তরুণ কলামিষ্ট তারেকুল ইসলামের লেখাটি পড়ে ভাল লাগল
লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ০৬ অক্টোবর, ২০১৩, ০৯:২৬:২০ রাত
সম্প্রতি সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত `ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া' শীর্ষক আন্তর্জাতিক গণবক্তৃতা ও সম্মিলনী সেমিনারে বিশিষ্ট কয়েকজনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার।
-তারেকুল ইসলাম
১.
আওয়ামী লীগের শাসনামলেই কবি শামসুর রাহমানের ওপর হামলা, যশোরে উদীচির অনুষ্ঠানে এবং রমনার বটমূলে বোমা হামলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের সূত্রপাত। অথচ ডা. দীপু মনি ঐ সম্মিলনে বলেছেন, "২০০৬ সালে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। সে সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়। ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়"। বিএনপি আমলের এই ঘটনাগুলো সত্য; কিন্তু জঙ্গিবাদের সূচনা বিএনপি'র আমলে হয় নাই, হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে ছিয়ানব্বই'য়ে ক্ষমতায় আসার পর। আওয়ামী লীগাররা প্রায়ই বলে থাকে যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে জঙ্গি উত্থান ঘটে। তাদের এই কথার জবাবে বলা দরকার, কিন্তু সব জঙ্গি তো ধরা খেয়ে ফাঁসির দণ্ড পায় বিএনপি'র আমলে। উভয়ের আমলেই যখন এত জঙ্গির উৎপাত; তাহলে জঙ্গি দমনের পুরা কৃতিত্বই তো বিএনপির দেখা যাচ্ছে। শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইদের মতো প্রতিষ্ঠিত জঙ্গিরা বিএনপির আমলেই ফাঁসির দণ্ড পায় এবং জেএমবিকে নির্মূল করেছিল এই দলটিই। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রপাগান্ডার জোরে সেই কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিতে চায় বিএনপির সাফল্যের ঝুলি থেকে।
২.
শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক রোহান গুনারত্মে বাংলাদেশ থেকে উগ্রধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা রুখতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, "বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তবে এখনও তা অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় পৌঁছেনি। এখনই ব্যবস্থা নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী। এটা মৌলবাদিতা রুখতে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। ...আফগানিস্তানে তালেবানদের দ্বারা হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে একইভাবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের বুদ্ধিভিক্তিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য ইতিহাস সম্মিলনীর মতো এ ধরনের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ"। কিন্তু গত মাসের শেষের দিকেই তো শ্রীলঙ্কায় উগ্র জাতীয়তাবাদী সিংহলী দল এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে মসজিদে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদের আগ্রাসনের মুখে সংখ্যালঘু মুসলমানরা অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। অথচ সেইসব বিষয়ে কিছুই বলেন নাই শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক গুনারত্মে। থুথু মারি এইসব কথিত স্বার্থবাজ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবসায়ী অধ্যাপকদের।
৩.
সম্মিলনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, "ধর্মকে ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন তাঁরা একটি নীতি নিয়েছিল। ভাগ কর, শাসন কর। এই নীতি নেয়ার ফলে তাঁদের শাসন করতে সুবিধা হয়। পাশাপাশি তখন মুসলিম লীগও ধর্ম ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিণতিতে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ভাগ হয়"। বুঝলাম মুসলিম লীগ ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে; কিন্তু পাশাপাশি ভারতের গান্ধী-নেহরুর তৎকালীন কংগ্রেস, এবং বিজেপি'র মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক দলও কি রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার করে নাই বা করে না? ভারতের তীব্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদদের মদতে দাঙ্গা ঘটিয়ে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, বাবরি মসজিদের জমি নিয়ে আদালতের রায়ে বিচারের নামে তামাশা বা প্রহসনের নাটক দেখেছি, বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদীর ইন্ধনে গুজরাটের রায়টে কয়েক হাজার মুসলমান মারা যায়, বালাকোটের দাঙ্গার কথাও মনে পড়ে (ভারত সেকুলার রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও!)। কই এইসব কিছু তো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মুখ দিয়ে বের হলো না। এগুলো তো সত্য ইতিহাসই। এক কানা চক্ষুবিশিষ্ট এইসব পেইড বুদ্ধিজীবীরা মুসলমানদের পাছার গু'য়ের দিকেই নজর রাখেন বেশি।
৪.
আবুল বারকাত তার সহজাত দালালির ভূমিকা নিয়ে বলেছেন, "দেশে গত ৪০ বছরের মৌলবাদের অর্থনীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর মৌলবাদের অর্থনীতির মাধ্যমে তাঁরা নিট মুনাফা করে ২ হাজার কোটি টাকা। দেশের ১২টি সেক্টরে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। প্রথম তাঁরা ’৭১ সালে লুটপাটের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহ করে"। প্রকৃত ইতিহাস হলো, একাত্তর সালে পরাজিত পাকিস্তান আর্মির রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাংক, গোলা-বারুদসহ যাবতীয় যুদ্ধাস্ত্র লুটপাট করে নিয়ে যায় ভারত। এই ইতিহাস সবাই জানেন। অথচ বারকাত মার্কা রাসভতুল্য এইসব বিকৃত তথ্য আমরা নতুন করে পেলাম। এছাড়া বারকাত সাহেব আরো বলেছেন, "দেশে জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। বিগত বছরগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষা কয়েকগুণ বেড়েছে। এখন প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদ্রাসার ছাত্র। মাদ্রাসা পড়াদের ৭৫ ভাগই হলো বেকার"। মাদ্রাসা পড়–য়া বেকার ছাত্রদের নিয়েও দেখি আজকাল বারকাত সাহেব চিন্তা করেন!! তার অঙ্কের সূত্র ধরেই বলি, প্রতি দুইজন বেকার আধুনিক শিক্ষার ছাত্রের বিপরীতে একজন বেকার মাদ্রাসার ছাত্র তো অনেক ভালো! আগে সাধারণ পাবলিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষিত বেকার ছাত্রদের বেকারত্ব দূর করার চিন্তা করা উচিত বারকাত সাহেবের।
৫.
আরেক দেশস্বীকৃত ভারতের দালাল ড. গওহর রিজভী বলেছেন, "বাঙালীর রক্তের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবাহিত হচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবেই এ দেশের মানুষ চিরকালই উদার ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। কখনই অন্য ধর্মের প্রতি আঘাত হানেনি। সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে"। তার কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে গণভোট কিংবা গণজরিপ করা হলেই প্রমাণ হয়ে যাবে বাংলাদেশের মানুষ আগে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বোঝে কি বোঝে না? যেখানে শুধু 'অসাম্প্রদায়িকতা' কথাটা বললেই যথেষ্ট, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে অসাম্প্রদায়িক বানানোর প্রকল্প 'অলস মস্তিষ্কের আতিশয্য' ছাড়া আর কিছু নয় থেকে যাবে।
৬.
এছাড়া সম্মিলনে 'ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ' 'ধর্মনিরপেক্ষ দক্ষিণ এশিয়া' গড়ার ব্যাপারে উপস্থিত সকল বক্তাই একমত হয়েছেন। সম্মিলনে মূল বক্তা ভারতের জামিয়া মিল্লাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুশিরুল হাসান বলেছেন, "অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র পথ। এর কোন বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্ম বিরোধিতা নয়"। তার কথা শুনে আমার মনে হলো, যদি তিনি সেকুলারিজমের বাংলা শব্দ 'ধর্মনিরপেক্ষতা' করে থাকেন তাহলে সকলেরই বিভ্রান্ত হওয়ার কথা। তিনি সেকুলারিজমের বাংলা শব্দকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' বলেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেকুলারিজমের বাংলা শব্দ 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বলাটা সবচে বড় বিভ্রান্তির বিষয়। যেখানে রাষ্ট্র এবং সমাজকে ধর্মবিযুক্ত রাখাই সেকুলাজিমের প্রধান ধর্ম, সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি অতি মধুর হলেও সেকুলারিজমের বাংলা শব্দ হিসেবে এর ব্যবহার প্রতারণামূলক। তাই তো বলা হচ্ছে, "ধর্মনিরেপক্ষতা মানে ধর্মবিরোধিতা নয়"। সেকুলারিজমকে এইদেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কৌশলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এর বাংলা শব্দ করা হয়েছে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। সেকুলারিজমের উদ্ভব ইউরোপে- রাষ্ট্র এবং গীর্জার মধ্যে হাজার বছরের দ্বন্দ্ব ও বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই সেকুলারিজম নামক প্রপঞ্চের জন্ম। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে গীর্জা তথা খ্রিস্টধর্মের প্রভাব থেকে সর্বাত্মকভাবে মুক্ত করে মানুষের জ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা রাষ্ট্রপরিচালনার উদ্দেশ্যেই প্রটেস্ট্যান্টদের জোর প্রচেষ্টায় সেকুলারিজম নামক মতবাদের উৎপত্তি। আর আমাদের এই জনপদের ইতিহাসে ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের সেরকম কোনো সংঘাত সৃষ্টি হয়নি যে, ইউরোপের কাছ থেকে সমাধানের কোনো মন্ত্র আমদানি করতে হবে।
যা-ই হোক, এখন যেসব মুসলিম নামধারীরা রাষ্ট্র এবং সমাজকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাখার পক্ষে তাদেরকে আমি 'প্রটেস্ট্যান্ট মুসলিম' বলে অভিহিত করি। আমার মতে, ইহজাগতিক পরিমন্ডলে বসবাস করে সেকুলার হওয়ার চেয়ে নন-সেকুলার হওয়ার মধ্যেই গৌরব বেশি। কেউ ব্যক্তিগতভাবে সেকুলার হলে কার বাপের কী আসে যায়। কিন্তু সেকুলারিজমের পক্ষ থেকে সবচে বড় হুমকি হলো রাষ্ট্রনৈতিক। সেকুলারিজম তখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন সে রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। এমনকি রাজনৈতিক সেকুলার বয়ানে ধর্মবিশ্বাসীদের উপেক্ষা করা বা এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেও প্রচন্ড সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়। আমাদের এই তীব্র ধর্মপ্রাণ জনসমাজকে উপেক্ষা করে সরাসরি বাংলাদেশকে সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করা হলে কামাল আতাতুর্কের বিভীষণ সেকুলারি দানব রাষ্ট্রযন্ত্রে চেপে বসার সম্ভাবনা বেশি। ধর্ম পালনের মানবিক অধিকার হরণের ভয়াবহ সেকুলার রাজনীতির ইতিহাস তো তা-ই বলে।
লিংক:https://www.facebook.com/tarequl.islam.549/posts/426412764129520?notif_t=like
বিষয়: বিবিধ
১৪৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন