গল্প হলেও গল্প নয় এক সংগ্রামী যুবক লালুর গল্প ( প্রথম পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন সত্যলিখন ২৩ অক্টোবর, ২০১৩, ০৮:৫২:৪৫ রাত

গল্প হলেও গল্প নয়

এক সংগ্রামী যুবক লালুর গল্প

( প্রথম পর্ব)



মা, আমি পান্তা ভাত আর ডিম দিয়ে ভাত খাবো না, নারিকেল আর গুড় দিয়ে ছিড়া খেয়ে স্কুলে যাব। মা তো অবাক হয়ে বললো, “কি বলছো বাবা, এখনো তো আমন ধান কাটা শুরু হয় নাই ।আর দুই দিন পরেই ধান কেটে আনুক ।তারপর মা তোকে ছিড়া নারিকেল আর গুড় দিয়ে দিব”।

দুরন্ত কিশোর লালু ,মা কে কিছুই না বলে, এক বুক পানিতে কাচি হাতে নিয়ে ধান ক্ষেত থেকে ধান কেটে এনে খড়কুটা ছাড়ায়ে সেই ধান লাকড়ির চুলায় সিদ্ধ করে তা বেজে ছিড়া বানায়ে মা এর সামনে এনে দেয়।নারিকেল দিতে বললে তাও শুনে যে গাছে আছে ঘরে নেই একলাফে গাছের মগ ডাল থেকে নারিকেল ফেড়ে তা দিয়ে ছিড়া খাওয়া শেষ স্কুলে গেল ।

লালু, খেলা ধুলায় পড়া লেখায় যেমন ছটপটে তেমন ঢানপিঠে এক ছেলে।কুস্তি আর গোল্লাছুটে লালুকে হারায় কে।লালুর বাবা একদিকে স্কুল হেডমাস্টার আবার একজন সফল কৃষক। যার ফলে অনেক সদস্যের পরিবার হওয়ার পর গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ছিল।লালুর বাবার নিয়ম ছিল, কাজের সময় সবাই কাজ ভাগ করে নিয়ে যার টা সে শেষ করে রাখতে হবে, স্কুলের সময় স্কুল আর পড়ার সময় পড়া।লালু এই সব শেষ করেও গরু ছাগল কবুতর পালত ।লালু ছিলো পাড়ার দামাল ছেলেদের নেতা।তাই সে বলে দিত কেউ খেজুরের রস কেউ চাল কেউ লাকড়ি আর সে রান্না ও নারিকেল আনার দায়িত্ব নিয়ে কনকনে শীতের রাতে খেজুরের পায়েস রান্না করে ফেলত।আর বন্ধুদের নিয়ে হৈ হোল্লা করে খেয়ে আনন্দে রাত কাটাতো।

হঠাত ১৯৭১ সালে লালুদের পরিবারে নেমে আসে এক ভয়াবহ ঘুর্নিঝড়। সেই ধমকা হাওয়ায় হিরো পরিবারের লালুদের পরিবার হয়ে যায় জিরো।সেই ধ্বংসলীলায় লালুর ঐ ছোট চাচা মারা যান আর এক বাসার কাক ঝড়ের তান্ডবে ছড়িয়ে পড়ে সাত বাসায়।১৯৭৫ সালে আবার সবাই এক হওয়া শুরু করে।এক একজন একেক দিকে নিজের মাথা লুকানোর ঠাই করে নিতে লাগল। কিশোর লালু একা নিজের কথা না ভেবে বাবার মায়ের কষ্ট কমানোর জন্য ছোট বড় আরো ৪ ভাইকে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসল।সব ভাই দের কে বিভিন্ন বাসায় লোজিং মাস্টার হিসাবে দিলেন আর সব বাসার বাচ্ছাদের আর ভাইদেরকে নিজে গিয়ে গিয়ে সকাল আর সন্ধ্যায় পড়াতেন ।তার বিনিময়ে তারা শুধু ভাইদেরকে খাবার আর থাকার জায়গা দিল।তার সাথে নিজের পড়াও চালিয়ে গেল ।

লালুর দাদা ছিলেন অনেক বড় মাদ্রাসার হেডমাস্টার।তাই দাদা লালুর ইসলামের প্রতি ছোট বেলা থেকেই আগ্রহ দেখে আরো দাদা-দাদী আদর বেশী করতেন। ছোট চাচা কোরানের ধারক বাহক হিসাবে কাজ করতেন সাথে লালুকেও রাখতেন।

তাই ইসলামী আন্দোলনের ছিলো একজন বড় মাপের দায়িত্বশীল ও তুখার বক্ত্যা । সে খানেও লালু পিছিয়ে নেই।

লালু যৌবনে পা দিলেন।কলেজের পড়ার সাথে সাথে মাছ চাষের ট্রেনিং দিলো।সেখানে প্রথম হয়ে পুরুস্কার পেলেন । আর তারা চাষ করার জন্য মাছ দিলেন তা দিয়ে নিজেদের পুকুর আর বর্গা পুকুরে মাছের চাষ করে লালু পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের ব্যাবস্থ্যা করলেন।ভাইদের পড়ার খরচ দিয়ে তাদের পড়া এগিয়ে নিয়ে গেলেন।লালুর স্বপ্ন ছিল পরিবারের সবাইকে শিক্ষিত করে তোলা তার সাথে নিজেও শিক্ষিত হয়ে পরিবারের অবস্থ্যার পরিবর্তন আনা।তাই লালু বড় ভাইকে হাতে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন।

ঢাকা এসে লালু আরো কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে থাকে। বহু দিন যায় সারা দিনেও এক মুঠো অন্ন জুটে নাই পেটে।৩ দিনের উপবাস হয়ে ২ মাইল হেটে গিয়ে নিজের মামার বাসায় গিয়ে ভাত খান।মামা পরের সাপ্তায় আবার খাবার সময় লালু কে দেখে আগের সেই সুন্দর মুখটা কালবৈশাখীর কালো মেঘের মতো করে ফেলেন। মামা পরে জানিয়ে দেন এই ভাবে যেন ওনার আদরের ছেলের জন্য রান্না করা ভাল খাবারে এসে ভাগ না বসায়।লালু তাতেও হাল ছাড়া হয় না।

লালু নিজে আবার সেই কষ্ট শুরু করলেন।অনেক কষ্টের পর একটা টিউশনি আল্লাহ মিলিয়ে দেন ।আর লালুর সততা ও ইসলামের প্রতি একনিষ্টতা দেখে সেই বাসায় গিন্নী মায়না হিসাবে খাবার দিতেন।আর বাড়ির কর্তা তার জন্য স্কুলের একটা চাকরী ঠিক করে দিলেন।লালু কখনো নিজের শুখের জন্য লালায়িত ছিল না ।তাই এই টিউশনি আর স্কুলের চাকরী নিজের সাথে আনা বড় ভাইকে দিয়ে ভাইয়ের কষ্ট দূর করেন।প্রথম দিকে থাকার খাবার অনেক কষ্ট হলেও পরের দিকে হলে ডাব্লিং সিট পেয়ে যায়।তাতে থাকার আর ডাল ভাত খাবারের ব্যবস্থ্যা হয়ে যায়।আলহামদুলিল্লাহ।

অন্য ভাই বোনদের ও নিজের পড়ার খরচ চালানোর জন্য লালু আবার ঢাকার দূর দুরান্তে পায়ে হেটে গিয়ে ৩টি টিউশনি করাতো।৩টার মোট বেতন ছিল ৫০০টাকা।প্রথম মাসের টাকা দিয়ে একবাসার গীন্নি একশার্ট প্রতিদিন পরার কারনে আর না আসতে বলে দেন।আরেক বাসায় জুতার তলা ফাটা কেন তাই আরেক খাণেও না করে দেয়।হায়রে লালুর কপালটাই কেমন জানি? কিন্তু অদম্য স্পীহার লালু তাতে মোটেও হতাশ নয়।কারন লালু জানত,পর্বতআরোহী কখনো সমতল ভুমি পাবে না।কিন্তু তারপরেও তাকে সেই পর্বতের চুড়ায় উঠতে হবে।আর যেই টাকা পেল তা দিয়ে মায়ের পরার কাপড় ,বোনের স্কুলের জামা আর বাবার জন্য শীতের লেপ কিনে দিলো।লালুর, তার বাবা মায়ের প্রতি ছিলো অনেক সন্মান ও দরদী।সবাইকে নিয়ে এমনি করে কষ্টের মাঝে চলল লালুর সংগ্রামী জীবন।

একদিন লালু দেখেন ,তার রুমমিট তারই মত আর্থিক অস্বচ্ছল বন্ধুর গায়ে নতুন শার্ট।বন্ধু কোথায় আলাদ্দিনের চেরাগের সন্ধান পেল জানতে চাইলে সে তা বলল না ।লালু এর রহস্য বের করার জন্য সেই বন্ধুর পিছু নিলো।পরে দেখল বন্ধু গিয়ে ডুকলো মতিঝিল সোনালী ব্যাংকে। বুঝতে আর বাকী রইল বন্ধু এখানে কি করে ।সে দেখলো বন্ধু ব্যাংক এ একাউন্ট বা টাকা তুলতে আসা অশিক্ষিত মানুষ দের ফরম গুলো পুরোন করে দিলে তারা পারিশ্রমিক হিসাবে ৫-১০টাকা দিয়ে যায়।প্রথম দিন সব দেখলো ।পরের দিন থেকে লালু একই কাজ শুরু করল। লালুর ভাগ্যের চাকা একটূ ঘূরতে শুরু করল।তখনি লালু গ্রামের ভাইদের ঢাকা আনা শুরু করল।এখানে কাউকে কলেজে কাউকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করায়ে দিলো। আর তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার জন্য নিজে গাদার মত পরিশ্রম করতে শুরু করল।

আমি প্রথম পর্বে লালুর কিশোর আর যৌবনের প্রথম দিক পর্যন্ত গল্পের আসলাম।এখনো বাকী আছে আছে লালুর দাম্পত্য জীবনের গল্প ।সেই পর্যন্ত আমার সাথে থাকবেন।

শিক্ষাঃ

১। বর্তমান বয়সের ছেলেরা কিশোর বয়স টা হেলায় ফেলায় কাটিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ এর জীবনের ফাউন্ডেশান গড়তে হয় এই কিশোর বয়সে। যার উপর নির্ভর করে তার যৌবন সহ বাকী জীবন। কিশোর দের মধ্যে অনেকে এখন এই মুল্যবান সময়টা বন্ধু বান্ধব ,আড্ডা বা নেটে বসে নষ্ট করে ফেলে।ভোরের সূর্য্য উঠা দেখেই মানুষ বলতে পারে বাকী দিন টা আবহাওয়া কেমন হবে।তেমনি কিশোর বয়স।

২।জীবনে কঠিন বিড়ম্বনা আসলে প্রচন্ড ব্যাথাকে আইস সাগরের মতো জমাট বেধে ধৈর্য্য ধারন করে রাখতে হবে।কারন একটি কুড়ি থেকে দুইটি পাতা আর দুইটি পাতার মাঝখান থেকেই একটি কলি বের হয় ,সেই কলিটাই পরে ফুলে পরিনত হয় ।এই ভাবে ধৈর্য্যধারন করেই আল্লাহর সন্তুষ্টি মিলে।

হে ঈমানদারগন! তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর।” (সুরা আলে ইমরান,আয়াত : ২০০)

“হে ঈমানদারগন! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সুরা বাকারা,আয়াত : ১৫৩)

৩। হতাশা বা নিরাশার কালো মেঘ যেনো হাত ছানি দিয়ে ভোরের সুর্য্যের সোনালী আলো ঢেকে দিতে না পারে ।তাই যুবকদের জীবনে নানা রকম ব্যার্থতা আসলে ভেঙ্গে পড়া যাবে না।জীবনের স্প্রীডব্রেকার আসবেই তখন থেমে না গিয়ে আরো পরিপুর্ন স্প্রীডে আগাতে হবে।

“মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো৷”আলে ইমরান

৪।একজন মুমিন সুখে থাকলেও আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত আর দুঃখে থাকলেও সরর করার মাধ্যমে ধৈর্য্য ধারন করা উচিত। তাতেও আল্লাহ স্নতুষ্টি হন ।

আবু ইয়াহইয়া সুহাইব বিন সিনান (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ “ঈমানদারের বিষয় নিয়ে আমি খুব আশ্চর্যবোধ করি। তার সকল কাজেই আছে কল্যাণ। ঈমানদার ছাড়া অন্য কোন মানুষের এই সৌভাগ্য নেই। তার যদি আনন্দ বা সুখকর কোন বিষয় অর্জিত হয়, তাহলে সে আল্লাহর শোকর করবে, ফলে তার কল্যাণ হবে। আর যদি তাকে কোন বিপদ-মুসিবত স্পর্ষ করে, তাহলে সে ধৈর্য ধারণ করবে। এতেও অর্জিত হবে তার কল্যাণ।” (মুসলিম)

৫। শুধু নিজের কথা না ভেবে মা বাবা ভাই বোন আত্নীয় স্বজন্দের কথাও ভাবতে হবে।আজকে তুমি যত বড় হয়ে এই পৃথিবীতে তোমার কৃতিত্ত্ব রেখে যাচ্ছ তা এই মা বাবার অবদান।আল্লাহর পরেই এই মা বাবার স্থান।মা বাবা কে অবহেলা করলে তোমার দুনিয়াও যাবে সাথে আখিরাতও যাবে।তোমার সব কিছুতে এই মা বাবার হোক আছে। তা আদায় করা তোমার জন্য ফরজ।

“পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো৷ যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে “উহ্” পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন৷” বনী ইসরাইলঃ ২৩-২৪

হে আল্লাহ আমাদের ধৈর্য্য ধারন করে কঠোর পরিশ্রম করার শক্তি দাও।



বিষয়: বিবিধ

২৪৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File