ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল’ ৯১ ইং স্বরণে...[গতকালের পর/শেষ পর্ব]

লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:৪১:২৮ সন্ধ্যা

(গতকালের পর)

২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ ইং স্বরনে....

সাগর, একটি লোমহর্ষক সমুদ্র অভিযান/ইহা একটি সত্য ঘঠনা )


গত কাল যারা ১ম পার্ট পড়েননি তাদের জন্য লিংক-

Click this link

আমরা গ্রুপিং করে করে সেখানে ত্রান সামগ্রী বিতরন করেছিলাম। কেউ কাপড়, কেউ খাদ্য-বস্তু, কেউ বস্ত্র-পাতি, ইত্যাদি বিতরন করেছিলাম। সেখানকার সক্ষম এবং শিক্ষিত লোকেরা আমাদের কাজে সহযোগিতা করেযাচ্ছিল। সিরাজুল ইসলাম নামের গাজীপুর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাদের কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। শুনেছি বর্তমানে ঐ সিরাজ ভাই ডি.সি অথবা জেলা জজ পর্যায়ের দায়িত্বে আছেন।

কুতুকদিয়ায় যখন আমরা সেবা বিতরন করছিলাম তখন সেখানে সেনা বাহিনীর হেলিকপ্টার আমাদেরকে রুটির ঝুড়ি নামিয়ে দিয়েছিল বিতরনের জন্য।

আমাদের কে দিয়েছিল কারন আকাশ থেকে ফেলা ঝুড়িগুলো আদম সন্তানের গলিত নাড়িভুড়ি এবং প্রভূ-ভক্ত জীব-জন্তুর পঁচা দূর্গন্ধ-যুক্ত পানিতে ডুবে যাচ্ছিল।

সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল ডাক্তারী করা। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবেনা যে আহত হয়নি। কারো হাত কেটে গেছে , কারো পা কেটে গেছে, কারো মাথা ফেঁটে গেছে, কারো বুকে জখম হয়েছে, কারো শরীরের মাংস সহ কেউ যেন খামছে খেয়ে ফেলেছে। জখম থেকে রক্ত ঝরছিল, পুঁচ ঝরছিল, পানি ঝরছিল এবং বিনা চিকিৎসায় পঁচা দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল। কারো মাথা ব্যথা, কারো গায়ে জ্বর, কারো পেট কামড়ী, কারো সর্দি, কারো ডায়রিয়া- এই তখন এলাকাবাসীর অবস্থা।

যেখানে আমরা সেবা বিতরন করছিলাম সেখানে গত আট দিনে অন্য কোন সরকারী বা বেসরকারী সাহায্যকারী দল পৌছেনি। আমি একেক বাড়ীতে যাচ্ছিলাম, আসলে ঘূর্ণি ঝড়ের কারনে সেখানে কোন বাড়ীর অস্থিত্ব ছিল না, ভাংগা বেড়া, টিন, গাছ ইত্যাদি মাটিতে বাঁকা করে রেখে অন্য পাশে বাঁশ খুটা দাঁড় করিয়ে কোন রকমে মানবেতর জীবন অতিক্রম করছিল।

সেখানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটা গ্রামের একূল-ওকূল সব দেখা যাচ্ছিল। কারন কোন গাছপালা বা বাড়ী ঘরের সজীব উপস্থিতি সেখানে ছিল না। বড় বড় গাছ যে গুলো ছিল তাও যেন এসিড দিয়ে গোসল করেছে। দ্বীপ কুতুবদিয়া যেন পুড়া ভিটার মত তামাটে হয়ে গিয়েছিল। গাছের অনেক উচুতে হয়ত দেখা যাচ্ছিল কারো ছিড়া লুঙ্গি অথবা গেঞ্জির টুকরা, কারো ওড়না অথবা ফিতার অংশ। আমি ওদের ঝুপড়ির নিকট যাচ্ছিলাম আর ওরা ছেলেমেয়ে এবং নিজেদেরকে নিয়ে আমার সামনে আসছিল চিকিৎসার জন্য। কেউ কেউ পরনে পর্যাপ্ত বস্ত্র নেই বলে আমার সামনে আসতে পারছিল না।

কেউ বলে ডাক্তার সাব আমার মেয়ের এই অবস্থা, কেউ বলে স্যার আমি তো মরে গেলাম। আমি তখন ডাক্তার। আমার বেশী পকেট ওয়ালা সাফারীর বিভিন্ন পকেটে ভিন্ন ভিন্ন ওষধ মওজুদ রেখেছিলাম। আমার পাশে পাশে মেডিক্যাল বক্স নিয়ে সেলিম ভাই ছিল। মেডিক্যাল বক্সে খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল, হিসটাসিন, এভোমিন ট্যাব, ডেটল-সেভলন, পানি শোধক ট্যাব, ডায়রিয়ার ট্যাব ও ক্যাপ, কারমিনা , বার্মার বাম, কটন ইত্যাদি ছিল।

আমি গরম পানি দিয়ে নিজ হাতে যত্নের সাথে ক্ষত স্থান ধুয়ে কটন দিয়ে পরিস্কার করে সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিলাম এবং টেবলেট ইত্যাদি কিভাবে খেতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আমাকে ঘিরে জটলা হয়ে যাচ্ছিল । রুগিদের আ: উ: ইত্যাদি আর্তচিৎকারে পরিবেশকে আরো বেশী বেদনাহত করে তুলছিল। আমি অত্যন্ত ধর্য্যের সাথে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষন করছিলাম এবং সেবা দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের অন্য গ্রুপগুলো এলাকার অন্য পাশে যার যার দায়িত্ব পালন কারে যাচ্ছিল ।

এলাকার গন্যমান্য সুস্থ লোকেরা ওদেরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। আমার সাথে সেলিম ভাই ছিল । আমার ওষুধের দরকার হলেই সেলিম ভাইকে কল করছিলাম। আর সেলিম ভাই ও জ্বী স্যার, কম্পাউন্ডার হাজির, আপনার কি চাই ? বলে বিনয়ের সাথে আমার সামনে মেডিকেল বক্স এগিয়ে দিচ্ছিল। ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমি না হেসে পারছিলাম না।

সবাই আমাকে ডাক্তার সাব, স্যার বলছে দেখে সেও নিজেকে কম্পাউন্ডার বানিয়ে নিয়েছে। সেলিম ভাই ও আমার সমবয়সী সৎ, সুন্দর এবং কর্মট এক সাহসী যুবক। আর্তমানবতার সেবায় সাগর পাড়ি দিয়ে আমাদের সাথে ছুটে গিয়েছিল দ্বীপ কুতুবদিয়ায়। সেলিম ভাই একজন ব্যবসায়ী, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে ব্যবসা করেন। বর্তমানে অনেক বড় ব্যবসায়ী এবং ফ্লাট বাড়িতে থাকেন ।

আমি রুগিদের কারমিনা খাইয়ে দিচ্ছিলাম, ডায়রিয়ার খাবার স্যালাইন দিচ্ছিলাম। খাবার পানির কলসীতে পানি শোধক ট্যাবলেট দিচ্ছিলাম। আহত রুগীদের ক্ষতস্থান গরম পানিতে ধুয়ে কটনে ডেটল/স্যাভলন লাগিয়ে পরিস্কার করে দিচ্ছিলাম। আমি নিজ হাতেই এসব করছিলাম। ছোটকালে আমার মনটা খুবই কোমল ছিল, মানুষের কষ্ট দেখলে নিজে নিজে খুব খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হত, নার্সিং এর উপর কোর্স নিয়ে রুগিদের সেবা করব, যাক।

ওদের শরীরের কাটা ঘা, বিনা চিকিৎসায় বা অযত্নে দূর্গন্ধ বের হচ্ছিল অতচ আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ওদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাদের সাথে মিশে যেতে। কোন রকম বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতা আমি অনুভব করিনি।

বরঞ্চ ওদের দু:খ দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না। চোঁখের অশ্র“ লুকাতে এক পাশে সরে যেতাম প্রকৃতির যুদ্ধ-বিধ্বস্থ দৃশ্যাবলী দেখার ভান করে। এভাবে মানুষের সেবা করে কত আনন্দ যে পাচ্ছিলাম তা ব্যক্ত করার মত ভাষা আমার জানা নেই। মানুষের সেবা করে এত আনন্দ পাওয়া যায় তা আমি কখনই ভাবতে পারিনি। আমার মনে হল এই আনন্দ আমি আর কোন দিন পাবনা। তাদের সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।

সেদিনের দৃশ্য মনে পড়লে এখন ও আমি অবিভূত হয়ে যাই। দূর্গতদের প্রকৃত সাহায্য তো শ-শরীরে এলাকাতে গিয়েই সম্ভব। অতচ শহরের মাঝে দূর্গতদের সমর্থনে কত জন দরদী কথার খই ফুটাচ্ছিল আর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছিল। সামান্য টাকার চেক অথবা একটি সেলাই হাত মেশিন দিয়ে পর্যন্ত ছবি সহ পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণীঝড়ের পর। আমাদের ত্যাগ আর সাহসটা এমন ছিল যে টিকমত যোগান পেলে ইহা জাতিসংঘ পুরস্কার পেতে পারত । অথবা জাতীয পর্যায়ে মানব সেবার স্বীকৃতি পেতে পারত । যদিও আমাদের তা উদ্দেশ্য ছিল না । আর সেদিন যদি আমাদের সাথে একটি ক্যামরা থাকত তাহলে আমরা বাজিমাত করতে পারতাম ।

যাই হোক । আমি ভাবছিলাম ওদের কথা। ওরা এবং আমরা সবাই একই দেশের অধিবাসী। দেশ আমাদের সবার থেকে টেক্স বা খাজানা আদায় করে। অথবা দেশের প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের মত ওদের ও একটি ভোটের অধিকার রয়েছে। অতচ সমুদ্রতীরবর্তী এই দূর্যোগপূর্ণ এলাকাতে ওরা একা থাকছে। আর আমরা থাকছি অপেক্ষাকৃত কম ঝুকিপূর্ণ এলাকায়। অত্র লেখার মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার দাবী হচ্ছে বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নাগরিক সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করা হোক ।

সমুদ্র পথে অনেক বৈদেশিক যোগাযোগ, মৎস এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সব আমরা ভোগ করব আর সমুদ্রের জলোচ্ছাস, ঘূর্ণীঝড়, মহামারী, ইত্যাদি ভোগ করবে ওরা একা এটা কেমন কথা ? অতচ এই আসমানী বালাগুলো আমরা শহর বাসীর কারনেই বেশীর ভাগ এসে থাকে। মনে পড়ে ঘূর্ণীঝড়ের কিছুদিন আগে ঢাকা গিয়েছিলাম। সেখানে মানবতার যে পাপী, ঘৃণ্য, নগ্ন চেহারা দেখেছিলাম, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে কান্ড সমূহ দেখেছিলাম এবং সারা দেশে চেয়ার কোচের নামে যে ভ্রাম্যমান সিনেমা হল প্রতিষ্টা হয়েছিল চারিদিকের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝাই যাচ্ছিল যে দেশবাসীকে মহান আল্লাহ একটু সতর্ক করে দিতে পারেন। এটা তখন সময়ের দাবী ছিল বলতে হবে। দেশের চা দোকান গুলো ছিল এক একটা সিনেমা হল, ভারতীয় নগ্ন ছবি ভি সি আর এর মাধ্যমে এলোপাথারি প্রদর্শন করা হচ্ছিল ।

যাই হোক, আমরা দৃশ্য বদল করে অনেকদুর এগিয়ে গেছি। এখন আবারো আগের দৃশ্যে ফিরে আসা যাক। পূর্বোক্ত বর্ণনায় মেডিকেল বক্সে আমরা যে কটনের উল্লেখ করে এসেছি সেই কটনই সাগরে ঝাপ দেওয়ার আগে কানের ছিদ্র পথে আটকে দিয়েছিলাম। আবারো ফিরে আসছি আগের বর্ণনায়, আমি এখন সাগরের ঢেউয়ে ভাসছি আর লোকটি আমার বুকের উপর। জাহাজ থেকে ধীরে ধীরে রশি টানা হচ্ছে। রশির টানে আমি ক্রমান্বয়ে জাহাজের বিশ হাতের মধ্যে চলে আসলাম। জাহাজ থেকে উৎসুক তিন তালার তিন সারি জনতা আমাকে উৎসাহিত করছিল।

এভাবে লোকটি সহ আমি যখন জাহাজের আরো কাছাকাছি চলে এলাম, তখন সাগরের শক্তিশালী ঢেউ এবং ছন্নছাড়া বাতাসের ঝাপটা আমাকে জাহাজের গা ঘেসে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমার বুকের উপর একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। পানি আমাকে বিপদ সীমার মধ্যে নিয়ে গেলেও ঐ অবস্থায় আমার করার কিছুই ছিল না। আমি তখন সম্পূর্ন অসহায় অবস্থায় ছিলাম।

পানির ঝাপটা আমাকে জাহাজের গা সেঁদে সেঁদে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। সাগরের ঢেউ এবং বাতাসের ঝাপটার এমন অসৌভন আচরনে আমি কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। ঠিক এ ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের কোন কৌশলই মাথার মধ্যে আসছে না। বিশাল জাহাজের ডক থেকে নিচের দিকে ইংরেজী ভী আকৃতির হওয়ায় আমি উপরের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ততক্ষনে পানি আমাকে জাহাজের পেছন বরাবর নিয়ে গেছে।

এমন সময় আমার মনে পড়ল জাহাজের পেছনেই তো রয়েছে সেই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পাকাঁ যার সাহায্যে দানবের মত এই বিরাট-কায় জাহাজটি চলন ক্ষমতা পায়। যার নাগালের মধ্যে গেলে আমাকে ছাতু বানিয়ে ছাড়বে। এটা মনে হতেই আমি দু’হাতে এলোপাতাড়ি রশি টানতে শুরু করলাম। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল এই বিপদ জনক অবস্থান থেকে তাড়াতাড়ি নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে। আরে ; রশি যত টানি তত চলে আসতেছে কেন ? তাহলে কি ওরা রশি ছেড়ে দিয়েছে ?

হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা ছোৎ কেরে উঠল। আমি চোঁখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মনে হল এই প্রথম বারের মত কিছুটা হলেও আমি ভয় পেলাম। এখন কি হবে ? আমি এমন অবস্থানে আছি যে জাহাজের কাউকে দেখতে ও পাচ্ছি না, আবার সংকেত ও দিতে পারছি না। লাইফ জেকেটের বাঁশী ও নেই যে আমার উপস্থিতি এবং অবস্থান ওদেরকে জানাব। জাহাজ বন্ধ বলে পিছনের পাঁকা না ঘুরারই কথা। কিন্তু আমি শুনেছি চলন্ত পানির ধাক্কায় ও পাঁকা ঘুরতে থাকে। তাছাড়া চলন্ত পানির মাঝে কিছু দাড়িয়ে থাকলে তার বিপরীত দিকের পানি এমনিতেই ঘুরতে থাকে। জাহাজের পিছনের পানিও ঘুরছিল।

আমি চিন্তা করছি ; এ অবস্থায় থাকলে বিপদের সম্ভাবনা ষোল আনাই থেকে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা হয়ত আমার বিপদ বুঝতে পেরেই রশি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ফেলে তো আর চলে যাবেনা। এটা মনে হতেই আমি প্রথমে হাতে এবং পরে পায়ে জাহাজের গায়ে জোরে ধাক্কা দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম।

এবার পানি ও আমাকে পিছন পানে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। প্রায় পঞ্চাশ ফিটের মত ভেসে চলার পর জাহাজের তৃতীয় তলা থেকে লোকেরা আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। ততনে রশি ও পানির উপরের দিকে ভেসে উঠেছে। আমি ল্য করলাম উপরের বাম দিক থেকে রশি পিছনের দিকে চলে আসছে। তাহলে ওরা শেষ পর্যন্ত রশি ছাড়েনি ? আমি বুঝতে পারলাম আমার নিরাপত্তার জন্যই রশি ঢিলে করে দিয়েছিল। উতাল-পাতাল ঢেউ আমাকে ক্রমাম্বয়ে ঘুরিয়ে জাহাজের বাম পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে গেল। আমি প্রথমে যে দিকে লাফ দিয়েছিলাম এখন ঠিক তার বিপরীত দিকে অবস্থান করছি।

এদিকে জাহাজের আড়াল হওয়ায় ঢেউ অপোকৃত কম মনে হচ্ছে। আমি জাহাজের লোকদের ইশারা করলাম তৃতীয় তলা থেকে রশি দ্বিতীয় তলার লোকদের দেওয়ার জন্য। ওরা রশি নামিয়ে দিল। আবার দ্বিতীয় তলার লোকদের ইশারা করলাম রশি নীচের তলার লোকদের হাতে দেবার জন্য। রশি যখন নীচের তালার লোকদের হাতে চলে আসল তখন তাদের ইশারা করলাম জাহাজের মধ্যখানে যেখানে সিঁড়ি আছে সেখানে আসার জন্যে। আমার বাম হাত বন্ধ থাকলেও ডান হাতে ইশারা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে তখন ওদেরকে রশি টানার জন্য সংকেত দিলাম।

আমার মুখে তখন বিজয়ের হাসি, চেহারায় প্রশান্তি। কারন আমার উদ্দেশ্য প্রায় সফল হল বলে। আমার সাথী যারা অসুস্থ অবস্থায় ঘুমাচ্ছিল , ছাদের উপর তাদেরকেও দেখতে পেলাম। তাদের কারো চেহারাই প্রসন্ন ছিলনা। আমার মুখে হাসি দেখে ওদের মুখে হাসি ফুটল বটে কিন্তু ওরা আমার জন্য এতই উদ্বীগ্ন ছিল যে এর জন্য অর্থাৎ আমার বাহাদুরির জন্য পরে আমাকে অনেক কৈপিয়ত দিতে হয়েছিল। কামাল ভাইতো আমাকে হারিয়ে আমার বাড়ীতে গিয়ে কি জবাব দেবেন এই চিন্তায় অস্থির ছিলেন। বড়সি খাওয়া বড় মাছকে যেমন সূতা টান দিয়ে আবার ঢিলে করে দিয়ে মাছকে হয়রানী বা দূর্বল করা হয়, তেমনি বড় ঢেউ আসলে আমার রশিও ঢিলে হয়ে যায়। পর মূহুর্তে আবার টানা হয়।

আমি ক্রমশ: জাহাজের কাছে চলে আসতে লাগলাম। জাহাজ হিসেবে সিঁড়ি মোটেই সুবিধার ছিল না। দুই দিকে রশি দিয়ে বেধে কতগুলো তক্তা পর পর বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাই সিঁড়ি। ডক থেকে পানি ১০/১২ হাত নীচে হওয়ায় তক্তার সিঁড়ি দিয়ে বেহুস লোকটিকে উপরে তোলা যাচ্ছিল না। এমনিতে অচেতন দেহগুলো হয় ভারি, তার উপর পানি খেয়ে লোকটির হলুদাব শরীরটা আরো ভারী হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে বলে আমার বাহু দুটো ও দূর্বল হয়ে পড়েছিল। অনেক কষ্টের পর আমার সর্ব শক্তি ব্যয় করে লোকটিকে জাহাজের লোকদের হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওরা কয়েক জনে ঝুকে পড়ে লোকটিকে উপরে তোলার পর আমি বললাম- এবার আমাকে ও তুলুন। কারন তখন সিঁড়ি বেয়ে নিজে নিজে উপরে উঠার মত শক্তি আমার অবশিষ্ট ছিলনা।

অবশেষে আমি যখন ডকে উঠে দাড়িয়েছি তখন বিজয়ের উল্লাসে আমার সমস্ত কান্তি নিমিষে দুর হয়ে গেল। অত:পর আমার পুরো গায়ে একটা বড় তোয়ালে জড়িয়ে দিয়ে কয়েক জনে ধরে আমাকে আমার কেবিনে নিয়ে আসল। ঐ অর্ধমৃত লোকটিকে আগেই দু’তলার মেডিকেল টিমের কাছে পৌছে দেয়া হয়েছিল। আমি এমনিতে তত দূর্বল ছিলাম না। কিন্তু ওদের সেবা করার আগ্রহ দেখে আমি যেন আরো বেশী কান্তি বোধ করছিলাম। আমার সেবায় একজন ২৩/২৪ বৎসরের যুবক ছিল বেশ অগ্রগন্য। সে নিজের বড় তোয়ালে দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মুছে ফেলার পর ঐ তোয়ালে আমার গায়ে জড়িয়ে রাখা হল। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার সেবা করে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে।

আমাকে বলা হল সমস্ত শরীর ঢিলে করে দিতে । আমি কেবিনে প্রথম শ্রেনীর বিশেষ ধরনের আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। ততক্ষনে উপর থেকে আমার বন্ধুরা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে। লোকেরা আমার পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত মেসেজ করে দিচ্ছিল। কেউ হাত, কেউ পা, কেউবা মাথা- মনে হয় কার আগে কে ভাগ্যবান হবে তার প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। অতচ এই লোকদের মতই আরেক জন বা কয়েকজনে ঐ লোকটিকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতে আহত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সাগরে ফেলে দিয়েছিল। একই আল্লাহর একটি দুনিয়ায় কত বিচিত্র রকমের সৃষ্টি যে আছে তা ঐ আল্লাহই ভাল জানেন।

আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের আন্তরিকতা দেখে আমি অবিভূত হয়ে পড়লাম। আমাকে নিয়ে ওদের তৎপরতার হিড়িক দেখে আমার বিশ্বকাপ ফুটবল হিরো ম্যারাডোনার কথা মনে পড়ে গেল। খেলার বিরতির সময় ম্যারাডোনাকেও এভাবে শরীর মেসেস করে দিতে দেখেছিলাম টিভির পর্দায়।

ওদিকে আমাকে নিয়ে ততক্ষনে উপছে পড়া দর্শকদের প্রশ্নের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কি নাম ? বাড়ী কোথায় ? কি করে ? থাকে কোথায় ? ইত্যাদি হরেক রকমের প্রশ্ন। আমি মোস্তফা কামাল ভাইকে ইশারা করলাম ওদের প্রশ্নের জবাব দিবার জন্য। কারন এত লোকের প্রশ্নের জবাব এক সঙ্গে দেয়া আমার জন্য সত্যই কষ্টকর ছিল। কামাল ভাইয়ের মুখে জবাব শুনে কেউ লিখে নিচ্ছিল, আর কেউ শুনেই তৃপ্তি পাচ্ছিল।

কামাল ভাইয়ের মুখে আমার নাম শুনে কেউ কেউ মন্তব্য করল বা: বা: দেখতে হবেনা নামটা কেমন। এখানে বলে রাখা দরকার আমার একটা ভাল নাম থাকলেও বন্দুরা আমাকে বাহাদুর বলেই ডাকত । কেউ কেউ বলল সত্যিই ও নামের একেবারে বাস্তব প্রতিমূর্তি। দারুন সাহস। এভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হল।

এতক্ষন পর্যন্ত যাদের বাহুতে জোর ছিল কেবল তারাই আমার কাছে আসতে পারছিল। ঝামেলা একটু কমলে এবার মুরব্বীরা আসতে শুরু করল। কেউ বলল- বেঁচে থাক বাবা, জানিনা কোন মায়ের সন্তান। আল্লাহ তোমার হায়াত দারাজ করুক। কেউ কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। একজন বললেন -তোমার বাড়ী কোথায় বাবা ? আমি বললাম- সাতকানিয়ায়। অন্যজন বলল- আমি বলছিলাম না, এ ঢাকার ছেলে হতেই পারেনা। এ আমাদের চাটগাঁর ছেলে। আমাদেরই ছেলে। মনে হল ওর বুকটা যেন গর্বে এক বিঘাত পর্যন্ত ফুলে উঠেছিল।

উল্লেখ্য যে, আমাদের সাথে ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষক মিলে পনের বিশ জনের একটা ত্রান কমিঠি কুতুবদিয়া যাচ্ছিল। সে কমিঠির সু-পন্ডিত ছাত্ররা চঞ্চলতায় ইতিমধ্যেই জাহাজের যাত্রীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল। আমি সাগরে যে সুইমিং জেকেট ব্যবহার করেছি সেটা তাদেরই ছিল।

আমি যখন লোকদের সাথে কথা বলছিলাম ও সেবা নিচ্ছিলাম তখন জাহাজের সহকারী নাবিক এসে আমাকে বললেন- চলুন, সাগরের লবণাক্ত দুষিত পানি আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে। পরিস্কার পানি দিয়ে গোসল করা দরকার। গেল সপ্তাহের ঘূর্ণীঝড়ে হাজার হাজার মরা মানুষ ও জীব জন্তুর মরা গলিত দেহ পানিতে মিশে আছে বলে পানিকে দুষিত বলা হচ্ছে। অন্যথায় সাগরের পানি হচ্ছে সচ্ছ, পরিস্কার এবং পবিত্র। নাবিক সাহেব আমাকে ধরে মহিলাদের বিশেষ স্নাগারে নিয়ে গেলেন। সাপ্লাইতে পানি নাই দেখে কন্ট্রোল রুমকে বলে পানি নিলেন। আমাকে ঝরণার নীচে দাড় করিয়ে ইংরেজী সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নতুন পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে গা মুছে দিলেন। তিনি নিজ হাতেই সব করলেন। আমি লক্ষ্য করলাম আগের সেই বড় তোয়ালে দিয়ে গা মুছলেন না। কারন ঐ তোয়ালেতে জীবানু থাকার সম্ভাবনা আছে। গোসল শেষ করে তিনি আমাকে রুমে পৌছে দিয়ে গেলেন।

তারপর জাহাজের মাষ্টার এসে আমার সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দেবার জন্য কর্মচারীদের বলে গেলেন। তিনি আমার সাথে কৌশল বিনিময় করলেন। কিছুক্ষন পর আমার সাথে যিনি দেখা করতে আসলেন তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। উনারা ও ত্রানসামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলেন। স্যারের পরিচয় পেয়ে আমি পাশের সিটে গিয়ে আমার সিট খালী করে স্যারকে বসতে দিলাম।

আমার পাশে বসেই স্যার আমাকে ঝাপটে ধরলেন এবং বললেন- যুবক, তোমার সৎ সাহস দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি। আরো অনেক্ষন কথা বলার পর স্যার মানিবেগ থেকে দু’টো ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। তারপর বললেন- বাহাদুর, এই কার্ড দুটো তুমি রাখ। এতে একটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরটা চট্টগ্রাম শহরে আমার ঠিকানা। তিনি আরো বললেন- জানিনা আমি তোমার কোন উপকার করতে পারব কিনা, কিন্তু যদি তুমি মনে কর আমি তোমার কোন উপকারে আসব ; তাহলে আজ নয়, এক বৎসর বা দুই বৎসর নয়, দশ বৎসর পর হলেও তুমি যদি আমার কাছে আস তাহলে আমি তোমার জন্য সম্ভব সব রকম চেষ্টা করব। স্যারের কথা আমার বেশ ভাল লাগল এবং আমি মনে মনে বেশ উৎসাহ বোধ করতে লাগলাম।

তিনি আরো বললেন- তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মত। আমাকে বড় ভাই মনে করেই তুমি আমার কাছে আসিও। আমি ধন্যবাদ দিয়ে স্যারের কার্ড দু’টো গ্রহন করলাম। দু:খের বিষয় হচ্ছে ঐ কার্ড দু’টো পরবর্তীতে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। সম্ভবত স্যারের নাম ছিল অলক রায় এবং বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরের মোহাম্মদ আলী রোডে। স্যারের দু’টো কার্ডেই একটি করে কাঠের খুদাই করা শিল্প কর্মের ছবি ছিল । পরে শুনেছিলাম ঐ শিল্প কর্মের জন্যে উনি স্বর্ন পদক পেয়েছিলেন।

জাহাজের ভিতরে অনেক্ষন পর্যন্ত লোকের বেষ্টনির মধ্যে বন্ধি অবস্থায় রয়েছি বলে অশ্বস্থি বোধ করছিলাম। ওরা আমাকে বের হতে দিচ্ছিল না আমার কষ্ট হবে বলে। প্রায় দু’ঘন্টা পর যখন দ্বিতলায় উদ্ধারকৃত লোকটিকে দেখতে গেলাম তখনো ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ী পথ ছেড়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম-ওর অবস্থা এখন কেমন ? একজন বলল- এই মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। আমি দেখলাম লোকটি একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে তখনো ঠক্ ঠক্ করে কাপছে।

দর্শকদের থেকে একজনে লোকটিকে বলল- তোমাকে কে উদ্ধার করেছে তাকে জানতো ? সে ক্ষীন কণ্ঠে বলল- জানি। ঐ লোকটি আবার বলল - তাহলে দেখাও তো এখান থেকে কে সেই উদ্ধারকারী। আমার গায়ে তখন বাদামী রঙের একটা হাতা গেঞ্জি এবং পরনে একটি রিলিপের লুঙ্গি। মাথার চুল এলো মেলো ভাবে কপালের চার পাশে ছড়িয়ে আছে। গোসলের পর হাতের কাছে চিরনী পাইনি। লোকটি চোঁখ মিট মিট করে একে একে সবার দিকে তাকাল। কিন্তু উদ্ধারকারীকে চিনতে পারল না।

ঐ লোকটি এবার আমার কাধে হাত দিয়ে বলল- এ-ই তোমাকে জীবনের বিনিময়ে ভয়ংকর সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে। সে আমার দিকে কিছুক্ষন থাকিয়ে থেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে অপ্রস্তুত ভাবে এদিক-ওদিক থাকাতে লাগলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর সে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে আমাকে নানা রকম দোয়া করতে লাগল। আমি বললাম- আপনার নাম কি ? সে ক্ষীন কণ্ঠে বলল-মোহাম্মদ মুহসিন। বাড়ী কোথায়- পটিয়া। এখন কেমন বোধ করছেন ? সে জবাব দিল খুব ভাল।

একজন দর্শক আমাকে জানাল ডাক্তার বলেছেন আর দু’এক মিনিট হলেই মারা যেত। তারপর ঐ দর্শক আবার বলল-আপনি না হলে ও নির্ঘাত মারা যেত। তার কথার সমর্থন জানাল আরো কয়েক জনে। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম- আপনাদের এ ধারনা ঠিক নয় । বাঁচা মরার ফয়সালা তো হয় আল্লাহর দরবারে। কোন মানুষ অন্য মানুষকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেনা । তারা বলল- তাতো বটেই, তবে আপনি হচ্ছেন উছিলা।

এরপর আমি মুক্ত হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজের তৃতীয় তলায় উঠলাম। এখানে এক পাশে যাত্রীদের বসার গ্যালারী মধ্যখানে খালী এবং অপর পাশে জাহাজের কট্রোলরুম। উড়ন্ত বিকেলের দখিনা বাতাস কিছুনের মধ্যেই হাড়-কাপিয়ে দেয়। আমার কপালের এলোমেলো চুল বাতাসের সাথে উড়ছিল। কিন্তু কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে বুক ভরে একটু শ্বাস নেব সে ফুরসত আমার কোথায়। আমাকে দেখেই লোকেরা কানাকানি আরম্ভ করে দিল। কেউ বলে- এই সেই যুবক যে অন্যের জন্যে নিজের জান বিপন্ন সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়েছিল। কেউ বলে দারুন সাহস ।

দু’এক জনে আমার সাথে সাহস করে কথা বলেছেতো চারিদিকে জড়ো হয়ে লোকেরা আমাকে ঘিরে ধরছে। আমি কিন্তু নার্ভাস বোধ করছিলাম। লজ্জায় আমার ইচ্ছে হচ্ছিল কোন গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। শেষ পর্যন্ত আর বের হব না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কেবিনে ফিরে আসলাম। সেখানেও দেখি একই অবস্থা, একই বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। আমাকে পেয়ে আলাপের মধ্যমনি করে আসন খালি করে দিল।

উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল আমাকে বললেন- আপনি কুতুবদিয়ায় আমাদের বাড়ীতে চলুন। ঝড়ে আমাদের বাড়ীর তেমন ক্ষতি হয়নি। আশ্রিত অনেক লোক আছে, তবে আপনি আসলে দ্বিতলার একটি রুম খালী করে দেয়া যাবে। আমি উনাকে বললাম-ভাই, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা যাচ্ছি একটা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে । আমরা এতদুর সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি যে, প্রয়োজনে প্রত্যেকে বস্তা কাধে নিয়ে ছয়-সাত মাইল ভিতরে নিয়ে যাব যেখানে আজ পর্যন্ত কোন সাহায্য পৌছেনি।

বাবুলকে আমি আরো বললাম- এক্ষনে আমি যদি আপনার সাথে চলে যাই, তাহলে আনন্দঘন সেই স্বর্গীয় মূহুর্ত থেকে বঞ্চিত থেকে যাব। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আর জোর করলেন না।

অনেক্ষন থেকে একটা বিষয় আমার মাথার মধ্যে আসছে না। সেই লোকটিকে পানিতে ফেলার পর থেকে যে ফেলেছে তাকে খুঁজছে সবাই। লোকটিকে একজনেতো আর একা একা ফেলতে পারেনি, তবে নিশ্চয় একজনের নেতৃত্বে কয়েকজনে মিলে ফেলেছে। ঐ নেপত্ব নায়কটাকে উদ্দেশ্য করেই সবাই কথার ঝাল মিটাচ্ছে। অনেকে মন্তব্য করেছে তাকেই সাগরে ফেলে দেয়া উচিত। কেউ কেউ বলেছে- তাকে দশ বার ফাঁসি দেয়া উচিত।

কেউ বলেছে তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হোক। কিন্তু লোকটি সেই যে গা ঢাকা দিয়েছে আর কেউ তাকে খুজে পায়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ আর তেমন আগ্রহও দেখাইনি। তবে একজনে মন্তব্য করেছিল লোকটির গায়ে লাল গেঞ্জি আছে। এখানেই আমার খট্কা। আমি উপরে নিচে কোন লাল গেঞ্জি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য আমি খুজেছি তাও নয়। গত প্রায় দুই ঘন্টা ধরে আমার সাথে তিন জন লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে বাবুল। অপর দুই জন পরে এসেছে।

এরমধ্যে একজন আমার বাড়ী সাতকানিয়া শুনে , সাতকানিয়া সরকারী কলেজ, ভোয়ালিয়া পাড়া, জাফর সাদেক ভাই অনেক কিছু নির্ভূল পরিচয় দিল। লোকটি আরো জানাল সে সাতকানিয়া কলেজের ছাত্র। গত প্রায় দুই তিন বৎসর আগে চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছে এখন কোথাও মাস্টারি না কি করে।

ফর্সা রঙের হালকা-পাতলা গঠনের লোকটির পরনে লুঙ্গি। গায়ে লাল হাফ হাতা গেঞ্জি, মাথার চুল ছোট করে ছাটা, ক্লিন সেভড, চোঁখ দু’টো সামান্য ট্যারা। কথা বার্তায় আমার সাথে ভালই ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। সেই যে প্রথমে আমার সামনে বসেছিল দিনের আলো থাকতে আর উঠেনি। এরই মধ্যে একজন এসে আমাকে ইশারা করে গেছে ; মনে হয় আপনার সামনের এই ব্যক্তিই লোকটিকে সাগরে ফেলে দিয়েছিল। হঠাৎ আমার মনে হল লোকটির গায়ে তো লাল গেঞ্জি। তাহলে কি ... .............।

হ্যাঁ , লোকটির সাথে এতক্ষন কথা বলে আমার যে ধারনা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে এরকম একটা কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব। আর যদি তা হয়ে থাকে তাহলে যে ওর তারিফ করতেই হয় । কারন একেবারে আমার সাথে বন্ধুত্ব। তার মানে সে ধরেই নিয়েছে বাঁচার এটাই পথ। আমার চিন্তাশ্রোত এক জায়গায় এসে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছিল। খেই হারিয়ে ফেলছিল এইজন্য যে আমরা এত কষ্ট, এত ত্যাগ স্বীকার করে যে দূস্থ-দূর্গত-মূমূর্ষ লোকদের জন্য কিছু সাহায্য নেবার চেষ্টা করছিলাম। যার উপর দিয়ে বয়ে গেছে অগ্নিবৃষ্টি বা এসিড বৃষ্টি এবং সোয়া দুই’শ কিলো বেগে ঘূর্ণীঝড়। লোকটির বাড়ি হচ্ছে সেই কুতুবদিয়ায়। আমি ধীরে ধীরে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবনার অতল গহবরে...................।

ঃ যবনিকা পতন ঃ

. [ আচ্ছা, ১৯৯১ ইংরেজীর সেই সময়ে আপনি কোথায় ছিলেন, আপনার কিছু মনে আছে ? ]

বিষয়: বিবিধ

২৩১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File