ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল’ ৯১ ইং স্বরনে.......

লিখেছেন লিখেছেন চাটিগাঁ থেকে বাহার ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:৫৬:৫৪ রাত

১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বরনীয় দিন । স্বরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণীঝড়ের কবলে এদিন বাংলাদেশের জনমানুষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় । এ সময়ের ঘঠনায় আমার থলেতে কিছু স্বরনীয় ঘঠনা জমে আছে.... তাই এখন শেয়ার করবো । ঘঠনা বেশী লম্বাচওড়া বলে দুপর্বে শেষ করবো । তবে আশা করা যায় আমার বিবরণে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে ।

.....................................................................................।

সাগর ( ইহা একটি সত্য ঘঠনা )

( ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল ' ১৯৯১ ইং স্বরনে )

ভূমিকা : সে দিন জাহাজে আমার সাথে যারা ছিল এবং জাহাজের প্রত্যেক্ষ দর্শি যারা, তারা সবাই আমাকে ঘঠনাটি লিখে রাখার জন্য উৎসাহিত করেছিল ( এখানে ঘঠনা বলতে মাঝসাগরে নিক্ষেপ করা একজন লোককে উদ্ধার অভিযানের কথা বলা হয়েছে ) । বলতে গেলে তাদের উৎসাহেই পরবর্তীতে আমি এই লেখায় হাত দিয়েছিলাম। সেদিন ঐ জাহাজে যারা ছিল তাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ হচ্ছে আমার লিখায় অনিচ্ছাকৃত কোন গলদ যদি থাকে তাহলে মেহেরবানী করে আমাকে জানালে আমি তা সংশোধন করে নিব। এই লেখায় সেদিনের ঘূর্ণীঝড়ের ক্ষতির যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবিকই প্রেকটিক্যাল। ঐতিহাসিকদের জন্য এখানে কিছু খিচুড়ী থাকতে ও পারে। তা ঐ ভয়াল রাতের অন্ধকারে যারা জীবন যুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ হাফেজ। ( ২৯/০৪/২০১৩ ইং )

ছয় মে ’ উনিশ’শো একানব্বই ইংরেজী, সোমবার। গভীর বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে উত্থাল ঢেউয়ের তরঙ্গ মালা ভেদ করে দানবের মত ছুটে চলছিল একটি জাহাজ। জাহাজের নাম ‘মহেশখালী’ ।

গন্তব্য স্থান কুতুবদিয়া। বিরাট তিন তলা জাহাজে প্রায় দুইশ যাত্রী। নীচ তলার প্রথম শ্রেণীর মহিলা কেবিনের এক পাশে আমাদের ত্রাণসামগ্রীর বস্তা রেখে অন্য পাশে সারিবদ্ধ চেয়ারে আমরা বসেছিলাম। সমুদ্র খুবই গরম। ঢেউয়ের পর ঢেউ আঘাত হানছিল জাহাজের গায়ে। মস্ত বড় জাহাজ ঢেউয়ের আঘাতে হেলে দুলে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। জাহাজ নৈশ কোচের পাঁকার মত উপর নীচে এবং ডানে বায়ে কাত হয়ে অনেকটা লাঠিমের মত ঘূর্ণন গতিতে এগিয়ে চলছিল।

আঁকা বাকা রাস্তায় চলন্ত ট্রেন যেভাবে যাত্রীদের হয়রানী করে জাহাজের আরোহীদের ও সেই একই অবস্থা। মনে হচ্ছিল যেন প্রতি মুহুর্তে ভূমিকম্প হচ্ছে।

মনে পড়ে ঐদিন থেকে ঠিক সাত দিন আগের সোমবারে ২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ ইংরেজী চট্টগ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য ছিল দশ নাম্ভার সিগনেল। সে রাত্রে এগারটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত (চট্টগ্রাম শহরে এবং আশেপাশের এলকায়) যে ভয়ংকর ঘূর্ণীঝড় বয়ে গিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ গর্কি ’

ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে দানব রুপি ড্রাগনের নি:শ্বাসের মত যে তপ্ত ঝড় এবং জলোচ্ছাস বয়ে গিয়েছিল তা শত বৎসরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। কবির কল্পনা, সাহিত্যিকের ভাষা, সাংবাদিকের কলম, শিল্পীর তুলি সব বোবা প্রমানীত হয়েছিল ঐ গর্কীর কাছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি একে অন্যের অস্থিত্বের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে পড়েছিল।

পরের দিন অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল স্থানীয় পত্রিকা অনুমান করে লিখেছিল দুই সহস্রাধিক নিহত। কিন্তু পরবর্তীতে এই সংখ্যা দুই থেকে তিন লাখের মাঝামাঝী ছিল। শুধু কুতুবদিয়া উপজেলায় মোট আশি হাজার লোকের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ নিহত বলে পত্র-পত্রিকায় ধারনা করা হচ্ছিল। মহেশখালী, বাঁশখালী, হাতিয়া , কক্সবাজার, আনোয়ারা ইত্যাদি এলাকায় পাইকারী হারে নিহত হয়েছিল। এমনকি সাতকানিয়া, পটিয়া, রাউজান ইত্যাদি এলাকায় ক্ষতি হয়নি এরকম প্রতি দশ হাজার ঘরের মধ্যে একটি ঘর খুজে পাওয়া রীতিমত মুসিবত হয়ে গিয়েছিল।

আজকে তেইশ বৎসর পর (২৯শে এপ্রিল ২০১৩ ইং ) এসে আমি এ দিনকে স্বরন করছি আর ঐ দিনের সমস্ত নিহতের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। সেদিন দেশের এহেন পরিস্থিতিতে নিজের উপর কিছু দায়িত্ব অনুভব করেছিলাম। দু’এক জন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম দূর্গত এলাকায় সাহায্যার্থে এগিয়ে যাব। যদিও আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। এই উদ্দেশ্যে ঘূর্ণীঝড়ের দু’দিন পর থেকেই আমরা আমাদের এলাকা থেকে ঘরে ঘরে ত্রান সামগ্রী সংগ্রহ করেছিলাম। প্রথমে উদ্দেশ্যে ছিল বাঁশখালী যাব। অবশ্য অন্যান্য এলাকার মত আমাদের গ্রামে ও ক্ষতি হয়নি এ রকম একটি বাড়ী ও পাওয়া যাবেনা। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের দরদ, ভালবাসা, সহানুভূতি আর কাকে বলে। যখন বললাম- বাঁশখালীর জন্যে সাহায্যে এগিয়ে আসুন তখন পুরুষ মহিলা সবাই সাধ্যমত দুই হাতে সাহায্য করল।

এদিকে আমাদের কাছে খবর পৌছল যে, কুতুবদিয়ায় যেমন অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে তেমনি গত ছয় সাত দিনে কোন সাহায্যই ওখানে পৌছেনি।

সেখানে যে কয়জন লোক কোন রকমে বেঁচে আছে তারা ও না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। অত:পর আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কুতুবদিয়ায় যাব স্থির করলাম। কিন্তু বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে ঝুকি পুর্ণ এই অভিযানে আমাদের সাথে যাবে কে ? বিশেষ করে আবহাওয়া এখনও ঘোলাটে। সমুদ্র খুবই গরম, প্রতি দিনই থাকছে সতর্কবাণী। নৌ-যোগাযোগ বন্ধ।

শেষ পর্যন্ত অনেককে বলে কয়ে গ্রাম থেকে একজন ও শহর থেকে তিনজন পাওয়া গেল। আমরা আগে থেকেই চার জন ছিলাম। কিন্তু বাঁশখালীর পরিবর্তে যখন কুতুবদিয়া যাব মনস্থ করলাম তখন দুই জন সরে পড়েছিল। ওরা হয়ত ভয় পেয়েছিল। তবে এই পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়াটা দোষনীয় বলা ঠিক হবে না। তা যাই হোক এক্ষনে আমাদের দলে জাহাজে আমরা মোট ছয় জন। আমি, মোস্তফা কামাল ভাই, সেলিম ভাই, ফেরদৌস ভাই, আরো দুই জনের নাম এখন আমার মনে পড়ছে না। সেখান থেকে একজনের বাড়ী ছিল সম্ভবত লোহাগাড়া থানার পদুয়ায়। জাহাজের হেয়ালী পূর্ণ গতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে আমার চার জন সাথী ইতিমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওরা সবাই দ্বিতলার ডকের মধ্যে কেউ বমির টেবলেট খেয়ে কেউ লেবুর টুকরা মুখে দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। জাহাজে স্বাভাবিক হাটা যাচ্ছিল না। লোকেরা হাটার সময় মনে হচ্ছিল যেন মাতাল হয়ে চলাফেরা করছে। কিছু না ধরে হাটা কষ্টকর ছিল।

সমুদ্র গরম এবং ঝুকিপূর্ণ বলে মহিলার সংখ্যা তেমন নেই। দুই চার জন যারা ছিল তারা কেউ এক পাশে চেয়ারে এবং বাকীরা মেঝেতে বসেছিল। সমুদ্র পথে এর আগে আমি একবার লঞ্চে ভ্রমন করেছিলাম। সে বার ও আমরা দলে ছিলাম ছয়জন। চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে কুতুবদিয়া, সেখানে একদিন থেকে পরদিন মহেশখালী এবং সর্বশেষ কক্সবাজার। উদ্দেশ্য ছিল ভ্রমনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে আমি কিছুটা সুস্থ রয়েছিলাম। অন্যদের কোন অভিজ্ঞতা নেই বলে ওরা প্রথম ধাক্কাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাদের অবস্থা দেখে আমার ও খারাফ লাগছিল। আমি একটা টেবলেট খেয়ে টেবিলে মাথা রেখে কিছুক্ষন নিরবে বসে থাকলাম।

বেশ কিছুক্ষন থেকে একজন লোককে জাহাজে গণপিঠুনি দেয়া হচ্ছিল। লোকটি নাকি কার পকেট মারতে চেয়েছিল এবং একজন ভদ্র মহিলার কান থেকে স্বর্ণের দুল টানতে চেষ্টা করেছিল। তাই লোকটিকে জাহাজের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানে হচ্ছে আর পিঠানো হচ্ছে।

হই হুল্লোড় শুনে আমি কেবিনের বাইরে এসে দেখি ২৪/২৫ বছরের এক যুবক গণ পিঠুনি খাচ্ছে আর নিজের নাম বলছে মোহাম্মদ মুহসিন এবং বাড়ী বলছে পটিয়া। আমি নিজের জায়গায় ফিরে আসলাম। অকেক্ষন পর জাহাজের পিছনে টয়লেটে গেছি। দেখি পিছনের ডকে ঐ লোকটিকে শুইয়ে কানের ভিতর সমুদ্রের লোনা পানি ঢেলে দেয়া হচ্ছে। লোকটিকে আগেই মারতে মারতে পরনের সমস্ত কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছিল। সমস্ত শরীরে একটা জাইঙ্গা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।

লোকটির গায়ের অনেক জায়গায় কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। ব্যাপারটা দেখে আমার তেমন ভাল না লাগলেও আমি চলে আসলাম আমার কেবিনে। আগেই বলেছি যাত্রীদের অবস্থা দেখে আমিও অসুস্থ বোধ করছিলাম। টেবলেটতো আগেই খেয়েছি এখন টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।

আমার পাশের আসনে কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই বাবুল। তিনি একজন ভদ্রলোকের কাছে ঝড়ের ক্ষতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। জাহাজের অনেক যাত্রীই বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল মরুভূমির বুক চিরে উঠের কাফেলার গতির মত করে। এমন সময় হঠাৎ খবর আসল মুহসিন নামের ঐ যুবকটিকে সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে।

এ খবরে সবাই চমকে উঠল, নিমেষেই দুর হয়ে গেল তন্দ্রা । বলে কি ? এত মারধর করার পরও লোকটির শাস্তি হল না ? একে বারে পানিতে ফেলে হত্যা ? তাও এই বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ মালায় নিক্ষেপ করে ? হত্যা করার মত অপরাধ সে করেছে বলে তো মনে হয়না। আমি তাড়াতাড়ি কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি সবাই পেছনের রেলিং থেকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। জাহাজ কিন্তু তখন ও সামনের দিকে বিরামহীন গতিতে ছুটে চলছিল। তখন বিকাল প্রায় চারটার মত হবে।

আমাদের জাহাজ গহিরার প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার মাঝ সাগর দিয়ে এগিয়ে চলছিল। বাঁশখালীর ছনুয়া আসতে আর বেশী দেরি নেই। চট্টগ্রামের সদর ঘাট থেকে সকাল দশটায় জাহাজ যাত্রা শুরু করেছিল। আমি ডকে বেরিয়ে মানুষের জন্য কিছুই দেখতে পেলাম না। তাড়াতাড়ী তিন তলায় উঠে গেলাম। উঠে দেখি বেশ অনেকখানি পেছনে কাল ধরনের কি একটা যেন ঢেউয়ের সাথে উঠানামা করছে। লোকেরা বলাবলি করছে ওটাই মানুষ।

ততক্ষনে জাহাজের মাষ্টারের নিকট খবর পৌছে গেছে। উনি বিজ্ঞ লোক , দেরি না করে সাথে সাথে জাহাজের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছেন। জাহাজ ধীরে ধীরে ঘুরে এবার উল্টা উত্তর মুখী চলতে আরম্ভ করল। জাহাজ ফিরতি পথে লোকটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাতেই হবে।

যাত্রী মহলের মধ্যে বলবলী হচ্ছে- লোকটিকে যে ফেলেছে তাকে ধরে রাখ। এত মারার পরও সাধ মিঠেনি ! আমি ও বুঝতে পারছিলাম না মানুষ এখনও এরকম মুর্খ রয়ে গেছে কিভাবে। আরে ! সে যদি কাউকে খুন ও করে বসত তাহলে আইন আদালত থানা পুলিশ কি জন্য রয়েছে ? তাকে নিয়ে এমনিতেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার আরো খারাপ লাগছিল , আমরা ত্রান সামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলাম কিছু দুস্থ লোকের সাহায্যার্থে । আর যাবার পথেই যদি একজন সুস্থ মানুষকে খুন করে যাই, তাহলে আমাদের সাহায্যের সার্থকতা কোথায়। জাহাজ লোকটির কাছাকাছি এসে বন্ধ হয়ে গেছে।

সব মানুষ একদিকে ঝুকে পড়েছে লোকটিকে দেখতে। জাহাজটি লোকটির প্রায় সাত-আট হাতের মধ্যে চলে এসেছে। তার হাত দুটো একটু একটু নড়ছে, তবে জ্ঞান আছে বলে মনে হয়না। তাকে উদ্দেশ্য করে জাহাজ থেকে একটি রঙ্গিন জেকেট ফেলে দেওয়া হল। জেকেট টাকে পানির ঢেউ অন্য দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তারপর রশি বাধা একটা টিউব খুব কাছেই ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু, লোকটির তো হুসই নেই, সুতরাং সে কিছুই ধরতে পারলনা। উলট-পালট ঢেউয়ের আঘাতে আবার সে জাহাজ থেকে দুরে সরে যেতে লাগল।

প্রথম থেকেই ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগছিল। একটি লোক চোঁখের সামনে এভাবে মারা যাবে আর আমরা জাহাজের প্রায় দু’শ মানুষ দিব্যি তামাশা দেখব ? এটা কেমন কথা। অতচ লোকটিকে বাচানোর কার্যকর কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করা হচ্ছিল না। লোকটি আবারো ঢেউয়ের আঘাতে ভেসে যাচ্ছে দেখে আমি মোস্তাফা কামাল ভাইকে বললাম- কামাল ভাই, আমি সাগরে ঝাপ মারছি। কামাল ভাই, হচ্ছেন আমাদের ত্রান কমিঠির লিডার । তিনি আমাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বললেন- আপনি কি পাগল হয়েছেন ? দেখছেন না সমুদ্র কি গরম ! আপনাকে খুজতে আরো পনের জন লাগবে। আমি বললাম- কিন্তু চোঁখের সামনে একটা তরতজা জীবন এভাবে অসময়ে ঝরে যাবে অতচ আমাদের করার কিছুই নেই ? আমার তো নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কামাল ভাই বললেন- জাহাজ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে , দেখেন না কি হয়।

ততক্ষনে সমুদ্রের হিংস্র ঢেউ লোকটিকে জাহাজ থেকে আবারও একশ গজের মত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জাহাজ আবার ষ্টার্ট নিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে লোকটির দিকে। আমি কামাল ভাইয়ের অজান্তে জাহাজের নীচের তলায় চলে আসলাম। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। তখন ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছিলাম। তবে আমার মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমুল ছিল যে লোকটিকে বাঁচাতেই হবে। কেবিনে এসেই ব্যাগ থেকে জরুরী প্রয়োজনে আনা জাইঙ্গাটা বের করে পড়ে নিলাম। জাইঙ্গাটা কেন পড়লাম তা হয়ত আমার অবচেতন মনে জানে অথবা জানেনা। আমি আসার সময় ফূল প্যান্ট পড়ে আসিনি কারন কুতুবদিয়ায় হয়ত আমাদেরকে বস্তা কাধে নিয়ে পানি এবং কাদার মধ্যে অনেকটা পথ হাটতে হতে পারে। আমি কেবিনের মধ্যে আনমনে পায়চারি করছিলাম।

এক ফাঁকে কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি, লোকটির অনেকটা কাছে চলে এসে জাহাজটি আবার দাড়িয়ে পড়েছে । আবার রশি বাধা টিউব ছুড়ে মেরে টেনে আনা হচ্ছে। লোকটির তখন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। জাহাজের উপর-নীচের তিন সারি লোক আফসোসের সাথে পর্যবেক্ষন করছে, একটা তরতজা প্রান অকালে ঝরে যাচ্ছে। সকলেই মর্মাহত, বেদনাহত, এবং চিন্তাকিষ্ট। মনে হচ্ছে বোবা দৃষ্টিতে অস্তরবি দেখা ছাড়া কারো যেন কিছুই করার নেই। শোকাতুর দৃষ্টিতে উপভোগ্য দৃশ্যপটই বটে ! আমার বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করছে। কোন ভয় বা শংকার লেশ মাত্র সেখানে নেই। আছে বিবেকের দংশন আর সিদ্ধান্তহীনতার যাতনা।

আমি রেলিং থেকে যখন দ্বিতীয় বার কেবিনে ঢুকি তখন আমার গায়ের সাফারী হাতে চলে এসেছে। গায়ে আছে হালকা সবুজ রংয়ের হাফহাতা গেঞ্জি। কেবিনে পায়চারি করতে করতে হাতের ঘড়ি খুলে পকেটে রেখে গায়ের অবশিষ্ট গেঞ্জি ও খুলে নিলাম। এভাবে নিজের অজান্তেই নিয়ে ফেললাম চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত । আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন মোটাসোটা এক ভদ্র লোক। ক্লিন সেভ্ট । যাবেন বাঁশখালীর ছনুয়ায় । এ মুহুর্তে রুমে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। তিনি এতক্ষন আমাকে লক্ষ করছিলেন। ভদ্রলোক আমার অবস্থা দেখে চোঁখ বিস্ফারিত করে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি সমুদ্রে ঝাপ মারবেন নাকি ? আমি বললাম- হ্যাঁ, লোকটিকে যে বাচাঁতে হবে । দেখছেন না, মরে গেলই বলে !

আমার শরীর তখন উত্তেনায় কাপছে। তারপর উনাকে বললাম - দয়া করে আমার কাপড় ও ঘড়ি আপনি রাখবেন। বলেই কেবিন থেকে বাহির হয়ে পড়লাম। তখন আমার পুরো শরীর উদোম, পরনে একটা লুঙ্গি । আমাকে খালী গায়ে দেখে কয়েকজন যাত্রী এসে আমাকে ঘিরে ধরল। একজন বলল- উনি মনে হয় সাগরে লাফ মারবেন। আমি বললাম- হ্যাঁ, আমি লাফ মারব। দেখছেন না ভাই, ওর জ্ঞান নেই ; রশি, টিউব কিছুই ধরতে পারছেন না। এমন সময় জাহাজের একজন কর্মচারী কোত্থেকে দৌড়ে এসে বলল- আপনি কি ঝাপ মারবেন ? আমি বললাম- হ্যাঁ। সে বলল- তাহলে একটু দাড়ান, লুঙ্গি নিয়ে সাঁতরাতে পারবেন না। আমি একটা জাইঙ্গা নিয়ে আসি। আমি কিছু বলার আগেই লোকটি চলে গেল এবং মুহুর্ত পরে একটা জাইঙ্গা নিয়ে এল।

‘ আমি জাইঙ্গা পড়েছি-’ বলেই পরনের লুঙ্গি খুলে ছেড়ে দিলাম। এখন আমার জাইঙ্গা ছাড়া সমস্ত শরীর উদোম। গা দেখা যাচ্ছিল বলে লজ্জায় আমার শরীরটা সংকুচিত হয়ে আসছিল। আমি লাফ দেওয়ার জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলে এক পা সামনে বাড়িয়েছি- এমন সময় পেছন থেকে একজন লোককে , ‘দাড়ান’, ‘দাড়ান’ বলে হাত তুলে চিৎকার করে করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকেরা আগন্তুক কে পথ ছেড়ে দিতে লাগল। কাছে আসলেন যিনি তাকে তিন তালার কন্ট্রোল রুমে নাবিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিতে দেখেছিলাম। অর্থাৎ জাহাজের মাষ্টার আথবা ক্যাপ্টেন না কি যেন বলে , তাই। উনি কাছে এসে আমাকে বললেন- আপনি সত্যি ঝাপ দিবেন ? আমি বলালাম- হ্যাঁ ! বলেই ঝাপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম. . . . . . . .।

মাষ্টার তাড়াতাড়ী বললেন- দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটা লাইফ জেকেট পড়ে নেন। বলেই কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন। আমি যে লাফ মারতে যাচ্ছিলাম, মাষ্টারের ডাকে শরীরের ভার সাম্য ঠিক রাখার জন্য রেলিং এর একটা লোহার হাতল ধরে ফেললাম। কয়েক মিনিট পরেই মাষ্টার একটা লালে গোলাপী লাইফ জেকেট নিয়ে আসলেন এবং তা আমাকে পরিয়ে দিতে লাগলেন। মাষ্টার সহ আরো কয়েক জনে আমাকে যখন জেকেটের ফিতা বেধে দিতে লাগলেন তখন আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই জন্য যে সবাই আমাকে ভাবছে ‘হিরু’।

নিজেকে কোন বিদেশী সিনেমার রঙ্গিন পর্দার দু:সাহসী ডুবুরীর মত অনুভূত হচ্ছিল। ছোট কালে আমার শখ ছিল ডুবুরী হয়ে সাগরের তলা থেকে মুক্তা সংগ্রহ করব অথবা নাবিক হয়ে মাসের পর মাস অথৈ সাগরে হারিয়ে যাব। ছোট কালের সেই শখের কথা এ মুহুর্তে আমার মনে পড়ে গেল। সব মিলে সময় পাঁচ মিনিট ও দেরী হয়নি। তৈরী হওয়ার পর আমাকে একটা রশি দেওয়া হল এবং রশির মাথা সব সময় হাতে রাখতে বলা হল। অত:পর আল্লাহর নাম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম সু-বিশাল তরঙ্গ মালার ভিতর। সাগরের বুকে পড়েই নিজেকে পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমাকে সহ ঢেউ একটা চক্কর খেল। অত:পর স্থির হয়ে থাকালাম ঐ মূমূর্ষ লোকটির দিকে। উপর-নিচে ভাসতে ভাসতে জাহাজ থেকে আবার প্রায় বিশ-পঁচিশ গজ সরে গিয়েছিল লোকটি। আমার সাথের রশিটা কোমরের সাথে গিট দিয়ে নিলাম। এরপর প্রি-ষ্টাইলে সাঁতার দিলাম লোকটির উদ্দেশ্যে।

সাতারের অভ্যাস আগে থেকেই ছিল । স্কুল জীবনে একবার গ্রাম্য ক্লাবের আয়োজিত সাঁতার কাটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার ও পেয়েছিলাম ।

আমার শরীরের সামনে বুকের সাথে এবং পিছনে পিঠের সাথে লম্বালম্বী লাগানো দুইটা করে এবং মাথার পিছনে পাশাপাশি একটা সহ মোট পাঁচটি শূলা । প্রত্যোকটি শূলার প্রস্থ্য ও বেধ তিন ইঞ্চি করে এবং দৈর্ঘ্য প্রায় বার ইঞ্চি । দুই শূলার মাঝখানে পাঁচ ইঞ্চির মত ফাঁক। এক শূলার সাথে অন্য শূলা আর্মী কালারের চওড়া ফিতা দিয়ে সংযুক্ত। অনেকটা বাচ্চা ছেলের স্কুল বেগের মত গঠন। গলার দিকে তিন ফুটের মত একটা চিকন সুতা। সুতার সাথে একটি শক্তিশালী বাঁশি বাধা থাকে যদিও এখন নেই। এই হচ্ছে সুইমিং জেকেট বা লাইফ জেকেট। যত বড় ঢেউই আসুক, এই জেকেট একজন লোককে ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম। আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে।

ঢেউয়ের বিপরীতে আমাকে যেতে হচ্ছে বলে কিছুটা বিঘ্ন ও গঠছিল। বড় ঢেউ আসলেই নিজেকে ঢিলে করে দিই। ফলে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয় এবং পরনেই আবার এগুতে শুরু করি। আমি লোকটিকে দেখতে পাচ্ছি। তবুও জাহাজ থেকে সবাই চিৎকার এবং ইশারা করে লোকটিকে দেখিয়ে দিচ্ছিল । বিরাট জাহাজের সমস্ত যাত্রী এক পাশে দাড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। মানুষের ভারে দানবাকৃতি জাহাজটি এক পাশে কাত হয়ে আছে। যাত্রীদের চেহারায় উৎকন্ঠার ভাব পরিলতি হচ্ছিল। আমি তখন তরঙ্গ মালা ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে ।

অবশেষে লোকটি আমার নাগালের মধ্যে এসে গেল এবং আমি তাকে ধরে ফেললাম। অত:পর লোকটিকে আমার বুকের উপর টেনে নিলাম। মাথার পিছনের শূলা আমার মাথাকে ভাসিয়ে রেখেছিল। লোকটি এখন আমার বুকের উপর সম্পুর্ন নিরাপত্তায় আছে। কিন্তু কোন হুসতো নেই-ই বরঞ্চ নাক-মুখ দিয়ে ফানা বের হচ্ছে। চেহারা হয়ে গেছে মরা সাপের মত হলুদাব। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে লোকটির নাক মুখ পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। ফলে চোঁখ, নাক এবং মুখের ভিতর লবণাক্ত পানি ঢুকে যাচ্ছে। আমি বাম হাতে ওর মাথাটি উপরের দিকে তুলে ধরে জাহাজে ইশারা করলাম ধীরে ধীরে রশি টানার জন্যে।

আমার গ্রীন সিগনেল পেয়ে জাহাজ থেকে রশি আস্তে আস্তে টানা শুরু করল। আমি তখন নিজেকে সম্পূর্ন পানির উপর ছেড়ে দিলাম। আমি জাহাজে থাকতেই কানের প্রবেশ পথ কটন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলাম যাতে লবণাক্ত পানি মাথার ভিতর ঢুকতে না পারে। কারন আমার ধারনা ছিল মাথার ভিতর লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে চিন্তা ধারা স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না। তা ছাড়া মাঝ দরিয়ায় জ্ঞান হারাবার ও আশংকা করেছিলাম। উল্লেখ্য যে সম্পুর্ন বেসরকারী আমাদের এই ত্রান অভিযানে আমরা খুব ছোট খাট জিনিসের প্রতি ও নজর দিয়েছিলাম। যেমন- মুমবাতি, ম্যাচ, কাপুর, সিপ্টেপিন, ব্লেড, টয়লেট পেপার, বোল, গ্লাস, চামচ, এমন কি আমরা সুই-সুতা পর্যন্ত নিয়েছিলাম।

আমাদের সাত বস্তা ত্রান সামগ্রীর প্রধান বিষয় ছিল খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ। খাদ্য ছিল চিড়াগুড়। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয় ; সেটা হল লবণ তৈরীর দেশে আমাদেরকে লবণ ও নিতে হয়েছিল।

. ছোট বড় সকলের জন্যে মোট নয়শত ঊনষাট পিছ কাপড় আমাদের সাথে ছিল। এসমস্ত ত্রান সামগ্রী বিতরন করতে গিয়ে কুতুবদিয়ায় আমরা বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের জ্ঞান ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছিল বহু নতুন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা.... . সাথেই থাকুন ...

( আগামীকাল শেষ পার্ট প্রকাশ পাবে )

Click this link

এই লিংক কাজ না করলে

http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/2668/rashic/13721

" সাগর " ২য় পার্ট পড়ার দাওয়াত দিচ্ছি- আশা করি ভাল লাগবে, সেই সাথে অনেক কিছেই জানবেন । আশা করি মিস করবেন না.।

বিষয়: বিবিধ

৩০৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File