর ঢুকতে না পারে। কারণ আমার ধারনা ছিল মাথার ভিতর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে চিন্তা ধারা স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না। তা ছাড়া মাঝ দরিয়ায় জ্ঞান হারাবারও আশংকা করেছিলাম। উল্লেখ্য যে সম্পুর্ন বেসরকারী আমাদের এই ত্রাণ অভিযানে আমরা খুব ছোট খাট জিনিসের প্রতিও নজর রেখেছিলাম। যেমন- মোমবাতি, ম্যাচ, কাপুর, সিপ্টেপিন, ব্লেড, টয়লেট পেপার, বোল, গ্লাস, চামচ, এমন কি আমরা সুই-সুতা পর্যন্ত নিয়েছিলাম।
আমাদের সাত বস্তা ত্রাণ সামগ্রীর প্রধান বিষয় ছিল খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ। খাদ্য ছিল চিড়াগুড়। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয়; সেটা হল লবণ তৈরীর দেশে আমাদেরকে লবণও নিতে হয়েছিল। ছোট বড় সকলের জন্যে মোট নয়শত ঊনষাট পিছ কাপড় আমাদের সাথে ছিল। এ সমস্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে কুতুবদিয়ায় আমরা বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছিল বহু নতুন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
আমরা গ্রুপিং করে করে সেখানে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছিলাম। কেউ কাপড়, কেউ খাদ্য-বস্তু, কেউ বস্ত্র-পাতি, ইত্যাদি বিতরণ করেছিলাম। সেখানকার সক্ষম এবং শিক্ষিত লোকেরা আমাদের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। সিরাজুল ইসলাম নামের গাজীপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাদেরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। শুনেছি বর্তমানে ঐ সিরাজুল ইসলাম ভাই জেলা জজ পর্যায়ের দায়িত্বে আছেন।
কুতুবদিয়ায় যখন আমরা সেবা বিতরণ করছিলাম তখন সেখানে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আমাদেরকে রুটির ঝুড়ি নামিয়ে দিয়েছিল বিতরনের জন্য। আমাদের কে দিয়েছিল কারণ আকাশ থেকে ফেলা ঝুড়িগুলো আদম সন্তানের গলিত নাড়িভুড়ি এবং প্রভূ ভক্ত জীব-জন্তুর পঁচা দূর্গন্ধ-যুক্ত পানিতে ডুবে যাচ্ছিল বলে।
সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল ডাক্তারী করা। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবেনা যে আহত হয়নি। কারো হাত কেটে গেছে, কারো পা কেটে গেছে, কারো মাথা ফেঁটে গেছে, কারো বুকে জখম হয়েছে, কারো শরীরের মাংস সহ কেউ যেন খামছে খেয়ে ফেলেছে। জখম থেকে রক্ত ঝরছিল, পুঁচ ঝরছিল, পানি ঝরছিল এবং বিনা চিকিৎসায় পঁচা দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল। কারো মাথা ব্যথা, কারো গায়ে জ্বর, কারো পেট কামড়ি, কারো সর্দি, কারো ডায়রিয়া- এই ছিল তখন এলাকাবাসীর অবস্থা।
যেখানে আমরা সেবা বিতরণ করছিলাম সেখানে গত আট দিনে অন্য কোন সরকারী বা বেসরকারী সাহায্যকারী দল পৌছেনি। আমি একেক বাড়ীতে যাচ্ছিলাম, আসলে ঘূর্ণি ঝড়ের কারণে সেখানে কোন বাড়ীর অস্থিত্ব ছিল না, ভাংগা বেড়া, টিন, গাছ ইত্যাদি মাটিতে বাঁকা করে রেখে অন্য পাশে বাঁশ খুটা দাঁড় করিয়ে কোন রকমে মানবেতর জীবন অতিক্রম করছিল এলাকাবাসী।
সেখানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটা গ্রামের একূল-ওকূল সব দেখা যাচ্ছিল। কারণ কোন গাছপালা বা বাড়ি ঘরের সজিব উপস্থিতি সেখানে ছিল না। বড় বড় গাছ যেগুলো ছিল তাও যেন এসিড দিয়ে গোসল করেছে। দ্বীপ কুতুবদিয়া যেন পুড়া ভিটার মত তামাটে হয়ে গেছে। গাছের অনেক উঁচুতে হয়ত দেখা যাচ্ছে কারো ছিড়া লুঙ্গি অথবা গেঞ্জির টুকরা, কারো ওড়না অথবা ফিতার অংশ। আমি ওদের ঝুপড়ির নিকট যাচ্ছিলাম আর ওরা ছেলেমেয়ে এবং নিজেদেরকে নিয়ে আমার সামনে আসছিল চিকিৎসার জন্য। কেউ কেউ পরনে পর্যাপ্ত বস্ত্র নেই বলে আমার সামনে আসতে পারছিল না লজ্জ্বায়। কেউ বলে ডাক্তার সাব আমার মেয়ের এই অবস্থা, কেউ বলে স্যার আমি তো মরে গেলাম। আমি তখন ডাক্তার। আমার বেশী পকেটওয়ালা সাফারীর বিভিন্ন পকেটে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ মওজুদ রেখেছিলাম। আমার পাশে পাশে মেডিকেল বক্স নিয়ে সেলিম ভাই ছিল। মেডিকেল বক্সে খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল, হিসটাসিন, এভোমিন ট্যাব, ডেটল-সেভলন, পানি শোধক ট্যাব, ডায়রিয়ার ট্যাব ও ক্যাপ, কারমিনা, বার্মার বাম, কটন ইত্যাদি ছিল।
আমি গরম পানি দিয়ে নিজ হাতে যত্নের সাথে ক্ষত স্থান ধুয়ে কটন দিয়ে পরিস্কার করে সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিলাম এবং টেবলেট ইত্যাদি কিভাবে খেতে হবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আমাকে ঘিরে জটলা হয়ে যাচ্ছে। রুগিদের আ: উ: ইত্যাদি আর্তচিৎকারে পরিবেশকে আরো বেশী বেদনাহত করে তুলছে। আমি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি এবং সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অন্য গ্র”পগুলো এলাকার অন্য পাশে যার যার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিল।
এলাকার গন্যমান্য সুস্থ লোকেরা ওদেরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। আমার সাথে সেলিম ভাই ছিল। আমার ওষুধের দরকার হলেই সেলিম ভাইকে কল করছিলাম। আর সেলিম ভাইও জ্বী স্যার, কম্পাউন্ডার হাজির, আপনার কি চাই? বলে বিনয়ের সাথে আমার সামনে মেডিকেল বক্স এগিয়ে দিচ্ছিল। সেলিম ভাইয়ের বলার ভঙ্গি দেখে আমি দু:খের মাঝেও না হেসে পারছিলাম না।
সবাই আমাকে ডাক্তার সাব, স্যার বলছে দেখে সেও নিজেকে কম্পাউন্ডার বানিয়ে নিয়েছে। সেলিম ভাইও আমার সমবয়সী সৎ, সুন্দর এবং কর্মট এক সাহসী যুবক। আর্তমানবতার সেবায় সাগর পাড়ি দিয়ে আমাদের সাথে ছুটে গিয়েছিল দ্বীপ কুতুবদিয়ায়। সেলিম ভাই একজন ব্যবসায়ী, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা করেন। বর্তমানে অনেক বড় ব্যবসায়ী।
আমি রুগিদের কারমিনা খাইয়ে দিচ্ছিলাম, ডায়রিয়ার খাবার স্যালাইন দিচ্ছিলাম। খাবার পানির কলসীতে পানি শোধক ট্যাবলেট দিচ্ছিলাম। আহত রুগীদের ক্ষতস্থান গরম পানিতে ধুয়ে কটনে ডেটল/স্যাভলন লাগিয়ে পরিস্কার করে দিচ্ছিলাম। আমি নিজ হাতেই এসব করছিলাম। ছোটকালে আমার মনটা খুবই কোমল নরম ছিল, মানুষের কষ্ট দেখলে নিজে নিজে খুব খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হত, নার্সিং এর উপর কোর্স করে রুগিদের সেবা করব, যাক।
ওদের শরীরের কাটা ঘা, বিনা চিকিৎসায় বা অযত্নে দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল অথচ আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ওদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাদের সাথে মিশে যেতে, তাদের কষ্টের ভাগ নিতে। কোন রকম বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতা আমি অনুভব করিনি। বরঞ্চ ওদের দু:খ দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না। চোঁখের অশ্রু লুকাতে এক পাশে সরে যেতাম প্রকৃতির যুদ্ধ-বিধ্বস্থ দৃশ্যাবলী দেখার ভান করে। এভাবে মানুষের সেবা করে কত আনন্দ যে পাচ্ছিলাম তা ব্যক্ত করার মত ভাষা আমার জানা নেই।
মনে মনে আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া করছিলাম এমন বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবা করার জন্য আমাকেও মনোনিত করেছেন বলে। মানুষের সেবা করে এত আনন্দ পাওয়া যায় তা আমি কখনই ভাবতে পারিনি। আমার মনে হল এই আনন্দ আমি আর কোন দিন পাবনা। তাদের সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।
সেদিনের দৃশ্য মনে পড়লে এখনও আমি অবিভূত হয়ে যাই। দূর্গতদের প্রকৃত সাহায্যতো স্ব-শরীরে দূর্গত এলাকাতে গিয়েই সম্ভব। অথচ শহরের মাঝে দূর্গতদের সমর্থনে কত জনদরদী কথার খই ফুটাচ্ছিল আর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছিল। সামান্য টাকার চেক অথবা একটি সেলাই হাতমেশিন দিয়ে পর্যন্ত ছবিসহ পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর। আমাদের ত্যাগ আর সাহসটা এমন ছিল যে ঠিকমত যোগান বা প্রচার পেলে ইহা জাতিসংঘ পুরস্কার পেতে পারত। অথবা জাতীয় পর্যায়ে মানব সেবার স্বীকৃতি পেতে পারত যদিও আমাদের সেরকম উদ্দেশ্য ছিল না। আর সেদিন যদি আমাদের সাথে একটি ক্যামেরা থাকত তাহলে আমরা বাজিমাত করে দিতে পারতাম। জলজ্যান্ত সব ছবি তুলে ধরে বিশ্বকে চকমে দিতে পারতাম।
আমি ভাবছিলাম ওদের কথা। ওরা এবং আমরা সবাই একই দেশের অধিবাসী। দেশ আমাদের সবার কাছ থেকে টেক্স বা খাজানা আদায় করে। অথবা দেশের প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের মত ওদেরও একটি ভোটের অধিকার রয়েছে। অতচ সমুদ্রতীরবর্তী এই দূর্যোগপূর্ণ এলাকাতে ওরা একা থাকছে। আর আমরা থাকছি অপেক্ষাকৃত কম ঝুকিপূর্ণ এলাকায়। অত্র লেখার মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার দাবী হচ্ছে বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নাগরিক সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করা হোক।
সমুদ্র পথে অনেক বৈদেশিক যোগাযোগ, মৎস এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সব আমরা ভোগ করব আর সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী, ইত্যাদি ভোগ করবে ওরা একা এটা কেমন কথা? অতচ এই আসমানী বালাগুলো আমরা শহর বাসীর কারনেই বেশীর ভাগ এসে থাকে। মনে পড়ে ঘূর্ণিঝড়ের কিছুদিন আগে ঢাকা গিয়েছিলাম। সেখানে মানবতার যে পাপী, ঘৃণ্য, নগ্ন চেহারা দেখেছিলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে কান্ডসমূহ দেখেছিলাম এবং সারা দেশে চেয়ার কোচের নামে যে ভ্রাম্যমান সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। চারিদিকের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝাই যাচ্ছিল যে দেশবাসীকে মহান আল্লাহ একটু সতর্ক করে দিতে পারেন। এটা তখন সময়ের দাবী ছিল বলতে হবে। দেশের চা দোকান গুলো ছিল এক একটা সিনেমা হল, ভারতীয় নগ্ন ছবি ভি.সি.আর এর মাধ্যমে ১০/২০ টাকার বিনিময়ে, চা-পরোটার বিনিময়ে এলোপাথাড়ি প্রদর্শন করা হচ্ছিল।
যাই হোক, আমরা দৃশ্য বদল করে অনেকদুর এগিয়ে গেছি। এখন আবারো আগের দৃশ্যে ফিরে আসা যাক। পূর্বোক্ত বর্ণনায় মেডিকেল বক্সে আমরা যে কটনের উল্লেখ করে এসেছি সেই কটনই সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার আগে কানের ছিদ্র পথে আটকে দিয়েছিলাম। আবারো ফিরে আসছি আগের বর্ণনায়। আমি এখন সাগরের ঢেউয়ে ভাসছি আর লোকটি আমার বুকের উপর। জাহাজ থেকে ধীরে ধীরে রশি টানা হচ্ছে। রশির টানে আমি ক্রমান্বয়ে জাহাজের বিশ হাতের মধ্যে চলে আসলাম। জাহাজ থেকে উৎসুক তিন তলার তিন সারি জনতা আমাকে উৎসাহিত করছিল।
এভাবে লোকটি সহ আমি যখন জাহাজের আরো কাছাকাছি চলে এলাম, তখন সাগরের শক্তিশালী ঢেউ এবং ছন্নছাড়া বাতাসের ঝাপটা আমাকে জাহাজের গা ঘেসে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমার বুকের উপর একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। পানি আমাকে বিপদ সীমার মধ্যে নিয়ে গেলেও ঐ অবস্থায় আমার করার কিছুই ছিল না। আমি তখন সম্পূর্ন অসহায় অবস্থায় ছিলাম।
পানির ঝাপটা আমাকে জাহাজের গা সেঁদে সেঁদে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। সাগরের ঢেউ এবং বাতাসের ঝাঁপটার এমন অশৌভন আচরণে আমি কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। ঠিক এ ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোন কৌশলই মাথার মধ্যে আসছে না। বিশাল জাহাজের ডক থেকে নিচের দিকে ইংরেজী ভী আকৃতির হওয়ায় আমি উপরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ততক্ষণে পানি আমাকে জাহাজের পেছন বরাবর নিয়ে গেছে।
এমন সময় আমার মনে পড়ল জাহাজের পেছনেই তো রয়েছে সেই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পাঁখা যার সাহায্যে দানবের মত এই বিরাটকায় জাহাজটি চলন ক্ষমতা পায়। যার নাগালের মধ্যে গেলে আমাকে ছাতু বানিয়ে ছাড়বে। এটা মনে হতেই আমি দু’হাতে এলোপাতাড়ি রশি টানতে শুরু করলাম। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল এই বিপদজনক অবস্থান থেকে তাড়াতাড়ি নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে।
আরে; রশি যত টানি তত চলে আসতেছে কেন? তাহলে কি জাহাজ থেকে ওরা রশি ছেড়ে দিয়েছে? হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা ছোৎ কেরে উঠল। আমি চোঁখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মনে হল এই প্রথম বারের মত কিছুটা হলেও আমি ভয় পেলাম। এখন কি হবে? আমি এমন অবস্থানে আছি জাহাজের কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না, আবার সংকেতও দিতে পারছি না। লাইফ জেকেটের বাঁশীও নেই যে আমার উপস্থিতি এবং অবস্থান ওদেরকে জানাব। জাহাজ বন্ধ বলে পিছনের পাঁখা না ঘুরারই কথা। কিন্তু আমি শোনেছি চলন্ত পানির ধাক্কায়ও পাঁখা ঘুরতে থাকে। তাছাড়া চলন্ত পানির মাঝে কিছু দাঁড়িয়ে থাকলে তার বিপরীত দিকের পানি এমনিতেই ঘুরতে থাকে। জাহাজের পিছনের পানিও ঘুরছিল।
আমি চিন্তা করতেছি, এ অবস্থায় থাকলে বিপদের সম্ভাবনা ষোল আনাই থেকে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা হয়ত আমার বিপদ বুঝতে পেরেই রশি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ফেলে তো আর চলে যাবেনা। এটা মনে হতেই আমি প্রথমে হাতে এবং পরে পায়ে জাহাজের গায়ে জোরে ধাক্কা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম। এবার পানিও আমাকে পিছন পানে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। প্রায় পঞ্চাশ ফিটের মত ভেসে চলার পর জাহাজের তৃতীয় তলা থেকে লোকেরা আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। ততক্ষণে রশিও পানির উপরের দিকে ভেসে উঠেছে। আমি লক্ষ্য করলাম উপরের বাম দিক থেকে রশি পিছনের দিকে চলে আসছে। তাহলে ওরা শেষ পর্যন্ত রশি ছাড়েনি? আমি বুঝতে পারলাম আমার নিরাপত্তার জন্যই রশি ঢিলে করে দিয়েছিল। উতাল-পাতাল ঢেউ আমাকে ক্রমাম্বয়ে ঘুরিয়ে জাহাজের বাম পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে গেল। আমি প্রথমে যে দিকে লাফ দিয়েছিলাম এখন ঠিক তার বিপরীত দিকে অবস্থান করছি।
এদিকে জাহাজের আড়াল হওয়ায় ঢেউ অপেক্ষাকৃত কম মনে হচ্ছে। আমি জাহাজের লোকদের ইশারা করলাম তৃতীয় তলা থেকে রশি দ্বিতীয় তলার লোকদের দেওয়ার জন্য। ওরা রশি নামিয়ে দিল। আবার দ্বিতীয় তলার লোকদের ইশারা করলাম রশি নীচের তলার লোকদের হাতে দেবার জন্য। রশি যখন নীচের তলার লোকদের হাতে চলে আসল তখন তাদের ইশারা করলাম জাহাজের মধ্যখানে যেখানে সিঁড়ি আছে সেখানে আসার জন্যে। আমার বাম হাত বন্ধ থাকলেও ডান হাতে ইশারা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে তখন ওদেরকে রশি টানার জন্য সংকেত দিলাম।
আমার মুখে তখন বিজয়ের হাসি, চেহারায় প্রশান্তি। কারণ আমার উদ্দেশ্য প্রায় সফল হল বলে। আমার সাথী যারা অসুস্থ অবস্থায় ঘুমাচ্ছিল, ছাদের উপর তাদেরকেও দেখতে পেলাম। তাদের কারো চেহারাই প্রসন্ন ছিলনা। আমার মুখে হাসি দেখে ওদের মুখে হাসি ফুটল বটে কিন্তু ওরা আমার জন্য এতই উদ্বিগ্ন ছিল যে এর জন্য অর্থাৎ আমার বাহাদুরির জন্য পরে আমাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল। কামাল ভাইতো আমাকে হারিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে কি জবাব দেবেন এই চিন্তায় অস্থির ছিলেন। বড়শি খাওয়া বড় মাছকে যেমন সূতা টান দিয়ে আবার ঢিলে করে দিয়ে মাছকে হয়রানী বা দূর্বল করা হয়, তেমনি বড় ঢেউ আসলে আমার রশিও ঢিলে হয়ে যায়। পর মূহুর্তে আবার টানা শুর” হয়।
আমি ক্রমশ: জাহাজের কাছে চলে আসতে লাগলাম। জাহাজ হিসেবে সিঁড়ি মোটেই সুবিধের ছিল না। দুই দিকে রশির গিঁট দিয়ে বেঁধে কতগুলো তক্তা পর পর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, এটাই সিঁড়ি। ডক থেকে পানি ১০/১২ হাত নীচে হওয়ায় তক্তার সিঁড়ি দিয়ে বেহুশ লোকটিকে উপরে তোলা যাচ্ছে না। এমনিতে অচেতন দেহগুলো হয় ভারি, তার উপর পানি খেয়ে লোকটির হলুদাভ শরীরটা আরো ভারী হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে বলে আমার বাহু দুটোও দূর্বল হয়ে পড়েছিল। অনেক কষ্টের পর আমার সর্বশক্তি ব্যয় করে লোকটিকে জাহাজের লোকদের হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওরা কয়েক জনে ঝুকে পড়ে লোকটিকে উপরে তোলার পর আমি বললাম- এবার আমাকেও তুলুন। কারণ তখন তক্তার সিঁড়ি বেয়ে নিজে নিজে উপরে উঠার মত শক্তি আমার অবশিষ্ট ছিলনা।
অবশেষে আমি যখন ডকে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন বিজয়ের উল্লাসে আমার সমস্ত ক্লান্তি নিমিষে দুর হয়ে গেল। অত:পর আমার পুরো গায়ে একটা বড় তোয়ালে জড়িয়ে দিয়ে কয়েক জনে ধরে আমাকে আমার কেবিনে নিয়ে আসল। ঐ অর্ধমৃত লোকটিকে আগেই দু’তলার মেডিকেল টিমের কাছে পৌছে দেয়া হয়েছিল। আমি এমনিতে তত দূর্বল ছিলাম না। কিন্তু ওদের সেবা করার আগ্রহ দেখে আমি যেন আরো বেশী ক্লান্তি বোধ করছিলাম। আমার সেবায় একজন ২৩/২৪ বৎসরের যুবক ছিল বেশ অগ্রগন্য। সে নিজের বড় তোয়ালে দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মুছে ফেলার পর ঐ তোয়ালে আমার গায়ে জড়িয়ে রাখা হল। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার সেবা করে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে। ঐ ভাইটিকে এখন পেলে আমি বুকে জড়িয়ে ধরতাম।
আমাকে বলা হল সমস্ত শরীর ঢিলে করে দিতে। আমি কেবিনে প্রথম শ্রেনীর বিশেষ ধরনের আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। ততক্ষনে উপর থেকে আমার বন্ধুরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকেরা আমার পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত মেসেজ করে দিচ্ছিল। কেউ হাত, কেউ পা, কেউবা মাথা- মনে হয় কার আগে কে ভাগ্যবান হবে তার প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। অথচ এই লোকদের মতই আরেকজন বা কয়েকজনে ঐ লোকটিকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতে আহত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সাগরে ফেলে দিয়েছিল। একই আল্লাহর একটি দুনিয়ায় কত বিচিত্র রকমের সৃষ্টি যে আছে তা ঐ আল্লাহই ভাল জানেন।
আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের আন্তরিকতা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমাকে নিয়ে ওদের তৎপরতার হিড়িক দেখে আমার বিশ্বকাপ ফুটবল হিরো ম্যারাডোনার কথা মনে পড়ল। খেলার বিরতির সময় ম্যারাডোনাকেও এভাবে শরীর মেসেজ করে দিতে দেখেছিলাম টিভির পর্দায়।
ওদিকে আমাকে নিয়ে ততক্ষণে উপছে পড়া দর্শকদের প্রশ্নের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কি নাম?
বাড়ী কোথায়?
কি করে?
থাকে কোথায়? ইত্যাদি হরেক রকমের প্রশ্ন। আমি মোস্তফা কামাল(বর্তমানে মরহুম, আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুন, আমিন) ভাইকে ইশারা করলাম ওদের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য। কারণ এত লোকের প্রশ্নের জবাব এক সঙ্গে দেয়া আমার জন্য সত্যই কষ্টকর ছিল। কামাল ভাইয়ের মুখে জবাব শোনে কেউ লিখে নিচ্ছে, আর কেউ শুনেই তৃপ্তি পাচ্ছে।
কামাল ভাইয়ের মুখে আমার নাম শুনে কেউ কেউ মন্তব্য করল বা: বা: দেখতে হবেনা নামটা কেমন। আমার মূল নাম আহমদ রশিদ বাহাদুর হলেও সবাই শেষের অংশটিই ডাকত। তবে বিশেষ মূহুর্তে আমার আব্বা আমাকে বাহার বলে ডাকতেন। নাম শুনে কেউ কেউ বলল সত্যিই ও নামের একেবারে বাস্তব প্রতিমূর্তি, বাহাদুরই বটে! দারুণ সাহস! এভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হল।
এতক্ষণ পর্যন্ত যাদের বাহুতে জোর ছিল কেবল তারাই আমার কাছে আসতে পারছিল। ঝামেলা একটু কমলে এবার মুরব্বীরা আসতে শুরু করল। কেউ বলল- বেঁচে থাক বাবা, জানিনা কোন মায়ের সন্তান। আল্লাহ তোমার হায়াত দারাজ করুক। কেউ কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। একজন বললেন- তোমার বাড়ী কোথায় বাবা? আমি বললাম- সাতকানিয়া। অন্যজন বলল- আমি বলছিলাম না, এ ঢাকার ছেলে হতেই পারেনা। এ আমাদের চাটগাঁর ছেলে, আমাদেরই ছেলে। মনে হল মুরব্বির বুকটা যেন গর্বে এক বিঘত পর্যন্ত ফুলে উঠেছে।
উল্লেখ্য যে, আমাদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষক মিলে পনের বিশ জনের একটা ত্রাণ কমিটি কুতুবদিয়া যাচ্ছিল। সে কমিটির সু-পন্ডিত ছাত্ররা চঞ্চলতায় ইতিমধ্যেই জাহাজের যাত্রীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল। আমি সাগরে যে সুইমিং জেকেট ব্যবহার করেছি সেটা তাদেরই ছিল।
আমি যখন লোকদের সাথে কথা বলছিলাম ও সেবা নিচ্ছিলাম তখন জাহাজের সহকারী নাবিক এসে আমাকে বললেন- চলুন, সাগরের লবণাক্ত দুষিত পানি আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে। পরিস্কার পানি দিয়ে গোসল করা দরকার। গেল সপ্তাহের ঘূর্ণীঝড়ে হাজার হাজার মরা মানুষ ও জীব জন্তুর মরা গলিত দেহ পানিতে মিশে আছে বলে পানিকে দুষিত বলা হচ্ছে। অন্যথায় সাগরের পানি হচ্ছে সচ্ছ, পরিস্কার এবং পবিত্র। নাবিক সাহেব আমাকে ধরে মহিলাদের বিশেষ স্নানাগারে নিয়ে গেলেন। সাপ্লাইতে পানি নাই দেখে কন্ট্রোল রুমকে বলে পানি নিলেন। আমাকে ঝরণার নীচে দাঁড় করিয়ে ইংরেজী সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নতুন পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে গা মুছে দিলেন। তিনি নিজ হাতেই সব করলেন। আমি লক্ষ্য করলাম আগের সেই বড় তোয়ালে দিয়ে গা মুছলেন না। কারণ ঐ তোয়ালেতে জীবানু থাকার সম্ভাবনা আছে। গোসল শেষ করে তিনি আমাকে রুমে পৌছে দিয়ে গেলেন।
তারপর জাহাজের মাষ্টার এসে আমার সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দেবার জন্য কর্মচারীদের বলে গেলেন। তিনি আমার সাথে কৌশল বিনিময় করলেন। কিছুক্ষণ পর আমার সাথে যিনি দেখা করতে আসলেন তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। উনারাও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলেন। স্যারের পরিচয় পেয়ে আমি পাশের সিটে গিয়ে আমার সিট খালী করে স্যারকে বসতে দিলাম।
আমার পাশে বসেই স্যার আমাকে ঝাঁপটে ধরলেন এবং বললেন- যুবক, তোমার সৎ সাহস দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি। আরো অনেক্ষণ কথা বলার পর স্যার মানিবেগ থেকে দু’টো ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। তারপর বললেন- বাহাদুর, এই কার্ড দুটো তুমি রাখ। এতে একটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরটা চট্টগ্রাম শহরে আমার ঠিকানা। তিনি আরো বললেন- জানিনা আমি তোমার কোন উপকার করতে পারব কিনা, কিন্তু যদি তুমি মনে কর আমি তোমার কোন উপকারে আসব; তাহলে আজ নয়, এক বৎসর বা দুই বৎসর নয়, দশ বৎসর পর হলেও তুমি যদি আমার কাছে আস তাহলে আমি তোমার জন্য সম্ভব সব রকম চেষ্টা করব। স্যারের কথা আমার বেশ ভাল লাগল এবং আমি মনে মনে বেশ উৎসাহ বোধ করতে লাগলাম।
তিনি আরো বললেন- তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মত। আমাকে বড় ভাই মনে করেই তুমি আমার কাছে আসিও। আমি ধন্যবাদ দিয়ে স্যারের কার্ড দু’টো গ্রহণ করলাম।
স্যারের নাম ছিল অলক রায় এবং বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরের মোহাম্মদ আলী রোডে। স্যারের দু’টো কার্ডেই একটি করে কাঠের খুঁদাই করা শিল্প কর্মের ছবি ছিল। পরে শুনেছিলাম ঐ শিল্প কর্মের জন্যে উনি স্বর্নপদক পেয়েছিলেন।
এই ঘটনা যখন আমি লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিই তখন স্যারের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ করেছিলাম। স্যার উত্তরও দিয়েছিলেন। তবে স্যারের কথামত কোনদিন স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। সেদিন স্যার আমাকে ফিরতি চিঠিতে লিখেছিলেন-
‘‘¯স্নেহের বাহার,
তোমাকে ভুলিনি। জীবনে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ সচরাচর ঘটেনা। এই সাহসী যুবকের কথা অনেককেই বলেছি। তোমার সেদিনের অনুভূতি লিখতে চাচ্ছ জেনে খুশী হয়েছি। টেলিফোন করে যে কোনদিন সন্ধ্যার পর আসতে পার।
জানিনা তোমার দেয়া ঠিকানায় আমার এ চিঠি পৌছাবে কিনা। যা’হোক, তোমার সাক্ষাতের অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ কামনা রইল।
অলক স্যার,
১৮/০৯/১৯৯৬/চট্টগ্রাম ’’
জাহাজের ভিতরে অনেক্ষণ পর্যন্ত লোকের বেষ্টনির মধ্যে বন্ধি অবস্থায় ছিলাম বলে অশ্বস্তি বোধ করছিলাম। ওরা আমাকে বের হতে দিচ্ছে না আমার কষ্ট হবে বলে। প্রায় দু’ঘন্টা পর যখন দ্বিতলায় উদ্ধারকৃত লোকটিকে দেখতে গেলাম তখনও ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম-ওর অবস্থা এখন কেমন? একজন বলল- এই মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। আমি দেখলাম লোকটি একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে তখনো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে।
দর্শকদের থেকে একজনে লোকটিকে বলল- তোমাকে কে উদ্ধার করেছে তাকে জান তো? সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল- জানি। ঐ লোকটি আবার বলল - তাহলে দেখাও তো এখান থেকে কে সেই উদ্ধারকারী। আমার গায়ে তখন বাদামী রঙের একটা হাতা গেঞ্জি এবং পরনে একটি রিলিফের লুঙ্গি। মাথার চুল এলো মেলো ভাবে কপালের চার পাশে ছড়িয়ে আছে। গোসলের পর হাতের কাছে চিরনি পাইনি। লোকটি চোঁখ মিট মিট করে একে একে সবার দিকে তাকাল। কিন্তু উদ্ধারকারীকে চিনতে পারল না।
ঐ লোকটি এবার আমার কাধে হাত দিয়ে বলল- এ-ই তোমাকে জিবনের বিনিময়ে ভয়ংকর সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ থাকিয়ে থেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে অপ্রস্তুত ভাবে এদিক ওদিক থাকাতে লাগলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর সে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে আমাকে নানা রকম দোয়া করতে লাগল। আমি বললাম- আপনার নাম কি? সে ক্ষীন কণ্ঠে বলল-মোহাম্মদ মুহসিন। বাড়ী কোথায়- পটিয়া। এখন কেমন বোধ করছেন? সে জবাব দিল খুব ভাল। একজন দর্শক আমাকে জানাল ডাক্তার বলেছেন আর দু’এক মিনিট হলেই মারা যেত। তারপর ঐ দর্শক আবার বলল-আপনি না হলে ও নির্ঘাত মারা যেত। তার কথার সমর্থন জানাল আরো কয়েক জনে। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম- আপনাদের এ ধারণা ঠিক নয়। বাঁচা মরার ফয়সালা তো হয় আল্লাহর দরবারে। কোন মানুষ অন্য মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেনা। তারা বলল- তাতো বটেই, তবে আপনি হচ্ছেন উছিলা।
এরপর আমি মুক্ত হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজের তৃতীয় তলায় উঠলাম। এখানে এক পাশে যাত্রীদের বসার গ্যালারী মধ্যখানে খালী এবং অপর পাশে জাহাজের কট্রোলরুম। উড়ন্ত বিকেলের দখিণা বাতাস কিছুক্ষণের মধ্যেই হাড়-কাঁপিয়ে দেয়। আমার কপালের এলোমেলো চুল বাতাসের সাথে উড়ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুক ভরে একটু শ্বাস নেব সে ফুরসত আমার কোথায়। আমাকে দেখেই লোকেরা কানাকানি আরম্ভ করে দিল। কেউ বলে- এই সেই যুবক যে অন্যের জন্যে নিজের জান বিপন্ন করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেউ বলে দারুণ সাহস। কেউ বলে বাপের বেটা!
দু’এক জন আমার সাথে সাহস করে কথা বলেছে তো চারিদিকে জড়ো হয়ে লোকেরা আমাকে ঘিরে ধরছে। আমি কিন্তু নার্ভাস বোধ করছিলাম। লজ্জায় আমার ইচ্ছে হচ্ছিল কোন গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। শেষ পর্যন্ত আর বের হব না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেবিনে ফিরে আসলাম। সেখানেও দেখি একই অবস্থা, একই বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। আমাকে পেয়ে আলাপের মধ্যমণি করে আসন খালি করে দিল।
উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল আমাকে বললেন- আপনি কুতুবদিয়ায় আমাদের বাড়িতে চলুন। ঝড়ে আমাদের বাড়ির তেমন ক্ষতি হয়নি। আশ্রিত অনেক লোক আছে, তবে আপনি আসলে দ্বিতলার একটি রুম খালী করে দেয়া যাবে। আমি উনাকে বললাম-ভাই, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা যাচ্ছি একটা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা এতদুর সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি যে, প্রয়োজনে প্রত্যেকে বস্তা কাধে নিয়ে ছয়-সাত মাইল ভিতরে নিয়ে যাব যেখানে আজ পর্যন্ত কোন সাহায্য পৌছেনি।
বাবুলকে আমি আরো বললাম- এক্ষণে আমি যদি আপনার সাথে চলে যাই, তাহলে আনন্দঘন সেই স্বর্গীয় মূহুর্ত থেকে বঞ্চিত থেকে যাব। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আর জোর করলেন না।
অনেক্ষণ থেকে একটা বিষয় আমার মাথায় আসছিল না। সেই লোকটিকে পানিতে ফেলার পর থেকে যে ফেলেছে তাকে খুঁজছে সবাই। লোকটিকে একজনেতো আর ফেলতে পারেনি, তবে নিশ্চয় একজনের নেতৃত্বে কয়েকজনে মিলে ফেলেছে। ঐ নেপত্য নায়কটাকে উদ্দেশ্য করেই সবাই কথার ঝাল মিটাচ্ছে। অনেকে মন্তব্য করেছে তাকেই সাগরে ফেলে দেয়া উচিত। কেউ কেউ বলছে- তাকে দশ বার ফাঁসি দেয়া উচিত।
কেউ বলছে তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হোক। কিন্তু লোকটি সেই যে গা ঢাকা দিয়েছে আর কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ আর তেমন আগ্রহও দেখায় নি। তবে একজনে মন্তব্য করেছিল লোকটির গায়ে লাল গেঞ্জি আছে। এখানেই আমার খট্কা। আমি উপরে নিচে কোন লাল গেঞ্জি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য আমি খুঁজেছি তাও নয়। গত প্রায় দুই ঘন্টা ধরে আমার সাথে তিন জন লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে বাবুল। অপর দুই জন পরে এসেছে।
এরমধ্যে একজন আমার বাড়ী সাতকানিয়া শোনে, সাতকানিয়া সরকারী কলেজ, ভোয়ালিয়া পাড়া, জাফর সাদেক ভাই অনেক কিছু নির্ভূল পরিচয় দিল। লোকটি আরো জানালো সে সাতকানিয়া কলেজের ছাত্র। গত প্রায় দুই তিন বৎসর আগে চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছে, এখন কোথাও মাস্টারি না কি করে।
ফর্সা রঙের হালকা-পাতলা গঠনের লোকটির পরনে লুঙ্গি। গায়ে লাল হাফ হাতা গেঞ্জি, মাথার চুল ছোট করে ছাটা, ক্লিন সেভড, চোঁখ দু’টো সামান্য ট্যারা। কথা বার্তায় আমার সাথে ভালই ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। সেই যে প্রথমে আমার সামনে বসেছিল দিনের আলো থাকতে আর উঠেনি। এরই মধ্যে একজন এসে আমাকে ইশারা করে গেছে ; মনে হয় আপনার সামনের এই ব্যক্তিই লোকটিকে সাগরে ফেলে দিয়েছিল। হঠাৎ আমার মনে হল লোকটির গায়ে তো লাল গেঞ্জি। তাহলে কি.............।
হ্যাঁ, লোকটির সাথে এতক্ষণ কথা বলে আমার যে ধারনা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে এরকম একটা কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব। আর যদি তা হয়ে থাকে তাহলে যে ওর তারিফ করতেই হয়। কারণ একেবারে আমার সাথে বন্ধুত্ব। তার মানে সে ধরেই নিয়েছে বাঁচার এটাই পথ। আমার চিন্তাশ্রোত এক জায়গায় এসে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছে। খেই হারিয়ে ফেলছে এইজন্য যে আমরা এত কষ্ট, এত ত্যাগ স্বীকার করে যে দূস্থ-দূর্গত-মূমূর্ষ লোকদের জন্য কিছু সাহায্য নেবার চেষ্টা করছিলাম। যার উপর দিয়ে বয়ে গেছে অগ্নিবৃষ্টি বা এসিড বৃষ্টির সাথে জলোচ্ছ্বাস এবং সোয়া দুই’শ কিলো বেগে ঘূর্ণিঝড়। লোকটির বাড়ি হচ্ছে সেই কুতুবদিয়ায়। আমি ধীরে ধীরে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবনার অতল গহবরে..............।
==============
বিষয়: বিবিধ
৮০২৯ বার পঠিত, ৫৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভয়াবহত ঘূর্ণীঝড়ের কারণে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক কঠিন অনেক কষ্টের ,কিন্তু কই সবাই এগুলো ভুলে গিয়ে শুধু হিংসার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে দিয়েছে।
সুন্দর বলেছেন । আন্তরিক ধন্যবাদ ।
বি.দ্র. ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বলিত পোস্টটি স্টিকি করার জন্য মডুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তাই একই পর্বে দিয়েছি ।
মডু মামা/মামীরা এসব বিষয়কে সিরিয়াজ ভয় পায়। অতিরিক্ত ভয় + ফূল স্পীডে বুক কাঁপা মডারেশ্যনের জন্য ক্ষতিকর। তাই এরকম শিরোনামের কোন পোস্ট স্টিকি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মামা/মামীরা।
আপ্নাদের বিশ্বস্ত,
মডু'র ভাগিনা
আশায় বুক বাধা ভাল ।
অসাধারণ পোষ্টটি স্টিকি করার জন্য।
২৯শে এপ্রিল কোনদিন আমার স্মৃতি থেকে মুছবে না।
আপনি সাহসী, তার চেয়ে বড় কথা আপনি মানবিক, আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি আল্লাহকে ভালবাসেন এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কাজ করেন। মানুষের কাছে স্বীকৃতি না পাওয়াই ভাল, তাহলে পুরোটা আল্লাহর কাছে জমা থাকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন
উপকুলীয় জনগোষ্ঠীর সাথে শহুরে লোকজনের তুলনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসতে ভাসতে এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে আমাদের নিয়মনীতি সব ধুয়েমুছে গিয়েছে, অথচ এর জন্য আমাদের কোন লজ্জাবোধ বা দুশ্চিন্তাও নেই। এই জাতিকে রক্ষা করা দুরূহ মনে হচ্ছে।
ঘটনাটি আমাদের সাথে শ্যেয়ার করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ
মানুষের কষ্টের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
সুন্দর উৎসাহমূলক মন্তব্যের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ । এতদিন মানুষ দেশ ছেড়ে থাকে কি করে আমি বুঝিনা ।:
মানুষ দেশ ছেড়ে থাকে কি করে আপনার বুঝার কথা না, আপনাকে যেহেতু থাকতে হয়নি কখনো। তবে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা বলে একটা ব্যাপার আছে যেটা আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বোঝেনা। আমাদের শিল্প সাহিত্য বরাবরই প্রবাসীদের দোষ দিয়ে থাকে, তারা ক্যারিয়ারিস্ট, দেশ ও দশের কথা ভাবেনা, বাবামাকে দেখেনা- ভাই, দেশ ডুবতে বসেছে, এমন অবস্থায় দেশটা ভেসে আছে প্রবাসীদের রেমিটেন্সের ওপর, এক একজন প্রবাসী নিজের পরিবার ছাড়াও ভাইবোন আত্মীয়স্বজনের পরিবার টানে, দেশের বাড়ীতে স্কুল মসজিদের জন্য খরচ করে। ঘুষ খাবেনা বলে বাবামা ছেলের ইনকামে সন্তুষ্ট না বলেই যে ছেলেটাকে দেশ ছাড়তে হয় সে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো ছাড়া বাবামায়ের জন্য আর কি করতে পারে? অন্যের জুতো পায়ে না দিয়ে তাকে বুঝা কি সম্ভব? একইভাবে অন্যের অবস্থান না বুঝে তাকে দোষারোপ করাও অনুচিত। মানুষকে বিচার করার অধিকার আল্লাহ মানুষকে দেননি। ব্লগে প্রায়ই এই ধরনের লেখা দেখি, তখন আর মন্তব্য করতে ইচ্ছা করেনা। আপনি বুঝদার, তাই আপনাকে বললাম। কিছু মনে করবেন না। সালাম।
শুধু আমাকে নিয়ে আপনার অনুভূতির জবাব দিতে ব্লগে একটি পোষ্ট দিলাম।
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/2668/rashic/44242
অনেক কিছুই জানা হলো ১৯৯১ এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং আপনাদের ত্রাণ অভিজ্ঞতার মাঝে। আপনাদের মতো দুঃসাহসীরা আছে বলেই সমাজটা এখনো টিকে আছে.....
ভাল কাজ করার লোক যুগে যুগে ছিল, আছে, থাকবে। তবে সঠিক যোগানের অভাবে অনেকের ইচ্ছা থাকলেও উপায় করতে পারেন না । বর্তমানেও কিছু সামাজিক কাজ করার ইচ্ছাকে বুকে ধারন করে এগিয়ে যাচ্ছি । আল্লাহপাক চাইলে মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই । চট্টগ্রামের আনোয়ারায় আত্বীয়তা করেছেন শুনে ভাল লাগল । অন্তত কোন একদিন দেখা হবার সম্ভাবনা উকি দিল । আগামীকাল সকালেও আনোয়ারা যাবো, একটি চক্ষুশিবির অনুষ্ঠানে মেহমান হিসেবে । ওটা হচ্ছে আনোয়ারার বুরুমছড়া ।
ভাল থাকবেন এবং দোয়া করবেন ।
আরেকটা কথা...কিছু যদি মনে না করেন...কিছু বানানে, শব্দে কিছু ভুল আছে। ওগুলো যদি একটু ঠিক করে নিতেন, খুব ভালো হতো। এটা আসলে একটা ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট মনে হচ্ছে আমার কাছে। তাই এর যথাযথ সংরক্ষন জরুরী। তাই বললাম। আপনার যদি সময় না থাকে আপনি চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি।
জাযাকআল্লাহ
লেখা দেইখা মনটা প্রথম হইছিলো খুব ঘোলা।
সেই কখন যে পড়েছিলাম সাইমুম সিরিজ বই
মাসুদ রানাও থাকতো হাতে, বনহুর ছিলো সই।
সাগড় বিজয় অভিযানের কাহিনী এই পড়ে
যেন আমি হারিয়ে গেলাম সাইমুমের সেই ঝড়ে।
জীবন উজাড় করেই যেন আহমদ মুসাই ফের
সাগড় বুকে ঝাঁপ দিতে তাই করলোনা খুব দের।
মনটা প্রথম হইলেও ঘোলা এক নিমিষেই শেষ
দস্যু বনহুর পড়ার মতোই দাড়িয়ে গেলো কেশ।
বাহার ভাইকেও চেনাও হলো ভীতি হইলো দূর
ভয় কি আবার থাকতে এমন ভাই বড় বাহাদুর।
এমন বাহাদুর যেন ফের যুগে যুগেই আসে
মুহসীনরাও নতুন জীবন পেয়ে যেন হাসে।
আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই ।
‘সাগর’নামের অত্র লেখাটি পুস্তিকাকারে ছাপানোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে । লেখাটি পড়ে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করে যারা মন্তব্য করেছেন তাদের নাম ঠিকানাসহ উক্ত মন্তব্য বইর শেষের দিকে ছাপানো হবে । যারা এখনও মন্তব্য করেননি তাদেরকে মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করছি ।
বিশাল লেখা, পুরো আরেকদিন পড়ব, ইনশাল্লাহ।
শিক্ষণীয় এবং অনেক অভিজ্ঞতার সঞ্চয় আছে..বাকী মন্তব্য পরবর্তীতে..
ধন্যবাদ আপনাকে ।
আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে আপনার সাথে দেখা হবে।
-------------------------------------------------
১। কথা দিয়েছিলাম পুরো লোমহর্ষক কাহিনী আরেক দিন পড়ার। পড়লাম, এক নি:শ্বাসে! সত্যিই আপনি বীর বাহাদুরই বটে! আমাদের দেশে এত টিভি নাটক, সিনেমা, টেলি ফিল্ম রচিত হয় কল্পনাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে। তাতে সত্যের লেশও মাত্র থাকে না! সাময়িক উল্লাস এবং কিছু বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল করার জন্য। এমন কাহিনী দিয়ে তো কিছু একটা করা যাবে সেটা নিশ্চিত। যার নায়ক স্বয়ং এখনও আছেন। হয়তবা ভবিষ্যতে আমাদের কাঙ্খিত আশা পূরণ হতে পারে।
২। ২৪ বৎসর পরেও লিখলেও আপনার স্মৃতিতে তা জীবন্ত রূপেই ফুটে উঠেছে।্বোয়ালখালীতেও প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে যার সাক্ষী তো আমরা। এখানে রাউজানের কথা এসেছে, কিন্তু ঘুর্ণিঘড় গোর্কির গতিপথ -বোয়ালখালীর পড়েই রাউজান পড়ে। সে হিসেবে বোয়ালখালীর কথা একটু উল্লেখ করলে ভাল হতো।
৩। ১৯৯১এর কিয়ামতের বিভীষিকার আগে অনেকেরই ধারণা ছিল এমন যে, আমাদের চট্টগ্রামে কোনদিন ঘূর্ণিঝড় বা অন্য কোন বালা মুসিবত আসবে না! আসতে পারে না কারণ চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল-যার প্রয়োজনও ছিল।
৪। পরিশেষে আপনার কলমের তুলিতে এমন একটি স্মরণীয় ঘটনার কথামালা পড়লাম যার সাক্ষী তো ছিলামই তবে লেখার চিন্তা করিনি। আপনি আমাদের সে আশা পূরণ করেছেন। একজন বিপদগ্রস্ত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তরঙ্গ-বিক্ষুদ্ধ সাগরের উর্মিমালার সাথে যুদ্ধ করে উদ্ধার করেছিলেন (আল্লাহর অশেষ দয়ায়) তার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।
অসাধারণ মন্তব্য করেছেন মিয়াজী ভাই যদি আমার প্রশংসা বেশী হয়ে গেছে। কেউ আমার প্রশংসা করলে আমি একেবা্রেই নার্ভাস হয়ে যাই। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
দোয়া করবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন