শুধু জীবন দিলেই বিপ্লব হয় না
লিখেছেন লিখেছেন বিপ্লবী ০৬ মে, ২০১৩, ০২:৫৬:৫৯ দুপুর
৫ মে ২০১৩’র কালো রাত। রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষগুলোকে হঠাৎ করেই সশস্ত্র রাস্ট্রীয় বাহিনীর গুলীর সামনে অকাতরে প্রান দিতে হলো শুধু মাত্র তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীর কারনে। হত্যাযজ্ঞ এখনো থেমে নেই। পৈশাচিক উন্মত্ততায় নাগরিক হত্যা চালানো হচ্ছে দেশব্যাপী। পুরো জাতিকে পারলে গুলীতে ঝাঁজরা করতে চাইছে উন্মত্ত রাস্ট্রীয় খুনীরা; যেন আড়ালে রাক্ষুসে দন্ত বিকশিত কোন এক ম্যানিয়াকের জেনোসাইডের খায়েশ পুরো করতে গোলামেরা নেমেছে রক্তের এ হোলী খেলায়।
নাগরিকেরা শাসকের নির্দেশে গণহত্যার শিকার হলো। এবার আর ভিনদেশী কোনো হানাদারদের হাতে নয়। নিজ দেশে স্বাধীন দেশের সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। সত্যি আশ্চর্য গণতন্ত্রের নামে গণহত্যা। ৭১ এর ২৫মার্চের সেই কালো রাতের অনুভুতি জাতির অনেক সন্তানই আবার তাদের জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বার টের পেলেন। নতুন প্রজন্মের মানুষগুলো বুঝতে পারল কালরাতের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল। তবে একটি বিষয় লক্ষনীয় মিল, সেটি হলো ২৫ মার্চ কালো রাতে যেমন সরকারী সশস্ত্র বাহিনী ঝাঁপিয়ে পরেছিল নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর; আজকের দিনেও সেই একই চরিত্রে আবির্ভূত হলো সরকারী বাহিনী সেই একই নিরস্ত্র জনতার উপর।
আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, কিভাবে নিজের আত্তীয় স্বজনদের দ্বারা ভরপুর বাহিনীগুলোর খুনিরা নিজের মানুষদের বুকে মাথায় গুলি চালালো। এরই নাম হলো নিরাপত্তা বাহিনী। যদিও মিডিয়াতে বলা হয় যৌথবাহিনী। নিরাপত্তা আর যাকেই দিক, নিরস্ত্র সংখাগরিষ্ঠ জনতাকে যে দেয়া হয় না, সেটা বোধ করি আমার সাথে কম বেশি সবাই একমত হবেন। আর সোজা কথা হলো আমাদের বাহিনীগুলো বানানো হয় শুধু মাত্র নিজের মানুষের হাত থেকে গণবিরোধী সরকারকে বাঁচানোর জন্য।
যদি একটু বেশি সত্য কথা বলতে চাই, তবে বলতেই হয়, আমাদের এই সকল বাহিনীগুলো নিজেদের দেশের সেবায় যুক্ত করতে শপথ যেই ভাষাতেই আর যত কসম করেই করুক না কেন, জনতা তাদের দ্বারা সেবা কতদূর পায় তা আমরা কম বেশি সবাই জানি। আর সব চেয়ে ভয়ংকর হলো আমাদের এই সকল বীরেরা এক একটা বিশাল তকমা বুকে সাটিয়ে শুধু মাত্র নিরস্ত্র নাগরিকদের দিকে বন্দুক তাক করতেই বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করেন, আর ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার সহ বিভিন্ন নামে নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা করতেই নিজেদের বেশি বাহাদুর ভাবেন। তাদের এই নিরস্ত্র নাগরিক হত্যায় আমরা লজ্জা পেলেও তাদের লজ্জা সরমের বালাই আবার একটু কম বলেই দেখা যায়। তাইত বিশাল বিশাল পদবিধারী কর্মকর্তারা কালো পোশাকের পুলিশের সহযোগী বাহিনীতে এসেও নিরস্ত্র মানুষকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে বীরের মত হত্যা করতে খুবই গর্ববোধ করেন।
আমি নিজেও আমাদের জাতীয় এই সকল বীরদের নিয়ে এক সময় গর্ববোধ করতাম। ভাবতাম জাতির ক্রান্তি লগ্নে এদের অন্ন বস্ত্র আর বেতনের মালিক জনগনকে রক্ষা করবে সার্বভৌমত্ব রক্ষার মত করেই। জনগণ হীন সার্বভৌমত্ব কি করে হয় তা আমার মাথায় আসে না, আমাদের ওই সকল পোশাকি বীরদের মাথায় কি ভাবে আসে আমার জানা নেই। তবে আমাদের বাহিনীগুলোর সদস্যদের দোষ দেই না। এরা আসলে কমান্ডের অধীন, কিন্তু কমান্ডারদের শিক্ষা, বিবেক আর বিশ্বাসের ভিত্তি আজ অনেক তলানিতে গিয়ে দাড়িয়েছে। আমার এ জন্য আফসোস হয়। সত্য কথা যারা বলতে পারেন না, জাতির প্রতি যারা কর্মচারী হয়েও আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন না, তাদের নিয়ে অন্তত আমি আর ভাবতে চাই না। আর চাই না বলেই এই লেখাটি লিখেছি। আর বোধ হয় ওদের নিয়ে লিখব না, লেখার প্রয়োজনও হবে বলে মনে হয় না।
জাতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। রাজনৈতিক পরিভাষায়, নিজেদের স্বার্থে এক এক দল এক এক বিশ্লেষণ করে, কিন্তু আমি তাদের এই সকল ফালতু কথাকে এখন আর পাত্তা দেই না। রাজনীতিতে এখন সার্টিফিকেটধারী মূর্খদের বড় বেশি সমাগম। এরা কি বলে কি বলতে চায়, আমি তা বুঝতে বার বার ব্যর্থ হই। হতে পারে আমারই জ্ঞান বা বোঝার ক্ষমতা কম। সেটা হলেও খুশিই হতাম যদি জাতির কল্যাণ হত।
দ্বিজাতি তত্ত্বই হলো মূলতঃ এই পৃথিবীর আদিকাল থেকে চলে আসা সংঘাতের মূল কারণ। ইন্ডিয়ার বিভক্তি এমন কি পাকিস্তানের বিভক্তির উত্স ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। আজকেও স্বাধীনতার এত বছর পরেও আবারো সেই দ্বিজাতি তত্ত্বই সকল ভাবনার মূল কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। একদিকে আর্যবাদের বন্ধু বাঙালি জনগোষ্ঠী, বিপরীতে আর্য ব্রাম্মন্যবাদ বিরোধী বাংলাদেশী জনগোষ্টি। এটি সম্পূর্ণই আমার নিজের বিশ্লেষণ, কারো যে পছন্দ হতেই হবে এমন নয়, বা কারো পছন্দের অপেক্ষা করেও আমি চলি না বা বলি না।
আজকে উদ্ভুত এই দ্বিজাতির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই পর্যায় ক্রমে ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশীদের দ্বন্দ্বে পরিনত হয়, যেটি ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশীদের জাতীয় দ্বন্দ্ব। পূর্ব বাংলায় কেবলমাত্র মহান দেশপ্রেমিক সিরাজ সিকদারই ছিলেন যিনি জাতীয় দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই তার রণ কৌশল নির্ধারণ করতেন। আজকের নতুন পুরনো রাজনীতিকেরা নিজেরাও পরেন না, জানেন না, নতুন প্রজন্মকেও জানতে বা পড়তে উত্সাহিত করেন না। এতে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত রাজনৈতিক জেনারেশন ও সংস্কৃতি। একই দশা আমাদের মিডিয়া জগতে। আজকের বাংলাদেশে সাংবাদিক যারা তৈরী হচ্ছে এরা হলো দুর্বিসহ ভাবে একচোখা, পা চাটা, মূর্খতায় ভরপুর দাম্ভিক একটি শ্রেণী। তবে এরা সহজেই এদের নিজ গোত্রের জনগোষ্ঠী বেছে নিয়ে তাদের সেবা করতে পারে। এই সকল প্রজাতির ভেতরেও ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। আমার এই লেখায় কেউ মনে কষ্ট পেলেও আমি দুঃখিত না।
এখন প্রশ্ন হলো এই দ্বিজাতির ভেতরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং দ্বন্দ্ব থেকে কি বের হবার পথ নেই। এমন প্রশ্নও আছে, অনেকে পসেটিভ বললেও আমার হিসেব হলো নাই। আর এই দুই মেরুকরণের জাতি গোষ্ঠির ভেতরে শত্রুতা দূর হবার কোনো উপায় নাই। শ্রেণী স্বার্থে ধান্দাবাজ ব্যবসায়ী বা রাজনীতিকদের ভেতরে সন্ধি হতে পারে, কিন্তু জনতাকে ব্যবহার করতে করতে এদের ভেতরে যে এনিমি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এ থেকে বের হবার আর পথ নেই। কয়েকটি জেনারেশনের ভেতরে সুকৌশলে এই ঘৃণার বিষবাস্প যেভাবে ছড়ানো হয়েছে, জেনেটিক্যালি তা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তাইত আমরা আর প্রতিপক্ষ দেখি না দেখি শত্রু। এই আমরা হলাম এক পক্ষের সাধারণ বাঙালি যাদের বিশ্বাস এর ভিত্তি এক জায়গাতে আটকে থাকে না এবং এরা দারুন প্রভুভক্ত হয়, অন্য পক্ষের বাংলাদেশী যারা কি করতে চায় নিজেরাও তা জানিও না বা জানতেও চাই না, বা অন্য কাউকে বোঝাতেও চাই না, দরকার হলে পদলেহন করব, এমনই ভাব।
এই রকমের দুইটি জাতি কি একত্রে বাস করতে পারে পাশাপাশি? আমি এখনো ভাবছি, একাই ভাবছি, আমি আমার এই ভাবনাটা আজ থেকে অন্যদেরও সাথে নিয়ে ভাবতে চাই। পাঠক দয়া করে বিষয়টিতে একটু নজর দিন, ভাবুন এবং নিজেদের মতকে মিলিয়ে দেখুন। আমার বিশ্বাস পৃথিবীতে মানচিত্র, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত যেমন স্থায়ী না, একটি সময়ের পরে সময়ের প্রয়োজনে সেটি পরিবর্তিত হয়, হতে পারে, আমরা চেষ্টা করলে এই দ্বিজাতি দ্বন্দ্বেরও পরিবর্তন সম্ভব। তবে তা কেবল আরো কয়েকটি প্রজন্ম তৈরী করে, যাদের জেনেটিক্যালি পরিবর্তন আসবে এবং তাও যদি আমরা আজ থেকে শুরু করি।
আমরা জাতীয় জীবনের দ্বন্দ্বগুলোকে চলতি সময়ের আলোকে সমাধানের চেষ্টা করি গদিকে সামনে রেখে। সমস্যার মূলোৎপাটন করতে চাই না। ফলাফল সবাই জানি, বুঝি; স্বীকার করি না যতক্ষন নিজে লাভবান হবার নিশ্চয়তা না পাই। কেবলমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই গণতন্ত্র ভাবি। মানি। আর নির্বাচিতদের দ্বারা শোষিত নিপীড়িত হই।
এই সামন্ততান্ত্রিক গণতন্ত্রের কারনেই রাজনৈতিক শ্রেণীটি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে বেশি। এরাই আবার আমলাতন্ত্রকে লাই দিয়ে জাতির বাকি সর্বনাশ করেছে। মানুষের শেষ আশ্রয় উচ্চ আদালতকে দলীয় ক্যাডার দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাষ্ট্রের এমন একটি অর্গান নাই যেখানে মানুষ নিরাপদ এবং দুর্নীতি ছাড়া কারুর জীবন এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
এ সকল সমস্যা দিয়ে বেরিয়ে আসতে সময় যেমন প্রয়োজন, তেমনি ক্ষমতাসীনরাও কখনোই সে সুযোগ দেবে না। কিন্তু ইনিশিয়েটিভ তো নাগরিকদেরই নিতে হবে। একটি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠার এ বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নিতে বিপ্লবের হাতিয়ার দরকার। কিন্তু বিপ্লবের হাতিয়ার কোথায়? তাকিয়ে দেখো, হাতিয়ার তোমার পাশেই, প্রয়োজন শুধু নিজের করে নেয়া। শুধু জীবন দিলেই বিপ্লব হয় না, উল্টোটাও করতে হয়।
নির্বিচার নাগরিক হত্যা করে পৃথিবীতে অদ্যাবধি কোন শাসক নির্বিঘ্নে পৃথিবী ছাড়তে পারেন নি। ১টি জাতিকে ২টিতে পরিনত করেও যে রক্ষা হবে এমন গ্যারান্টি কে দেবে? জনতা বিপ্লবী হলে উপায় নাই। বিপ্লবে জয় হলে এমনিতেই সব বৈধ হয়ে যায়। বাংলাদেশী জাতি তেমন একটি বৈধ দিনের নতুন আলোর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
২০২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন