আ’লীগ সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত ও ভয়ঙ্কর করে তুলছে!!!!!
লিখেছেন লিখেছেন বিপ্লবী ১৮ মে, ২০১৩, ১২:২২:০৮ দুপুর
শিরোনাম দেখে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। কিন্তু মতাসীনদের বদৌলতে সব মিলিয়ে দেশের অবস্থা এতটাই ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এর চাইতে ভালো কোনো বিষয় ও শিরোনামের কথা কল্পনা করা যাচ্ছে না। এখানে উদ্দেশ্য আসলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা দেয়া। ইতিহাস যাদের স্বচ্ছভাবে জানা নেই কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক ইতিহাস’ যারা মুখস্থ ও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই ‘বঙ্গবন্ধু’র ব্যাপারেও বিস্তর জেনেছেন। জানতেই হবে। কারণ, সবকিছু তো তিনি একাই করে গেছেন! ভয় নেই, মতাসীনদের সে ‘সঠিক ইতিহাস’কে চ্যালেঞ্জ বা অস্বীকার করা মোটেও উদ্দেশ্য নয়, এই নিবন্ধে শুধু একটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। সেটা গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মকাণ্ড। কারণ জানতে হলে দু-চারটি বিষয়ের দিকে ল্য করতে হবে। মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গভীর রাতে চালানো গণহত্যা থেকে দেশজুড়ে চলমান গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতন পর্যন্ত সরকারের কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ধমক দিয়ে সংলাপে বসার যে আহ্বান জানিয়েছেন তার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের নেয়া সংলাপের উদ্যোগকে তো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায়ই নেই। এর কারণ, সংলাপ নামের আয়োজনের জন্য রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। মাথা বাংলাদেশের জনগণের হলেও ব্যথায় এরই মধ্যে কাতর হয়ে পড়েছেন সেই বিদেশীরা, যাদের বিরুদ্ধে অনেক উপলইে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তপে করার এবং রাষ্ট্রমতায় রদবদল ঘটানোর প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে।
শুরুতে বলা দরকার, সচেতন অনেকেও মনে করেছিলেন, বিশেষ করে মতিঝিলে গণহত্যা চালানোর অপরাধবোধের চাপে মতাসীনরা হয়তো কিছুটা হলেও সমঝে চলবেন। এমন বক্তব্য দেয়া থেকে অন্তত বিরত থাকবেন, যার ফলে রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে না যায়। অন্যদিকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে পাতি নেতারা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেও লাফিয়ে এসে গেছেন দৃশ্যপটে। আক্রমণও করে চলেছেন যথারীতি। যেমন ৯ মে এক দলীয় অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের যে ‘বাচ্চা-বাচ্চা’ কর্মীরা মারা গেছেন সেসব মাদরাসা ছাত্রকে নাকি বেগম খালেদা জিয়া ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন! তাদের কাঁধে ভর করে তিনি নাকি মতায় যেতে চেয়েছিলেন! তার নির্দেশেই হেফাজত কর্মীরা নাকি ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, পবিত্র কুরআন শরীফ পুড়িয়েছে! এসব কারণে খালেদা জিয়াকে ‘হুকুমের আসামি’ বানানো হবে। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ও সুরে কথাগুলো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ, এমন এক সময়ে বেছে বেছে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি ‘হুকুমের আসামি’ বানানোর হুমকি দিয়েছেন যখন এফবিসিসিআইসহ দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী ও মহলের পাশাপাশি বিদেশীরাও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হতে শুরু করেছেন। মাত্র ক’দিন আগে, ৭ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা এক সংবাদ সম্মেলনে উভয় পকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। এদিকে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলও একই আহ্বান মুখে ১০ মে ঢাকায় এসে তিনদিনের সফর সেরে ফিরে গেছেন। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবহিত না থাকার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি যখন আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানানোর পরিবর্তে হুমকি উচ্চারণ করেন এবং ভয় দেখান, তখন একথা মনে না করে উপায় থাকে না যে, তার মধ্যে আর যা-ই হোক অন্তত সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্য বা সদিচ্ছা নেই। তিনি বরং সঙ্কটকেই আরও ঘনীভূত করতে চাচ্ছেন।
ল্য করলে দেখা যাবে, দলীয় ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মূলকথাগুলোও কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। তিনি এমনভাবেই অভিযোগ তুলেছেন যা শুনে মনে হতে পারে যেন হেফাজতে ইসলাম রাতারাতি বিএনপি হয়ে গেছে অথবা বেগম খালেদা জিয়া নিজেই বিএনপি ছেড়ে হেফাজতের আমীর হয়ে বসেছেন! অথচ সত্য হলো, ৫ মে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি হেফাজত ঘোষণা করেছিল এক মাস আগেÑ ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে। এ প্রসঙ্গে খুবই ল্যণীয় অন্য একটি বিষয় হলো, বেগম খালেদা জিয়ার ওপর সব দোষ চাপাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সুকৌশলে গণহত্যার অপরাধকে আড়াল করতে চেয়েছেন। অথচ প্রাথমিক মুহূর্ত থেকেই সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জেনে গিয়েছিল, যৌথ বাহিনী কতটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। রাতের অন্ধকারে চালানো ওই অভিযানে হাজারের অংকে হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছেন বলে প্রচারণা রয়েছে। ফেইসবুক ও অনলাইন পত্রিকাসহ বিদেশী গণমাধ্যমেও অনেক লাশের ছবি দেখা গেছে। অভিযোগ উঠেছে লাশ গুম করে ফেলারও। ওই হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেেিত কর্তব্য যেখানে ছিল দোষ স্বীকার করা ও জনগণের কাছে মা চাওয়া, প্রধানমন্ত্রী সেখানে উল্টো আবারও আক্রমণাত্মক কৌশলই নিয়েছেন। বলার অপো রাখে না, এর পেছনেও রয়েছে সংলাপ ও সমঝোতা এড়িয়ে যাওয়ার একই উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকেও সম্ভবত ‘এক হাত’ দেখাতে চেয়েছেন তিনি। কারণ, বিশেষ করে গত ফেব্র“য়ারি থেকে চলমান রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেেিত খালেদা জিয়া বেশ কিছু উপলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হুকুমের আসামি’ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সর্বশেষ ৪ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশে তো অঙ্গীকারের সুরেই জানিয়ে রেখেছেন তিনি। কথার মারপ্যাঁচে প্রধানমন্ত্রী আসলে সে ঘোষণারই জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, খালেদা জিয়াকেই ‘হুকুমের আসামি’ বানাবেন তিনি। রাজনীতি করেন বলে প্রতিপকে ‘এক হাত’ নিতে চাইতেই পারেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তার একার চাওয়াটাই সব নয়, বিশেষ করে এমন এক সময়েÑ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘ পর্যন্ত বিষয়টির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। এজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, দেশের সঙ্গে গণতন্ত্রকে শুধু নয়, সম্মানের সঙ্গে নিজেকে বাঁচাতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রীর উচিত উস্কানি ও সংঘাতের পথ ছেড়ে সমঝোতামুখী হওয়া।
অন্যদিকে সরকারের নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জীবনের ত্রেগুলোকে একটি একটি করে পর্যালোচনা করলে কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনার হদিসই পাওয়া যাবে না। কারণ, কোনো একটি েেত্রই শেখ হাসিনার সরকার জনগণের আশা-আকাক্সা পূরণ করার ধারে-কাছে যেতে পারেনি। আসলে যায়নি। এর কারণ, নির্বাচনের আগে দেয়া বিভিন্ন ভাষণে ও মেনিফেস্টোতে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তেমন ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। ভেতরে ভেতরে তারা অন্য কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে আর যা-ই থাকুক, গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চিন্তা বা সদিচ্ছা অন্তত ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারের বিভিন্ন পদেেপর মধ্য দিয়ে। সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যাচ্ছেÑ বিশেষ করে মতিঝিলের গণহত্যার পর তো বটেই। শুধু গণহত্যার কথাই বা বলা কেন, সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও কি সরকার কখনো, কোনো পর্যায়ে গণতন্ত্রসম্মত আচরণ করেছে? সরকারের বেআইনি পদপে এবং র্যাব-পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের হামলায় বিরোধী কোনো দল মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করতে পারছে না। গ্রেফতার, শ্যোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি বাড়ছে মিথ্যা মামলার সংখ্যা। ওদিকে গণতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র জাতীয় সংসদকে পঙ্গু করা হয়েছে প্রথম অধিবেশন থেকে। সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে বিরোধী দলের এমপিদের বাইরে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করেছেন মতাসীনরা। সংসদ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পরিষ্কার হয়েছে, জাতীয় সংসদের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ নেই মতাসীনদের। সংসদকে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ত্রেকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে শেখ হাসিনার সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ত্রেই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছে সরকার। গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবেই চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার।
ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্য শেখ হাসিনার নিজের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে মোটেও বিস্মিত হননি। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সংগ্রামী’ দল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এ ধরনের পন্থাই নিয়েছে। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে মতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। তখন সভাপতি ছিলেন মরহুম আবদুল মালেক উকিল। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে দলটি ৩৯টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান অর্জন করেছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলটি আরো একবার চার দফা পূর্বশর্ত উপস্থাপন করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড়কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে দলটি গুরুতর দুটি প্রতারণা করেছিল। প্রথমটি ছিল পূর্বশর্ত পূরণ করার প্রশ্নে। আওয়ামী লীগের প থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না করা হলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে ঘোষণা এসেছিল ‘চরমপত্র’ আকারে। কিন্তু পূর্বশর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও ১৯ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের প্রার্থী হয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। প্রতারণার দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের আত্মীয়-স্বজনরা সে সময় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগ অনশনরতদের আশ্বাস দিয়েছিল, দণ্ডাদেশ বাতিল না করা হলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই ঘোষণা সত্ত্বেও অনশন ভাঙানোর একদিন পরই শেখ হাসিনা নির্বাচনে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ওদিকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৮১)।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপল।ে তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিলÑ যে অভ্যুত্থানকে সর্বোচ্চ আদালত ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মতা থেকে বিএনপির বিদায়ে উল্লসিত হয়ে দলটির মুখপত্র দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল (২৫ মার্চ, ১৯৮২)। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফা এবং চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেবার সংসদে ৭৬টি আসনসহ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়েছিলেন।
প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। কারণগুলো শুধু কৌতূহলোদ্দীপক নয়, কোনো কোনোটি আবার ‘বড়ো দল’ আওয়ামী লীগের জন্য অসম্মানজনকও বটে। পাশাপাশি রয়েছে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্যের বিশেষ দিক। সে বৈশিষ্ট্য দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা- কখনো একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া। ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্রের জন্য পরিচালিত সে আন্দোলনে ছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী। আন্দোলনের আড়ালে শেখ হাসিনা সে সময় আওয়ামী লীগের বহুবার ব্যবহৃত কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাত দলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। কারণ প্রেসিডেন্ট এরশাদ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার এই পদেেপর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে সকলের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরো একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটতো। জামায়াতে ইসলামীর এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের মতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা দরকার। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। পরিবর্তে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল এমন দু’জন মাত্র নেতাকে, যাদের সঙ্গে সামরিক শাসক এরশাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলÑ একজন দীর্ঘদিন তার মন্ত্রিত্ব করেছেন (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), অন্যজন ছিলেন এরশাদের ১৯৮৮-র সংসদে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের নেতা (জাসদের আ স ম আবদুর রব)। অর্থাৎ এেেত্রও আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নাম সর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। আসলেও কথাটা কঠিন সত্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার বহু চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে আসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছিলেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নিÑ তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নাম সর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। জোট গঠনের এ পদেেপর মধ্য দিয়ে প্রকৃত পে আওয়ামী লীগের অমতা ও জনসমর্থনহীনতার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্য সহযোগিতা নিয়ে মতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই ‘সততা’ ও ‘সদিচ্ছা’ আওয়ামী লীগেরÑ বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার!
এমন অতীত রয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য ধমক দিয়ে সংলাপে বসার আহ্বান জানান, গোপন আয়োজনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে মাঠে নামান এবং জাতিসংঘকে পর্যন্ত ডেকে আনেন তখন উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে সচেতন সকল মহলে উল্টো উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার মধ্যে সত্যিই সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সদিচ্ছা রয়েছে কি না। প্রশ্ন ওঠে, তার মতো একজন নেত্রীর কাছে গণতন্ত্র শেখার কিছু থাকতে পারে কি না। উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক পর্যবেকরা কিন্তু বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মরহুম পিতার কথাও স্মরণ না করে পারছেন না। কারণ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রথম কবর তিনিই দিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সবদিক থেকে পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন মাত্র। তিনি সেই সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বাকশাল আসলে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৫৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন