ছেলেরা আমার বন্ধু

লিখেছেন লিখেছেন সত্যলিখন ২৭ আগস্ট, ২০১৩, ১০:৫৭:২৯ রাত

ছেলেরা আমার বন্ধু



ছোট বেলা থেকে ছেলেদের খুব আদর লাগত । তাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম ।কল্পনার সাগরে ভেলা ভাসিয়ে তাদের সেখানে চড়িয়ে অনেক দূর দুররান্তে ভেসে বেড়াতে খুব ভালো লাগত। বুকের মাঝে যত ব্যাথাই কাল মেঘের মত জমা হত তাদের কাছে মন উজার করে বলতাম ।তারা বুঝত কিনা তা চিন্তা করার বয়স আমার তখন ছিল না ।কারন আকি ছিলাম তাদের একজন কিশোরী মা ।সাগরের মাঝে খড়কুটাও নাকি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অবলম্ভন হিসাবে ধরে রাখে ।আমার কাছে ছেলেদের তেমন মনে হত ।

যৌথ সংসারের কাজের ফাকে ফাকে ছেলেদের সাথে খেলতে আমার খুব ভাল লাগত ।ওদের সাথে কেউ খেলুক আমি সেটা পছন্দ করতাম না ।আমি ওদের ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দেশ বিদেশ ঘুরিয়ে আনতাম ।কি আনন্দ করতাম ঘূরে আসার পরে ।কে কোন দেশে যাবে আগেই বলতে হত ।কেন যাবে তাও বলতে হত ।আর ঘোড়া হতাম আমি । ছোট রুমের ভিতরে দরজা বদ্ধ করে থাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছিল একেকটা দেশ ।কোন দেশে যাওয়া হলে কিছুক্ষন থাকতে হত ।এর মাজে আমি পড়া চালিয়ে যেতাম ।

আমার অনেক ইসলামিক গল্পের বই পড়তে হত তাদের গল্প শুনানোর জন্য ।ইসলামিক গল্প গুলা বেশি শুনতে চাইত ।আমি ছোট বেলায় বাবা হারান মেয়ে তাই বাবা ডাকতে পারি নাই ।সমবয়সিরা তাদের বাবাকে ডাকলে তাকিয়ে থাকতাম ,আর মন দিয়ে শুনতাম ।তাই আমি ছেলেদের এখন মন ভরে বাবা , আব্বু এই সব ডাকে ডাকি। ওদের মাঝে এই জন্য প্রতি্যোগিতা হত ।কে কতবার আব্বু ডাক শুনেছে।

ওদের পড়া লেখা আর আমার পড়ালেখা একসাথে চলত। নিদিষ্ট সময় থাকত এর ভিতরে কেউই কার সাথে কথা বলতে পারত না।মিষ্টি কুমড়ার বিচি কে বাদাম বানিয়ে ছিলতে ছিলতে সুরা গুলো মুখস্ত করান হত। এক আয়াতে মুখস্থ্য বলতে পারলে ৫ টা বিচি দেওয়া হত ।তাতেও ছেলেদের মাঝে কি এক অপুরন্ত আনন্দ ছিল ।

আমার সুবিদার জন্য তাদের কোএ্যাডুকেশণে ভর্ত্তি করাতে হয়। কারন আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করা আর তাদের আনা নেওয়ার সুবিদার জন্য ভার্সিটির পাশের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরটরী স্কুলে ভর্ত্তি করাতে হয় । তাই তারা প্রথম প্রথম খুব লজ্জা পেত ।পরে পরে মেয়েরা কিছু বললে আমার কাছে এসে আগেই বলত । আমি যা বুঝিয়ে বলতাম তাই মেনে নিত। বড় হওয়ার পরও আমাকে বান্ধবী্র মত বাহিরের সব কথা বলত । বিয়ের অনুষ্টান শেষে মেঝে ছেলে কে তার বউ এর পাশে বসাতে তার চাচী ফুফুরা নিলে সেখানেও আম্মু বলে জোর গলায় ডাক দিয়ে আমাকে খুজতে থাকে । আমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে সে একটা মেয়ের পাশে গিয়ে বসবে ।এই নিয়ে এখন আত্নীয় রা হাসাহাসি করেন।

এমন কি এখনও বড় হয়েও তাদের মনের সব কথা আমাকে বলে । ওদের আপন জন রা এই নিয়ে হাসাহাসি করত। আমি তাদের মনে কোন ভয় সৃষ্টি করি নাই । তাদের প্রতিটি কথার ব্যাখ্যা সহজ ভাবে করেছি । প্রতিটি প্রশ্নের জবাব সহজ ভাবে দিয়েছি। জানার কৌতুহলে বাধা দেই নাই।



ওদের পড়া আমি না ধরলে ওদের মনঃপুত হতনা ।প্রতিটি পড়ার হিসাব আমাকে নিতে হত । স্কুল ফিরার পর আমাকে অনেক ক্ষন আগে শুনতে হত াজ স্কুলে কে কি বলেছে বা কে কি করেছে । আমাকে পড়ার বিষয় , দিন ও সময় হিসাব করে দিতে হত । এখনও দিতে হয় । লন্ডন থেকে পরীক্ষা দিয়েছে, তখনো আমাকে বলতে হয়েছে কখণ কী পড়বে ।পরীক্ষার সময় ওদের পরীক্ষা, না আমার পরীক্ষা এটা বুঝতে কষ্ট হত।

ইসলামিক মাইন্ডের ছেলেদের সাথে চলতে চলতে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করে। আলহামদুলিল্লাহ । ঐ সব ছেলেদের আমার বাসায় নিয়ে আসত ।আমার ছেলেদের কে ইসলামের অনেক জ্ঞান তারা দান করে ।আমার বাসায় প্রোগ্রাম হত । সেই খানে তাদের ভাইয়ারা কি বলেছে সব এসে আমাকে শুনাত ।আমার মেয়ে না থাকায় তারা আমার সাথে মেয়েদের চেয়ে বেশি কাজ করত। কাজ ভাগ করে নিত । আমার কাজ ছিল বার বার very good , আলহামদুলিল্লাহ , মাসাআল্লাহ ,মারহাবা ইত্যাদি উতসাহ উদ্দীপনা মুলক কথা বলা ।

ঈদের সময় বেশি আনন্দ হত। ওদের আব্বুর নিয়ম ছিল ৫ ছেলেকে ঈদের কয়দিন আগে এক সাথে দোকানে নিয়ে যেতেন । সামর্থের ভিতরে যার যা পছন্দ তা কিনে দিতেন ।সারা বছরে এই একবারই কিনা কাটা হত । কিন্তু ছেলেরা তাদের আম্মু কে ছাড়া পছন্দ করতে পারত না । তা না হলে মনে হত তারা ঠকে যাছে ।পরার পর আমাকে বারবার বলতে হত তোমাদের খুব সুন্দর লাগছে।

মসজিদ থেকে বা ইসলামের জ্ঞানের শিক্ষিত কোণো ভাই থেকে কোরানের বা হাদিসের অজানা কিছু জেনে আসলে আগে এসে আমাকে শিখায় ।আমি ছেলেদের থেকে অনেক কিছূ শিখি এখন ।আমার জীবনের অনেক ভুল আমার ছেলেরা সংশোধন করিয়ে দেয় এখন । বাগানের আগাছা পরিস্কার না করলে গাছ তার গোলাপ গুলো সুন্দর ভাবে সাজাতে পারে না । তাই আল্লাহ আমাদের পরিবারের বাগানের আগাছা নামের ভূল গুলো সরানোর মাধ্যমে আমাদের জ়ীবনকে সুন্দর ভাবে সাজানোর তাওফিক দান করুক ।

যে ছেলেদের বুকের গহীন কোনে সুশীতল আলো বাতাস দিয়ে লালন পালন করেছি । বাহিরের প্রচন্ড ঝড় ঝাপটা নিজে হজম করেছি তাদের কে তা মুকাবিলা করতে দেই নি । ব্যারিস্টারি পড়তে বিদেশ যেতে হবে ।এটা মন মানতে চাইল না ।তাদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকব ।ভাবলাম ভিসা পাওয়া কি এত সোজা।কিন্তু আল্লাহর রহমত থাকলে যে সব সোজা তা আমার বুঝ তে বাকি রইল না । গুলশান সাইমন সেন্টার থেকে ফোন করে যখন খবর দিল যে ভিসা পেয়েছে তখন শূধু আল্লাহর কাছে শোকর করে কান্না করি । যতই দিন যাচ্ছে বিদায়ের পালা ততই ঘনিয়ে আসছে ।

মাইক্রোবাসটি যখন বিমান বন্দরে ঢুকছিল তখনো বুঝতে পারিনি এই মাইক্রবাসটি বের হতে আমার এত কষ্ট হবে । ছটো দুই ছেলে খুব আনন্দ করছিল । ছেলে দের দিকে যত বার তাকাচ্ছিলাম আমার হৃদয়ের ভালবাসার বাদ্য যন্ত্রে ততবার বন্ধু হারানোর কান্নার সুর বেজে বেজে উঠছিল । বন্ধুর ব্যাথায় আমার হৃদয়ের কাল মেঘ আকাশ ভরে গেল ।প্রকৃ্তির বারিধারা আর আমার দুই নয়নের বারিধারা একাকার হয়ে গেল।আমি বাসায় এসে বন্ধু হারান ব্যাথায় আহত পাখির মত ডানা ঝাপ্টায়ে ছটপট করতে থাকলাম ।

আমি ঐদিন বুঝেছিলাম প্রানপ্রিয় বন্ধু দূরে গেলে অন্য বন্ধু কেমন করে । আর সারা বিশ্বের মায়েরা সন্তান দূরে রেখে আহত পাখির ন্যায় ডানা ঝাপটিয়ে কেমন ছটপট করে তাদের মনের না বলা ব্যাথা হজম করে । আজও আমার দুই নয়ন মৃগয়া হরিনীর ন্যায় আমার বন্ধুদের খুজে ।ওদের প্রিয় খাবার গুলো খেতে এখনো কষ্ট হয় ।



আমার এই লেখার পিছনে সব ছেয়ে বড় উদ্দেশ্য আমরা সন্তান কে শুধু শাসন না করে ভালবাসার মাধ্যমে তাদের কে সুন্দর একটা সমাজ উপহার দিতে পারি । মায়ের ভালবাসার টানে সন্তান অনেক খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে পারে । ইসলামের পথে অগ্রসর হতে মায়ের অবদান অনেক বেশি ।

আমি এখনও ভয়ে থাকি তারা তাদের দুনিয়াবী কর্ম কান্ডের জন্য আমাকে জাহান্নামে নিবে না জান্নাতে নিবে । আমাকে কি গুনাগার মা হিসাবে হাশরের মাঠে ডাক শুনতে হয় নাকি ?

হে আমাদের পালন কর্তা ,স্বামী ও সন্তান দের এমন বানিয়েদিন যাতে চোখ শীতল হয়ে যায় এবং আমাদেরকে মুত্তাকিন দের জন্য আদর্শ স্বরুপ দান করুন । সকল মায়ের সন্তানদের ছদগায়ে জারিয়া হিসাবে দান করুন ।আমিন ।আমিন ।আমিন।

বিষয়: বিবিধ

৩৬৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File