বাবারে আমার চারটা সন্তান বেঁচে আছে। ওদের মানুষ করতে হবে।

লিখেছেন লিখেছেন বিপ্লবী ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:২০:৫৫ দুপুর



১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় মৃত্যুকূপে কাটিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসছে মানুষ। জীবিতদের উদ্ধারে প্রাণান্তকর চেষ্টা হয়েছে গতকালও। সর্বশেষ রাত পর্যন্ত জীবিত চারজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। উদ্ধারকর্মীদের অবস্থান থেকে ৭২ ফুট নিচে ছিলেন এ চার পোশাক শ্রমিক। তাদের মাথার উপর দেড় থেকে দুই ফুট ফাঁকা জায়গা। তাই নড়াচড়ার সুযোগ খুব একটা নেই। এমন অবস্থায়ই মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় বেঁচেছিলেন। তাদের উদ্ধারের আগ পর্যন্ত খাবার ও অক্সিজেন সরবরাহ করে সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়। এ চার শ্রমিককে জীবিত উদ্ধারে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। টানা ২০ ঘণ্টা ধরে

সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাদের কাছাকাছি পৌঁছেন উদ্ধারকর্মীরা। গতকাল বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে ধসে পড়া ভবনের তৃতীয় তলা থেকে হাবীব নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। পরনে তার লাল গেঞ্জি ও মুখে দাড়ি। তার জীবিত উদ্ধারের পরপরই বরিশাল জেলার সাদেক নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকর্মী মোস্তফা কামাল বলেন, ১০৩ ঘণ্টা পরও ধসে পড়া ভবনের পূর্বপাশে পাঁচ ও ছয় তলার বাথরুমের কাছাকাছি অন্তত ১২ থেকে ১৫ জনের আর্তনাদের শব্দ শোনা গেছে। উদ্ধারকর্মী হাফিজুর রহমান খান বলেন, আটকে পড়া শাহজাহান, রাজু, শিল্পী নামে দু’জন ও মনোয়ারার সঙ্গে কথা বলেছি। খাবার দিয়েছি। পানি দিয়েছি। হাফিজ বলেন, চার তলা ফ্লোরে আমার স্ত্রীও আটকে আছে। তার নাম নাজমা। শনিবার পর্যন্ত নাজমার সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আর কথা বলতে পারছি না। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, যে দেশে জীবিত ব্যক্তির চেয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা করা হয় সে দেশে না থাকাই ভাল। উদ্ধারকর্মী আবু সাঈদ চাঁদ বলেন, এখনও অনেক মানুষ সুস্থ আছেন। তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনেছি। এর আগে কারও ঠ্যাং কেটে, কারও কোমর কেটে জীবিত উদ্ধার করেছি। এখনও ৪ তলার একটি বীমের নিচে আয়নাল নামে এক ব্যক্তি চাপা পড়ে আছে। তাকে উদ্ধার করা যায়নি।

গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের সিএমএইচ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া ২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৩৭৭ জনের। উদ্ধারকর্মীদের তথ্যমতে- ভেতরে আরও অনেক মানুষ জীবিত রয়েছেন। যাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা অসম্ভব। এদিকে গত পাঁচ দিন পর নিখোঁজের তালিকা আরও লম্বা হয়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১২৫০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। সেনাবাহিনীর জিওসি মেজর জেনারেল হাসান সোহরাওয়ার্দী বলেন, ধসে পড়া ভবনের নিচে চারজন ব্যক্তির উপস্থিতি জানতে পেরেছি। তাদের উদ্ধার করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। ওই অপারেশন সফল হলেই ধংসস্তূপ সরাতে ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে।

ধ্বংসস্তূপে লাশ আর লাশ: ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে লাশের সারি। যেখানেই চোখ যায় সেখানেই পড়ে আছে বিকৃত লাশের সারি। উদ্ধারকর্মী চঞ্চল বেেলন, ভবন ধসের পর থেকেই আমি উদ্ধার কাজে নিয়েজিত। স্বেচ্ছায় কাজ করছি। গতকাল ছাদের সুড়ঙ্গ দিয়ে ৭ম তলা পর্যন্ত পৌঁছে দেখেছি সেখানে লাশ আর লাশ। অন্ততপক্ষে ১০ জনের মৃতদেহ দেখেছি। চঞ্চল আরও বলেন, আমার বাড়ি শরীয়তপুরে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। ধসে পড়ার সময় কাছেই ছিলাম। বিবেকের তাড়নায় উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছি। এখন পর্যন্ত ৭-৮ জন জীবিত ও মৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছি।

ধ্বংসস্তূপে সন্তানের প্রসব: উদ্ধারকর্মী মেহেদী হাসান বলেন, ধসে পড়ার তিন ঘণ্টা পরই গার্মেন্ট কর্মী নিলুফার ইয়াসমিন একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তারা দু’জনেই ছাদের বীমের চাপায় সুরক্ষিত ছিলেন। তিনদিন পর শনিবার সকালে সন্তানসহ মাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মেহেদী বলেন, ভবনের বেইসমেন্টে ৪০ থেকে ৫০টি গাড়ি রয়েছে। এর বেশির ভাগ চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।

রড কাটার মেশিনে হাত-পা কেটেছি: প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও উদ্ধারকর্মীদের অভাবে অসংখ্য নারী-পুরুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রড কাটার মেশিন দিয়ে কেটে বের করা হয়। উদ্ধারকর্মী চাদ বলেন, চাপাপড়া মানুষের আকুতি সহ্য করতে পারিনি। তারা পা ধরে বাঁচার আকুতি জানায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে কারও পা, কারও হাত কেটে বের করেছি। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ৫ম তলায় একজন মহিলার কোমরের ওপরে বীম পড়ে ছিল। তিনি আর্তচিৎকার করে বলছিলেন, বাবারে আমার চারটা সন্তান বেঁচে আছে। ওদের মানুষ করতে হবে। আমারে কেটে হলেও বের করো। চাঁদ বলেন, তখন মেশিন না থাকায় বের করতে পারিনি। খাবার দিয়ে এসেছি। পরে মেশিন নিয়ে গিয়ে দেখি, তিনি মারা গেছেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জের উদ্ধারকর্মী আলী আজগর খোকন বলেন, ভেতরে আরও অনেক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজনের হাতে লেখা একটি চিঠি সেনাকর্মকর্তাদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তবে ওই চিঠিতে কি লেখা ছিল সে বিষয়ে জানা যায়নি।

স্যালাইনের পাইপ চুষে বেঁচে আছে: এদিকে শনাক্ত হওয়া বেশির ভাগ মানুষের কাছে অক্সিজেনের পাশাপাশি স্যালাইনের পাইপ সরবরাহ করা হয়েছে। ওই পাইপ চুষে চুষে এখনও অনেক মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ধসে পড়া ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় তাদের অবস্থান। উদ্ধারকর্মী শাকিল বলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের বের করা সম্ভব না হলে বাঁচার আশা ছেড়ে দিতে হবে।

ধ্বনিত হচ্ছে ক্লান্ত আর্তনাদ: উদ্ধারকর্মী কাওছার আলম বলেন, ১০০ ঘণ্টা পরও ধ্বংসস্তূপে মিলছে জীবনের সন্ধান। ধ্বনিত হচ্ছে অর্ধমৃত মানুষের ক্লান্ত প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, তৃতীয় তলার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে কান পেতে শুনেছি- একজন পুরুষ কণ্ঠের ক্লান্ত আর্তনাদ। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বলছিলেন, আল্লাহ রে পানি চাই। উদ্ধারকর্মী সুমন বলেন, সকাল থেকেই তৃতীয় তলায় রাজু নামে এক ব্যক্তির উপস্থিতি জানা গেছে। তার সঙ্গে আরও ৫-৭ জন মানুষ আছেন। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের শেষ পরিণতি জানান যায়নি। যদিও সুড়ঙ্গপথে তাদের কাছে অক্সিজেন ও খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।

উদ্ধার করতে গিয়ে অসুস্থ ১৫: এদিকে ভবনের ভেতর থেকে জীবিত ও মৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে গিয়ে অন্ততপক্ষে ১০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে উদ্ধারকর্মী শামীম হোসেন, দীপু, সোহেল পারভেজ রয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রানা, এমপির ফাঁসির দাবিতে মিছিল: এদিকে ভবন মালিক সোহেল রানা গ্রেপ্তারের পরপরই রানা ও স্থানীয় এমপি তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শ্রমিক ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। গতকাল বিকালে ধসে পড়া ভবনের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও থানা রোডে কয়েক শ’ মানুষ বিক্ষোভ করেন।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না: সুইং অপারেটর শরীফার খোঁজে রংপুর তারাগঞ্জ এলাকা থেকে এসেছেন মাতা ময়ূরী বেগম। টানা পাঁচ দিন ধরে অপেক্ষা করেও মেয়ের খোঁজ পাননি। যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকেই মেয়ের ছবি দেখাচ্ছেন। আর বলছেন, বাবারে, আমি গরিব মানুষ। আমার মাইয়াডারে বাঁচান। নিখোঁজ সালমার ভাই জুয়েল বলেন, আমার বোন এখনও বেঁচে আছে। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন। এভাবেই আকুতি করছেন আরও শত শত অপেক্ষমাণ স্বজনরা। তাদের বিশ্বাস- নিখোঁজ রা এখনও জীবিত আছেন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ট্রেনিং কমপ্লেক্সের ভাইস চেয়ারম্যান দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, আমরা যেখানেই জীবিত মানুষের সন্ধান পাচ্ছি সেখানেই সুড়ঙ্গ কেটে বের করার জন্য উদ্ধারকর্মী পাঠাচ্ছি। তিনি বলেন, সেনা তদারকে উদ্ধার কাজের সমন্বয় করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই উদ্ধার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

Click this link

বিষয়: বিবিধ

২১৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File