বাঙালি, বাংলাদেশী এবং ইসলামী সংস্কৃতি
লিখেছেন লিখেছেন রুপসিবাংলা ১৬ মে, ২০১৩, ১০:৪৭:১৭ রাত
বাঙালি সংস্কৃতি, এর উত্স,উপাদান, বিস্তৃতি এবং জাতি গঠনে এর ভূমিকা কেমন সেটি যেমন একটি চমত্কার আলোচনার বিষয়, তেমনি কিভাবে এদেশের মানুষ ইসলামী সংস্কৃতির আদলে নিজেদের সংস্কৃতি গড়তে সচেষ্ট হলো সে আলোচলাও কম আকর্ষনীয় নয়| মাঝে দিয়ে বাংলাদেশী সংস্কৃতি একটি ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি এ দশের মানুষকে উপহার দেবার কিঞ্চিত চেষ্টা করলেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ না থাকায় এর গতিপ্রকৃতি, উপাদান উত্কৃষ্টতা, এবং এর স্বল্পমেয়াদী কিম্বা দীর্ঘ মেয়াদী ফলাফল ও অজ্ঞাত থেকে গেলো | তবে বাংলাদেশী সংস্কৃতির বলয় সম্ভবত না ইসলামকে দুরে ঠেলে দেয় আর না বান্গালিত্তকে পর করে দেয় | সে আলোচনা পরে আসছি|
ভাষার সাথে সংস্কৃতির যে যোগ সেটি নতুন করে বলার কিছু নয়, সে হিসাবে বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক যদি বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরা হয় তা হলে এর উত্স চর্যাপদের মাধমেই বলতে হবে | বাংলা ভাষা সহ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ভাষাসমূহে সংস্কৃত ভাষার যে প্রভাব সেটি যেমন মৌলিক তেমনি গভীর; এটি যেমন একটি দিক ঠিক এর অন্য একটি দিক ও রয়েছে| হিন্দু ধর্মের যে বেদগ্রন্থাবলী যেমন, সাম বেদ, ঋক বেদ, যজুর বেদ, এবং অথর্ব বেদ- এগুলোর যে আবেদন কিম্বা এগুলোর যে সংবাদ সেগুলোর বহন হলো আদি সংস্কৃতি ভাষা | এ বেদ সমূহের যে কথকতা, যে আবেদন, যে অভিবাক্তি, যে নিদর্শনাবলী এবং নির্দেশনাবলী, যে ভাবতত্ত, যে ঈশ্বর তত্ত্ব, যে মানবিকতার ধারণা, যে জ্ঞানপুঞ্জ, যে অধ্যাত্তিকতা, যে প্রায়োগিকতা, এর সবকিছুর কেন্দ্রীয় বিষয়-বক্তি হলো মানুষ অর্থাৎ মানুষের জন্য-ই এ মহা আয়োজন | এ আয়োজন বৃথা কোনো সৃজন নয় বটেই | ফলত: যেটি ঘটলো যে চর্যাপদ হতে এ ভাষার জন্ম, সে ভাষা বাহক বনে গেলো একটি নির্দিষ্ট ধারার ধার্মিকতা বা ধর্মতত্ত্ব | এখানে মনে রাখা দরকার, গোটা এশিয়া এবং ওই সময়কার পাশ্চাত্তেও মানুষের ভালো-মন্দ বিচারের জন্য ধর্ম এবং তার শিক্ষাকে-ই প্রধান উত্স ধরা হত, এখনো তাই হয় এ উপমহাদেশে | এর ফলে যা হলো সেটি হলো বেদ কেন্দ্রিক সংস্কৃতি তথা হিন্দু ধর্ম কেন্দ্রিক সংস্কৃতি সংস্কৃত ভাষাভাষী মানুষের দৈনন্দিন সংস্কৃতির অন্যতম উত্সে পরিনত হঅল এবং অনেক গোত্রকেন্দ্রিক, জাতিকেন্দ্রিক, সংস্কৃতি স্বাভাবিক বাস্তবিকতার কারণেই হারিয়ে গেলো | এর সুদুরপ্রসারী ফলাফল যে দাড়ালো সেটি হলো এই , সংস্কৃত ভাষাকে মূল ধরে যে ভাষার-ই আবির্ভাব হলো সে ভাষার এবং সেই ভাষা আশ্রিত সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ ঘটলো বেদকেন্দ্রিক সংস্কৃতির | সুতরাং বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক অথবা বাংলা ভাষা নির্ভর যে বাঙালি সংস্কৃতি সেটি ভাষাগত কারণে যেহেতু সংস্কৃত ভাষা নিঃসৃত সেহেতু বাঙালি সংস্কৃতি প্রচন্ড ভাবে সার্বিক দিক দিয়ে বেদ কেন্দ্রিক সংস্কৃতি দ্বারা আবর্তিত-আচ্ছাদিত-পুষ্টিত-প্রসারিত-প্রথিত |
কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির এ চলমানতায় বিপত্তি ঘটলো যখন ইসলাম এ দেশের আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন-দলন-হনন-পেষণ থেকে তথাকথিত নিম্ন জাতের মানুষদের ন্যায় ভিত্তিক প্রাপ্তি-যোগ-অনুযোগ-প্রভাব-প্রতিপত্তি-সাচ্ছন্দ-স্বাধীনতা-মনুষ্য ফিরিয়ে দেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে আগমন করলো এবং মানুষের মন ও দেশ জয় করলো, ন্যায় ভিত্তিক-সমশ্রেনিক-আনুপাতিক সমতা ভিত্তিক একটি সমাজ উপহার দিলো, শত শত নানা জাত-উপজাত-উচ্চশ্রেনী-নিম্নশ্রেনী অবয়বের মানুষদের আশ্রয় দিলো ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে নিজ নিজ ভাষায় তখন থেকে ভাষা ঠিক থাকলেও ভাষার বাহক সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটলো | অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে বেদ কেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব কমতে শুরু করলো | বরং এ স্থলে যোগ হলো ফার্সি ভাষা ও সংস্কৃতি এবং আরবী ভাষার নানা উপাদান | ইসলামকে মানুষ তাদের জীবন-যাপনের সুত্র মেনে নিয়ে এ ধর্মের শিক্ষার আলোকে নতুন ভাবে সৃজন করতে সচেস্ট হলো তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিশ্বাস-আস্থা-শাসন-জাতিগঠন প্রক্রিয়া | অনেক হিন্দু জমিদার এবং উচ্চজাতের মানুষ ও আকৃষ্ট হলো এর শ্রেনীহীন-বঞ্চনাহীন-মানবকেন্দ্রিক মতাদর্শের প্রতি| এক নতুন ধারার বাঙ্গালা সাহিত্য জন্ম নেয় যেটি তার বৃন্ত থেকে একেবারেই আলাদা অর্থাৎ এ ভাষার আদি উত্স বেদ-বাণী বাহক সংস্কৃত ভাষা হলেও পরবর্তিতে এটি তার অবয়ব পরিবর্তনের ধারায় পরিনত হলো এক ভিন্ন স্বাদের সংস্কৃতির বাহক হিসাবে| অন্য একটি মজার দৃশ্যও পরিলোক্ষিত হয়, আর সেটি হলো একই ভাষার দুই ভিন্নই সংস্কৃতি| এই সংস্কৃতি-ই পরিগণিত হয় ইসলামী সংস্কৃতি নামে| সুতরাং দেখা যায়, ইসলামী সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির মতো ভাষার উত্সের কারণে চাপিয়ে দেয়া বেদ-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি নয় বরং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন| মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলামিক সংস্কৃতিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বলয়ে শুধু আশ্রয়-ই দেয় নি বরং একে লালিত-পালিত-পুষ্টিত-পরিচার্জিত করেছে, করেছে উত্কর্ষিত| এটি তার দখলে নিয়েছে মানুষের অন্দর-বাহির সকল মহলকেই| সাথে সাথে একটি সুক্ষ অপ্রস্ফুটিত-সুপ্ত-প্রলয়ংকারী সাংস্কৃতিক দ্বন্ধের জন্ম দিলো যেটি অপেক্ষমান থাকলো কয়েক শতাব্দী| উপনিবেশিক শাসনাধীন থাকবার সুবাধে ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু উপাদান ও মিশ্রিত হয় বঙ্গীয় বাঙালি সংস্কৃতিতে| এ তাবত মিশ্রন প্রক্রিয়া এবং সন্গাকৃতিক দ্বন্ধের সুপ্তাবস্থা চলে প্রায় কয়েক শতাব্দী জুড়ে যার ইতি ঘটে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যখন বাংলা ভাষা একটি গ্রহনীয় রূপ লাভ করেছে| মজার ব্যাপার হলো '৭১ পরবর্তী বাঙ্গালা ভাষা ফিরে গেলো ইসলাম-পূর্ব বাঙ্গালা ভাষার যে অবস্থান সেখানে; অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি '৭১ পরবর্তিতে রাজনৈতিক-ধর্মীয়-অধ্যাত্তিক-ভৌগলিক-অর্থনৈতিক-মতাদর্শিক কারণে বাঙ্গালা ভাষার উপর বেদ-ভাষা কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ভিন্ন অন্য যে কোনো ভাষা-নির্ভর সংস্কৃতির প্রভাব শুন্যের কোটায় চলে আসলো | এক সময়ের সুপ্ত সাংস্কৃতিক দ্বন্ধ অনুকুল পরিবেশে সক্রিয় হতে শুরু করলো|
অনেকটা খালি মাথা গোল দেবার আয়োজন চললো বেদ-ভাষা কেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার-গবেষণা-উত্কর্ষতার জন্য| একদিকে ইসলামী রাজনীতি-সমাজনীতি-সংস্কৃতির প্রবাহমানতার অনুপস্থিতি অন্যদিকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চতুর্মুখী সহমর্মিতা-সহযোগিতা-রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক আনুকুল্য ইসলামী সংস্কৃতির অবদমনের গতিকে বেগবান করে তুলেছিলো| এই দ্বান্ধিকতার মাঝে ফাঁকা মাঠে গোল দেবার কাজে বাধ সাধলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুধ্হ বাংলাদেশি সংস্কৃতির ধারা প্রবর্তনের আহবান| ফলে কিছুটা হোচট খেলো বাঙালি সংস্কৃতির বাধাহীন অগ্রসরতা| প্রাথমিকভাবে নানা আয়াজন থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, শিক্ষিত জনবলের অভাব, দূরদর্শী চিন্তাশীল বাক্তির অপ্রতুলতা, ক্ষমতার ক্ষয়িষ্ণুতা, ইত্যাদি বাংলাদেশি সংস্কৃতি নামে পৃথক ধারার সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে দ্বন্দে টিকে থাকতে পারে নি|তবে যে কাজটি সন্তর্পনে কিছুটা হলেও করা সম্ভব হয়েছে সেটি হলো একটি ভিন্ন স্বাদের ইসলামী সংস্কৃতির উদ্ভাবন এবং বাঙালি সংস্কৃতির সর্ব থাবার আস্ফালন প্রতিহত করণ|
যে দেশে নব্বই ভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, সে দেশের মানুষের সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রতিফলন থাকা অনেকটা বাঞ্চনীয়-ই বটে| কিন্তু এই ইসলাম মিশ্রিত সংস্কৃতির স্থলে বেদ-ভাষা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে আবশ্যিক-অনিবার্য-প্রথাগত-ঐতিহ্যবাহক ধরে নিয়ে সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস-চেতনা-চিন্তা-ঐতিহাসিকতাকে অপমানিত করার প্রয়াস শুধু দুঃখজনক-ই নয় বরং অনভিপ্রেত এবং প্রতিরোধ্য| বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি এখন ত্রি-মূখী দ্বন্ধে পিষ্ট, বেদ-ভাষা কেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলাদেশি সংস্কৃতি বলয়ে আশ্রিত ইসলামী সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তি-আশ্রিত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি| এ ত্রি-মূখী দ্বান্দিকতার মাঝে নিজের চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বলয় খুঁজে নিয়ে সেটিকে অগ্রসর করে নেবার দায়িত্ব থেকে কোনো বক্তি মুক্ত নন| এ দায়িত্তানুভুতি পরিপালনে দরকার জ্ঞান,জ্ঞান,জ্ঞান এবং স্বল্প ও বৃহত্তর পরিসরে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সামর্থানুযায়ী অনুশীলন|
বিষয়: বিবিধ
১৮৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন